জাহিদের সাথে আমার বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও জাহিদের দিক থেকেই আগ্রহ ছিল বেশী। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুবাদে জাহিদের সাথে পরিচয় ছিল ক্যাম্পাস লাইফের প্রথম দিক থেকেই। ও ছিল আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। ছাত্রাবস্থায় ও খুব আমুদে ধরনের ছিল। ক্যাম্পাসে সারাক্ষণ হুল্লোড় আর আনন্দ করে বেড়াতো ওদের ব্যাচটা আর মধ্যমনি ছিল অবশ্যই জাহিদ। ওর যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লাগতো সেটা হচ্ছে ওর আধুনিক মানসিকতা, নারী জাগরণ বিষয়ক কথাবার্তা। পরিচয়ের প্রথম দিকে ভাবতাম, এই ছেলের জীবনসঙ্গী না জানি কত সুখী হবে। এতো উদার মানসিকতার মানুষতো আজকাল দেখাই যায়না। ও যখন আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় বলতে দ্বিধা নেই আমি টলে গিয়েছিলাম প্রায়ই। কিন্তু বাবা আর বড় ভাইদের শাসনের ভয়ে নিজেই পিছিয়ে এসেছিলাম। জাহিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল আর তাই হাল ছেড়ে না দিয়ে আমার থেকে কথা আদায় করেছিল ও চাকুরী পেয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো পর্যন্ত যেন আমি কোথাও অন্য কাউকে কথা দিয়ে না ফেলি। আগেই বলেছি ওকেও আমার পছন্দ সাথে এরকম ডেডিকেশন কেউ দেখালে কথা না দিয়ে উপায় কি থাকে?
জাহিদ ছিল দারুন মেধাবী। আর তাই নিজের পড়াশোনা গোছানোর সাথে সাথে আমার পড়াশোনাতেও সাহায্য করেছে বেশ অনেকটাই। মাস্টার্স পাস করার সাথে সাথেই একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ওর চাকুরী হয়ে যায়। ওর চাকুরী স্থায়ী হওয়া পর্যন্ত আমিই অপেক্ষা করতে বলি। এই ফাঁকে আমার অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। ওর চাকুরীর বছর না ঘুরতেই ঘটা করে বাসায় প্রস্তাব। যেহেতু আমি রাজীই ছিলাম সাথে বাসার মানুষজনও ওর সম্পর্কে ভাসা ভাসা জানতো কাজেই কোন সমস্যা ছাড়াই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের প্রথম তিন মাস যেন কেটে যায় মুক্ত পাখির মতো।
এ কয়দিন পড়াশোনা, ক্লাস নামকাওয়াস্তে করলেও আনন্দে রাশ টানা জরুরী মনে করে আজ থেকে আবার সিরিয়াস হয়ে যাব বলে ভেবেছি। সকালে জাহিদের সাথে বাসা থেকে বের হবার মুখে জাহিদ হঠাৎ বলে বসে, ‘মাথায় ঘোমটাটা আরেকটু ভালো করে দাও তমা। লোকজন কেমন করে তাকাচ্ছে দেখো। এই পাতলা জামাটা না পরলেও পারতে।’
আমার জানামতে নারী অধিকার সচেতন আধুনিক মানসিকতার জাহিদের মুখে এমনতর কথা শুনে আমি চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেই, ‘ ফুলহাতার এই জামাতো আগেও ভার্সিটিতে পরে গিয়েছি। কই এরকম কিছু তো কেউ বলেনি।’
‘আগের দিন আর এখন কি আর এক? এখন তুমি আমার বৌ। আমি চাইনা কেউ তোমার দিকে অন্যদৃষ্টিতে তাকাক।’
দুজনেরই দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি আর কথা বাড়াইনি।
তবে সেদিন থেকেই বুঝি শুরু হলো আমার জাহিদের চরিত্রের অন্যরূপ দেখা। এই রঙের কাপড় কেন পরলে? ঐ ছেলের সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলার কি আছে? ভার্সিটি থেকে সোজা বাসায় না ফিরে কিসের এতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা? তোমার ঐ সুমন নামের কাজিনটা তোমাকে এতো ঘনঘন ফোন দেয় কেন? সারাদিন ফেসবুকে কি করো? অন্য কোন ছেলের মেসেজ বা কমেন্টের খবরদার রিপ্লাই দেবেনা। তুমি তো জানোনা ছেলেরা কি পরিমাণ খারাপ। সব ফাঁদে ফেলার জন্য ওঁত পেতে থাকে। মাথা শরীর আরেকটু ভালো করে ঢেকেঢুকে চলবে। হিজাব পরতে পারোনা, কত মেয়ে পুরো মুখ ঢেকে রাখে। প্রতিদিন কেন ভার্সিটির ক্লাস করতে হবে? মাস্টার্সে কি এমন ছাতামাথা পড়ায়? বাসায় বসে পড়লেই পারো। তোমাকে তো আর চাকুরী করতে হবেনা আমার রোজগারে তো দিব্যি দুজনের চলে যাবে। এমনকি আমার একা একা বাইরে যাওয়াও তার পছন্দ না।
ভাবছেন ও আমাকে শুধুই শাসন করে? ঠিক তা না। আমাকে দারুন ভালবাসেও পাশাপাশি। অফিস থেকে ফেরার পথে বেলীফুলের মালা নয়তো বকুল ফুলের; আর কোনটা না পেলে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা নয়তো কিছু গোলাপ ওর হাতে থাকবেই। সাথে হয়তো এক ডজন কাঁচের চুড়ি, নয়তো টিপের পাতা, বেতন পাওয়ার দিনে হয়তো কচি কলাপাতা বা লাল টুকটুকে তাঁতের শাড়ি। প্রায়শই প্যাকেট করে নিয়ে আসে ফুচকা, হাওয়ায় মিঠাই, অথবা আমড়ামাখা। জোছনা রাতে বারান্দায় বসে এক কাপ চায়ে দুজনে চুমুক দিয়ে চা খাওয়া কিংবা ভরা বৃষ্টিতে দুজনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখা। কিন্তু ভালবাসার এই বহিঃপ্রকাশটুকু শুধুই ঘটে চার দেয়ালে আমাদের দুকামরার সংসারে। যদি বলি চলো ছাদে যেয়ে বৃষ্টিতে ভিজি অথবা চলো বাইরে গিয়ে ফুচকা খেয়ে আসি তাতে তার ঘোর আপত্তি। লোকে আমায় দেখে ফেলবে বা লোকে বাজে কথা বলবে এ ধরনের হাস্যকর অজুহাত।
ওর এই অকারণ আধিপত্য দেখানো আচরণের সাথে অপরিচিত আমি দিনে দিনে খেই হারিয়ে ফেলতে থাকি। সারাক্ষণ খেয়াল রাখার কারণে ওর ভালবাসাগুলোও আমার কাছে মনে হয় চাপিয়ে দেয়া। সংসারে সুখে থাকার স্বার্থে আমি একটু একটু করে মানিয়ে নেই আর নিজের পৃথিবী গুটিয়ে আনতে থাকি। বাসার কারো কাছেও কিছু বলিনা কারণ জাহিদকে তো আমারও পছন্দ ছিল। তারপর একদিন বুঝি আমার ধৈর্যের বাঁধটুকু ভেঙে যায় যেদিন জাহিদ জানায় আমার চাকুরী করা তার পছন্দ না কাজেই আমি যেন কোথাও চাকুরীর আবেদন না করি। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না এ থেকে মুক্তির কি উপায়? কারণ আমার বাসার সবার সাথেও তার রয়েছে মেয়েজামাই সুলভ দারুন সখ্যতা। ওকে খুশী রাখতে গিয়ে আমি আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। মাস্টার্সের রেজাল্টের কপিটা নিয়ে আমি কান্নায় ভেঙে পরি। এতো ভালো রেজাল্ট আমার অথচ আমার স্বামীর অযাচিত অধিকারবোধের প্রশ্নে আমার এই ফলাফল আর এতোদিনের পরিশ্রম একেবারেই মূল্যহীন।
মানুষ বোধহয় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মরিয়া হয়েই ওঠে। গত দেড় বছরে ওর চাপিয়ে দেয়া বাঁধা নিষেধের পাহাড়ের চাপে আমার নিঃশ্বাস বুঝি আটকে যাচ্ছিল। আমি অবশেষে মুখ খুলি, আমি কাজ করতে চাই বলে পরিস্কারভাবে জানাই জাহিদকে। বেশ ঝটপট এবং পরিস্কার উত্তরও পেয়ে যাই, চাকুরী করলে তার সংসার ছেড়ে দিতে হবে। আমাকে নাকী কোনভাবেই সুখী করা সম্ভব না তার পক্ষে। কারণ আমি একজন অত্যন্ত বহির্মুখী চিন্তাধারার মানুষ। জবাবে কিছু বলতে গিয়েছিলাম, ফিরিয়ে উত্তর এসেছে এক্ষুনি এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে না গেলে আমাকে সে মেরেই ফেলবে। অনেকটা টেনেহিঁচড়ে বের করে দিয়ে দড়াম করে দরজাও লাগিয়ে দেয়। গত দেড় বছরে প্রতিবার আমিই আমার ভুল হয়েছে কি হয়নি বুঝে বা না বুঝে জাহিদের কাছে শুধু মাফই চেয়ে গেছি, আর এরকম কিছু হবেনা বলে। তারই রেশে জাহিদ হয়তো ভেবেছিল আবারো করজোড়ে মাফ চেয়ে আমি ফিরে আসবো তার ঘরে।
……………….
আমার বাবা মা আমাকে সে রাতে ফিরিয়ে দেয়নি। জাহিদ ফিরে এসেছিল কিন্তু নিজের আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আমি আর সে সাহস করতে পারিনি। আমি এখন একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের খুব উঁচুপদে আছি। কাজের পাশাপাশি ব্যস্ত আছি একটা ছিন্নমূল শিশু ও নারীদের কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান নিয়ে। প্রতি শুক্রবারে আমি যখন মেয়ে আর বাচ্চাগুলোর খোঁজ নিতে যাই এক অপরিসীম ভালবাসায় তারা আমার হৃদয় ভরে দেয়।
ওদেরকে জড়িয়ে ধরে আমি শেখাই মানুষকে মানুষের দোষগুণ নিয়েই ভালবাসতে হয়। নিজের অকারণ অধিকারবোধ কারো ওপর চাপিয়ে দিলে তার ফলাফল শুধু একপেশেই হয়, যার সবচেয়ে বড় সাক্ষী যে এই আমি। প্রহসনমূলক অধিকারের চাপে দূর্বল মানুষটাকে মেনে নিতে হয় একাকী জীবন চলা নয়তো ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবিহীন সংসারে ইট কাঠ পাথরের মতো জীবন বয়ে চলা।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস