অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০১

0
4

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- এক।
লেখা: সিহাব হোসেন।

“আরিশার বিয়ে তোর খালাতো ভাই নাহিদের সাথে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলেটা সরকারি চাকরি করে, জানিসই তো?”

মায়ের কথায় কোনো হেলদোল দেখা গেল না সায়নের। সে আপনমনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে কাজ করে চলল। ছেলের এমনআচরণে রাবেয়া বেগমের মেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি মুখের ওপর বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন,
– “তোকে কিছু বলেছি, কানে নিচ্ছিস না কেন?”
– “সবই তো শুনছি। যা হওয়ার, তাই হয়েছে।”
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “আমার কত ইচ্ছা ছিল আরিশাকে তোর বউ করে এই ঘরে আনব! কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হলো না।”
– “আমাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণ নিশ্চয়ই আমার লেখাপড়া কম।”
ছেলের কথায় রাবেয়া বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি অসহায় গলায় বললেন,
– “আসলে তা নয়। তোর খালা-খালু খুব জোর করছিল। তার ওপর আরিশার দুলাভাইয়েরও ইচ্ছা ছিল নাহিদের সাথেই বিয়েটা হোক।”
– “বাদ দাও তো, মা। আমি তো আগেই বলেছিলাম ওইসব হবে না। কেন ওদের কাছে নত হতে গেলে? আজকাল বিয়ের বাজারে সরকারি চাকরিজীবী ছেলের দামই সবচেয়ে বেশি।”
– “হুম। ভালোর কোনো দাম নেই আজকাল।”

হতাশ হয়ে রাবেয়া বেগম উঠে চলে গেলেন। সায়ন চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। আরিশা, তার মেজো খালার মেয়ে। আর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই নাহিদ হলো বড় খালার ছেলে। আরিশা আর সায়ন প্রায় সমবয়সী। একসাথে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে। এরপর আর সায়নের পড়ালেখাটা এগোয়নি। পারিবারিক জটিলতায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে বাবা-মা চাইলেও পড়াশোনায় চার বছরের ব্যবধানটা সে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাবার ব্যবসায় মন দিয়েছে। সেই সাথে অনলাইনে টুকটাক কাজ করে মাস শেষে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে সে।

একটা সময় ছিল যখন আরিশা ও সায়নের সম্পর্ক ছিল মধুর। যেকোনো প্রয়োজনে সবার আগে ডাক পড়ত সায়নের। কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট হোক বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া, সায়ন ছিল তার প্রথম পছন্দ। খালাতো ভাই-বোন হলেও তাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু এই সুন্দর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে বছর দুয়েক আগে।
হঠাৎ করেই সায়নের বাবার ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হয়। ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ব্যাংকের দেনার চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারলে জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক সেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আরিশার বাবা, সায়নের মেজো খালু। তার দেওয়া টাকায় সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া যায়।

সায়ন যেহেতু ব্যবসার হিসাব-নিকাশ দেখত, তার চোখে পড়ল প্রতি সপ্তাহে বাবা মোটা অঙ্কের একটা টাকা আলাদা করে রাখছেন। জিজ্ঞেস করলে বাবা এড়িয়ে যান। বিষয়টা খটকা লাগায় সে তার মাকে খুলে বলে। সব শুনে রাবেয়া বেগম জানান,
– “এই টাকাটা তোর খালুকে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয়।”
– “একবারে বেশি টাকা নিয়ে এভাবে অল্প অল্প করে দিলে তো উনাদেরই ক্ষতি। তার চেয়ে বাবাকে বলো টাকা জমিয়ে একবারে বেশি করে দিতে।”
– “এটা কোনো আসলের টাকা নয়। এটা সুদের টাকা। আর তোর খালু আমাদের এমনি এমনি টাকা দেয়নি, আমাদের এই বাড়িটা বন্ধক রাখতে হয়েছে।”
মায়ের কথাগুলো সায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে চমকে উঠল। যে মানুষটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ওমরাহ করে এসেছে, মসজিদ-মাদ্রাসায় উদার হাতে দান করে, সে কি না এমন একটা ঘৃণ্য কাজের সাথে জড়িত? তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাবেয়া বেগম আবার বলতে লাগলেন,
– “টাকা দিতে সামান্য দেরি হলেই খুব বা*জে ব্যবহার করে।”

সায়ন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কোনোভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। সোজা আরিশাকে ফোন করে সবটা জানাল। কিন্তু সব শুনে আরিশার উত্তর ছিল অপ্রত্যাশিত।
– “বাবার এই কাজে তো আমি দোষের কিছু দেখি না। তিনি টাকার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তো মানুষের উপকারই হচ্ছে।”
– “চড়া সুদে টাকা দিয়ে মানুষের উপকার হয়?”
– “তা নয়তো কী? আমার বাবার মতো মানুষেরা টাকা না দিলে তোমাদের মতো লোকদের তো না খেয়ে মরতে হতো।”
আরিশার কথায় সায়নের মাথা ঘুরে গেল। রাগে তার শরীর কাঁপছিল।
– “সুদের টাকা তোর পেটে গেছে তো, তাই এসব পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস। তোর বাবাকে বলিস, ধর্মের এই লেবাস ছেড়ে খাতা-কলম নিয়ে ভালোভাবে এই ব্যবসাই শুরু করতে।”
ব্যস, আর যায় কোথায়! আরিশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।
– “আমার বাবার নামে এত বড় কথা! দাঁড়া, আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে সব বলছি।”

আরিশা সেদিন বাসায় গিয়ে সব বলেছিল। আর তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। তার বাবা এমন চাপ সৃষ্টি করলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাড়ি বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
যেদিন সব টাকা শোধ করে দেওয়া হলো, সেদিন সন্ধ্যায় আরিশার বাবা তাদের বাসায় এলেন। সায়নের বাবা শাহেদ সাহেবের হাত চেপে ধরে কান্নার অভিনয় করে বললেন,
– “দেখেন ভাই, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। নয়তো আমি আখিরাতে আটকে যাব।”
সায়নের বাবা-মায়ের মন এতটাই নরম যে, তাদের এই মিষ্টি কথায় তারা মুহূর্তেই গলে গেলেন। কিন্তু সায়নের মন থেকে তাদের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা সেদিনই উঠে গিয়েছিল।

চেয়ারে হেলান দেওয়া সায়নের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে তিক্ত হাসি। আরিশার প্রত্যাখ্যানের কারণ শুধু তার কম লেখাপড়া বা সরকারি চাকরি না থাকা নয়। কারণটা আসলে মূল্যবোধের, যা দুই বছর আগেই তাদের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছিল। যে দেয়াল ভাঙার কোনো পথ আর খোলা নেই।
বাড়ি বিক্রি করে খালুর সব দেনা শোধ করার পরও হাতে বেশ কিছু টাকা রয়ে গিয়েছিল। সেই টাকাই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র সম্বল। শাহেদ সাহেব আর সায়ন মিলে নতুন উদ্যমে আবার ব্যবসায় মন দিল। এবার ভাগ্য তাদের সহায় হলো। আগের অভিজ্ঞতা আর কঠোর পরিশ্রমে ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগল না। ব্যবসা লাভের মুখ দেখতে শুরু করল।

এই সচ্ছলতার দিনগুলোতেও সায়নের মনে পড়ত সেই দুঃসময়ের কথা, যখন তারা দেনায় জর্জরিত ছিল। কত মানুষের কত কটু কথা! অবাক করা বিষয় হলো, পরের চেয়ে নিজের মামা-খালারাই বেশি আঘাত দিয়ে কথা বলেছে। অথচ চাচারা তাদের সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি তাচ্ছিল্য আর নিচু চোখে দেখেছে আরিশার বড় বোন, দুলাভাই আর নাহিদের পরিবার। লেখাপড়া কম, এই খোঁটা দিয়ে তারা প্রায়ই বলত, জীবনে সায়ন কিছুই করতে পারবে না। এই অপমানই তার জেদকে শানিত করেছিল। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, জীবনে এমন কিছু করে দেখাবে, যাতে সবাই বোঝে যে পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়াও সফল হওয়া যায়। এরই মধ্যে একদিন সায়নের মা তাকে এসে জানালেন,
– “তোর খালার সাথে আমি কথা বলেছি।”
– “কী নিয়ে কথা হলো?”
– “তোর আর আরিশার বিয়ে নিয়ে। তুই তো এখন আল্লাহর রহমতে ভালোই আয় করছিস। তাই তারাও আর আপত্তি করছে না।”
সায়নের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। সে বলল,
– “আমার এমন সুদি পরিবারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।”
– “ওরা যা ইচ্ছা করুক, তাতে কী? কিন্তু আরিশা তো মেয়ে হিসেবে খারাপ না। এমন শান্তশিষ্ট, ভদ্র মেয়ে এখনকার দিনে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
– “দেখো, তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।”
সায়ন দায়সারাভাবে উত্তর দিল।
রাবেয়া বেগম একটু ইতস্তত করে বললেন,
– “এর আগে তোর বড় খালা নাহিদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তোর খালু তখন রাজি হয়নি। নাহিদের বয়স বেশি, তার ওপর চাকরিরও কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। তবে শুনছি, একটা সরকারি চাকরির জন্য নাকি খুব চেষ্টা করছে।”
– “একবার চাকরিটা হতে দাও, তারপর দেখবে তোমার বোন আর তার স্বামী আমাকে বাদ দিয়ে নাহিদের সাথেই বিয়েটা ঠিক করবে।”
– “মোটেও না। এমনটা হতেই পারে না।”
– “তাহলে বলো তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিয়ে দিতে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”
– “আরে, বিয়েশাদির ব্যাপার, একটু তো সময় লাগবেই।”

সায়ন শুধু মুচকি হাসল। তার অনুমান যে কতটা সঠিক ছিল, তা প্রমাণ হতে বেশিদিন লাগল না। মাস খানেকের মধ্যেই নাহিদের সরকারি চাকরিটা হয়ে গেল। আর ঠিক পরদিনই খবর এল, আরিশার বিয়ে সায়নের পরিবর্তে নাহিদের সাথেই ঠিক হয়েছে। সায়ন বুঝতে পারছিল, আরিশার বাবা-মা নিশ্চয়ই কোনো অপমানজনক কথা বলেছে, যা তার মা লজ্জায় তাকে বলতে পারছেন না।

সেদিন বিকেলে সায়ন কলেজের পেছনের পুকুরঘাটের সিঁড়িতে একা বসে ছিল। চারপাশের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কলরব তার একাকিত্বকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার খেয়াল হলো, কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। কারণটা তার অজানা, তবে অনুমান করতে কষ্ট হলো না। এমন সময় পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠের ডাক এল, “সায়ন!”

সায়ন উঠে দাঁড়াল। আরিশা। সেই তাকে এখানে দেখা করতে বলেছে। দুজন পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। সায়নের মনে ভেসে উঠল শৈশবের স্মৃতি। কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো! যা-ই করত, দুজন একসাথেই করত। মাধ্যমিকের পরও সব ঠিক ছিল। কিন্তু মাঝখানের একটা ঝড় যেন সবকিছু ওলটপালট করে দিল। টাকার লেনদেন আত্মীয়তার সম্পর্ককে কতটা ঠুনকো করে দেয়, তা সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল আরিশা। তার কণ্ঠে ছিল বিদ্রূপের সুর।
– “কেন ডেকেছি তা হয়তো বুঝতে পারছো? তোমার বাবা-মা তো তোমাকে খুব বুদ্ধিমান বলে। তাই বলো দেখি।”
– “নিশ্চয়ই তোর বাবা-মা কী কী অপমানজনক কথা বলে আমাকে বাতিল করেছে, তা জানানোর জন্য। কারণ যত যাই হোক, আমি কষ্ট পাব বলে মা আমাকে সবটা বলেনি।”
– “বাহ! আন্টি তো তোমাকে নিয়ে ভুল কিছু বলে না।”
– “দেরি না করে বলে ফেল।”
আরিশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে শুরু করল,
– “প্রথমত, তোমাদের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। আর ভবিষ্যতে যে করতে পারবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। আমি সারাজীবন এ বাড়ি-ও বাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে পারব না। দ্বিতীয়ত, তোমার লেখাপড়া কম। সমাজে দশ জন মানুষের সামনে তোমাকে নিয়ে চলতে আমার অসুবিধা হবে। আর তৃতীয়ত, তোমার এই ব্যবসার আয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আর কী… বাতিল।”
– “জানতাম। এজন্যই তো আমি নিষেধ করেছিলাম। তবে এটা হওয়া দরকার ছিল।”
আরিশা অবাক হয়ে বলল,
– “কেন?”
– “নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য। এই প্রত্যাখ্যানটা আমাকে জীবনে সফল হতে আরও বেশি সাহায্য করবে।”
আরিশা এবার ব্যঙ্গ করে হেসে উঠল।
– “নিজের ওই ব্যবসা আর অনলাইন জুয়া ছাড়া জীবনে কিছুই করতে পারবি না। যেদিন ধরা খাবে, সেদিন সব শেষ। যাইহোক, বিয়ের দাওয়াত রইল।”

কথাটা শেষ করে আরিশা হনহন করে নিজের পথে হাঁটতে শুরু করল। সায়ন তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, অপমানই হবে তার সাফল্যের সিঁড়ি।

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে