অদ্ভুত প্রণয় পর্ব-০১

0
1694

#অদ্ভুত_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১

-‘মা, আমি ঐ হাঁটুর বয়সী মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবো না।’

‘কেন?’

‘তুমি কী সত্যিই না জানার ভান করছো?ওকে বিয়ে করলে ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।’

ছেলের মুখশ্রী থেকে আগের ন্যায় উত্তর শুনে আমেনা রহমান বরাবরের মতো হতাশ হলেন।
‘ওই মেয়েকে বিয়ে করলে তোর ক্ষতি কী বাপ্! আর জীবন নষ্ট ক্যান হবে? তুই আমার রত্ন।’

-‘ মা, তুমি কী আসলেই বুঝতেছো না না-কি না বুঝার ভান করছো? তোমাকে আর কতবার বুঝাবো! একটা অনাথ ছোট মেয়েকে আমি আমার বউ মানতে পারব না। আর তার চেয়ে বড়ো কথা আমি অন্য আরেকজনকে ভালোবাসি সেটা তুমি জানো।’

-‘আমি এতো কিছু বুঝি না। তোর বিয়ে ওর সাথেই হবে।ওই মেয়েটা তো অনাথ ছিল না!’বলতে বলতেই আমেনা বেগম অন্যমনস্ক হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘তোর জন্য ওই মেয়েটাকেই পছন্দ করেছি বাপ্ আর তোর বউ সেই মেয়েই হবে।’

আয়াস হতাশ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না, মেয়েটাকে নিজের জীবন থেকে এতো তাড়াতাড়ি বঞ্চিত করতে! সে এটাও জানে, এই মুহূর্তে মায়ের সাথে আর বাড়তি কথা বলতে গেলেই মা কান্না করে দিবে। তাই সকালেই শান্ত মাথায় বুঝাবে ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিলেই আমেনা রহমানের কথায় থেমে যায়।

‘আমি কাল গ্রামে যাবো মেয়েটাকে দেখতে, সাথে তুই সহ যাবি।’

মায়ের কথায় আয়াস ফিরে তাকালো।
-‘মা, এইবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি এমনটা করতে পারো না আর আমার ইচ্ছেকেও তো প্রাধান্য দেওয়া উচিত তোমার। নিশিকে আমি ভালোবাসি মা। তুমি শুধু শুধু পাগলামি করছো। মাঝখানে ওই ছোট্ট মেয়েটার জীবন বরবাদ করছো।’

ছেলের কথা শুনে আমেনা রহমান মুখের উপর শাড়ির আঁচল টেনে কান্নার ভান করে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে বলে উঠল,
-‘আর আমার কথা? তুই এখনো ওই মেয়েটার মধ্যে পড়ে আছিস? শহরের এসব মেয়ের মধ্যে ভালো বউ হওয়ার কোনো গুন নেই। মায়ের মূল্য তোর কাছে এতো তাড়াতাড়ি শেষ! আমি যে সেই ছোট্টবেলা থেকে তোরে কোলে-পিঠে করে কষ্ট করে আজ এতদূর এগিয়ে এনেছি! সেই মায়ের মূল্য তোর কাছে নাই বাপ্!’

আয়াস মলিন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে এক ফলক তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘তোমার যা ইচ্ছে তাই করো কিন্তু আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমি যাও কালাম চাচাকে নিয়ে।” বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আমেনা রহমান শাড়ির আঁচল মুখ থেকে ফেলে দিলেন। অবশেষে তার প্ল্যান সফল হলো। ছেলেকে কোনোমতেই রাজি করানোর দরকার। তার ওই মেয়েটাকে পছন্দ না,শুধুমাত্র এই কারণেই এই পন্থাটা অবলম্বন করেছে। মেয়েটার মধ্যে শালীনতার কিছুই নেই। শাড়িও পড়তে জানে না। রান্না-বান্না কিছুই পারে না, সেই মেয়েকে তার এই আদরের একমাত্র ছেলেটার বউ করে কেন আনবে! এই শহরে আসার পর একটা মেয়েও আমেনা রহমানের মন মতো মনে হয়নি তাই গ্রামের মেয়েই আনবে। তাই তো তার ছোটবেলার বান্ধবীকে কথা দিয়েছিলো। তার শেষ কথা যে রাখতে হবে! মা বাপ্ ম’রা মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখতে পারলে তারই শান্তি। তাতেও তার ছেলের বাধা! যাক, অন্ততঃ তার আশাটা পূর্ণ হতে যাচ্ছে ভেবেই আমেনা রহমান বিজয়ের হাসি দিলেন।

———

আয়াস রুমে ঢুকেই আগে ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। এই মুহূর্তে একটা লম্বা শাওয়ার না নিলেই নয়! সব চিন্তা একসাথে এসে ভর করেছে! এক গোলক ধাঁধায় বন্দী পড়ে গেছে।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে লেপটপ নিয়ে বসতেই পাশে রাখা মোবাইলটা তীব্র শব্দে বেজে উঠল। মোবাইল হাতে নিয়েই দেখলো স্ক্রিনে ‘নিশির’ নামটা গুটি গুটি অক্ষরে ভেসে উঠেছে।

আয়াস কল না ধরে মোবাইল আবার একই জায়গায় রেখে দিতে গিয়ে কী বুঝে আবার রিসিভ করলো। শুধু শুধু মেয়েটাকে চিন্তায় ফেলে লাভ নেই।

‘হ্যালো’

‘আয়াস, তুমি অফিস থেকে এসেছো? আন্টির কী খবর? উনি কী আজ আর বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলেছে?’
আয়াস কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে নিশির একের পর এক বাক্য ভেসে আসলো।

আয়াস নিশির শেষের কথাটার উত্তর ইচ্ছাকৃত ভাবেই মিথ্যে বলল। সে জানে, এখন যদি নিশিকে মায়ের কথাটা বলে তাহলে মেয়েটা রাতের খাবার খাবে না আর মেয়েটার মন নিমিষে খারাপ হয়ে যাবে। এমনিতেও কতগুলো দিন ঘুরে মেয়েটা তাকে পেয়েছে! আয়াস যথা-সম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

‘না, কিছু বলেনি।’

আয়াসের কথায় নিশি উৎফুল্ল হয়ে উঠল তা সে এই পাশ থেকেই বুঝলো।
-‘ওহ, জানো আয়াস! আমি মা-বাবাকে বলেছি, মা বাবা বলেছেন, তোমার মা প্রস্তাব নিয়ে আসলে রাজি হয়ে যাবেন আর তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন আরেকবার।’

আয়াসের নিশির এমন উৎফুল্লতা দেখে খারাপ লাগলো। সে অনিচ্ছাকৃতভাবেই ফোন রাখার তড়িঘড়ি করলো।

‘নিশি, আমার মাথা-ব্যথা করছে। একটু ঘুমাবো।’

নিশির উৎফুল্লতা হঠাৎ থেমে গেল, সে মলিন কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘কী বলো! মেডিসিন নিয়েছো?’

-‘মেডিসিন লাগবে না, ঘুমালেই চলবে।’

নিশি একটু মন খারাপ করে জবাব দিল,
-‘আচ্ছা, তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে উঠে জানাইয়ো।’

-‘হ্যাঁ, নিজের খেয়াল রাখিও।’ বলেই আয়াস কল কেটে দিল। সে খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল। মাথাটা ব্যথা করছে ভীষণ। কেন জানি হঠাৎ করে বড্ড খারাপ লাগছে। এই মুহূর্তে এক মগ কফি হলে মন্দ হয় না কিন্তু খাট ছেড়ে মোটেও উঠতে ইচ্ছে করছে না।
সে আবারও লেপটপের দিকে চোখ দিল কিন্তু দুই চোখে ক্লান্তি এসে ভর করেছে যেন। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল তৈরী করা উচিত কিন্তু চাইলেও লেপটপের দিকে আর দৃষ্টি দিতে পারলো না। অন্যদিন এক বসাতে একসাথে অনেক কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে পারতো অথচ আজ! আয়াস লেপটপ বন্ধ করে খাটের এক কিনারায় রেখে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। শোবার পরেও কোনোরকম শান্তি অনুভব হলো না। সে কাকে বেছে নিবে বুঝতে পারছে না। নিঃসন্দেহে মাকেই বেছে নিতে হবে কারণ এই মা ছাড়া পৃথিবীতে তার আপন থেকেও নেই। এই মা’ই তাকে ছোটবেলা থেকে এতো কষ্ট করে বাবার অনুপস্থিতিতে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে কিন্তু নিশিকে সে কিভাবে কথাটা বলবে, ভাবতে পারছে না! নিশিকেও সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার চেয়ে বড়ো কথা নিশি কীভাবে নিবে! অনেকগুলো মাস পেছনে ঘুরে আয়াসকে পেয়েছে। যেদিন আয়াস সম্মতি দিয়েছিল সেদিন মেয়েটির উৎফুল্লতায় আয়াসও হেসে দিয়েছিল। মেয়েটি যে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে! এই পৃথিবীতে আয়াসকে মায়ের পরে যদি আর কাওকে বেছে নিতে বলে তাহলে নিঃসন্দেহে আয়াস নিশিকেই বেছে নিবে। মানে আয়াসের মনে মায়ের পরের দ্বিতীয় স্থান নিশির। কিন্তু এখন তার মাথা কাজ করছে না। পৃথিবীর সবচেয়ে পছন্দের দুইজন থেকেই বেছে নেওয়া! এমতাবস্তায় আয়াসের কার্য কী সে বুঝতে পারছে না! হয়ত যে কেউ বলবে, মাকেই বেছে নিতে কিন্তু নিশি! নিশিও তো অনেক আগে থেকেই আয়াসকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে আসছে। তাকে কিভাবে ধোঁকা দিবে আয়াস! আর তার চেয়ে বড়ো কথা, নিজের মনকে কীভাবে বুঝাবে আয়াস! একদিকে মা আর অপরদিকে নিশি। তার সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসার দুইজন মানুষ! নিশি জানে, তাকে আয়াসের মা পছন্দ করে না কিন্তু তবুও সে অনেকভাবে আমেনা রহমানের মন জয় করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে আমেনা রহমানের অপছন্দের লিস্টেই রয়ে গিয়েছে তবুও। আয়াস ভাবতে পারে না, মা কেন নিশিকে পছন্দ করে না। নিঃসন্দেহে নিশিও সবদিক দিয়ে পারফেক্ট একটা মেয়ে। হয়ত অতি আদরের ধনির দুলালী তাই মায়ের একটা সন্দেহ থেকেই যায়! গ্রামের মানুষ তাই হয়ত! আমেনা রহমানের ভাষ্যমতে, শহরের মেয়েরা ভালো বউ হওয়ার যোগ্য নয় কিন্তু গ্রামের মেয়েরা সেইদিক দিয়ে পারফেক্ট, তারা সবকিছুই পারে কিন্তু আয়াস তার মা’কে এটা কিছুতেই বুঝে উঠাতে পারে না যে -সব মেয়ে এক নয়! গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন কোনো ভেদাভেদ নেই। মা আর নিশির মধ্যেই যেকোনো একজন। মাকে সে কিছুতেই ছাড়তে পারবে না আর নিশি! নিশিকেও তো সে মায়ের পরেই ভালোবাসে। আর নিশিও তো আয়াসকে ভালোবাসে। মেয়েটা কীভাবে থাকবে!

#চলবে কী?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে