#অনপেখিত
#পর্ব ১১
লিখা: Sidratul Muntaz
মেহেকের মাথায় হঠাৎ করেই চমৎকার বুদ্ধিটা এলো। ছোটবেলায় যখন বাড়িতে মাছ রান্না হতো, মেহেক কাঁটার ভয়ে ভাত খেতে চাইতো না। তখন আম্মা পোলাওয়ের চাল আর ডিম দিয়ে মজার একটা ডিশ রান্না করতেন। মেহেক আম্মার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্নার পুরো প্রস্তুতিটা দেখতো।আম্মা তার প্রিয় কিছু রান্না করলেই মেহেক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। শেখার জন্য না, অপেক্ষা করার জন্য। তার ধারণা ছিল অপেক্ষা করলেই রান্না দ্রুত শেষ হবে। কিন্তু এখন পোলাওয়ের চাল কোথায় পাবে? মেহেক পুরো রান্নাঘরে খুঁজেও পোলাওয়ের চাল পেল না। তবে ড্রামে বাসমতী চাল ছিল। এটা দিয়েও রান্না করা যায়। ডিনারে তারা বাসমতী চালের ভাতই খেয়েছিল। খেতে মন্দ না। কিন্তু মেহেকের ভয় লাগছে। এই চাল কি সে রাঁধতে পারবে? শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো রান্নাটা সে বাসমতী দিয়েই করবে। তাছাড়া অন্যকোনো উপায়ও নেই। মান-সম্মান বাঁচাতে হলে রান্না তো করতেই হবে। মেহেক চুলায় বাসমতী চাল সিদ্ধ বসিয়ে দিল। আম্মা সবসময় যতটুকু চাল তার দ্বিগুণ পানি দিয়ে চাল সিদ্ধ বসান। মেহেকও তাই করল। তারপর বসলো সবজি কাটতে। মজার ব্যাপার হলো, রেসিপিটা রান্না করতে যা কিছু প্রয়োজন সবই এখানে আছে। মেহেক গাজর আর বরবটি টুকরো করে হালকা আঁচে সিদ্ধ করল। তারপর টমেটো,পেয়াজ আর কাঁচামরিচ কেটে ঘি দিয়ে ভেজে নিল। হালকা সিদ্ধ গাজর আর বরবটিও ঢালল মিশ্রণে। তারপর লবণ আর হলুদের গুড়া মিশিয়ে ভালোমতো নেড়ে ভাজল সবকিছু। তিনটা ডিম ভেঙে দিল। এরপর সিদ্ধ করা বাসমতী চাল পুরোটাই ভাজা সবজীর সাথে মিশিয়ে দিল। উপরে ধনেপাতা ছড়িয়ে,একটু গোল মরিচ মিশিয়ে ভালো মতো নেড়েচেড়ে তৈরী করে ফেলল তার পছন্দের খাবার। আহ! কি সুন্দর গন্ধ! খেতেও নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। মেহেক খাবার নিয়ে ফারদিনের ঘরে গেল। ফারদিন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মোবাইল টিপছে। খাবারের গন্ধ শুনেই চোখ বন্ধ করে বলল,” ওয়াও,স্মেলস গুড! কি রান্না করেছো এটা?”
” ভাত, ডিম আর সবজীর মিশ্রণ। তাৎক্ষণিক কিছু মাথা আসছিল না।”
” দেখি।”
মেহেক ফারদিনের হাতে খাবারের প্লেট দিল। ফারদিন বলল,” চামচ?”
” আচ্ছা নিয়ে আসছি।”
মেহেক এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে চামচ এনে দিল। ফারদিন চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। কোনো কথা বলছিল না। এদিকে মেহেক চিন্তায় শেষ। খাবার ফারদিনের কেমন লেগেছে বোঝা যাচ্ছে না। ভালো-খারাপ কিছু একটা তো বলবে। এমন চুপ করে থাকার মানে কি? না পারতে মেহেক নিজেই জিজ্ঞেস করল,” রান্না কেমন হয়েছে?”
” খুব ভালো। কিন্তু লবণ একটু বেশি লাগছে। ঝাল দিয়েছো নাকি?”
” কাঁচামরিচ দিয়েছিলাম। আর একটু গোলমরিচের গুঁড়াও দিয়েছিলাম।”
” হুম। এজন্যই স্পাইসি লাগছে। লবণের পরিমাণটা ঠিক থাকলেই পারফেক্ট হতো।”
মেহেকের মনখারাপ হয়ে গেল। সামান্য লবণটা পর্যন্ত ঠিক করে দিতে পারল না সে। তার ভুল আন্দাজের জন্য এতো সুন্দর রান্নাটা কি নষ্ট হয়ে গেল? ফারদিন কি তাহলে কষ্ট করে খাচ্ছে? মেহেকের মনখারাপ করা চেহারা দেখে ফারদিন হেসে বলল,” আসলে রান্না খুবই ভালো হয়েছে।”
” সত্যি বলছেন?”
” হুম। বিশ্বাস না হলে তুমি খেয়ে দেখো।”
ফারদিন চামচ দিয়ে খাবার তুলে মেহেকের মুখের সামনে ধরল। মেহেক অবাক হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই তার মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। বরের হাত থেকে খাওয়ার সুযোগ কি মিস করা যায়? সে এক চামচ খেল। সত্যিই লবণ বেশি হয়েছে। হালকা তিতকুটে স্বাদ লাগছে। কিন্তু জিনিসটা একেবারে অখাদ্যও হয়নি। ফারদিন খুব আরাম করে খাওয়া শেষ করল। মেহেক বলল,” আরেকটু খাবেন?”
” আছে?”
” হুম। অনেক আছে।”
” তাহলে নিয়ে এসো।”
মেহেক যেই পাতে রান্না করেছিল পুরো পাতটাই তুলে আনল। এরপর ঘটলো সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনাটি। মেহেকের সামনে বসেই ফারদিন পুরো হাফকেজি চাল একাই খেয়ে ফেলল। মেহেক অবাক হয়ে শুধু দেখছিল। একটা মানুষ এতো দ্রুত কিভাবে খেতে পারে? এও কি সম্ভব? আর খাবারগুলো যাচ্ছে কোথায়? ফারদিনের পেট তো ফুলছে না। প্রথমদিকে যেমন ছিল এখনও পেট তেমনই আছে। ষাঁড়ের মতো এইভাবে খাওয়ার পরেও তার শরীরে মাংস নেই। কি আশ্চর্য না ব্যাপারটা? খাবারগুলো যায় কই আসলে? মেহেক মনে মনে ভাবল,” এমন রাক্ষসের মতো যে হাফকেজি চাল সাবাড় করতে পারে সে তো যেকোনো সময় তোকেও গিলে খেয়ে ফেলতে পারে মেহেক! সাবধানে থাকিস।”
খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফারদিন আরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মেহেককে থ্যাঙ্কিউ জানালো। ভালো খাওয়ার পর ভালো ঘুম হয়। ফারদিনের ঘুমে চোখ লেগে আসছে। এদিকে মেহেকের হঠাৎ হলুদ পাখিটির কথা মনে পড়ল। সারা ঘর খুঁজেও সে পাখিটিকে যখন পাচ্ছিল না তখন ফারদিনের কাছে এসে বলল,” এইযে শুনছেন।”
ফারদিন ঘুমের ঘোরে জবাব দিল,” হু?”
” পাখিটি কোথাও পাচ্ছি না।”
” উড়ে গেছে মনে হয়।”
” কিভাবে উড়ল? জানালা আটকানো ছিল না? ”
“দেয়ালের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে হয়তো। তাতে কি হয়েছে মেহেক? পাখি কি আটকে রাখার জিনিস? সুযোগ পেলে তো যাবেই।”
” কিন্তু পাখিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।”
ফারদিন কোনো উত্তর দিল না। মেহেক আবার ওকে ডাকল,” এই আপনি শুনছেন?”
” বিরক্ত করো না তো মেহেক। ঘুমাতে দাও।”
ধমকটা দিয়েই ফারদিন অন্যদিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মেহেক চুপচাপ হেঁটে বারান্দায় চলে এলো। তার মন একদম খারাপ হয়ে গেল। না পাখির জন্য নয়। তার প্রতি ফারদিনের উদাসীন মনোভাবের জন্য। তার যে মনখারাপ হলো এতে যেনো ফারদিনের কিচ্ছু যায় আসে না। তার কাছে ঘুমটাই বড় হয়ে গেল? সেই রাতে আর ঘুম আসলো না মেহেকের। সারারাত সে বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিল। সকালে ফারদিন ঘুম ভেঙে মেহেককে বিছানায় না পেয়ে বারান্দায় এলো। দেখলো মেহেক মেঝেতে বসে আছে চুপ করে। ফারদিন ওর পাশে বসলো।
” তোমার কি হয়েছে মেহেক? রাতে ঘুমাওনি?”
” ঘুম আসেনি।”
” কেন?”
” জানি না।”
” মনখারাপ?”
” হুম।”
” পাখির জন্য?”
” হুম। পাখিটা হারিয়ে গেছে। কোথায় গেল?”
ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা।
” পাখি কোথায় গেল আমি কিভাবে জানবো বলো? আমি নিজে পাখি হলে হয়তো জানতাম।”
মেহেক কোনো উত্তর দিল না। ফারদিন তাগাদা দিয়ে বলল,” আচ্ছা বাদ দাও৷ এখন উঠো, রেডি হও। আমরা ঘুরতে যাচ্ছি তো।”
” আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” সত্যি যাবে না?”
” উহুম।”
” ঠিকাছে। তুমি তাহলে বাড়িতেই থাকো। রেস্ট নাও। প্রয়োজন হলে ফোন করো। ওহ, তোমার কাছে তো মোবাইল নেই। আচ্ছা আমিই জামাল চাচার মোবাইলে ফোন করে খোঁজ নিবো। ঠিকাছে? যাচ্ছি।”
ফারদিন বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। মেহেকের সত্যি এবার খুব রাগ হলো। এই মানুষটা এত্তো উদাসীন কেন? মেহেক যখন বলল সে কোথাও যেতে চায় না তখন ফারদিনের কি উচিৎ ছিল না মেহেককে জোর করে নিয়ে যাওয়া? তা না করে কি বলল? বাড়িতে থাকো, রেস্ট নাও, ফোন করে খোঁজ নিবো। কি আশ্চর্য! একদম আব্বার মতো কথাবার্তা। ওহহো, মেহেক তো ভুলেই গেছিল। ফারদিনের তো এখন সুজি আছে৷ তাহলে মেহেককে তার কেন দরকার হবে? মেহেককে তো শুধু তখন দরকার যখন মাঝরাতে ক্ষিদে পাবে। আর রান্না করে দেওয়ার জন্য সুজি থাকবে না। এখন তো মেহেক ঝামেলা। মেহেককে নিয়ে ঘুরতে গেলে সুজির সাথে প্রেমটা হবে কিভাবে? মেহেক নিজেই নিজেকে ধমকালো,” বোকা মেহেক,গাঁধী মেহেক! তুই কেন বললি যাবি না? নিজের দোষে বরকে অন্যমেয়ের সাথে প্রেম করার সুযোগ করে দিলি। তোর মতো হাবলা এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।”
মেহেকের সত্যি ওদের সাথে ঘুরতে যাওয়া হলো না। মেহেক খুব অপেক্ষায় ছিল যেন ফারদিন অন্তত আরেকবার এসে তাকে জিজ্ঞেস করে,” তুমি কি যাবে মেহেক?” কিন্তু ফারদিন এলো না। জিজ্ঞেস করলো না। মেহেকেরও যাওয়া হলো না। মনখারাপ নিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল সে। বিকালে ঘুম ভাঙল জামাল চাচার বউ হোসনেয়ারা চাচীর ডাকে। তিনি মেহেকের জন্য একটি পাখির খাঁচা এনেছেন। খাঁচার ভেতর দুইটি পাখি একসাথে বন্দী। লভ বার্ডস। একটার রঙ হলুদ অন্যটা সবুজ। মাথা আর লেজ দুইটারই লাল। মনে হচ্ছে যেন টসটসে দুইটা পাকা আম। এতো সুন্দর! মেহেক খুশিতে হাসতে লাগল। হোসনেয়ারা চাচী বললেন একজন লোক এসে এই খাঁচাটা দিয়ে গেছে। ফারদিন অনলাইন থেকে মেহেকের জন্য এই পাখিগুলো কিনে পাঠিয়েছে। মেহেকের যেন আনন্দ আর ধরে না।সে নাচতে নাচতে পাখি নিয়ে মাঠে চলে এলো। খুশিতে ঝলমল করছিল তার চেহারা। পাখি দু’টোর নাম রাখা হলো,” মেহেক আর ফারদিন।”
সন্ধ্যায় ফারদিনরা বাড়ি ফিরে এলো। তারা উর্মি আর উজানকেও বেড়াতে নিয়ে গেছিল। উর্মি-উজান হলো জামাল চাচার দুই ছেলে-মেয়ের নাম। উর্মির বয়স চৌদ্দ আর উজানের এগারো। তাদের সাথে মেহেকের বেশ ভালোই সম্পর্ক। মেহেক উর্মিকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল তারা কোথায় ঘুরতে গেছিল, সারাদিন কি কি করেছে, কি খেয়েছে, আরও নানান প্রশ্ন। সবশেষে জিজ্ঞেস করল ফারদিন সারাদিন কার সাথে ছিল। সুজির সাথে নাকি সব বন্ধুদের সাথেই। উর্মি মনে হয় মেহেকের প্রশ্নের অর্থ বুঝে ফেলল। খুব সাবধানী কণ্ঠে বলল,” জানেন মেহেক আপু, ফারদিন ভাই কিন্তু সুজি আপারে সারাদিন কোলে নিয়াই ঘুরসে।”
এই কথা শুনে মেহেকের মুখে কৃষ্ণাভ ছায়া পড়ল।
” মানে?”
” হো। সুজি আপায় পানিতে নামতে ভয় পাইতাসিল। তখন ফারদিন ভাই সবার সামনে তারে কান্দে নিয়া সাতার কাটসে। আমরা নৌকায় উঠসি। কিন্তু ওরা আলাদা কইরা স্পিড বোটে চড়সে। সুজি আপার লগে জড়ায় ধইরা ফারদিন ভাইয়ের মোবাইলে ছবিও আছে।”
” আর কি কি করেছে ওরা?”
” একটু পর পর আড়ালে গিয়া খালি কথা কয় দুইজনে। আর সুজি আপা খালি কান্দে। কান্দে আর টিস্যু দিয়া নাক মুছে।”
” কাঁদে কেন?”
” ওইডা তো আমি জানি না। আমারে কি আর কইসে ক্যান কান্দে? কিন্তু আমি দেখসি কানতে।”
” আর কিছু দেখিসনি? আচ্ছা, তোর ফারদিন ভাই কি সুজিকে চুমু-টুমু দিয়েছে একবারও? ”
এই প্রশ্ন শুনে উর্মি লজ্জায় হেসে দিল।মুখ চেপে হাসি থামিয়ে বলল,” কি জানি? দিলেও কি আর আমার সামনে দিবো? কিন্তু আমার মনে হয় দিসে। ওরা তো সারাদিন একজন-আরেকজনের লগে চিপকায় আছিল। দেইখা মনে হইবো, আপনে কেউ না। সুজি আপাই ফারদিন ভাইয়ের বউ।”
মেহেকের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল উর্মির থেকে কথাগুলো শুনে। ইচ্ছে করছিল ওই সুজির বাচ্চার ঘাড় ধরে এনে ড্রেনের পানিতে চুবাতে। কত্তবড় বেয়াদব মেয়ে হলে আরেকজনের বরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে! তার বাপ-মা কি তাকে শিক্ষা দেয়নি? ইশশ, মেহেক যদি পারতো ওই সুজির খাবারে ইঁদুরের ঔষধ মিশিয়ে দিতো। উর্মি বলেছিল ফারদিনের মোবাইলে সুজির সাথে জড়িয়ে ধরা ছবি আছে। সেই ছবি যদি একবার দাদুকে দেখানো যায় তাহলে ফারদিন থাকবে অলটাইম দৌড়ের উপর। ফারদিন ওয়াশরুমে ঢুকেছিল গোসল করতে। ওর মোবাইলটা বিছানায় রাখা ছিল। মেহেক সাবধানে বিছানা থেকে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। বারান্দার দরজাও আটকে দিল। তারপর ফারদিনের মোবাইলের লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকলো আজকের ছবিগুলো দেখার জন্য। অনেকগুলো ছবি। বেশিরভাগই গ্রুপ ফটো। বন্ধুরা একসাথে সেলফি তুলেছে। শুধু সুজি আর ফারদিনেরও কয়েকটা ছবি আছে। তবে সুজির সাথে ফারদিন যেভাবে ছবি তুলেছে, আনজীর,ওয়াসীমও একইভাবে ছবি তুলেছে। তাই ব্যাপারটা মেহেকের কাছে তেমন খারাপ লাগল না। কিন্তু ফারদিন সুজিকে পিঠে উঠিয়ে সাতার কাটার ভিডিওটা দেখে মেহেকের একদম মন ভেঙে গেল। স্পিড বোটে যখন ওরা উঠেছিল, কেউ একজন তাদের ভিডিও করছিল। সেই ভিডিওতে সুজি পেছন থেকে ফারদিনকে জাপটে ধরে ছিল। অন্য একটা ভিডিও দেখে মেহেকের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগল। ভিডিওটি করেছে পূর্বিতা। ওরা একটা মাঠের মতো জায়গায় বসে ছিল। কে কি করছে তার সবকিছুর ভিডিওতে রেকর্ড করা হচ্ছিল। আনজীর দূরবিন চোখে লাগিয়ে কি যেন খুঁজছে। পূর্বিতা আনজীরকে নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করল। তারপর চলে গেল ওয়াসীমের কাছে। ওয়াসীম নিজেও কিছু একটা ভিডিও করছিল। পূর্বিতা ওয়াসীমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফারদিন আর সুজির দিকে ক্যামেরা তাক করল। সেই দৃশ্য দেখে মেহেকের চোখ ছলকে পানি চলে এলো। ফারদিন সুজির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সুজির লম্বা, তরঙ্গায়িত চুলগুলো হাতে নিয়ে খেলছে। একটা সময় মুখ ডুবিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিল। তারপর বলল,” কি শ্যাম্পু লাগিয়েছিস? এতো ঘ্রাণ কেন?”
মেহেকের প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে পুরো ভিডিওটা শেষ করতে পারল না। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছিল। ফারদিন ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই মেহেক মোবাইলটা জায়গামতো রেখে চুপচাপ বিছানায় বসে রইল।ফারদিন গোসল শেষ করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো। মেহেককে দেখেই হাসি মুখে বলল,” হাই।”
মেহেক জবাব দিল না। ফারদিন বিছানায় বসে বলল,” পাখি পছন্দ হয়েছে?”
” হুম। সুন্দর। ”
” কেউ তো একটা থ্যাংকসও দিল না।”
মেহেকের তখন রেগে-মেগে বলতে ইচ্ছে করল,” তোর মতো বেঈমানকে আবার থ্যাংকস কিসের? তুই শুধু খাবি চড়। উল্টা-পাল্টা ছেঁচা লাগানো চড়।”
ফারদিনের হাসি হাসি চেহারাটা দেখতেই বিরক্ত লাগছে। মেহেক উঠে চলে যাচ্ছিল। ফারদিন ওর হাত ধরে বলল,” আরে কোথায় যাচ্ছো?”
অন্যসময় হলে মেহেক এখন খুশির জোয়ারে হাবুডুবু খেতো। ফারদিন তার হাত ধরেছে! এরচেয়ে খুশির ঘটনা আর কি হতে পারে? কিন্তু এখন খুশিটা লাগছে না। মেহেক থমথমে কণ্ঠে বলল,” পাশের রুমে যাচ্ছি।”
” কেন?”
” ঘুমাবো।”
ফারদিন টেনে এনে মেহেককে বিছানায় বসিয়ে বলল,” যেতে হবে না তো। এখানেই থাকো। নাহলে মাঝরাতে আবার ক্ষিদে পেলে আমি তোমাকে পাশের রুমে ডাকতে যেতে পারবো না।”
মেহেক মনে মনে বলল,” কেন? যার কোলে শুতে গিয়েছিলেন সে আপনাকে রান্না করে খাওয়াতে পারে না? আমার কাছেই কেন খাওয়ার জন্য আসতে হয়? আমি কি আপনার রাধুনি হই?”
” মেহেক তোমার কি এখনও মনখারাপ? আচ্ছা কি হয়েছে আমাকে বলোতো?”
” কিছু হয়নি।”
” শিউর?”
” হুম।”
” তাহলে হোসনেয়ারা চাচী যে বললেন তুমি নাকি সারাদিন কিছু খাওনি? এটা কি ধরণের কথা মেহেক? না খেয়ে কিভাবে থাকো?”
” খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষিদে নেই।”
” এই কথা বললে তো হবে না। চলো খেতে যাবে।”
” উহুম। আমি যাবো না।”
” নিশ্চয়ই যাবে তুমি।”
ফারদিন চোখ রাঙালো। মেহেক মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমি যাবো না, যাবো না কোথাও যাবো না। আপনি এমন করছেন কেন আমার সাথে? আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না!”
ফারদিন থতমত খেয়ে গেল মেহেকের অদ্ভুত আচরণে। মেহেক বিছানায় বসে কাঁদতে লাগল। ফারদিন ওর পাশে বসে সিরিয়াস হয়ে বলল,” তোমার কি হয়েছে মেহেক?”
মেহেক কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,” জানেন, ছোটবেলায় যখন আমি জন্মেছিলাম সাতদিন আব্বা আমাকে কোলে নেয়নি। কারণ আমি মেয়ে। আর তিনি ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করেছিলেন। আমাকে নিয়ে আব্বা খুশি ছিলেন না। মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন একটা ছেলে সন্তান। শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার অপরাধে আমি আব্বার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি জন্ম থেকেই। আমার আব্বা আমার সামনে আমার চাচাতো ভাইদের আদর করতেন। তাদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন। আমাকে কখনও নিতেন না। প্রায় সবকিছু থেকেই আমাকে বঞ্চিত করতেন। কারণ আমি মেয়ে! এটাই আমার একমাত্র অপরাধ। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতাম। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর হয়তো আমার এই অবহেলার জীবনটা বদলে যাবে। আমি যাকে ভালোবাসবো সেও শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। কিন্তু হলো না। কারণ আমি মেয়ে এবং আমি মেহেক। পোড়া কপালী মেহেক। আমার কপালে ভালোবাসা কখনও সয় না।”
ফারদিন হতভম্ব হয়ে কথাগুলো শুনছিল। মেহেক চোখ বন্ধ করে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। ফারদিন ওকে দুইহাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” মেহেক, এই মেয়ে এদিকে তাকাও।”
মেহেক তাকাল না। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজকে সে খুব কাঁদবে। তার জন্মটাই বোধ হয় কাঁদার জন্য হয়েছিল।
চলবে