অদ্ভুত প্রণয় পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
1216

#অদ্ভুত_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩(অন্তিম পর্ব )

আয়াস একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। দ্বিতীয়বারের মতো এটা মুখে নেওয়া। সেই প্রথম আবেগের বশে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এটা নিয়েছিল এরপর আর নেয়নি। কিন্তু আজ থেকে বোধহয় এটাই সঙ্গী। যদি সব কষ্ট ধোয়ার সাথে উড়ে যেত! সে চাঁদবিহীন অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইল। আজ আকাশটারও তার জীবনের মতো অন্ধকারে ঢাকা।

নিশিকে এখনো বলা হয়নি যে সে বিয়ে করে ফেলেছে। আজকে মা ইচ্ছে করেই ডেকে নিয়েছিল। ছোট পরিসরেই হুট্ করে বিয়েটা। আয়াস নিশির কথা ভাবলো। সারাদিন মোবাইলে না পেয়ে মেয়েটা বোধহয় চিন্তা করছে। ইচ্ছে করেই মোবাইলটা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে অন করলো। অন করার সাথে সাথে নিশির কল ঢুকলো। আয়াস মলিন শ্বাস ফেললো। তার মানে নিশি মোবাইল নিয়েই বসে ছিল। সে নিজেকে যথা সম্ভব প্রস্তুত করে কল রিসিভ করলো।

‘আয়াস, সারাদিন মোবাইল বন্ধ কেন ছিল?তুমি ঠিক আছো তো? কী হয়েছে?’

‘নিশি ‘ আয়াসের শান্ত কণ্ঠ শুনে নিশির কথার আওয়াজ কমে গেল।

‘সব ঠিক আছে তো আয়াস? আর তুমি? আমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে তুমি ঠিক নেই।’

আয়াস বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল। তার কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু বলতে না চাইলেও বলতে হবে। আজ থেকে তাঁদের মধ্যে অনেক দুরুত্ব।

‘নিশি আমি বিয়ে করে ফেলেছি।’ এক নিঃশ্বাসে চোখ বন্ধ করে আয়াস কথাটা বলে ফেলল।
কথাটা বলার পরে বিপরীত দিক থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে আয়াস চুপ করে রইল।

নিশি থম মেরে রয়েছে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সে সহ্য করতে না পেরে মোবাইল কেটে দিল।

আয়াস বার দুয়েক আবারো কল লাগালো কিন্তু নিশি কল ধরলো না। আয়াস জানে এখন মেয়েটা কান্না করছে হয়ত কিন্তু নিশি ভীষণ সহ্যক্ষমতাশীল মেয়ে। সে ঠিকই সহ্য করে আবারো কল ব্যাক করবে। সে নিজের নরম খোলসটা কাউকে দেখায় না।

আয়াস ঐভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। রাত বাড়ছে আর তার মনের ভেতর র’ক্ত’ক্ষরণ হচ্ছে। তখনই ফোনে নিশির নাম্বার থেকে কল আসতেই আয়াস তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো।

‘আয়াস, তুমি মজা করোনি তো?’ বেশ শান্ত স্বরে কথাটা বললো নিশি। নিশির এমন শান্ত স্বর শুনে আয়াসের খারাপ লাগলেও দেখালো না।

‘না, মজা হলে তো ভালোই হতো।’

‘ওহ!’

‘মেয়েটি কেমন? সুন্দর? আন্টির পছন্দ বলে কথা। ভাগ্যবতী মেয়ে!’

আয়াসের নিশ্চুপতা দেখে নিশি হাসলো।

‘ মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ো না। তার তো কোনো দোষ নেই। এখন আমার আর কোনো অধিকার নেই কিন্তু সেই মেয়েটির আছে। আমাকে আর মনে করিয়ো না। আজ থেকে আমাদের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দুরুত্ব! তাই না?’

‘নিশি তোমার কথাগুলো শুনে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।’ বলতে চেয়েও বললো না। কারণ আয়াস কথাগুলো বললে নিশি নিজেকে যা শক্ত করেছে তাও করতে পারবে না।

‘নিশি, তোমাকে কীভাবে ভুলি?’

‘হাহ! ভুলে যাবে। দেখো অভ্যাস হয়ে যাবে।’ বলতে বলতেই নিশির গলা কেঁপে উঠলো।

আয়াস বুঝতে পারলো মেয়েটা নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। বোধহয় মুখ চেপে কান্না করছে।

‘নিশি!’

‘আয়াস, ফোন রেখে দিও। আর দুইটা মিনিট সময় নিবো। আজকের পরে থেকে আর কল দিবো না। তোমার বউ হয়ত কষ্ট পাবে। পাবেই বা না কেন! বাসর রাত নিয়ে সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে, হোক না আশা ছাড়া বিয়ে! বাসর রাতে তার স্বামী প্রাক্তনের সাথে কথা বলছে। এটা কেই বা সহ্য করবে! আমি হলে তো ভুলেও করতাম না।’

শেষের কথাগুলো বলে নিশি চুপ হয়ে গেল। আয়াস শান্তভাবে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ করলেই নিশির কান্নাভেজা মুখ চেপে ধরে কান্না করার মুহূর্তটা ভেসে উঠছে।

‘আচ্ছা, শোনো আয়াস। আমি না বাইরে পড়তে যাবো। খুব তাড়াতাড়ি যাবো। আমাদের হয়ত আর দেখা হবে না। অবিশ্বাস্য না? আমাদের শেষ দেখাটাতেও ভাবিনি যে ঐটাই ঐভাবে আমাদের শেষ দেখা। হাহা।’

আয়াস নিশ্চুপ হয়ে রইল। নিশির একেকটা কথা তার ভেতরে তীরের মতো বিধছে।

‘আয়াস, কাল একটা উপহার পাঠাবো। রাখিও। আর মনে করে মেয়েটিকে আপন করে নিয়ো। আমি জানি মেয়েটা তোমার কাছে অনেক সুখে থাকবে। ভালো থেকো। রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

আয়াসকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিশি কল কেটে দিল। আয়াস আরেকবার কল দিতেই মোবাইল বন্ধ পেল। সে জানে এখন মেয়েটা কান্না করবে। আর দেশের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তার বিয়ের কথা শুনেই নিয়েছে। নাহয় মেয়েটা এখানে থাকলে এসব সহ্য করতে পারবে না। আয়াস এতদিনে ভালো করেই চিনে নিয়েছে নিশিকে। এতকিছুর পরেও কত শান্ত থাকার চেষ্টা করে গেল মেয়েটা! নিজের উপরেই সব চালিয়ে নিবে।

‘আপনি ঘুমাবেন না?’ পেছনে থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসতেই আয়াসের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেল। সে রেগে গেল। ‘ভুলেও বউ বউ ভাব ধরতে আসবে না, আমার কাছে তুমি কোনোদিন সেই স্থান পাবে না, মায়ের কথায় অনিচ্ছাকৃত তোমাকে বিয়ে করা।’ বলতে চেয়েও সেই কথা আবার গিলে ফেলল। নিশির কথাগুলো ভাবনায় এসেছে, আসলেই মেয়েটির তো কোনো দোষ নেই। মেনে নিতে না পারুক, ভালো ব্যবহার না করুক কিন্তু খারাপ ব্যবহার করাও উচিত না।

‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি এখানে ব্যালকনিতে ঘুমাবো।’

‘কিন্তু এখানে…’ বলতে গিয়ে আয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।

পরেরদিন দারোয়ান আয়াসের কাছে একটি বক্স নিয়ে হাজির হলো। আয়াস বক্সটির উপরের নাম দেখেই তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলো কিন্তু নিশিকে আর পেল না। নিশির গাড়ি রাস্তার শেষে এক টুকরো হাওয়ার মতো করে দেখা গেল।

নিশি পেছনে দিয়ে আয়াসকে দেখেছে। গভীর থেকে একটা বড়ো শ্বাস ফেলল। এই পরিচিত রাস্তাটা দিয়ে হয়ত আর আসা হবে না। সে আয়াসের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,’আমাদের আর দেখা না হোক।’ নিশি গাড়ির কাঁচ ভেদ করে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। আর আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠলো,’হয়ত বহুবছর পরে স্মৃতির টানে দেশে ফিরে আসবো। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে না পেরে তোমাকে লুকিয়ে দেখতে আসবো। হয়ত আড়াল থেকেই কোনো এক সন্ধ্যায় দেখা হয়ে যাবে কিন্তু কথা হবে না। বহু বারণ থাকবে। একই পথ দিয়ে চলেও গন্তব্য ভিন্ন হবে। হয়ত ঐ গানটির মতোই হবে। হঠাৎ সন্ধ্যে দেখা হবে কিন্তু মাঝখানে থাকবে অনেক বারণ!’

আয়াস রুমে এসে বক্সটি খুলতেই দেখলো দুইটা যুগল ঘড়ি। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ের। একই ডিজাইনের। আয়াস ঘড়ি দুটোতে হাত বুলিয়ে দিল। নিশি নিশ্চই তার আর নিজের জন্যই এই ঘড়িগুলো নিয়েছিল! ঘড়ির উপরে খুব যত্নসহকারে একটা চিরকুট লেখা।

‘নতুন দম্পতির জন্য শুভকামনা। ভালো থেকো। সুখে থেকো। আমি চলে যাচ্ছি। দোয়া করো আমার জন্য।’

‘আমি চলে যাচ্ছি’ লেখাটা আয়াস বার তিনেক পড়লো। তার ভেতরে ভেতরে র’ক্ত’ক্ষ’রণে ছেয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না সে। আয়াস মোবাইল হাতে নিয়ে নিশির নাম্বারে কল করতেই নাম্বার বন্ধ পেল। সে ঘড়ি দুইটা আর চিঠিটা পড়ে দূরের ঐ আকাশের দিকে তাকালো। একই আকাশের নিচে হয়েও একদিনের ব্যাবধানে কত দুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে! যে দুরুত্বটা আর কমবার নয়! তার জীবনের মোড় এভাবে ঘুরে না গেলেও পারতো!

#সমাপ্ত
(গল্পটি মূলত আশেপাশে বাস্তবতা সাপেক্ষে। অনেকে বলছেন না? এরকমও হয়? অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য যে হ্যাঁ এরকম অহরহ আছে। আমার নিজের চোখে দেখা। এটা সামান্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টামাত্র। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে