#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- তিন।
লেখা: সিহাব হোসেন।
গভীর রাত। গায়ে হলুদের কোলাহল কমে এলেও খাওয়ার আয়োজন তখনো চলছে। সায়ন একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কেউ তাকে খাওয়ার কথা বলছে না। অথচ তার অন্য কাজিনদের কী ভীষণ খাতিরযত্ন করে খাওয়ানো হচ্ছে! এই নির্লজ্জ অবহেলা তার আত্মসম্মানে বড় বেশি আ*ঘা*ত করল। সে সেখান থেকে উঠে স্টেজের কাছে এসে দাঁড়াল। লিমা তখনো সেখানেই বসে ছিল। হঠাৎ সায়নের মেজো খালা লিমাকে কী একটা কাজে ডেকে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় লিমা সায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “খেয়েছ তুমি?”
– “না।”
– “তাহলে চলে এসো, একসাথে খাই।”
তাদের কথা কানে যেতেই আরিশার বড় বোন আফসানা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল,
– “তুমি গিয়ে খেয়ে নাও তো। ওর সময় হলে ও নিজেই খেয়ে নেবে।”
লিমা আর কথা বাড়াল না। সায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত বাজে পৌনে দশটা। প্রায় সবারই খাওয়া শেষ, শুধু তার সময় হয়নি। এত অবহেলা আর সহ্য করা যায় না। সে নিঃশব্দে অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। কাছেই দাদির বাড়ি। সেখানে গিয়েই রাতের খাবারটা সারল এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এই অপমান সহ্য করে আর ওদের কোনো অনুষ্ঠানে সে যাবে না।
পরদিন সকালে রাবেয়া বেগম যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বললেন, সায়ন মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিল,
– “আমি যাব না।”
ছেলের কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চোখের ভাষা দেখেই রাবেয়া বেগম বুঝে গিয়েছিলেন গত রাতের ঘটনা। তাই তিনি আর জোর করলেন না। সায়ন ঠিক করল, আজকের দিনটা সে নিজের মতো করে কাটাবে।
ওদিকে বিয়ের বাড়িতে তখন সাজসাজ রব। লিমা কনের ঘরে আরিশাকে সাজিয়ে দিচ্ছিল। রুমে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই সুযোগে লিমা বলল,
– “তুই সায়ন সম্পর্কে আমাকে যা যা বলেছিস, তার একটাও তো সত্যি না। ওকে দেখে তো কোনোভাবেই টোকাই মনে হয় না। সে তো তোরই খালাতো ভাই, তার সম্পর্কে এমন নিচু কথা বলা কি তোর ঠিক হয়েছে?”
– “এছাড়া আর কী বলব?” আরিশার নির্লিপ্ত জবাব।
– “মানুষকে এভাবে ছোট করা একদমই ঠিক না। কাল রাতে আমি সবটাই দেখেছি, তোরা ওদের কতটা অবহেলা করিস। মনে রাখিস, মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির হতে পারে। আবার কালকের ফকির পরশু রাজা হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ কখন কার ভাগ্য কীভাবে ঘুরিয়ে দেন, তা কেউ জানে না।”
– “একটা কথা জানিস? এই দুনিয়ায় যার টাকা নেই, তার কোনো দামও নেই। ওদের সাহস কত বড়, আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়! কী যোগ্যতা আছে ওর? না আছে লেখাপড়া, না আছে ঠিকমতো আয় করে খাওয়ানোর মুরোদ। আর নাহিদকে দেখ, ও যা আয় করে, সায়ন তা দশ বছরেও করতে পারবে না।”
– “ঘুষ খায় না তো আবার?”
কথাটা শুনেই আরিশা দাঁত কটমট করে লিমার দিকে তাকাল। লিমা পরিস্থিতি হালকা করতে হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল।
লিমা সেদিন পুরো অনুষ্ঠানে সায়নকে খুঁজেছিল, কিন্তু কোথাও তাকে পায়নি। তাই আরিশার কাছে তার ফোন নম্বর চাইল, কিন্তু সে দিল না। বাধ্য হয়ে সে তৌহিদের কাছে গেল।
– “আমি সায়নের বন্ধু। ওর নম্বরটা কি পাওয়া যাবে?”
তৌহিদ নম্বরটা দিতেই লিমা ফোন করল। না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সায়ন বলল,
– “এত অবহেলা আর সহ্য করা যায় না। তবে আজকের পর থেকে যে আমার সাথে যেমন ব্যবহার করবে, সে ঠিক তেমনটাই ফেরত পাবে।”
– “যাক, এতক্ষণে তাহলে বুঝেছ। কেউ অবহেলা করলে বা নিচু চোখে দেখলে এক মুহূর্তও তার কাছে থাকবে না। আর বিশেষ করে নিজের দুর্বলতা কখনো কাউকে বুঝতে দিও না।”
– “হুম।”
দুপুরে দাদির বাড়ি থেকে খেয়ে নিজের ভাড়া বাসায় ফিরতেই সায়ন দেখল, বাড়িওয়ালার ছেলে রিফাত সিঁড়িতে বসে কাঁদছে। রিফাত সায়নের চেয়ে দুই বছরের ছোট, অনার্সে পড়ে। বাসায় তখন আর কেউ ছিল না। সায়ন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
রিফাত চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
– “তিশা আর আমি একসাথে স্কুল-কলেজে পড়েছি। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আজ রাবেয়া আন্টি (সায়নের মা) এসে বলে গেলেন, তিশার মা-বাবা নাকি তার সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে।”
সায়ন কথাটা শুনে মুচকি হাসল। তিশা হলো তার সেই মামাতো বোন, যার সাথে গতরাতে তার মা বিয়ের কথা বলছিলেন। সায়ন তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– “আরে ধুর! বিয়ে দিতে চাইলেই কি আর হয়ে যাবে নাকি?”
– “কিন্তু ভাইয়া, আমার মা-ও তো তিশাকে মেনে নিতে চায় না। কারণ আমরা সমবয়সী।”
সায়ন কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
– “আচ্ছা, আমি যদি তোমাদের বিয়েটা পড়িয়ে দিই, তাহলে কেমন হয়?”
রিফাতের চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! সে আমতা আমতা করে বলল,
– “কিন্তু মা যদি কিছু বলে…”
– “প্রথম প্রথম একটু ব*কাব*কি করবেই। তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকো। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর কিছুই বলবে না।”
এরই মধ্যে লিমার ফোন এল। সে উত্তেজিত হয়ে জানাল, বিয়ের আসরে মোহরানা নিয়ে বিশাল ঝামেলা শুরু হয়েছে। আরিশার বাবা পনেরো লাখ টাকা মোহরানা ধার্য করতে চান, কিন্তু নাহিদ পাঁচ লাখের বেশি দিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত নাহিদ একটা শর্ত দিল,পনেরো লাখ মোহরানা সে দেবে, যদি আরিশার বাবা যৌতুক হিসেবে পাঁচ ভরি সোনা দেন। তার যুক্তি, বড় মেয়ের বিয়ের সময় যদি দিতে পারেন, তাহলে ছোট মেয়ের বেলায় সমস্যা কোথায়? অবশেষে অনেক দর-কষাকষির পর পনেরো লাখ টাকা মোহরানা আর ছয় মাস পর পাঁচ ভরি সোনা দেওয়ার শর্তে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।
খবরটা শুনে সায়ন হাসতে লাগল। বিয়ে হতে না হতেই ঝামেলা শুরু! ভবিষ্যতেও যে আরও কত কী নাটকীয়তা অপেক্ষা করছে, তা ভেবেই তার হাসি পেল।
সায়ন আর রিফাত মিলে পরিকল্পনা করল, আগামী শনিবারেই তারা কাজটা সেরে ফেলবে। পরিকল্পনা মতোই শনিবার সকালে সায়ন, রিফাত আর তিশাকে নিয়ে কাজী অফিসে হাজির হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল এক নতুন বিপত্তি। রিফাত আর তিশা একা, সাক্ষী হিসেবে এসেছে শুধু রিফাতের এক বন্ধু। বিয়ের জন্য অন্তত দুজন সাক্ষী দরকার। সায়ন রিফাতকে বলল,
– “রিফাত, তোমার আর কোনো বন্ধুকে ফোন দিয়ে ডাকো।”
– “আরে ভাই, এরা সব গা*দ্দার। ঝামেলার ভয়ে কেউ আসতে চাইছে না।” রিফাতের কণ্ঠে রাজ্যের হতাশা।
উপায়ন্তর না দেখে সায়নের হঠাৎ করেই লিমার কথা মনে পড়ল। কেন যেন তার মনে হলো, একমাত্র সেই-ই এই মুহূর্তে সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো না। ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই লিমা কাজী অফিসে এসে হাজির হলো। এরপর আর কোনো বাধা রইল না। কাজী সাহেব তাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে লিমা সায়নকে জিজ্ঞেস করল,
– “আজ বা কাল একবার দেখা করতে পারবে?”
– “বাসার এই ঝামেলাটা আগে শেষ করি। তারপর না হয় দেখা করব।”
– “আচ্ছা। কী হয় না হয়, আমাকে কিন্তু অবশ্যই জানিও।”
এই বলে লিমা একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল। রিফাত দুষ্টুমি করে হাসতে হাসতে বলল,
– “ভাই, আপনি চাইলেই তো আজ আপনারও শুভ কাজটা হয়ে যেত, তাই না?”
– “ধুর! ও আমার ভালো বন্ধু। এর বেশি কিছু না।”
তিশা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
– “আমরাও তো একসময় ভালো বন্ধুই ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।”
বাড়িতে ফিরে সায়ন সরাসরি রিফাতের মাকে সবটা খুলে বলল। সব শুনে রিফাতের মা তো রেগে আগুন। তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। অন্যদিকে, রিফাতের বাবা মুচকি মুচকি হাসছেন, কিন্তু স্ত্রীর ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে রাবেয়া বেগমের অবস্থা আরও করুণ। তিনি হাসবেন না কাঁদবেন, সেটাই বুঝতে পারছেন না। নিজের ছেলের জন্য যে মেয়েটিকে তিনি এত শখ করে ঠিক করেছিলেন, সেই মেয়েকে কি না তার ছেলেই আরেকজনের সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এল! সায়ন পরিস্থিতি সামাল দিতে রিফাতের মাকে বুঝিয়ে বলল,
– “আন্টি, ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। আমি জানি, ওরা সমবয়সী বলে আপনি মানতে চাইছেন না। কিন্তু ওরা যদি নিজেদের ভালোটা বুঝতে পারে, তাহলে আপনি বা আমি কী করতে পারি? ধরুন, ওদের অন্য কারও সাথে বিয়ে হলো। তাতে কী হবে? শুধু আপনার ইচ্ছাটা পূরণ হবে। কিন্তু রিফাত তার স্ত্রীর হক ঠিকভাবে আদায় করতে পারবে না, আর তিশাও তার স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কারণ তাদের মন তো এখানেই পড়ে থাকবে।”
সায়নের যুক্তির কাছে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। চুপচাপ তিশার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং ফোন করে তিশার বাবা-মাকে সব জানালেন। তারাও খুব বেশি দেরি করলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকা করে ফেললেন।
সবকিছু মিটে যাওয়ার পর রাবেয়া বেগম মুখ মলিন করে বসে রইলেন। সায়ন তার পাশে বসে হেসে বলল,
– “কী হলো তোমার? মন খারাপ?”
– “তোর জন্য যাকে ঠিক করলাম…”
– “আরে মা, এত অস্থির হচ্ছ কেন? যদি থাকে নসিবে, আপনা-আপনি কেউ না কেউ আসিবে। আর তাছাড়া, জীবনে এখনো অনেক পথ চলা বাকি, অনেক কিছু করা বাকি, অনেক কিছু দেখা বাকি। আগে সেই স্বপ্নগুলো পূরণ হোক, তারপর বাকিটা না হয় দেখা যাবে।”
অবশেষে ঠিক হলো, রিফাত আর তিশার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে এক মাস পর। সন্ধ্যায় লিমা ফোন করে খুনসুটির সুরে বলল,
– “কী ব্যাপার? নিজের চেয়ে ছোটদেরও বিয়ে হয়ে গেল। তোমার বিয়ের ফুল কবে ফুটবে?”
– “ফুল ফোটার আগেই তো ছাগলে এসে খেয়ে যাচ্ছে। যেদিন সফলভাবে চারপাশে বেড়া দিতে পারব, সেদিনই ফুটে যাবে।”
সায়নের রসিকতায় লিমা ফোনের ওপাশ থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দে সায়নের মনেও যেন একরাশ ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ল।
চলবে….!