অনপেখিত পর্ব-১+২

0
3803

#অনপেখিত
#পর্ব_১
Sidratul Muntaz

” ভাইয়া, লাইট নেভাবেন না দয়া করে। আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”
” লাইট নেভানো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। তাছাড়া আমার ঘরে আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। তোমার কি?
রূঢ় কণ্ঠে জবাব দিয়ে ফারদিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বধূবেশীর দিকে। মেয়েটির চোখে ভয় আর আতঙ্কের এক গভীর ছাপ স্পষ্ট। এই রূপবতীর সাথে আজ ফারদিনের বাসর রাত। তারই বিছানায় বসে তারই সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী তাকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করছে। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত! প্রথম পরিচয়েই নববধূর মুখে এমন ভাইয়া ডাক শুনলে যে কেউ হতাশ হবে। তবে ফারদিন এই মুহুর্তে হতাশ নয়। সে বিরক্ত। কঠিনভাবে বিরক্ত। চোখ-মুখ শক্ত বানিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ফারদিন বলল,
” লাইট বন্ধ থাকবে। অবশ্যই বন্ধ থাকবে।”
মেয়েটার চেহারায় ভয়ের সাথে সাথে এখন রাজ্যের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেল। ফারদিন লাইট বন্ধ করতে গেলেই মেয়েটি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো,” ভাইয়া প্লিজ…”
ফারদিন আঁড়চোখে তাকালো। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” কি সমস্যা?”
মেয়েটি চুপ রইল। কণ্ঠনালী কাঁপছিল তার। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
” লাইট জ্বালানো থাক।” পিচ্চি মেয়েদের এই এক সমস্যা। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই কেঁদে ভাসায়। এই মেয়েটির বয়স কত হবে? দাদু বলেছিলেন আঠারো হয়ে গেছে। আসলেই কি হয়েছে? নাকি দাদু বাড়িয়ে বলেছেন? সত্যতা যাচাই করতে ফারদিন সোফায় বসে কিছুটা ভদ্রতা সহিত প্রশ্ন করল,
” তোমার বয়স কত?”
মেয়েটা মাথা নামিয়ে উত্তর দেয়,” ষোল।”
ফারদিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আক্রোশে। তার মানে দাদু মিথ্যেই বলেছিলেন। মেয়েটাকে এখন তার আরও বিরক্ত লাগছে। শেষমেষ কি না বাল্যবিবাহই করতে হলো! নিজেকে নিকৃষ্টতম মানুষ মনে হচ্ছে। ফারদিন গলা ঝেড়ে প্রায় হুকুমের স্বরে বলল,” তুমি এই ঘরে থাকতে পারবে না। পাশের ঘরে চলে যাও।”
মেয়েটা আঁতকে উঠা দৃষ্টিতে ফারদিনের দিকে তাকালো। দেখে মনে হলো তাকে ভয়ংকর কোনো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফারদিন বলল, ” কি ব্যাপার? যেতে বললাম না?”
ষোড়শী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” কিন্তু বাহিরে তো অনেক মানুষ। আমি পাশের ঘরে গেলে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কি বলবো?”
” কি আবার বলবে? আমি তোমাকে বের করে দিয়েছি এটাই বলবে! নাকি এটা বলতে লজ্জা লাগবে?”
ফারদিনের বিদ্রুপমাখা কণ্ঠের কাছে পরাজিত মেয়েটি কোনো উত্তর দিতে পারল না। ফারদিন তাগাদা দিল,” সময় নষ্ট না করে যা বলছি তাই করো। নাহলে আমার বিছানা ছাড়ো। আমাকে ঘুমাতে দাও। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। সারারাত তোমার ঢং নিয়ে বসে থাকার মতো সময় নেই আমার।”
মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফারদিন জহুরি চোখে মেয়েটার উচ্চতা পরিমাপ করল। মোটামুটি লম্বা বলা যায়। শাড়ি পড়ার কারণে তাকে কিছুটা মোটা দেখাচ্ছে। এমনিতে মেয়েটা শুকনো। ফারদিন ছবিতে দেখেছিল। সামনা-সামনি কখনও দেখা হয়নি তাদের। মেয়েটাও হয়তো ফারদিনকে এই প্রথমবার দেখছে। তবে ছবির চেয়ে মেয়েটিকে বাস্তবে দেখতে বেশি সুন্দর। মেয়েটি বিছানার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। ফারদিন কাছে এসে বলল,” এই বিয়েতে আমার সম্মতি ছিল না। এটা নিশ্চয়ই তুমি জানো।”
” জ্বী।”
” তবুও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলে কিভাবে?”
ষোড়শী নিশ্চুপ। ফারদিন কাঠখোট্টা গলায় বলল,” কি ব্যাপার?”
” আমার আব্বার কথায় রাজি হয়েছি।”
” স্ট্রেঞ্জ! তোমার আব্বা বলল আর তুমিও একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে?”
” বিয়ে তো অপরিচিত’র মধ্যেই হয়।”
” তুমি জানো আমি যে তোমার থেকে দশ বছরের বড়?”
” জানি।”
” তবুও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে?”
ফারদিনের কণ্ঠে বিস্ময়। মেয়েটা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
” আমার আব্বা আম্মার চেয়ে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। তাদের তো বিয়ে হয়েছে৷ তাছাড়া শুধুমাত্র বয়সের ব্যবধান বিয়েতে নাকচ করার কোনো কারণ হতে পারে না।”
ফারদিন থতমত খেল। এই কথার দ্বারা মেয়েটা কি বুঝাতে চাইছে? সে বিয়ে করে খুব খুশি? গ্রামের মেয়ে বলে তাকে সহজ, সরল আর বোকা ভেবেছিল ফারদিন। কিন্তু এই মুহুর্তে মেয়েটিকে একটুও বোকা মনে হচ্ছে না। ফারদিন বলল,” নাম কি তোমার?”
” মেহেক ইমরোজ।”
” নাম তো সুন্দর। ”
” ধন্যবাদ।”
সামান্য লাজুক কণ্ঠে বলল মেহেক।
” প্রশংসা করেছি বলে ভেবে নিও না এই ঘরেই তোমাকে থাকতে দিবো। তোমার এই বাক্স-পেটরা সাথে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারো বিদায় হও।”
মেহেক বিছানা থেকে তার শাড়ির ব্যাগ আর হ্যান্ড পার্স তুলে নিল। শাড়িটা তাকে রাতে পরার জন্য দেওয়া হয়েছিল। মেহেক বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফারদিন বলল,
” শোনো, বাহিরে কাউকে দেখলে বোলো আমার ঘরে যেনো জগভর্তি পানি রেখে যায়।”
” ঠিকাছে ভাইয়া।”
ফারদিন তেতে উঠলো,” ভাইয়া মানে? কে তোমার ভাইয়া?”
” আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। ভাইয়া না ডাকলে আর কি ডাকবো?”
কথা ঠিক। ভাইয়া ছাড়া মেয়েটি তাকে আর কি ডাকবে? তাছাড়া ভাইয়া ডাকে দোষ নেই। কিন্তু যতবার মেয়েটি তাকে ভাইয়া ডাকে ততবার ফারদিনের মনে পড়ে যায়, এই পিচ্চি তার বিয়ে করা বউ! ফারদিন কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
” কিছু না। যাও তুমি।”
মেহেক বেরিয়ে যেতেই ফারদিন লাইট নিভিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। দুই চোখ জুড়ে তার রাজ্যের ক্লান্তি। কতদিন শান্তিতে ঘুমায় না সে। আমেরিকা থেকে আসার পর যখন দাদু বলল তাকে বিয়ে করতে হবে তখন থেকেই ঘুম, শান্তি সব লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আজকে সে আরাম করে ঘুমাবে। অনেকদিনের ঘুম একসাথে ঘুমিয়ে নিবে। আহ! ঘুমে এতো শান্তি! চোখ প্রায় লেগে এসেছিল ফারদিনের। মোমবাতির আবছা আলোয় মেহেক তার রূপবান স্বামীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। ঘুমালে কাউকে এতো মোহনীয় লাগে বুঝি? হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো ফারদিন। মেহেককে মোমবাতি হাতে তার মুখের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেহেক খিলখিল করে হেসে বলল,
” আরে আমি মেহেক। আপনার জন্য জগভর্তি পানি এনেছি!”

চলবে

#অনপেখিত
পর্ব_২
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেকের এহেন রসিকতায় ফারদিনের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। রুষ্ট বাচ্যে ধমক দিল,
” তুমি এখানে কি করছো? আর মোমবাতি কেনো জ্বালিয়েছো?”
মেহেক ভয়ে জুবুথুবু কণ্ঠে বলল,” অন্ধকারে লাইট জ্বালালে আপনি জেগে যেতেন। যাতে আপনার ঘুমে ডিস্টার্ব না হয় তাই মোমবাতি নিয়ে এসেছি।”
” তাহলে মোমবাতি আমার মুখের সামনে ধরে হা করে তাকিয়ে ছিলে কেনো?”
মেহেক এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। ওর ওই গাঁ জ্বালানো হাসিতে ফারদিন আরও রাগে ফেটে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
” লাইট জ্বালাও দ্রুত!”
মেহেক লাইট জ্বালিয়ে দিল। দুইশো বিশ ভোল্টের লাইটের আলোয় ফারদিন ভালো করে দেখতে পেল মেহেককে। বেনারসি বদলে বেগুনী সুতির শাড়ি পড়েছে সে। মুখে এখন কোনো প্রসাধন নেই। মেকাপ তুলে ফেলেছে। চুল খোলা। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো একপিঠ রেশমি চুলের অর্ধেকটাই সামনে আনা। এই মেয়েকে এখন পুরো বাচ্চা লাগছে। ফারদিন যদি বিয়ের আগে একবার দেখে নিতো মেয়েটিকে তাহলে জীবনেও বিয়েতে রাজি হতো না। এই বিয়ে তার জীবন-মরণের প্রশ্ন৷ সারাজীবন অসম বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সে কাটাবে কি করে? তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাই বা হবে কিভাবে? আমেরিকায় বেড়ে উঠা ফারদিনের রুচি কখনোই মেহেকের রুচির সাথে মিলবে না। বয়সের পাশাপাশি তাদের মধ্যে আরও অনেক ফারাক আছে। আকাশ-পাতাল ফারাক! এমন নয় যে মেহেককে দেখতে অসুন্দর। ভালো করে তাকালে মেহেক চমৎকার রূপবতী। কিন্তু ফারদিন তার দিকে ভালো করে তাকাতেও অনিচ্ছুক। মেয়েটা যে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট! এখানেই তার সবচেয়ে বড় অরুচি। মেহেক বলল,” ভাইয়া, আপনার জন্য পানি এনেছি।”
” নাও, পানি আমার মাথায় ঢালো। ঢালো!”
ফারদিন মাথা এগিয়ে দিল। মেহেক প্রায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল। মানুষটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? ফারদিন খিটখিটে মেজাজে বলল,” আরেকবার ভাইয়া ডাকলে কাঁচের জগ তোমার মাথায় ভাঙবো আমি।”
মেহেক নেতানো গলায় বলল,” স্যরি ভাইয়া।”
ফারদিন এবার রেগে-মেগে ভরাট কণ্ঠে এমন জোরে ধমক দিল যে মেহেক ভয়ে কাঁচের জগ নিয়েই কোনোমতে দৌড়ে ছুটে পালালো। বাপরে বাপ! এমন ভয়ংকর ধমক সে জীবনেও খায়নি৷ তার আব্বাও তাকে এমন ধমক কখনও দেয়নি। ফারদিনের রাগ অনেক বেশি এই কথা বিয়ের আগেই জানতে পেরেছিল মেহেক। যখন ফারদিন তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে এসেছিল। মেহেক দরজার আড়ালে লুকিয়ে ফারদিনকে দেখে এতো ভয় পেয়েছিল যে সেদিন ইচ্ছে করেই পাত্রপক্ষের সামনে যায়নি সে। তার মনে হচ্ছিল সামনে গেলেই ওই রাগী পাত্র তাকে চিবিয়ে খেয়ে নিবে। ফারদিনের চৌখা নাকের ডগা, সারাক্ষণ কপাল কুচকে রাখা, সরু চোখে তাকানো, এইসব দেখলে যেকোনো সুস্থ মানুষের হৃৎপিন্ডে দামামা বাজতে শুরু করবে। এই কাঠখোট্টা স্বভাবের অতিরিক্ত মেজাজের মানুষটিকে ছোট্ট মেহেক সামলাবে কি করে? সত্যি বলতে, প্রথম দর্শনেই মেহেক তার হবু স্বামীর প্রেমে পড়েছিল। মেহেককে দরজার বাহিরে কাঁচের জগ হাতে দাঁড়ানো দেখে ফারদিনের ভাবী তিশা এগিয়ে আসল। তিশা ফারদিনের আপন ভাবী না। ফারদিনের চাচাতো ভাইয়ের বউ হয় সে। মেহেকের পেছনে দাঁড়িয়ে তিশা বলল,
” মেহেক, তুমি দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কি করছো?”
মেহেক এতো ভয় পেয়ে ছিল যে হঠাৎ তিশার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো। বুকে থুতু দিতে দিতে বলল,” আপু আপনি?”
” ভয় পেয়েছো নাকি?” হেসে ফেললো তিশা।
” আমি তোমার আপু না, ভাবী হই বুঝেছো?”
মেহেক অপ্রস্তুতভাবে মাথা নাড়ল। এই বাড়িতে কেবল এই মেয়েটির সঙ্গেই তার একটু খাতির আছে। বিয়ের আগে মেয়েটি একবার তাদের বাড়ি এসেছিল৷ তাকে আংটি পরিয়েছে।তিশা হাসি মুখে বলল,” তুমি ঘরের বাহিরে কি করছো?”
মেহেক আমতা-আমতা শুরু করল। সে উত্তর দিতে পারছে না দেখে তিশা নিজেই বলল,” ফারদিনের জন্য পানি আনতে গেছিলে?”
” জ্বী ভাবী।”
মেহেক আশেপাশে তাকাল। বাড়িটা নীরব লাগছে। অতিরথিরা কি সবাই চলে গেছে? মেহেক রান্নাঘর থেকে পানি আনার সময় কাউকে দেখেনি। কাজের মেয়ে লিয়া তাকে পানি ঢেলে দিয়েছে। মেহেক জিজ্ঞেস করল,” মেহমানরা কি সব চলে গেছে ভাবী?”
” হ্যাঁ। গেস্টরা তো সেই কখন চলে গেছে। দাদুও ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার ভাইয়াও ঘুম।”
মেহেক উৎফুল্ল হয়ে বলল,
” তাহলে ভাবী, আপনি আমার সাথে চলুন। আমি আর আপনি একসাথে থাকবো।”
” মানে কি? আজকে না তোমার বাসররাত? তুমি আমার সাথে থাকবে কেন?”
ভারী অবাক শোনালো তিশার কণ্ঠ। মেহেক গোমরা মুখে বলল,” উনি তো আমাকে বের করে দিয়েছে ভাবী?”
” মানে?”
বিস্ময়ে ফেটে পড়ল তিশা। মেহেকের হাত ধরে বলল,” এসো আমার সাথে। ছেলেটা নাটক শুরু করেছে নাকি? নতুন বউকে কেউ বাসরঘর থেকে বের করে দেয়? এটা তো খুব অন্যায়।”
ফারদিন একটা বালিশ মাথায় চেপে ঘুমিয়ে ছিল। তিশা শব্দ করে ডাকলো,” ফারদিন, এইযে দেবরসাহেব। কি শুনলাম এইসব?”
ফারদিন চোখমুখ কুচকে দারুণ বিরক্তিসূচক কণ্ঠে উত্তর দিল,” কি?”
” তোমার বউ বাহিরে কি করে?”
” আমি কি জানি কি করে?”
” এইসব বললে তো হবে না। এই বিছানা কি তোমার একার? এই রুমটা কি তোমার একার? আজকে থেকে মেহেকও সবকিছুর সমান ভাগীদার। তুমি ওকে এইভাবে বের করে দিতে পারো না।”
ফারদিন বক্র দৃষ্টিতে একবার মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক ভয়ে তিশার পেছনে মুখ লুকালো। তিশা অভয় দিয়ে বলল,” কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!”
তারপর ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আজকে তোমার এইসব হম্বিতম্বি একদম চলবে না দেবরসাহেব। মেহেককে তোমার বিছানায় থাকতে দাও। নাহলে কিন্তু দাদুকে ডাকবো আমি?”
” ভাবী, তুমিও শুরু করেছো? মানে আমার ঘরে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই?”
” বিয়ের পর সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। এটাই নিয়ম।”
” এই মেয়ে কি তোমাকে উকিল হিসেবে ভাড়া করে এনেছে?”
” ভাড়া করে আনবে কেনো? বড়বোন হিসেবে আমি ওর পাশে দাঁড়িয়েছি। বাচ্চা মেয়েটাকে একলা পেয়ে তুমি নির্যাতন করছিলে।”
” নির্যাতন কখন করলাম?”
ফারদিনের চেহারায় বিস্ময়। তিশা ধমক দেওয়ার মতো বলল,” মাঝরাতে তুমি ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছো৷ এইটা কি নির্যাতন করা নয়? দাদুকে যদি এইসব একবার বলি..”
” বার-বার দাদুকে কেনো টানছো? তুমি নিজেও কি দাদুর থেকে কম? ওকে বলো আমার ঘরে আমি লাইট অফ করে ঘুমাবো। এই নিয়ে কোনো রেস্ট্রিকশন চলবে না। ওর থাকতে ইচ্ছে হলে থাকবে নাহলে চলে যাবে।”
তিশা মেহেকের দিকে তাকালো,” লাইট বন্ধ থাকলে তোমার কোনো প্রবলেম আছে?”
মেহেক মাথা নিচু করে না বলল। তিশা বলল,” এইতো, দেখেছো? ওর কোনো প্রবলেম নেই। লক্ষী একটা মেয়ে। শুয়ে পড়ো তোমরা। গুড নাইট। আমি তাহলে গেলাম। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে ডেকো মেহেক৷ ভয় পেয়ো না।”
” ঠিকাছে।”
ফারদিন বিরক্তিসূচক শব্দ করে বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে রইল। মেহেক দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে সন্তর্পণে ফারদিনের পাশে এসে শুলো। কিন্তু তার খুব শীত লাগছিল। এসি’র পাওয়ার হাইস্পিডে। কাঁথা ফারদিনের কাছে। মেহেক বলতে চাইল,” আমি কি একটু কাঁথাটা নিতে পারি?”
এই কথা বলার জন্য সে যেই না মুখ খুলতে যাবে অমনি ফারদিন বলে উঠলো,” আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ভাবীকে ডেকে এনেছো তাই না? তুমি তো খুব চালু মাল!”
মেহেক অসহায়ের মতো বলল,” আমি কি করবো? আপনিই তো বলেছেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যেনো বলি আপনি আমাকে বের করে দিয়েছেন। আমি তো ভাবীকে সেটাই বলেছি।”
ফারদিন এ পর্যায়ে কোনো উত্তর দিল না। মেহেক কাঁথার ব্যাপারে বলতে গেলেই ফারদিন
ধমক দিয়ে উঠলো,” কোনো কথা না। জাস্ট সাইলেন্ট।”
মেহেক মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে গেল। শাড়ি দিয়েই কোনোমতে নিজেকে ঢেকে রাখল। রাক্ষসের কাছে কাঁথা চেয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে শাড়িই ভালো। ভোরবেলা ফারদিনের ঘুম ভাঙলো মেহেকের চুলের পানির ঝাপটায়। রেগে-মেগে সে বিছানা থেকে উঠে বসলো। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে৷ এতো দ্রুত ফারদিন জীবনে ঘুম থেকে উঠেনি৷ তার ঘুম ভাঙার সময় এগারোটা কি বারোটা। আজকে এই মেয়েটার জন্য তার ঘুমটাও পরিপূর্ণ হলো না।তুমুল বিরক্তি নিয়ে ফারদিন বলল,
” এই মেয়ে, তোমার সমস্যা কি? এতো সকালে গোসল করেছো কেন?”
মেহেক নিচু গলায় বলল,” গোসল করলেও আপনার সমস্যা?”
” তাই বলে এতো সকালে? শীত লাগে না তোমার?”
” শীত লাগলেও লাভ কি? বিয়ের পর তো সবার সকালেই গোসল করতে হয়। আপনি জানেন না?”
এই কথা বলে মেয়েটা নির্বিকার ভঙ্গিতে চুল ঝারতে লাগল। পানির ঝাপটা ফারদিনের নাকমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ফারদিনের হুশ নেই। সে আপাতত বিস্মিত, স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। বিয়ের পর সকালে গোসল করতে হয় এইসব ফালতু কথা এই পিচ্চি মেয়েকে কে শেখালো? এখন তো দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল ফারদিনের। এই অবস্থায় মেয়েটা ঘর থেকে বের হলে বাড়ির মানুষ উল্টা-পাল্টা চিন্তা করবে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কাছে এনে দুইটা থাপ্পড় লাগাতে। ফারদিন মেহেককে ধমক দিতে নিচ্ছিল। তখনি দরজায় কারো করাঘাত। ফারদিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। যে-ই আসুক, সে তাকাবে না। তিশা ঘরে ঢুকেই মেহেককে উদ্দেশ্য করে বলল,” ওয়াও, তোমাকে সুন্দর লাগছে মেহেক। গোসল করেছো?”
তিশা এমন ভঙ্গিতে কথাটা জিজ্ঞেস করল যে ভেতরে ভেতরে ফারদিন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। গোসল করেছে ওই মেয়েটা। তার এতো লজ্জা লাগছে কেন?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে