#অনপেখিত
পর্ব_৬
লিখা: Sidratul Muntaz
মেহেক এক দৌড়ে ছুটে গেল বাথরুমে। নাক, মুখ, চোখ থেকে শুরু করে চেহারার প্রত্যেকটা অঙ্গ ঝলসে যাচ্ছে যেনো। কল ছেড়ে আজলা ভর্তি পানি ঝটপট ঢালতে লাগল চেহারায়। ফারদিন এতোক্ষণে নিচে চলে গেছে। সুজিকে গ্যারেজের সামনে দাঁড়ানো দেখে ফারদিন দৌড়ে গেল সেখানে। ফারদিনকে দেখে সুজি সামনে হাঁটতে লাগল। ফারদিন ওর হাত ধরে ফেলল,” দাঁড়াও সুজি, এটা কি ধরণের পাগলামি হলো? তুমি মেহেকের সাথে এমন কেন করলে?”
সুজি আক্রোশে প্রায় গর্জন করে উঠলো,” তুমি আমার সাথে এটা কি করলে ফারদিন? এতোবড় ধোঁকা আমি তোমার থেকে এক্সপেক্ট করিনি।”
” তাই? কিভাবে আমি তোমাকে ধোঁকা দিলাম?”
” আবার জিজ্ঞেস করছো? তুমি যে বিয়ে করেছো এটা তোমার বাড়ি এসে কেন জানতে হলো আমাকে? আগে কেন জানলাম না?”
” দেখো সুজি, বিয়েটা অনেক তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছে। কাউকে জানানোর মতো অবস্থাই ছিল না।ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও জানতাম না যে আমি বিয়ে করছি।”
সুজি টিস্যুতে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” তোমার ফ্যামিলি তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে? তুমি তো একটা এডাল্ট পারসন। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে হয় কিভাবে?”
ফারদিন মাথা নিচু করে বলল,
” বিয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়নি। আমার সম্মতিতেই হয়েছে।”
সুজি অবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,” কি? তুমি আমার সাথে এটা করতে পারো না ফারদিন।”
” কি করেছি আমি?”
” আমাকে ঠকিয়েছো।”
” আমি তো কখনও বলিনি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাহলে ঠকানোর প্রসঙ্গ আসছে কিভাবে?”
সুজি এই কথা শুনে এতো বেশি আহত হলো যে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু আয়ত্ত করতে পারছিল না। তার খুব দুঃখ লাগছিল। বুক ফেটে কান্না উঠে আসতে চাইছিল। সে প্রশ্ন করল স্তব্ধ কণ্ঠে,
” সত্যিই কি আমাদের মাঝে কখনও ভালোবাসা ছিল না ফারদিন?”
ফারদিন নিশ্চুপ। সত্যি বলতে, সে নিজেও সুজিকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার পরিস্থিতি এখন আর নেই। সুজি কখনোই জানবে না ফারদিন তাকে প্রপোজ করার জন্য কত আয়োজন সাজিয়ে রেখেছিল মনে। কত স্বপ্ন সাজিয়েছিল দিনের পর দিন। সুজি জানবে না কখনও ফারদিনের অব্যক্ত অনুভূতিগুলোর গুঞ্জন। কিছু কিছু অনুভূতি এভাবেই আড়ালে থেকে যায়। আজীবন!
মেহেক বাথরুমের ছোট্ট জানালা থেকে দেখছিল দু’জনকে। ফারদিন ওই বেয়াদব মেয়েটার কাছে আবার কি করতে গেছে? মেয়েটা কতবড় অন্যায় করল মেহেকের সাথে। ভাগ্যিস কফিটা ঠান্ডা ছিল। ধোঁয়া উঠা কফি হলে এতোক্ষণে মেহেকের ফরসা গাল ঝলসে যেতো। চেহারায় ফোশকা পড়তো। কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল। মেহেক লাল চুলের ওই শাকচুন্নিকে কিছুতেই ছাড়বে না। প্রতিশোধ সে নিবেই। মেহেক বাথরুম থেকে বেরোতেই দেখল লিয়া বালতিভরা পানি নিয়ে এসেছে ঘর মুছতে। বালতির নোংরা পানি কালো দেখাচ্ছে। মেহেক বলল,
” লিয়া, এদিকে এসো। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
” কি কাজ ভাবী?”
” বলছি। বালতিটা উঠিয়ে আমার সাথে এসো।”
লিয়া মেহেকের কথামতো বালতি নিয়ে ওর পেছন পেছন এলো। মেহেক আদেশের সুরে বলল,
” এখন এই পুরো বালতির পানি ওই মেয়েটার উপর ঢেলে দিবে।”
লিয়া চোখ কপালে তুলে বলল,” কেন ভাবী?”
” আমি বলেছি এজন্য।”
” ছি, ছি, আমি পারবো না। ছোটভাই দেখলে খবর আছে।”
মেহেক চোখ রাঙিয়ে বলল,
” কেউ দেখবে না। আমি যেটা বলছি সেটা করো। তোমাকে স্পেশাল টিপ দিবো। একটা নতুন জামা কিনে দিবো।”
লিয়া শুকনো মুখে বলল,” কিন্তু ছোটভাই যদি দেখে?”
” বললাম তো দেখবে না।”
” ঠিকাছে।”
” এক মিনিট, সাবধানে ঢালবে। আমার প্রাণনাথের গাঁয়ে যেনো একফোঁটাও নোংরা পানি না লাগে।”
” প্রাণনাথ মানে?”
” মানে তোমার ছোটভাই।”
লিয়া ফিক করে হেসে দিল। এক বালতি নোংরা পানি সত্যি সত্যি বাথরুমের জানালা দিয়ে আছড়ে পড়ল সুজির উপর। সুজির পুরো গোসল হয়ে গেল। ফারদিন ছিটকে দূরে সরে গেলেও সুজি সরতে পারেনি। ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ভেজা শরীর নিয়ে সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তার শরীর থেকে দূর্গন্ধ আসছে। কি বিছরি, কি বাজে! মেহেক হাসতে হাসতে জানালা থেকে সরে গেল। লিয়াকেও সরার জন্য ইশারা করেছিল কিন্তু বোকা লিয়া সরেনি। পরে মেহেক হাত দিয়ে টেনে লিয়াকে জানালার সামনে থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে নিচ থেকে ফারদিন লিয়ার সেলোয়ার কামিজের ওরনা দেখে ফেলেছিল। ভ্রু কুচকে সে ভাবল, লিয়া এই কাজ কেন করল? পরেই তার মাথায় এলো, লিয়া এইরকম করতে পারে না। সে খুব শান্তশিষ্ট ভদ্র একটা মেয়ে। এমন শয়তানি বুদ্ধি তার মাথায় আসার কথা না। নিশ্চয়ই মেহেকের কথায় লিয়া এটা করেছে। কিন্তু মেহেকটা এতো ফাজিল!
মেহেক হাসতে হাসতে লিয়াকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো। খুশি খুশি কণ্ঠে বলল,” তুমি খুব ভালো কাজ করেছো লিয়া। ভেরি গুড। তুমি যেটা চাইবে আমি তোমাকে সেটাই দিবো।”
” কিন্তু আমার ভয় লাগতাসে ভাবী। ছোটভাই যদি কিছু বলে? উনি মনে হয় বুঝে ফেলবে পানি যে আমরাই ঢালসি।”
” তুমি বোকার মতো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? এজন্যই তো বুঝে ফেলবে। তোমাকে সরে যেতে বলেছিলাম না?”
” এখন কি হবে ভাবী?”
” কিছু হবে না। আমি ম্যানেজ করবোনে যাও।”
ঠিক ওই সময় কলিংবেল বাজল। লিয়া বলল,” ছোটভাই আসছে। আমি গেলাম ভাবী।”
” আরে, ভয় পাচ্ছো কেন? যাও দরজা খুলো। কিছু হবে না। শুধু একটু একটিং করবা। ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে রাখবা। যেনো কিছুই হয়নি।”
এই কথা বলে মেহেক রান্নাঘরে চলে গেল। লিয়া দরজা খুলতেই দেখল ফারদিন সুজিকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। লিয়ার মুখ দিয়ে অজান্তেই আর্তনাদ বেরিয়ে আসল,” ভাবী!”
মেহেক রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই ফারদিন আর সুজিকে দেখতে পেল। রীতিমতো তার পিলে চমকে উঠলো। হাতে ছিল কাঁচের প্লেট। পড়ে ভেঙে গেল। ছলছল দৃষ্টিতে অসহায় মেহেক নির্ণিমেষ চেয়ে রইল ওদের দিকে। ফারদিন কাউকেই তোয়াক্কা না করে সুজিকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেল। লিয়া ধীরপায়ে মেহেকের দিকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে ডাকল,” ভাবী!”
মেহেকের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বাহিত হচ্ছে। দৃশ্যটা যেনো তার হৃৎপিন্ডে আঘাত করেছে। শেষমেষ কি দেখলো সে এটা? আর কিছু ভালো লাগছে না। এই পৃথিবী বিষাক্ত মনে হচ্ছে। মেহেক লিয়ার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে গেস্টরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সেই দরজা লিয়া সারাদিন ডেকেও আর খোলাতে পারল না। দুপুরে তিশা আরশাদ সাহেবকে নিয়ে ফিরে এলো। ততক্ষণে সুজি চলে গিয়েছে। ফারদিনও বাসায় ছিল না। মেহেকের দরজা বন্ধের কারণ তিশা লিয়ার কাছে জানতে চাইলে লিয়া সবকিছু বিস্তারিত বলল। তিশা ব্যাপারটা কাউকে জানালো না। ফারদিনের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করল। ফারদিন ফিরল রাতে। তিশা তৎক্ষণাৎ ফারদিনের ঘরে ছুটে গেল। তাকে অনুরোধ করল মেহেকের কাছে যেনো ক্ষমা চায়। মেহেক সারাদিন কিছু খায়নি। ফারদিন যেনো তাকে খেতে বলে। ফারদিন প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। মেয়েটা এমনিই অতিরিক্ত আশকারা পেয়ে মাথায় উঠে গেছে। এখন আবার ক্ষমা চাইতে গেলে আরও মাথায় উঠবে। কিন্তু তিশা বলল,” তুমি যদি না যাও তাহলে আমি দাদুকে সবকিছু জানাবো।”
ফারদিনের বরাবরই দাদুর প্রতি একটা ভীতি আছে। বাধ্য হয়েই তাকে যেতে হলো মেহেকের কাছে। কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,” কে?”
” আমি ফারদিন। দরজা খোলো মেহেক।”
এক মিনিটও লাগলো না। মেহেক সাথে সাথে দরজা খুলে দিল। এতোক্ষণ ধরে শুধু এই একটা ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল সে। অবশেষে ডাকটা শুনতে পেরে নিজেকে বিশ্বজয়ী বোধ হচ্ছে। কিন্তু এতো সহজে গলে পড়লে তো চলবে না। তার নিজেরও একটা দাম আছে। সেই দাম বজায় রাখতে হবে। তাই মেহেক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” কি চাই?”
” সারাদিন দরজা বন্ধ করে রেখেছো কেন? সমস্যা কি তোমার?”
মেহেক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে বলল,” আপনি কেন এসেছেন সেটা বলুন।”
” ভাবী বলল সারাদিন নাকি কিছু খাওনি? ড্রামা শুরু করেছো? এমন করলে কিন্তু বাপের বাড়ি নিয়ে রেখে আসবো। চলো আমার সাথে।”
” হাত ছাড়ুন আমার। আমি যাবো না।”
” যাবে না মানে?”
খুব রেগে গেল ফারদিন। মেহেক একটু পিছিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,” আগে বলুন, ওই মেয়েটা কে?”
” কোন মেয়ে?”
” ওইযে, সকালে যে এসেছিল। আটা,ময়দা,সুজি।”
” ও আমার ভার্সিটি ফ্রেন্ড।”
” মিথ্যে কথা। ফ্রেন্ড হলে ওকে আপনি কোলে নিলেন কেন?”
” এজন্য তুমি দরজা বন্ধ করে সারাদিন না খেয়ে আছো? আমি সুজিকে কোলে নিয়েছিলাম বলে?”
মেহেক অপ্রতিভ হয়ে বলল,” না.. মানে হ্যাঁ। আমার খারাপ লেগেছে।”
” আগে ভেবে দেখো তুমি নিজে কি করেছিলে? ওর গাঁয়ে যদি ময়লা পানি না ঢালতে তাহলে আমি ওকে বাড়িতেও আনতাম না আর কোলেও নিতাম না। সব তোমার জন্য হয়েছে। দোষ তোমার।”
” আর সুজির হালুয়ার কোনো দোষ নেই?ও আমার মুখে কফি কেন ঢাললো?”
” এজন্য তুমি এই কাজ করবে?”
” অবশ্যই করবো।”
” এটা খুব বাচ্চামো মেহেক। এসো আমার সাথে।”
” যাবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
” শর্ত মানে?”
” শর্ত মানে কন্ডিশন। আপনি তো আবার ইংরেজি ছাড়া বুঝেন না।”
” কি কন্ডিশন?”
মেহেক লাজুক মুখে বলল,” ওই সুজির হালুয়াকে যেভাবে কোলে নিয়েছিলেন আমাকেও সেভাবে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।”
ফারদিন চোয়াল শক্ত করে কাঠ কাঠ গলায় বলল,” আসার দরকার নেই। তুমি এখানেই থাকো।”
ফারদিন চলে যাচ্ছিল। মেহেক বলল,” আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান।”
ফারদিন স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করল,” যাবে কি-না?”
” আপনি কি চান? আমি দাদুকে গিয়ে বলে দেই যে সকালে ফাঁকা বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছিল আর আপনি তাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে ঢুকেছেন? ”
” হোয়াট?” ফারদিন হতবাক। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” ব্ল্যাকমেইল করছো?”
” যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। কিন্তু অস্বীকার তো করতে পারবেন না। লিয়া সাক্ষী আছে।”
ফারদিনের কান দিয়ে যেনো গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। মেহেক বলল,
” যেটা চাই সেটা তো বললাম। এবার করলে করুন নাহলে আমি গেলাম।”
ফারদিন বাধ্য হয়েই কোলে নিল মেহেককে। মেহেকের আনন্দ আর ধরে না। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিল,” বাহ, মেহেক বাহ! তুই একটা ফার্স্ট ক্লাস চীজ। বিয়ের তৃতীয়দিনই বরের কোলে উঠে গেলি। ভেরি গুড!”
মেহেককে কোলে নিয়ে বিছানা পর্যন্ত এসে ফারদিন যখন তাকে নামাতে নিবে তখন মেহেক তার গলা জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ফারদিন অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বলল ” কি হলো? তাকিয়ে আছো কেন?”
” আপনাকে দেখছি।”
” কেন?”
” আপনি অনেক সুন্দর!”
চলবে