অনপেখিত পর্ব-০৮

0
1813

#অনপেখিত
পর্ব_৮
লিখা: Sidratul Muntaz

ফারদিন বলল,” তুমি পেছনে গিয়ে বসো সুজি। ওকে উঠানোর কি দরকার?”
ফারদিনের উত্তরে মেহেকের চেহারায় একটা আশ্চর্য অহংকারবোধ জন্ম নিল। ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরী হলো। সেই আত্মবিশ্বাসী চকচকে দৃষ্টি নিয়ে সুজির দিকে তাকালো সে। সুজি ঈর্ষান্বিত চেহারায় মেহেককে কয়েক মিনিট দেখে নিয়ে শেষমেষ পেছনে গিয়েই বসলো। গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করল। ফারদিনের এই মুহুর্তের আচরণে মেহেকের মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেও সেই আনন্দটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ যখন মনে পড়লো, সে না এলে ফারদিন শুধু সুজিকে নিয়েই চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছিল তখনই মনটা বিষাক্ত এক অনুভূতিতে তিক্ত হয়ে এলো। নিজের প্রতি জন্ম নিল বিতৃষ্ণা। সে সুজির চেয়ে সুন্দর হতে পারলো না বলেই কি তার প্রতি এমন অবিচার? আয়নায় তাকিয়ে পেছনে বসে থাকা সুজিকে একবার দেখলো মেহেক। মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর বললে ভুল হবে অনেক বেশিই সুন্দর। বাদামী চোখের মণি, লালচে চুল, সোনালী ফরসা গায়ের রঙ, ঠোঁটের আকৃতি মোহনীয়, চেহারায় নায়িকা-নায়িকা ভাব, বেশ ভালোই লম্বা। আর ও পোশাক-আশাকেও কত স্মার্ট! দেখলেই বোঝা যায় সে খুব এলিগেন্ট। মেহেক কি কখনও পারবে সুজির মতো হতে? একটু পরেই গাড়ি থামলো চার রাস্তার এক মোড়ে। সেখানে অপেক্ষারত দুইজন ছেলে আর একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন ছেলের গাঁয়ে খয়েরী টি-শার্ট অন্যজন পরে আছে নেভি ব্লু জ্যাকেট। আর মেয়েটার গাঁয়ে কাঁচা কলাপাতা রঙের সেলোয়ার-কামিজ। তবে কামিজের হাতা নেই। ফরসা বাহু দৃশ্যমান হয়ে আছে। ফারদিন গাড়ি থামিয়ে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করল। সুজিও হাত নাড়িয়ে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করল। ওরা ইংরেজি আর বাংলার সংমিশ্রণে কথা বলছে। এ ধরণের কথা শুনলে মেহেকের কেমন একটু লজ্জা লাগে। ছেলে দু’জনের দৃষ্টি আটকে গেল মেহেকের দিকে। নেভী ব্লু জ্যাকেটওয়ালা প্রশ্ন করল,” এইটা কে?”
ওই প্রশ্নে সুজির হাসি হাসি চেহারাটা কালোবর্ণ ধারণ করল। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” ফারদিনকেই জিজ্ঞেস করো।”
ফারদিন উত্তর দিল,” ওর নাম মেহেক। আমার ওয়াইফ।”
তিনজনের চেহারায় এখন খেলা করছে বিস্ময়। যেনো মাত্র শোনা কথাটা তারা হজম করে উঠতে পারলো না। গাড়িতে উঠে বসার পর মেয়েটাই প্রথমে মেহেকের সাথে কথা বলল,” হাই, আমি পূর্বিতা। ফারদিনের কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।”
পূর্বিতার দেখা-দেখি খয়েরী টি-শার্টওয়ালাও বলল,
” হ্যালো, আমি ওয়াসিম। ফারদিনের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড।”
মেহেক কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করছিল ওদের সামনে।
সে কথা শুরু করল সালাম দিয়ে,” আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আমি মেহেক ইমরোজ।”
পূর্বিতা বলল,” বাহ, খুব সুন্দর নাম তো।”
ওয়াসিম হাসি দিয়ে বলল,” আপনি তাহলে আমাদের সবার ভাবী, তাই না?”
নীল জ্যাকেটওয়ালা ওয়াসিমের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” আরে বেটা, আপনি আপনি করছিস কেন? দেখছিস না কত ছোট মেয়ে! ওকে আপনি বললে মানায়?”
পূর্বিতা বলল,” হ্যাঁ তাইতো। আমরা ওকে তুমি করেই বলতে পারি। যেহেতু আমাদের পুচকী ভাবী। তাই না?”
মেহেক আন্তরিকভাবে হেসে বলল,” জ্বী অবশ্যই।”
নীল জ্যাকেট পরা ছেলেটির নাম আনজির। সে ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” এই শালা, তোর প্রবলেম কি? বিয়ে করে দাওয়াত দিস না কেন?”
ফারদিন আক্ষেপের সুরে বলল,” আরে ভাই, বিয়ে এতো তাড়াহুড়ার মধ্যে হয়েছে যে নিজের বাপ-মা’র জন্যেও অপেক্ষা করতে পারিনি। বাবা-মা আসলে রিসিপশন হবে। তখন ভেবেছিলাম তোদের সবাইকে একসাথে জানাবো।”
পূর্বিতা বলল,” তাহলে আজকেরটা কি সারপ্রাইজ ছিল?”
বন্ধুরা সমস্বরে হেসে উঠলো। ফারদিনও ওদের হাসিতে যোগ দিয়ে বলল,” ধরে নে তাই।”
আনজির সুজির দিকে তাকিয়ে বলল,” সত্যি, খুব বিরাট একটা সারপ্রাইজ ছিল!” মেহেকের কিছুটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। ঠিক এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে জেদ করে ফারদিনের সাথে ঘুরতে আসা মোটেও উচিৎ হয়নি। যতই সবাই মেহেকের সাথে হেসে হেসে কথা বলুক না কেন, মনে মনে প্রত্যেকের মধ্যেই একটা জড়তা কাজ করছে। এই জড়তার কারণ হতে পারে সুজি আর ফারদিনের মধ্যকার সম্পর্ক। আচ্ছা,তাদের মধ্যে কি প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল?

গল্প-গুজব করতে করতে সময়গুলো যেন কিভাবে কেটে যাচ্ছিল। কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে গাড়ি থামানো হলো লাঞ্চের জন্য। সবাই নেমে হাত-মুখ ধুঁয়ে টেবিলে খেতে বসলো। তখন আনজির আর ওয়াসিম ফারদিনকে নিয়ে কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেল। আর আসার নাম নেই। পূর্বিতা আর সুজি বসেছিল মেহেকের সাথে। একটু পর ওরাও উঠে চলে গেল। পূর্বিতা যাওয়ার আগে মেহেককে বলল,” পুচকী ভাবী, তুমি একটু বসো। আমরা ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
ওরা চলে যাওয়ার পর মিনিট পাঁচেক একা একাই বসে রইল মেহেক। হঠাৎ কোথ থেকে যেন অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দের উৎস বরাবর মেহেক এগিয়ে যেতেই আবিষ্কার করল ফারদিন ও তার বন্ধুরা একটা খালি জায়গায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আনজির ফারদিনের কলার ধরে রাগান্বিত স্বরে বলছে,” তুই শালা এটা কিভাবে করলি সুজির সাথে? এতো বেঈমান তুই?”
পূর্বিতা বলল,” আমার নামেও একটা চড় লাগা। ওকে ফ্রেন্ড বলতেও আমার লজ্জা লাগছে।”
ওয়াসিম বলল,” আচ্ছা বিয়ে করেছিস ভালো কথা৷ তাই বলে এইরকম একটা মেয়েকে? এইটা তো পিচ্চি মেয়ে! আমার ওর সমান একটা ভাগনী আছে। ”
ফারদিন বলল,” আচ্ছা তোরা আমার কন্ডিশনটা কি একটু বুঝবি না? আমি কেন বিয়ে করেছি সেটা আগে শোন!”
আনজির বলল,” যে কারণেই বিয়ে করিস। মূলকথা হলো তুই সুজিকে ঠকিয়েছিস।”
ফারদিন তেতে উঠলো এবার,” আরে বাল, কিভাবে ওকে ঠকালাম আমি? আমি কি জীবনে বলসি যে আমি ওকে ভালোবাসি?”
পূর্বিতা হতবাক, ” এইটা মুখে বলতে হবে কেন? তুই না বললেও এটা আমরা সবাই জানতাম। ওপেন সিকরেটের মতো ছিল ব্যাপারটা। ইনফ্যাক্ট আমরা তো ভেবেছিলাম তুই সুজিকে প্রপোজ করার জন্যই চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছিস। ওকে সারপ্রাইজ দিবি। কিন্তু বেচারী এতোবড় সারপ্রাইজ পেল যে এখন কোনো কথাই বলতে পারছে না। একবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ।”
ফারদিন অপরাধী গলায় বলল,” সুজি, আই এম স্যরি।”
সুজি হাত ভাজ করে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফারদিনের কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল তার উপর। রাগে ফুঁসে উঠে সুজি বলল,” তুমি আবার কথা বলছো কোন সাহসে? এতো ইজিলি আমি তোমাকে জীবনেও মাফ করবো না ফারদিন। আমি তো এখানে আসতেই চাইনি। শুধু বন্ধুদের অনুরোধে এসেছি। নাহলে তোমার কিংবা তোমার ওয়াইফের চেহারা দেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। আর আমি তো ভাবতেই পারছি না, তুমি আমাদের ট্রিপে ওই মেয়েটাকে পর্যন্ত নিয়ে এসেছো। কেন? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? এতোবড় কষ্ট দিয়েও আশ মিটেনি তোমার?”
সুজি অনেক বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিল। পূর্বিতা ওকে দুই হাত দিয়ে ধরে থামালো,” আচ্ছা কাম ডাউন মাই ডিয়ার। মেয়েটা আশেপাশেই আছে। শুনতে পেলে প্রবলেম হয়ে যাবে। বেচারার সংসারে আগুন লাগবে পরে।”
সুজি বেপরোয়া ভাবে বলল,” লাগুক আগুন। আমার জীবনটা ছাড়খাড় করে দিয়ে ও এখন খুব সুখে থাকবে তাই না? আমি বের করছি ওর সুখে থাকা।”
সুজির চোখ দিয়ে স্রোতের ন্যায় অশ্রু গড়াচ্ছিল।ফারদিন আচমকা কাছে এসে সুজিকে জড়িয়ে ধরে কোমল কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি সুজি। এক্সট্রিমলি স্যরি!”
মেহেক এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না। মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো ফুপিয়ে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে