অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০২

0
2

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- দুই।
লেখা: সিহাব হোসেন।

ল্যাপটপের নীল আলোয় সায়নের মুখটা ভাবলেশহীন। সে গভীর মনোযোগে কাজ করে চলেছে। রাবেয়া বেগম নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে তার পাশে বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ গলায় বললেন,
– “তোর খালা-খালু বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেছে।”
সায়ন ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করল,
– “কী বললে তুমি?”
– “কী আর বলব? এতবার করে বলে গেল, এখন না গিয়ে কি কোনো উপায় আছে?”
– “তোমরা যেতে পারো, কিন্তু আমি যাব না।”
– “কেন?”
– “যে মানুষগুলো আমাদের বারবার এতটা নিচু করে কথা বলেছে, তোমার কি মনে হয় এতকিছুর পরেও তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা উচিত?”
– “আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে নেই, সে যেমনই হোক। তারা মন্দ বলে কি তুইও তাদের মতো হবি? রাগ করে কোনো লাভ হবে না। তুই যদি না যাস, তাহলে আশেপাশের লোকেরা ভাববে, ওরা বিয়েটা দেয়নি বলেই আমরা অপমানে যাইনি।”
– “হুম, তা ঠিক বলেছ।”

আরিশার গায়ে হলুদের দিন। পুরো বাড়ি মেহমান আর উৎসবের কোলাহলে মুখর। সবাই হলুদ মাখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝে এক কোণে, একটা সাধারণ পোশাকে চুপচাপ বসে আছে সায়ন। তার চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর নেই, চারপাশের কোনো দিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন সময় তার বন্ধু তৌহিদ একটা চেয়ার টেনে পাশে বসল। তাকে দেখে সায়ন বেশ অবাক হলো।
– “তুই এখানে?”
– “আমাকেও দাওয়াত দিয়েছে।”
– “ওহ।”
– “সত্যি বলতে, আরিশাকে তুই বিয়ে করলে মন্দ হতো না। কোন দিক দিয়ে ওর চেয়ে তুই কম? তোর সাথেই ওকে বেশি মানাত। তাছাড়া এখনকার দিনে ওর মতো ভালো মেয়ে পাওয়া অনেক কঠিন। আজকাল তো কমবেশি সবাই সম্পর্কে জড়ায়।”
সায়ন মৃদু হাসল। বলল,
– “সম্পর্কে জড়ালেই যে একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায়, ব্যাপারটা এমন না। ভালো বা খারাপ নির্ভর করে তার চরিত্র আর পারিবারিক শিক্ষার ওপর। তোর চোখে আরিশা হয়তো সবচেয়ে ভালো মেয়ে, কিন্তু আমি তোকে বলছি, ওকে বিয়ে করে কোনো মানুষ কোনোদিন সুখী হতে পারবে না।”
তৌহিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন?”
– “সেটা না হয় অজানাই থাক। যদি কখনো ভাগ্যে থাকে, তাহলে এমনিতেই জানতে পারবি।”

তৌহিদ এবার শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,

– “যাক, তাহলে তুই মানুষ চিনতে ভুল করিসনি। যে মেয়ে নিজেকে সবার কাছে বড় প্রমাণ করার জন্য অন্যকে ছোট করতে পারে, সে কেমন তা আমরা সবাই জানি। শুধু সামাজিকতার খাতিরে সবার সাথে তাল মিলিয়ে ভালো-মন্দ বলতে হয়। কারণ এই সমাজে সত্যি কথা বললে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী-ই বা জোটে?”

এরই মধ্যে আরিশাকে সাজিয়ে এনে স্টেজে বসানো হলো। চারপাশ থেকে সবাই তাকে ঘিরে ধরল। উজ্জ্বল আলোয় আরিশার মুখ ঝলমল করছে। সেই দিকে তাকিয়ে সায়নের মনে পড়ে গেল নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো। এক অদ্ভুত, বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

বাড়ি বিক্রি করে ব্যবসাটা যখন সবেমাত্র লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে, তখন থেকেই বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। সেই মতোই শুরু হলো মেয়ে খোঁজা। প্রথম যে মেয়েটিকে দেখতে যাওয়া হলো, তার পরিবার আগে থেকেই সায়নের খোঁজখবর নিয়েছিল এবং মোটামুটি রাজি ছিল। সবাই বসার ঘরে অপেক্ষা করছে, এমন সময় মেয়েকে আনা হলো। মেয়েটি ছিল সায়নের চেয়ে তিন বছরের বড়। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সায়নের মনে মনে নিজের চেয়ে সিনিয়র কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মেয়েটি সায়নকে দেখা মাত্রই মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠল,

– “আরে, এই ছেলেকে তো দেখে মনে হচ্ছে আমার চেয়েও বয়সে ছোট! এর মধ্যে তো এখনো ম্যাচিউরিটিই আসেনি। একে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

প্রথম প্রত্যাখ্যান। এরপর আবার শুরু হলো মেয়ে দেখার পালা। কিন্তু বারবার একই জায়গায় এসে সব আটকে যেতে লাগল। সব পছন্দ হলেও পাত্রের নিজস্ব বাড়ি নেই, ভাড়া বাসায় থাকে, এই একটি কারণে বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ ভেঙে গেল। এমনকি নিজেদের চেয়ে আর্থিক ভাবে দুর্বল পরিবারেও দেখা গেল তাদের চাহিদা আর দেমাগ আরও বেশি। সায়ন একসময় আশাই ছেড়ে দিল। সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে তার বিয়ে করা হবে না। এই সমাজে একজন ভালো মানুষের চেয়ে তার সম্পদের পরিমাণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে চরিত্রহীন, নেশাখোর হলেও সমস্যা নেই, যদি তার টাকা আর বাড়ি থাকে।

শেষবার বাবা-মা জানালেন, এবার নাকি সব ঠিকঠাক। মেয়ের বাবা রাজি, শুধু পছন্দ হলেই তাড়াতাড়ি বিয়ের দিন ঠিক করা হবে। কিন্তু সায়নের মন বলছিল, এবারও কিছু একটা হবে। সে বাবা-মায়ের সাথে বসে অপেক্ষা করছিল মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটকের ফোন এল, মেয়ে তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে।

আর তারপর এল আরিশার প্রস্তাব। ওকে তো বিয়ে করার ইচ্ছাই ছিল না তার, কেবল বাবা-মায়ের জেদের কাছেই রাজি হয়েছিল। একদিন সে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
– “মা, বারবার দেখছ আমার বিয়েটা হচ্ছে না, তারপরও কেন এত চেষ্টা করছ?”
– “তুই তো জানিস, আমাদের আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্কগুলোতে কেমন ভাটা পড়েছে। আর তা ছাড়া এই বাড়িতে আমার বড্ড একা লাগে। একজন নতুন মানুষ এলে আমার একাকিত্বটা ঘুচবে, নতুন করে সম্পর্কও গড়ে উঠবে।”

সায়ন মনে মনে ভাবল, সে-ও তো তাই চায়। জীবনে এমন একজন আসুক, যে তাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানসিক শান্তি দেবে, তাকে বুঝবে। ঠিক এমন সময় সাউন্ড বক্সের প্রবল আওয়াজে তার ভাবনার জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সে বাস্তবে ফিরে এল, যেখানে সবাই সুখী, শুধু সে ছাড়া।

এত কোলাহলের মাঝে হঠাৎ সায়নের চোখ আটকে গেল আরিশার পাশে বসে থাকা একটি মেয়ের ওপর। চারপাশে যখন হলুদের ছড়াছড়ি, তখন মেয়েটি পরেছে ধবধবে সাদা এক শাড়ি। মুখে নেই কোনো মেকআপের আস্তরন, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা, আর সেই খোঁপায় গোঁজা একটি টকটকে লাল গোলাপ। মেয়েটির সরল সৌন্দর্য যেন এই কৃত্রিম আলোর উৎসবে এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস। ঠিক তখনই মেয়েটি সায়নের দিকে তাকাল। সায়নের চিনতে ভুল হলো না, এ তো লিমা!

সেই ক্লাস এইটের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। লিমা তখন তাদের ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছিল। কেন যেন প্রথম দিন থেকেই মেয়েটাকে তার খুব ভালো লাগত। একা একা বসে থাকলেই লিমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত, আর সে আনমনে হাসত। কিন্তু অদ্ভুত এক লজ্জায় কখনো তার সাথে সামনাসামনি কথা বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। লিমার হাসি দেখলে বুকের ভেতর এক অন্যরকম অনুভূতি হতো, যা ছিল ছেলেমানুষি আর হাস্যকর।

সায়ন যখন অতীতের ভাবনায় ডুবে ছিল, ঠিক তখনই লিমা স্টেজ থেকে নেমে তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। সায়ন তাকে আসতে দেখে বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করল। লিমা সামনে এসে দাঁড়াতেই সে রীতিমতো ঘামতে শুরু করল। লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “সায়ন?”
সায়ন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, পা দুটো যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই, রীতিমতো কাঁপছে। সে কোনোমতে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জবাব দিল।
– “এতদিন কোথায় ছিলে?”
– “কে… কেন? বাসায়।”
– “আরে, এমন কাঁপছ কেন? স্বাভাবিক হও। আমি কি বা*ঘ নাকি ভা-ল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলব?”

সায়ন কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তার আগেই পেটে প্রচণ্ড এক মোচড় দিল। সে বুঝতে পারল, আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। দ্রুত লিমার সামনে থেকে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল সে। তার এই কাণ্ড দেখে লিমার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা বোধ হয় আর কোনোদিনও পাল্টাবে না। আমি সামনে এলেই কেন যে এমন করে, কে জানে! ভেবেচিন্তে লিমা আবার স্টেজে গিয়ে আরিশার পাশে বসল।

কিছুক্ষণ পর সায়ন স্বস্তি পেয়ে আবার অনুষ্ঠানে ফিরে এল। কিন্তু মানুষের এত ভিড়, এত কোলাহল তার আর ভালো লাগছিল না। তাই সে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে সে চমকে পেছনে তাকাল। লিমাকে দেখে সে যেন আবারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
– “তোমার সমস্যাটা কী, বলো তো? আমাকে দেখলেই এভাবে পালিয়ে যাও কেন?”
– “জা-জানি না তো।”
– “আচ্ছা। তো বলো, কী খবর তোমার? আমি আরিশার কাছে তোমার খোঁজ কতবার করেছি, কিন্তু ও কখনো তোমার কথা ঠিকভাবে বলেনি। তোমার প্রসঙ্গ উঠলেই এড়িয়ে যেত। একবার তো বলেছিল, তুমি নাকি টোকাইদের সাথে ঘোরাফেরা করো।”
সায়ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “মজা করছ?”
– “একদম সিরিয়াসলি বলছি। আরও বলেছিল, তুমি নাকি ইচ্ছা করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছ। কিন্তু আমার কেন যেন বিশ্বাস হয়নি। তোমার মতো একজন ভালো ছাত্র হুট করে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। কী হয়েছিল সত্যি করে বলো তো?”
সায়ন কিছু বলার আগেই লিমা আবার বলল,
– “আচ্ছা, চলো এখান থেকে একটু বাইরে হাঁটি। এই প্রচণ্ড আওয়াজে আমার মাথা ধরে গেছে।”

ঠান্ডা বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে সায়ন তার জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঝড়-ঝাপ্টার কথা লিমাকে খুলে বলল। বাবার ব্যবসায় লোকসান, খালুর কাছ থেকে সুদে টাকা নেওয়া, বাড়ি বন্ধক রাখা, আরিশার পরিবারের অপমান আর নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পেছনের সব কষ্টকর স্মৃতি সে অকপটে বলে গেল। সব শুনে লিমা অবাক হয়ে বলল,
– “আরিশা তো প্রায়ই বলত, তার মামা, খালু, দুলাভাই সবাই নাকি অনেক বড় বড় পদে চাকরি করে। তারা তো চাইলেই তোমাদের সাহায্য করতে পারত। কিন্তু তা না করে, উল্টো তোমাদের জীবনটা আরও কঠিন করে তুলেছে। এমন আত্মীয় থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”
– “আমার ভাগ্যে যা ছিল, সেটাই হয়েছে। অন্যকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ?” সায়নের কণ্ঠে ছিল গভীর এক উদাসীনতা।
– “আগে যখন আরিশাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত, তখন ভাবতাম হয়তো ও তোমাকে ভালোবাসে, তাই লজ্জায় কিছু বলে না। কিন্তু এখন দেখছি, ঘটনা তো পুরোই অন্য।”
– “হুম।”

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে তারা আবার অনুষ্ঠানের দিকে ফিরে এল। ভেতরে ঢুকতেই সায়ন দেখল, তার মা রাবেয়া বেগম তার এক খালাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে নিচু গলায় কথা বলছেন আর ইশারায় তাকে দেখাচ্ছেন। ওই মহিলার একটি মেয়ে আছে। সায়নের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, তার মা আবারও তার বিয়ের জন্য নতুন করে পাত্রী খোঁজার অভিযানে নেমেছেন। তার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে