#অনপেখিত
পর্ব_১০
লিখা: Sidratul Muntaz
কিন্তু লজ্জার পাশাপাশি তার মনে জন্ম নিল তীক্ষ্ণ ভালোলাগার এক শিহরিত অনুভূতি। কাঁপতে থাকা কণ্ঠনালী নিয়ে মেহেক আছন্নের মতো বলল,
” এর মানে কি আমি সুন্দর? ”
” নিঃসন্দেহে তুমি খুব সুন্দর মেহেক!”
ফারদিনের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে মেহেকের হৃদয় আবিষ্ট কম্পনে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল। এরকম প্রশংসা তার জন্য নতুন কিছু না। সে আরও অনেকের কাছে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকে খুব কিউট হওয়ার কারণে আদরের ভাগটাও তার বেশি ছিল। কিন্তু কথায় আছে না, অতিরিক্ত আদরে বাদর বনে যাওয়া। মেহেকের হয়েছে সেই দশা। দাদা-দাদী,চাচা,ফুপু,মামাদের আশকারা পেতে পেতে মেহেক উচ্ছন্নে গেছে। তাই লেখাপড়াটাও ঠিক মতো হয়নি। অংকের খাতায় শূন্য পেলেও রূপের খাতায় তার মার্কস সর্বদা একশোতে একশো! মেহেক জানে সেটা। জানার পরেও ফারদিনের কণ্ঠে নিজের প্রশংসা শুনে কেন এতো ভালো লাগছে? নিজেকে খুব বিশেষ মনে হচ্ছে। মেহেক কাকাতুয়া পাখিটির দিকে চেয়ে লাজুক কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল,” আমি কি এই কাকাতুয়াটির মতো সুন্দর? ”
ফারদিন হেসে বলল,
” তুমি এইটার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। ”
এইবার যেন মেহেকের খুশিতে দম আটকে আসার পালা। নিঃশ্বাস ভারী ভারী লাগছে। এতো অদ্ভুত আনন্দ আগে কখনও অনুভব হয়নি তো! মেহেক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,” সত্যি বলছেন?”
” হুম। সত্যিই তো।”
খুশিতে মেহেকের চোখ দিয়ে জল না বেরিয়ে যায়। আজকে মনে হচ্ছে, তার সুন্দর হওয়া সার্থক। তার মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াও সার্থক। তার তিনদিনের বিবাহিত জীবনের ভালোবাসাও সার্থক! মেহেক এইবার উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,” তাহলে কি আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
ফারদিন এই প্রশ্নে হঠাৎ চমকে গেল, থমকে গেল! এতোক্ষণে তার সম্বিৎ ফিরে এলো। মেহেক যে তার সামান্য প্রশংসাবাক্যের এমন অর্থ খুঁজে বের করবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। মেহেকের চোখের তারা দু’টি এই মুহুর্তে জ্বলজ্বল করছে। ফারদিনের ধারণা, এখন ভালোবাসার কথাটা অস্বীকার করলেই মেহেক কেঁদে ফেলতে পারে। বাচ্চা মেয়েটিকে কাঁদানোর কোনো মানে হয়? তাকে কষ্ট দিতে খারাপ লাগছে। চাইলে এখন মিথ্যে বলে মেহেককে খুশি করাই যায়। কিন্তু এই মিথ্যেটা তো শুধু মিথ্যে হবে না। হবে মস্তবড় প্রতারণা। কারণ ফারদিনের মনে একফোঁটাও ভালোবাসা নেই মেহেকের জন্য। যেটা আছে সেটা সহানুভূতি। ফারদিন বলল,
” অনেক রাত হয়ে গেছে মেহেক। ঘুমাতে যাও।”
ফারদিন এই কথা বলে আর দাঁড়াল না। চলে যাচ্ছিল। মেহেক ওর হাত চেপে ধরে বলল,” যাবেন না প্লিজ। আমার কথার উত্তর দিন। হ্যাঁ নাকি না? আপনি উত্তর না দিলে আমার ঘুম আসবে না।”
” উত্তর দেওয়ার সময় না এখন।”
” তাহলে কখন সময় হবে?”
” জানি না। তুমি ঘুমাতে যাও।”
” কিন্তু..”
” মেহেক!”
পুনরায় ফারদিনের সেই গম্ভীর কণ্ঠ, কঠিন দৃষ্টি। মেহেক হালকা নিভল। ফারদিনের হাতটাও ছেড়ে দিল। মাথা নিচু করল। ফারদিন চেহারার গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলল,” সোজা ঘরে যাবে তুমি এখন। আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”
এই কথা বলে সে হাঁটতে শুরু করল। মেহেক পাখিটাকে ধরে মাথা নিচু করে ফারদিনের পেছন পেছন এলো। বাড়িতে ঢোকার পর দুইজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। ফারদিন ঢুকে গেল তার রুমে আর মেহেক পূর্বিতা, সুজি যে রুমে শুয়েছে সেই রুমের দিকে এগিয়ে চলল। তার এখনও খুব খুশি লাগছে। ফারদিনের মুখে ভালোবাসার কথা শুনতে পারেনি তো কি হয়েছে? অন্তত নিজের রূপের প্রশংসা তো শুনেছে। ফারদিনের চোখে সে এই হলুদ পাখিটির চেয়েও সুন্দর। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? মেহেক মনে মনে ভাবছে এই পাখিটি সে সুজিকে নিয়ে দেখাবে। রসিয়ে রসিয়ে বলবে, ফারদিনের থেকে পাওয়া উপহার। তখন কেমন লাগবে সুজির? নিশ্চয়ই খুব জ্বলবে। জ্বলুক, মেহেক তো তাকে জ্বালাতেই চায়।
ফারদিন মাত্র দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়েছে। সারাদিন ড্রাইভ করে তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তখনি দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ফারদিনের বিরক্তির আর সীমা রইল না। এতোরাতে আবার কে? দরজা খুলে দেখল মেহেক। হলুদ পাখি হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন যথাসম্ভব কঠিনভাবে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”
” পূর্বিতা আপুদের ঘরের দরজা বন্ধ। আমি অনেকক্ষণ ধরে নক করছি। খুলছে না।”
” দরজা খুলছে না? আশ্চর্য! ”
ফারদিন ঠোঁট টিপে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল,” আচ্ছা, সামনের একটা রুম ফাঁকা আছে। তুমি ওইখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো, যাও।”
মেহেক তাও দাঁড়িয়ে রইল।ফারদিন দরজা আটকে দিতে নিচ্ছিল কিন্তু মেহেককে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,” কি ব্যাপার? যেতে বললাম না?”
” ভয় লাগছে।”
” ভয় লাগছে কেন?”
” একা থাকতেই ভয় লাগছে।”
” আগে কখনও একা থাকোনি তুমি?”
” থেকেছি। কিন্তু এখানে একা থাকতে ভয় লাগছে।”
” কেন?”
” আপনিই তো বলেছেন, পেয়ারাগাছের ভূতের ঘটনা সত্যি। ”
” এসব মিথ্যা। আমি মজা করেছিলাম তোমার সাথে।”
” কিন্তু আমার মনে যে ভয় ঢুকে গেল।”
ফারদিন ঠোঁট গোল করে একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা, তাহলে আর কি করার? ভেতরে এসো।”
মেহেক সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। যেন এতোক্ষণ এই আদেশের অপেক্ষাতেই ছিল সে। ঘরে ঢুকেই সে সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করল,” পাখিটা কোথায় রাখবো?”
” এইটা এখনও হাতে ধরে রাখার কি আছে? ছেড়ে দাও।”
” ছেড়ে দিলে উড়ে চলে যাবে তো।”
” জানালা আটকানো আছে। যাবে না।”
ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে উত্তর দিল ফারদিন।মেহেক পাখিটাকে ছাড়তেই এটা ছটফট করে উড়তে লাগল। মনে হয় পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে। মেহেকের দেখে হাসি পাচ্ছিল। ফারদিন লাইট নেভাতেই চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। কি ভয়ংকর অন্ধকার! কিছু দেখা যায় না। শরীরের লোম পর্যন্ত না। মেহেক বলল,” লাইট নেভালেন কেন? সব অন্ধকার হয়ে গেল তো।”
” অন্ধকার ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না।”
বিছানায় সটান শুয়ে হাই তুলতে তুলতে উত্তর দিল ফারদিন। মেহেকও ওর পাশে এসে শুলো। এতো অন্ধকারের মধ্যে সে জীবনেও ঘুমায়নি। কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। ফ্যানের শা শা শব্দ ছাড়া অন্যকোনো শব্দ নেই। পাখিটাও ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছিল না মেহেকের। সে খুব সাবধানে ফারদিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল,” এইযে শুনছেন? আমার একটুও ঘুম আসছে না। আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
ফারদিন তো ঘুমে বেহুশ। তার গরম নিঃশ্বাস মেহেকের চোখেমুখে লাগছে। সেই নিঃশ্বাসের সাথে একটা সুন্দর সুগন্ধ ভেসে আসছে। আজকে সিগারেটের গন্ধটা নেই৷ তার বদলে আছে অদ্ভুত এক নেশা নেশা সুভাষ। মেহেকের এতো ভালো লাগছিল! মনে হচ্ছিল, এই মানুষটির পাশে শুয়ে এইভাবে সে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ফারদিন মেহেকের কোমরে জড়িয়ে ধরল। মেহেক আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। সেই মুহুর্ত থেকে নড়াচড়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল তার। মনে হচ্ছিল একটু নড়লেই ফারদিন তাকে ছেড়ে দিবে। সে বঞ্চিত হবে স্বর্গীয় এই অনুভূতি থেকে। খুব সন্তর্পণে মাথাটা ফারদিনের বুকের উপর রাখলো মেহেক। শুনতে পেল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও তৃপ্তিকর শব্দটি। ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ। মেহেক যেন আর এই দুনিয়ায় নেই। হারিয়ে গেছে কাল্পনিক কোনো স্বপ্নময় জগতে। চোখের পাতা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসতে লাগল। অজান্তেই ঘুমে তলিয়ে গেল মেহেক।
মাঝরাতে কারো ফিসফিস ডাকে ঘুম ভাঙল।
” মেহেক, এই মেহেক।”
মেহেক আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল,” আম্মা প্লিজ, ঘুমাতে দাও।”
” মেহেক আমি ফারদিন।”
নামটা শোনামাত্রই সেকেন্ডের মধ্যে মেহেকের চোখ খুলে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল,” ও আপনি? স্যরি,স্যরি। কি হয়েছে?”
ফারদিনও উঠে বসে আছে। ঘরময় আবছা আলো। ফারদিনের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বলছে। ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
মেহেক মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। ঘুম থেকে ডেকে তুলে প্রশ্ন করা হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলে কি-না।অদ্ভুত! মেহেক চোখ কচলে বলল,” হ্যাঁ। ”
” এখনও খুব ঘুম পাচ্ছে?”
” না,না, আপনি বলুন। কেন ডেকেছেন?”
ফারদিন একটু ইতস্তত হয়ে বলল,” আসলে, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। খাওয়ার মতো কিছু পাচ্ছি না। তুমি কি রান্না করতে পারো?”
মেহেক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার জবান বন্ধ হয়ে গেল। মাঝরাতের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করছে, রান্না করতে পারো কি-না। অথচ মেহেক জীবনে ডিমভাজি পর্যন্ত নিজের হাতে করে খায়নি। ফারদিন তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। মেহেক ঢোক গিলে বলল,” অল্প অল্প পারি।”
” চলবে। আপাতত কিছু একটা হলেই চলবে। ক্ষিদের চোটে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। বাড়িতে থাকলে ফ্রীজে নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যেতো। কিন্তু এখানে ফ্রীজই নেই। আমি আবার রান্না করতে পারি না। আমেরিকায় মা-ই সব করতো। কখনও নিজের করে খেতে হয়নি। তাই অভ্যাস নেই। ওয়াসীম, আনজির, পূর্বিতা, ওরা খুব ভালো রান্না জানে। কিন্তু এই মাঝরাতে তো কাউকে ডাকতে পারছি না।”
” বুঝেছি। আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন? আমি আছি না? বলেন কি খেতে চান? আমি রান্না করে দিব।”
কথাটা মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল মেহেকের। সে নিজেই রান্নার কিছু জানে না। শুধু কফি বানানোটা শিখেছিল লিয়ার কাছে। তিশার সাহায্যে দাদুর জন্য মালাই চমচম বানিয়েছিল। মেহেকের রান্নার রেকর্ড এতোটুকুই। এর বেশি সে কিছু পারে না। কিন্তু ফারদিনের সামনে এই সত্য স্বীকার করা অসম্ভব!
রান্নাঘরে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ঝুড়িভর্তি ডিম আছে। ড্রামভরা চাল আছে। আর কিছু কাঁচা সবজি যেমন- বরবটি,টমেটো,গাজর,পেয়াজ,কাঁচা মরিচ আছে। এগুলো কিভাবে কাটতে হয় সেটা পর্যন্ত মেহেকের জানা নেই। জীবনে কখনও রান্নাঘরে পা না রাখা মেয়েটি মাঝরাতে বরের জন্য রান্না করতে ঘুম থেকে উঠে এসেছে! একেই বলে পরিবর্তন। ইশশ, বিয়ের আগে যদি মেহেক মায়ের কাছে একটু রান্নাটা শিখে নিতো তাহলে আজকে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না। এখন সে কিভাবে কি করবে? মেহেকের মন চাইছে কপাল চাপড়ে কাঁদতে। মনে মনে নিজেই নিজেকে ধমকালো,” ছি মেহেক, সামান্য একটা রান্না। এইটুকুও করতে পারিস না? তুই আসলে একটা গুড ফোর নাথিং! তাহলে বড়মুখ করে বলতে গেলি কেন? এখন কিছু রাঁধতে না পারলে মান-সম্মানটা কি আর থাকবে তোর? ”
চলবে