#অনপেখিত
পর্ব_৯
লিখা: Sidratul Muntaz
কেউ যাতে কান্না শুনে না ফেলে তাই মেহেক দৌড়ে জায়গাটি থেকে সরে আসলো। সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ফারদিনের সাথে সুজির সম্পর্ক ছিল। সে ভালোবাসে সুজিকে। নাহলে ওইভাবে জড়িয়ে ধরবে কেন? মেহেকের এখন মনে হচ্ছে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। বিয়ের আগে ফারদিনের সাথে তার অন্তত একবার দেখা করা উচিৎ ছিল৷ সে তো জানতো, ফারদিন তাকে পছন্দ করে বিয়ে করছে না। বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছে। তবুও সে বোকার মতো বিয়েটায় রাজি হয়ে গেল। এবার খুব আফসোস হচ্ছে। কেন রাজি হয়েছিল সে? কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন একটা জায়গায় যে মেহেক চাইলেও ফারদিনকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। মাত্র তিনদিনের বিবাহিত জীবনে সে ফারদিনকে তিন জনমের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসার বন্ধন উপেক্ষা করার শক্তি করুণাময় মেহেককে দেয়নি।
সুজি গলে পড়লো ফারদিনের উষ্ণ আলিঙ্গনে। হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,
” কেন এটা করলে ফারদিন? তুমি খুব খারাপ!”
ফারদিন আর সুজিকে একটু স্পেস দেওয়ার জন্য বন্ধুরা সরে গেল জায়গাটা থেকে। ফারদিন সুজিকে জড়িয়ে ধরে থেকেই বলল,
” আমি বুঝতে পারিনি এমন হয়ে যাবে। সত্যি বলতে আমি কখনও ভাবিইনি যে তুমি আমার ব্যাপারে এতো সিরিয়াস। এই বিয়েটা তোমাকে এতো বেশি কষ্ট দিবে।”
সুজি এইবার ফারদিনের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলল,” আর তুমি? তুমি আমার ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলে না?”
ফারদিন সুজির চেহারাটা দুইহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,” হ্যাঁ, আমিও সিরিয়াস ছিলাম। কিন্তু বাধ্য হয়েছিলাম বিয়েটা করতে। আমার অন্যকোনো উপায় ছিল না সুজি। তোমাকে তো আমি বুঝিয়ে বলেছি সব।”
” মেহেকের প্রতি তোমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাই না? শুধু বাগানবাড়ি ফিরে পাওয়ার জন্যই বিয়ে করেছো?”
” হ্যাঁ। ইনফ্যাক্ট মেহেকও এটা খুব ভালো করেই জানে। ও সব জেনে-শুনেই আমার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাহলে আমার কি দোষ বলো?”
” তাই যদি হয়, তাহলে এখন তো তুমি তোমার বাগানবাড়ি পেয়ে গেছো। এখন মেহেককে ডিভোর্স দিয়ে দাও! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সুজির কণ্ঠে তীব্র আকুলতা। ফারদিন হতাশ হয়ে বলল,
” এ ধরণের কথা মেহেক বললে মানা যেতো। তোমার মুখে এমন অবান্তর কথা মানায় না সুজি। তোমার বয়স তো ষোল না। তুমি কিভাবে এসব কথা বলছো? মেহেকের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন এটাই সবচেয়ে বড় সত্যি! আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে কেন ওর জীবনটা নষ্ট করবো? সেই অধিকার আমার নেই। এসব বলে কোনো লাভ নেই এখন।”
” কেন লাভ নেই? আমি ঠিকই তো বললাম। এতেই আমাদের সবার ভালো হবে। তাছাড়া যার প্রতি তোমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তার সাথে তুমি সংসার করবে কিভাবে?”
” এইটা তো মেহেক বুঝবে না। ওর এখনও বোঝার বয়স হয়নি সুজি। বুঝতে হবে আমাদেরকেই। ”
” কি বুঝতে হবে আমাদেরকে? তুমি ভালো না বেসেও ওর সাথে সংসার করে যাবে? পারবে করতে?”
” পারতে হবে।”
” কেন পারতে হবে?”
” দেখো সুজি, এখন আমি মেহেককে যা বলবো ও হয়তো বাধ্যের মতো সেটাই মেনে নিবে। কিন্তু ওর প্রতি অবিচার করা হবে। যদি মেহেক নিজের ইচ্ছায় আমাকে ডিভোর্স দিতে চায় তাহলে ঠিকাছে। কিন্তু আমি ওকে ডিভোর্স দিতে পারি না। বিয়ে করেছি মানে ওর প্রতি আমার দায়িত্ব এসে গেছে। সেই দায়িত্বটা তো অস্বীকার করতে পারবো না।”
” কিন্তু তুমি তো ওকে ভালোবাসো না। তাহলে এইটা কি ওকে ঠকানো হচ্ছে না? ঠকিয়ে আবার কিসের দায়িত্ব পালন?”
” আমাদের বিয়েটা তো ভালোবেসে হয়নি। অনেকটা চুক্তির বিয়ে বলা যায়। ওর বাবার দরকার ছিল একজন পাত্র আর আমার দরকার ছিল প্রোপার্টি। মেহেক এটা জানে। জেনেই ও বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাহলে ঠকানোর প্রশ্নই আসে না।”
” কিন্তু তবুও, ওর তো তোমার প্রতি এক্সপেকটেশন তৈরী হতেই পারে।”
” হতে পারে না। অলরেডি হয়েছে।”
” হ্যাঁ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহলে এবার তুমি কি করবে? ওকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে?”
” জানি না। শুধু এইটুকু জানি আমার প্রতি ওর অনুভূতি সবই আবেগ। তাই আমি ওর আবেগকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। কিন্তু একটা সময় ও পূর্ণবয়স্ক হবে, ঠিক- ভুল নিজেই বুঝতে শিখবে,নিজের ফিলিংসের ব্যাপারেও নিশ্চিত হবে। তখন হয়তো আমাদের এই বিয়েটার জন্য ও আফসোস করবে।”
” আর যদি আফসোস না করে? যদি দশবছর পরেও ও তোমাকেই চায়?”
ফারদিন চুপ করে রইল। সুজি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” কথা বলছো না কেন?”
ফারদিন থমথমে কণ্ঠে বলল,” এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।”
” কিন্তু যদি হয়?”
” হবে না।”
” তুমি নিশ্চিত? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে কি দশবছর ধরে আমরা অপেক্ষা করবো? কখন ওর ফিলিংস চেঞ্জ হবে আর কখন ও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
” দশবছর লাগবে না। আর পাঁচ-ছয় বছর গেলেই ও বুঝতে পারবে৷”
” তাহলে কি আমাকে আরও পাঁচ-ছয়বছর অপেক্ষা করতে হবে?”
” এই অপেক্ষা খুবই অনিশ্চিত সুজি। আমি চাই না তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করে তোমার লাইফের সুন্দর সময়গুলো নষ্ট করে ফেলো।”
সুজি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি তোমার জন্য সব পারবো। কিন্তু অনিশ্চিত অপেক্ষা কেন বলছো? তুমি তো একটু আগেই নিশ্চিত হয়ে বলেছো যে মেহেক প্রাপ্তবয়স্ক হলেই তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”
ফারদিন হেসে ফেলল এই পর্যায়ে।
” তুমি একদম বাচ্চাদের মতো করছো সুজি।”
” কেন? তুমি বলোনি এই কথা?”
” হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে তা তো আমরা কেউ জানি না।”
” আসলে তোমার নিজেরও মেহেকের প্রতি ইন্টারেস্ট আছে তাই না? আমার সামনে স্বীকার করছো না।”
” শেষমেষ এই চিনলে আমাকে?”
সুজি ধাক্কা মেরে ফারদিনকে দূরে সরিয়ে চলে গেল। রাগে ফাটছিল তার মস্তিষ্ক। ফারদিনের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। জীবনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে তার।
চট্টগ্রাম পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাগানবাড়ি দেখা-শোনার জন্য একজন লোক আগে থেকেই নিয়োজিত ছিলেন। নাম তার জামাল মিয়া। বিগত পাঁচবছর ধরে তিনি তাঁর স্ত্রী- সন্তানকে নিয়ে এইখানে থাকেন। জামাল মিয়ার স্ত্রীর নাম হোসনেয়ারা বেগম। তাদের একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আছে। মেয়েটির নাম উর্মি ছেলেটির নাম উজান। বাড়িটি হচ্ছে বিশাল এক সবুজ মাঠের ঠিক মাঝখানের উপত্যকায়। চারদিকে বাউন্ডারির মতো রাস্তা। বাড়ির ঠিক ডানপাশে একটা বকুল গাছ। পেছন সাইডেই আছে তেতুল তলা। তার পেছনে বড় একটা পর্বত। সেই পর্বতে আছে সরিষা ক্ষেত, বাহারি ধরণের ফুল গাছ। বাউন্ডারির মতো যে রাস্তা গেছে, তার মাঝখানে একটা সিঁড়ির মতো পথ বেয়ে চলে গেছে তৃতীয় সরু রাস্তাটি। সেই রাস্তার ডানপাশে লালশাকের ক্ষেত আর বামপাশে ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। সামনে বড় একটা পেয়ারা গাছ। বেশিরভাগ মানুষ বলে ওই পেয়ারা গাছে ভূত থাকে। অথচ ছোটবেলায় ওই পেয়ারা গাছটাই ছিল ফারদিনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় পেয়ারা গাছটিকে বড় সুন্দর দেখায়। ফারদিন ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময় এই গাছের নিচে এসে কাটাতো। এইখানে সবুজ নরম ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখার মতো শান্তি পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তে নেই। আমেরিকাতেও না। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই অনেক ক্লান্ত ছিল৷ তাই খুব দ্রুত শুয়ে পড়তে হলো। ভোরবেলায় সবার ঘুরতে যাওয়ারও পরিকল্পনা আছে। পূর্বিতা,সুজি আর মেহেক একরুমেই ঘুমাতে এলো। বাড়িতে মোট চারটা খালি রুম। পাঁচ নম্বর রুমে জামাল মিয়া ও তাঁর সংসার। খালি রুমগুলোর মধ্যে দুটো রুম একদম এডজাস্ট। এই দুইরুমকে একরুমই বলা যায় শুধু মাঝে দেয়াল দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। সেই রুমেই মেয়েরা শুয়েছে। সুজি মেহেকের সাথে থাকবে না তাই সে দেয়ালের অপর প্রান্তে গিয়ে শুয়ে ছিল। আজকে সারাদিনে পূর্বিতার সাথে মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে মেহেকের। ওরা গল্প করার জন্য একসাথে শুলো। কিন্তু হঠাৎ পাশের রুম থেকে সুজি ডাক দেওয়ায় পূর্বিতা উঠে সুজির কাছে চলে গেল৷ মেহেকের একা শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না। এই জায়গার আনাচে-কানাচে তার মুখস্ত। ছোটবেলায় অনেকবার আব্বা-আম্মার সাথে থাকতে এসেছিল সে এই বাড়িতে। তাই যখন ঘুম আসছিল না তখন শুয়ে শুয়ে বোর হওয়ার চেয়ে সে হাঁটতে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। জায়গাটা গ্রামের মতো হওয়ায় এইখানে শীতের উপদ্রব একটু বেশিই। মেহেক চাদর গাঁয়ে দিয়ে বের হয়েছে। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ওই পেয়ারা গাছ। আজকে জোৎস্নাও আছে। মেহেক পেয়ারা গাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা খুব সুন্দর দেখতে হলুদ রঙা পাখি ঠিক সেই মুহুর্তে ডালে এসে বসলো। মেহেক খুব সন্তর্পণে, কৌশলে পাখিটিকে ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এতো সুন্দর পাখিটি নাগালে পেয়েও ধরতে না পারলে তার জীবন বৃথা! মেহেক পাখির অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। যেই না ধরতে যাবে ওমনি পেছন থেকে কেউ একজন গর্জন করে উঠলো,” ভাউউউউ!”
মেহেক লাফিয়ে উঠে লালশাকের ক্ষেতে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। ফারদিন হাসতে হাসতে ওর একহাত চেপে ধরল। মেহেকের বুক তখনও ধুকপুক করছে। ফারদিনের হাসি হাসি মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সে। কথায় কথায় ধমকানো, গুরুগম্ভীর, ভ্রু কুচকে রাখা তীক্ষ্ণ মেজাজী মানুষটাও যে এমন রসিকতা করতে পারে তা মেহেকের ধারণাতীত ছিল। ফারদিন বলল,
” তুমি এইখানে কি করছো?”
” ঘুম আসছিল না। তাই হাঁটতে এসেছি। আপনি কি করছেন?”
” আমিও হাঁটতে এসেছি।”
” ও।”
মেহেক পেছন দিকে হেলে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। ফারদিন ওই অবস্থাতেই ওর হাতটা ধরে ফেলেছিল৷ এখনও ওরা ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মেহেক বলল,
” আমাকে টেনে তুলুন প্লিজ। এভাবেই ঝুলে থাকবো নাকি?”
” তুমি নিজে উঠে আসতে পারছো না?”
” আমি পারলে কি আর আপনাকে বলতাম?”
” আমি কেন কষ্ট করে টেনে তুলবো তোমাকে? নিজে উঠে আসতে পারলে আসো নাহলে ছেড়ে দিলাম।”
” না, না প্লিজ। ছাড়বেন না।”
মেহেক দুইহাত দিয়ে ফারদিনের হাতটি আঁকড়ে ধরলো। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। ফারদিনের চেহারায় ফিচেল হাসি। মেহেক অসহায় কণ্ঠে বলল,
” সত্যি আমি উঠতে পারছি না। বিশ্বাস করুন! আপনি একটু আমায় টেনে তুললে কি হয়? এমন করছেন কেন?”
ফারদিন মেহেকের ধরে থাকা হাতটি বেশ জোরে টান মারলো। মেহেক অনেকটাই ফারদিনের কাছে চলে আসলো। একদম বুকের কাছাকাছি। ফারদিনের গরম নিঃশ্বাস তার কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে।ব্যালেন্স হারিয়ে আরেকবার পড়ে যেতে নিচ্ছিল মেহেক তখন ফারদিন দুইহাতে ওর কোমড় আঁকড়ে ধরল। মেহেক খামচে ধরল ফারদিনের টি-শার্ট। তারপর মাথা তুলে তাকালো তার চেহারার দিকে। দৃষ্টি সেখানেই থমকে রইল কিছুক্ষণ। মেহেক নির্ণিমেষ চেয়ে রইল ফারদিনের চোখের দিকে। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে ওই চোখজোড়ায়। নাহলে তাকালেই এমন নেশা লেগে যায় কেন? ফারদিন হঠাৎ মৃদু কণ্ঠে বলল,” ছাড়বে না? নাকি সারারাত এভাবেই কাটাতে চাও?”
মেহেক লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দিল ফারদিনের টি-শার্ট। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” স্যরি।”
ফারদিন আরাম করে পেয়ারা গাছটার নিচে বসলো।
” জানো মেহেক, এই গাছে কিন্তু ভূত আছে।”
মেহেকও বসলো ওর পাশে।
” হ্যাঁ শুনেছি। আব্বা ভূতের গল্প বলতেন।”
” তোমার তো সাহস কম না। ভূতের গল্প জানার পরেও এখানে একা একা হাঁটতে এসেছো? ভয় লাগে না?”
” ভয় কেন লাগবে? গল্প তো গল্পই। এসব কি সত্যি হয় নাকি?”
ফারদিন আম্ভরিকভাবে বলল,
” সব সত্যি।”
” কি?”
” হুম। ওইযে সামনে খালি জায়গাটা দেখছো, ওইখানে আগে একটা পুকুর ছিল। আমাদের পরিচিত একটা মেয়ে গলায় কলসি বেঁধে ওই পুকুরে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকে জায়গাটা অভিশপ্ত। প্রায় রাতেই মানুষ এইখানে সাদা শাড়িওয়ালা কাউকে হাঁটতে দেখে।”
” আপনি মিথ্যে বলছেন।”
” আমার কথা বিশ্বাস না হলে জামাল চাচাকে ডেকে জিজ্ঞেস করো। ডাকবো জামাল চাচাকে?”
অন্ধকারে ফারদিনের সুন্দর চেহারাটাও কেমন যেনো ভূতের মতো দেখাচ্ছে। এক্ষুণি যদি ফারদিন বলে উঠে সে নিজেই ভূত তাহলে মেহেকের চেঁচিয়ে উঠতে দুই সেকেন্ডও লাগবে না। যদিও সে জানে ফারদিন ফাজলামি করছে। তবুও তার ভয় লাগছে। অসম্ভব ভয়! মেহেক বলল,” প্লিজ, ভূত আলোচনা বন্ধ করি আমরা? রাতের বেলা এসব শুনতে ভালো লাগে না।”
” তাহলে কি দিনের বেলা শুনতে চাও?”
” হ্যাঁ। এখন অন্য আলোচনা করুন।”
ফারদিন সটান করে শুয়ে পড়লো সবুজ ঘাসের উপর। মাথার পেছনে দুইহাত রেখে বলল,” জানো মেহেক, আগে এইখানে এইভাবে শুয়ে আকাশে তারা দেখতে অনেক ভালো লাগতো। এখন আকাশে খুব একটা তারা দেখা যায় না। আগের দিনগুলোই ছিল অন্যরকম।”
” এই ব্যাপারটা আমিও লক্ষ্য করেছি। আগে আসলেই আকাশে অনেক তারা দেখা যেতো। এখন কেন দেখা যায় না?”
” অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো নগরায়ন বৃদ্ধি, আলোক দূষণ। ”
” সেটা আবার কি?”
” আলোক দূষণ মানে হচ্ছে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার। আর নগরায়ন বৃদ্ধির কারণে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার বাড়ে। রাতে শতভাগ অন্ধকার না থাকায় অতিরিক্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। যে নক্ষত্রগুলো আলোক দূষণকে ছাপিয়ে যেতে পারে শুধু সেগুলোই আমরা তারা হিসেবে দেখতে পাই। এজন্যই খালি চোখে আকাশে তারা কম মনে হয়।”
মেহেক অতি মনোযোগী ছাত্রীর মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,” ও আচ্ছা!”
” এখন বলো, তুমি মধ্যরাতে এই গাছতলায় কি করছিলে?”
” একটা হলুদ পাখি ধরার চেষ্টা করছিলাম। খুব সুন্দর পাখি ছিল জানেন? আপনার জন্য পাখিটা ধরতে পারলাম না।”
এই কথার পরেই মেহেক আবার সেই পাখিটিকে দেখতে পেল।পাখিটি এখন সামনের কামরাঙা গাছে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মেহেক বলল,” ওইতো পাখিটা। কি সুন্দর! এই পাখির নাম কি?”
” এইটা তো হলুদ কাকাতুয়া।”
” আমার ওই কাকাতুয়াটা লাগবে।”
ফারদিন সত্যি সত্যি উঠে কামরাঙা গাছ থেকে ছো মেরে হলুদ কাকাতুয়াটা ধরে আনলো। মেহেক আনন্দে লাফিয়ে উঠে হাত তালি দিতে শুরু করল। ফারদিন কাছে আসতেই সে ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ। আপনি মারাত্মক একটা কাজ করেছেন।”
আচমকাই ফারদিনের ডানগালে চুমু বসিয়ে দিল মেহেক। ফারদিন ভ্যাবাচেকা খাওয়া কণ্ঠে বিড়বিড় করল,” পুরা বাচ্চা একটা!”
মেহেক পাখিটাকে হাতে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে পরখ করতে লাগল। ফারদিন পকেটে দুই হাত গুঁজে আয়েশী ভঙ্গিতে বলল,
” এখন কি করবে পাখিটা দিয়ে? এই পাখি কিন্তু খাওয়া যায় না।”
” অদ্ভুত! এতো সুন্দর পাখিটা কি আমি খাওয়ার জন্য ধরেছি? আমি কি এতোই নিষ্ঠুর?”
” তাহলে কি করবে?”
” দেখছেন না আদর করছি? কি সুন্দর একটা জিনিস! ”
” শুধু আদর করার জন্য এতো কষ্ট করে ধরে আনলাম?”
” হ্যাঁ অবশ্যই। কেন? সুন্দর জিনিস দেখলে আপনার আদর করতে ইচ্ছে করে না?”
” নাহ। যদি এমন হতো তাহলে তোমাকেও সারাদিন ধরে আদর করতে ইচ্ছে হতো।”
ফারদিন সরাসরি মেহেকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহেকের চেহারা লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো লাল টুকটুকে হয়ে গেল।
চলবে