#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- চার।
লেখা: সিহাব হোসেন।
আরিশার বাবা আফজাল হোসেন শুধু একজন বড় পাইকারি ব্যবসায়ীই নন, বাজারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও বটে। কাঁচামালের বড় আড়তের পাশাপাশি তিনি একটি সমিতি চালান, যা তার অবৈধ সুদের ব্যবসার একটি মোক্ষম আবরণ। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সমিতির নামে টাকা সংগ্রহ করে বছর শেষে সামান্য কিছু লভ্যাংশ দেন, আর সেই জমানো মূলধনটাই তিনি চড়া সুদে খাটান। টাকা দেওয়ার আগে বন্ধক হিসেবে রাখেন সোনাদানা বা জমির দলিল। কয়েক সপ্তাহ দিতে দেরি হলেই শুরু হয় তার আসল রূপের প্রকাশ; তখন বন্ধকি সোনা বা জমি, কোনোটিই আর ফেরত পাওয়ার উপায় থাকে না। এভাবেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
আজ তেমনই এক লোক তার বন্ধকি গয়না ফেরত নিতে এসেছেন। সব টাকা পরিশোধ করে তিনি যখন গয়না চাইলেন, আফজাল সাহেব অবজ্ঞার সুরে বললেন,
– “তোমাকে তো আর এসব ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বাপু। কারণ তোমার ডেট ওভার হয়ে গেছে।”
– “এসব কী বলছেন মিয়া ভাই! মাত্র চার সপ্তাহ লাভের টাকা দিতে পারিনি, আর তার জন্য আপনি আমার পুরো গয়নাটাই রেখে দেবেন?”
“তুমি জানো না? আমার এখানে চার সপ্তাহ পার হয়ে গেলে আমি আর কোনো মাল ফেরত দিই না।”
– “আমার দেড় লাখ টাকার জিনিসের বদলে আপনি মাত্র বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। চার সপ্তাহের সুদসহ আপনার মোট পাওনা হয় বত্রিশ হাজার টাকা। আপনি এই টাকাটা রেখে বাকিটা আমাকে দিয়ে দিন, ভাই।”
লোকটির অনুনয়ে আফজাল হোসেনের মেজাজ বি*গড়ে গেল। তিনি বসা থেকে হুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
– “সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে! কিসের টাকা পাবি তুই? তোকে আগেই বলেছিলাম, চার সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে না পারলে বন্ধকি জিনিস পুরোটাই আমার। তুই তো স্ট্যাম্পে সইও করেছিলি, ভুলে গেছিস?”
লোকটি আর কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি জানেন, পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো লাভ হবে না, কারণ শহরের প্রভাবশালী মহলে আফজাল হোসেনের ভালোই জানাশোনা। তাই তিনি অসহায়ভাবে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললেন,
– “আল্লাহ, তুমিই এই জু*লুমের বিচার একদিন করবে।”
আফজাল সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। মনে মনে বললেন, ‘আমি তো হজ করে এসেছি, আমার কিছুই হবে না। যদি কিছু হওয়ার থাকত, তাহলে তো কবেই হতো! কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, আমার সম্পদ তো শুধু বাড়ছেই। এর আগেও তো কত লোক কত অভিশাপ দিল, কই, কিছুই তো হলো না।’
ঠিক এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। দরজা খুলে তিনি দেখলেন, এলাকার কিছু যুবকসহ মসজিদ কমিটির একজন মুরুব্বি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিনীতভাবে বললেন,
– “ভাইসাব, আমরা মসজিদের জন্য একটা বার্ষিক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছি। আপনি যদি আমাদের সাথে শরিক হতেন, তাহলে খুব ভালো হতো।”
– “কেন নয়, কেন নয়! আপনারা ভেতরে আসুন, আমি দিচ্ছি।”
এরপর তিনি ঘরের ভেতর থেকে কড়কড়ে দশটি এক হাজার টাকার নোট এনে তাদের হাতে তুলে দিলেন। লোকটি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
– “আপনি এভাবেই আল্লাহর রাস্তায় দান করেন বলেই তো দিন দিন আপনার সম্পদে এত বরকত। আল্লাহ আপনার সম্পদে আরও বরকত দান করুন।”
ওদিকে, সায়ন এখন তার অনলাইন কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে। তাদের পারিবারিক ব্যবসার অবস্থাও দিন দিন ভালো হচ্ছে। একদিন রাবেয়া বেগম আফসোসের সুরে বললেন,
– “কী দরকার ছিল মেয়েটাকে রিফাতের সাথে বিয়ে দেওয়ার? যদি না দিতিস, তাহলে এতদিনে তোরও একটা বিয়ে হয়ে যেত।”
– “বিয়ের পর তাহলে ওর এখানে থেকে পরকীয়া করাটা আরও সহজ হতো, তাই না?”
রাবেয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
– “পরকীয়া? সেটা আবার কী জিনিস?”
মায়ের সরল প্রশ্নে সায়ন মনে মনে হাসল। ভাবল, তার মায়ের প্রজন্মটা কতই না ভালো ছিল! এখনকার সমাজের এই ভাইরাসের কথা তখনকার বেশিরভাগ মানুষই জানত না। যা এখন ডালভাতের মতো সহজ, সেই সময়ে তা ছিল কল্পনাতীত।
– “কী হলো, বলছিস না কেন?”
সায়ন হাসতে হাসতে বলল,
– “এর মানে হলো, পরের বউয়ের উপকার করা।”
– “কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলিস!”
– “থাক বাদ দাও তো আম্মু, এসব তুমি বুঝবে না। এটা এই প্রজন্মের একটা বড় ভাইরাসের নাম, যা আমাদের সমাজটাকে ভেতর থেকে একেবারে দূষিত করে দিচ্ছে। কত সংসার যে এর জন্য শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাবা-মা বেঁচে থেকেও সন্তানরা তাদের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে!”
– “হুম, বুঝতে পেরেছি।”
রাবেয়া বেগমের কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ। সায়ন বলতে লাগল,
– “তিশা মেয়ে হিসেবে হয়তো ভালো, কিন্তু ওর মধ্যে এখনো যথেষ্ট পরিপক্বতা আসেনি। ও রিফাতকে ভালোবাসত, তাই আমার সাথে বিয়ে হলে কখনো মন থেকে মানতে পারত না। আর এখন তো ভার্চুয়ালের যুগ, প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ করাটা কোনো ব্যাপারই না। তার সাথে কথা বলতে থাকলে আমাকে ও জীবনেও ভালোবাসতে পারত না। তুমি হয়তো বলবে, ফোন ব্যবহার করতে দিতাম না। কিন্তু তাতে ঝামেলা আরও বাড়ত, শেষে দিতে বাধ্যই হতাম। তোমাদের সময়, নানি-দাদির সময়ে তাদের যেখানে বিয়ে দেওয়া হতো, তারা ভাগ্যকে মেনে নিত। ধৈর্য ধরত, আর সে কারণেই স্বামীর সাথে অনায়াসে সুখী হতে পারত। কিন্তু এখনকার মেয়েরা প্রেমিকের সাথে বিয়ে না হলে দোষ দেয় তার স্বামীর। মনে করে, স্বামীর কারণেই সে তার প্রেমিককে হারিয়েছে। ধৈর্য কম, তাই না সে নিজে সুখী হতে পারে, আর না তার স্বামীকে সুখী করতে পারে।”
ছেলের কথাগুলো রাবেয়া বেগমকে গভীরভাবে নাড়া দিল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– “তুই ঠিকই বলেছিস বাবা। আমি এতটা গভীরে গিয়ে ভেবে দেখিনি। সময় যে কতটা বদলে গেছে, তা আমার মাথায়ই আসেনি। এই সাধারণ জিনিসটা হয়তো আমাদের মতো অনেক মায়ের মাথায় আসে না, আর তাই আমরা না বুঝেই সন্তানদের ভুল পথে ঠেলে দিই।”
– “হুম।”
সায়ন কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কথা গুলো বলল।
সকাল থেকেই আকাশটা কালো হয়ে আছে। মেঘে ঢাকা আকাশে সূর্যের দেখা নেই, তার বদলে বইছে একরাশ ঠান্ডা বাতাস। এমন দিনে কলেজের পেছনের পুকুরপাড়ে লিমার পাশে বসে আছে সায়ন। কিন্তু এই মনোরম পরিবেশেও তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর পায়ের পাতায় অনুভূত হচ্ছে এক অদ্ভুত কাঁপুনি। সে প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু তার ছটফটানি লিমার চোখ এড়াল না। লিমা তার এই অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলল,
– “তোমার সমস্যাটা কী, বলো তো? সেই প্রথম দিন থেকেই দেখছি, তুমি আমাকে দেখলেই থরথর করে কাঁপো। এর কারণটা কী, বলবে?”
– “তা তো আমি নিজেও জানি না।”
– “আজব ব্যাপার তো! যখন তুমি একা আমার পাশে থাকো, ঠিক তখনই এমন করো। অথচ অন্য সময় তো বেশ স্বাভাবিকই দেখি।”
– “যখন তোমায় নিয়ে ভাবি, তখন পা কাঁপে।” কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল সায়নের।
লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কী ভাবো শুনি?”
এই প্রশ্নে সায়ন আরও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “তুমি একটু বসো, আমি আসছি।”
– “কোথায় যাবে?”
– “এসে বলছি।”
বলেই সায়ন দ্রুত পায়ে পাবলিক টয়লেটের দিকে দৌড়াতে লাগল। লিমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে সে কেন ওদিকে যাচ্ছে। তার এই ছেলেমানুষি কাণ্ডে লিমা আপনমনেই হেসে ফেলল।
একটু পর যখন সায়ন ফিরে এল, তার চেহারায় তখন রাজ্যের প্রশান্তি। সে ধীর পায়ে এসে লিমার পাশে বসল। লিমা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করল,
– “বাথরুমে গিয়েছিলে?”
– “হুম। বুঝতে পারি না, তোমার সামনে এলেই আমার পেটে এমন কামড় দেয় কেন! অবস্থা এতটাই বেগতিক হয় যে, বাথরুমে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাই না।”
– “গায়ে হলুদের রাতেও তাহলে এই কারণেই পালিয়েছিলে, তাই তো?”
– “হুম। তুমি তো সায়েন্স নিয়ে পড়েছ, তো এই বিষয়ে তোমার বিজ্ঞান কী বলে?”
– “ইন্টারে কমার্স নিয়েছিলাম, তাই ঠিক বলতে পারছি না।”
এই বলে লিমা খিলখিল করে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দে পুকুরপাড়ের শান্ত পরিবেশটা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। সায়ন মুগ্ধ হয়ে তার হাসি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর সে জিজ্ঞেস করল,
– “আচ্ছা, তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?”
লিমা একটু ভেবে বলল,
– “উমম… একদম না। “আমি চাই আমার জীবনে এমন একজন আসুক, যে আমার মতোই একটু অন্যরকম হবে। যে আমি ছাড়া আর অন্য কারো দিকে তাকাবে না। আর… আমাকে একটু ভয়ও পাবে।”
– “আমি তো জানতাম, তোমার মতো মেয়েরা, যারা সহজে ছেলেদের পাত্তা দেয় না, তারা অনেক বেশি অ্যাটিটিউডওয়ালা ছেলে পছন্দ করে। লোকে বলে, তোমরা সুন্দর বলে তোমাদের অহংকারও নাকি অনেক বেশি।”
– “অনেকে হয়তো তাই, কিন্তু আমি তো বললামই, আমি সবার থেকে আলাদা। আমার একজন নরম মনের মানুষ দরকার, যে আমাকে খুব খুব ভালোবাসবে। আচ্ছা, চলো তো, অনেক গল্প হলো। এবার একটু হাঁটা যাক।”
– “চলো।”
তারা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই ঝুম করে বৃষ্টি নামল। দৌড়ে গিয়ে তারা কাছের একটা কফিশপে আশ্রয় নিল। সায়ন দুটি কফির অর্ডার করল। লিমা জানালার কাঁচের ওপর গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আনমনে দেখছিল। আর সায়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল লিমাকে। বৃষ্টিভেজা বিকেলের আলো-আঁধারিতে লিমাকে যেন আরও মায়াবী লাগছিল।
এমন সময় সায়ন পকেট থেকে সযত্নে রাখা একগোছা বেলি ফুলের মালা বের করে লিমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। লিমা চমকে উঠল। তার প্রিয় ফুল বেলি, কিন্তু সায়ন এটা কীভাবে জানল? তার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সায়নের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি, যা তার ভেতরের সব না বলা কথাগুলো যেন এক মুহূর্তেই প্রকাশ করে দিল।
চলবে….!