অথৈ মহল পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
40

২০ (অন্তিম পর্ব)
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
এখন ওরা যাবে কংলাক ঝর্ণায় গা ভাসাতে। এত কাছে থেকে ঝর্ণার পানি স্পর্শ না করলে কি চলে? ঝর্ণার কথা মনে পড়লেই গা শিরশির করে ওঠে যেন। নিবিড় স্থানীয় একজন গাইড সাথে নেয়। যদিও প্রয়োজন ছিল না। এখানে আগে ও এসেছিল। তবুও নিরাপত্তার জন্য নিয়ে নেয়।

অথৈ এক্সাইটেড অনেক। একটু পর পর বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছে। নিবিড় সুন্দর ভাবে সেসব উত্তর দিচ্ছে।
গাইডসহ ওরা দুজন পাহাড়ের ঢালু তে ট্রেকিং করছে।
নিবিড়ের যত ভয় অথৈ কে নিয়ে। সাবধানে দুজন নামছে।

“অথৈ, সাবধানে পা ফেলো কিন্তু। দেখে দেখে আসো। ”
“এত চিন্তা করতে হবে না তোমার। আমি পারব। আচ্ছা, এই পাহাড়ের নাম কংলাক পাহাড় নাম দেওয়া হয়েছে কেন? ”

“কংলাক পাড়াটি কমলাক পাড়া নামেও পরিচিত। স্থানীয় তথ্য মতে, এই পাড়াটির পাশে বড় বড় কমলা বাগান অবস্থিত বলে এটিকে কমলাক পাড়া বলা হয়। পাহাড়ের নিচে কংলাক ঝর্ণা অবস্থিত এবং এই ঝর্নার নামানুসারেই এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। ভাই ঠিক বললাম তো? ”

গাইড নিবিড়ের কথা শুনে হেসে ওর কথায় মাথা নাড়ায়। তিনি প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলছেন না। শুধু আশেপাশের জায়গা কোথায় কেমন সেগুলো টুকটাক বলছেন।

ট্রেকিং করতে করতে অথৈ হাপিয়ে গেছে। নিবিড় এক পাশে ওকে নিয়ে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়।

“কিছু সময় জোরে জোরে শ্বাস নাও একটু। ভালো লাগবে। ”

ওর কথামত অথৈ জোরে জোরে শ্বাস নেয়। যখন একটু হালকা লাগে তখন আবার হাঁটা শুরু করে।

সাজেকে ঝকঝকে রাস্তা, হ্যালিপ্যাড, রির্সোট এত পযর্টকে ঠাঁসা। তবে এই পথে সেসবের কোনো চিহ্ন নেই।
পুরোটা পথ এখনও বন্য! পথটা ক্রমাগত জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছে। কোনো রকমে পা ফেলে ফেলে পথ শেষ করতে হচ্ছে। পুরোটা পথ ঘন জঙ্গল আর প্রাচীন বৃক্ষে ঢাকা। বড় বড় লতা দেখে যে কারও মনে পড়ে যাবে টারজানের গল্প।

পাহাড় বেয়ে পুরোটাই নামার পথ। ক্রমশ নামছে ওরা। গতকাল সাজেকের উঁচু পাহাড় থেকে নিচের ভ্যালির জমানো মেঘের সৌর্ন্দয্য দেখেছিল। এসব পথে সারাটা সকাল মেঘের আনাগোনা। এখন সেই পথেই হাঁটছে।

উপর থেকে যতটা মসৃণ মনে হত, ততই বন্ধুর মনে হল এই পথে হাঁটতে এসে। অথৈ পাহাড়ি ট্রেকিং এ নতুন হওয়ায় পথ চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল ওর। অচেনা বুনো পরিবেশে ট্রেকিং করে নিচে আসার পর মিলল শীতল জলের ঝিরি পথ।

অন্যসব ঝিরির মতো এটাও পাথরে ঠাঁসা। দীর্ঘ পথ পাহাড় বেয়ে নামার পর এমন ঝিরিটা ওদের মধ্যে কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ করে দিল আবার ও। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে যাওয়া ঝিরির পথে ধরে কিছুদূর হেঁটে যায়। আরও সামনে ছোট–বড় পাথর ডিঙিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে উপর থেকে অনবরত। নিঃশব্দের পাহাড়জুড়ে ঝিরির এমন পথ চলা সত্যিকারের বন্য স্বাদ এনে দেয় প্রকৃতিতে।

ঝিরিতে বিশ্রাম সেরে আবার পাহাড় ধরে উঠতে হবে। দুপাশে জঙ্গল ঘেরা গভীর খাড়া পথ বেয়ে উঠতে থাকে। কিছুদূর যেতেই কানে আসল ঝর্ণার তীব্র আওয়াজ। সেই শব্দ হাঁটার গতি যেন বাড়িয়ে দিল। উঁচুনিচু পাহাড় বেয়ে নামতেই বড় পাথর ডিঙিয়ে চোখ পড়ে দীর্ঘ ঝর্ণার দিকে।

উঁচু পাহাড়ে খাঁজ বেয়ে উপর থেকে দুভাগে পড়ছে ঝর্ণা। তীব্র শব্দ ঘিরে রেখেছে এই অচেনা পরিবেশ। সুনসান নীরব পাহাড়ের মধ্যে একমাত্র শব্দ যেন এই জলের ধারা। অনবরত উপর থেকে বয়ে আসা এই পানির স্রোত বন্দি করে নিল অথৈ এর নজর। পুরোটা পথের ক্লান্তি রেখে আসলো এই জলের স্রোতে। নিচ থেকে উপরের দিকে তাকাতে ঝর্ণাটাকে বড়ই বিস্ময় মনে হল। এ যেন সত্যিকারের আদিমতা ঘিরে রেখেছে পুরো প্রাকৃতিক রাজ্য! মেঘে ঢাকা এমন একটা বিস্তৃত ভ্যালির বুকে এমন ঝর্ণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

নিবিড় অথৈ কে ধরে ঝর্ণার নিচে নেমে আসলো। একটা পাথরের উপর ওকে বসিয়ে দিয়ে কোমর জড়িয়ে রাখে। যেন পিছলে পড়ে না যায়। উপর থেকে ঝর্ণার জলরাশি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওদের। এই এখানে আসতে কত কষ্ট করল, কত ক্লান্তি সব এক নিমিষেই চলে গেল। প্রকৃতি কত সুন্দর ভাবে ওদের আগলে রেখেছে তার অপরুপ সৌন্দর্য দিয়ে।

অথৈ নিচে নামে। দুজন দুজন কে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। পাগলামি, বাচ্চামি, দুষ্টুমি সব এক সাথে শুরু হয়ে যায়। অনেক্ষণ এভাবে থাকার পর দুজনেই হাপিয়ে যায়। বসে থেকে চারপাশ দেখে। কিছু প্রেমকথন হতে থাকে। এমন পরিবেশে রোমান্টিকা তো আসবেই।

“আমাকে এই পৃথিবীর সুন্দর জায়গাটা দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নিবিড়। ”

নিবিড় ভ্রু উচিয়ে তাকায়।
“এই, বর কে কারা ধন্যবাদ দেয় শুনি? ”
“উম্ম, কেউ না দিক। আমার দিতে ইচ্ছে করল। অবশ্যই দেওয়া উচিত। ”
“আচ্ছা, তবে আরও অনেক অনেক সুন্দর দৃশ্য আছে। সেগুলো এখনো আপনার দেখা বাকি। বুঝলেন বউ? ”

“ইশ! কিভাবে বলে। ”
“লজ্জা পেলে বুঝি? ”
“যাও তো। ”
“এরপর তোমাকে আরও অনেক সুন্দর জায়গায় নিয়ে ঘুরব। তোমার যেখানে ইচ্ছে করবে নিয়ে যাব। ”
“পরের বার ট্যুরে তবে কাব্য ভাইয়াদের ও যেতে হবে। ”
“হ্যাঁ, সবাই মিলে যাব তো। একদম হৈহৈ করতে করতে যাব। ”

এই সুন্দর মুহুর্তটা ওরা আরও অনেক্ষণ উপভোগ করে। যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও যেতে তো হবেই।

পৃথিবীর আলো এখানে খুব কমই পড়ে বলে মনে হয়। বিকেল হতে হতে আলো যেন বিদায় জানাতে থাকলো ঝর্ণার উপর থেকে। পাহাড়ের দেয়াল আটকে দিচ্ছে সূর্যের আলোকরশ্মি।

আলোর আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগেই এই দীর্ঘ ঝর্ণাকে পেছনে ফেলে রওনা হলো ওদের নিজেদের গন্তব্যে।
_____
রাত বেড়েছে। নিবিড় বাইরে থেকে একটা ফানুস কিনে নিয়ে এসেছিল। দুজনে বারান্দায় চলে যায়। ফানুস উড়িয়ে দেয় এক সাথে। নিস্তব্ধ পাহাড়ের মাঝে দুটো মানব-মানবী। ফানুসের হলুদ আলোয় অথৈ কে তখন দেখাচ্ছিল ভীষণ আবেদনময়ী। ওরা আকাশে ফানুস উড়ে যাওয়া দেখে। আশেপাশের পাহাড়, আকাশ, মেঘ ওদের দেখে। এখানে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে ওরা মেঘের উপর চলে এসেছে। মেঘের দেশে ভাসছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর এই সময়গুলো। গোটা জীবনে এমন এক জায়গায় একবার আসলে সৃষ্টিকর্তার কাছে আরও একটা দিন বেশি বাঁচার প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করবে।

এখানে আসার পর থেকেই ওদের ফোন বন্ধ করা ছিল। দুজনেই চেয়েছিল যান্ত্রিক জীবন থেকে বেরিয়ে শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথে মিশে দুজন নীরবে সময় কাটাবে। এক জীবনে আর কি বা চাওয়ার থাকতে পারে?

সাজেকে ওদের কয়েক দিন পেরিয়ে যায়। এর মাঝে বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। আদিবাসীদের সাথে দেখা করেছে, কথা বলেছে। রুইলুই পাহাড়ের সবার গল্প শুনেছে, রিসাং ঝর্ণায় গিয়ে আরও একবার সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে। বাইরে ক্যাম্পিং করে বারবিকিউ করে সারারাত পার করেছে। মধুচন্দ্রিমা কে ঠিক তার মতো করেই কাটিয়েছে। নিবিড় চায়নি কোন একদিন অথৈ তাকে কিছু নিয়ে অভিযোগ করুক। যদিও সে জানে মেয়েটা কোনদিন অভিযোগ করবে না। তবুও চেয়েছে শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ওকে উপহার দেওয়ার। একজন বর হিসেবে তার বউ এর জন্য এতটুকু না করলে চলে কি?
_____
ওরা আজকে সিলেট ফিরে এসেছে। আসার সময় কল দিয়ে কাব্য, রিদ, নীল কে সবটা সাজিয়ে রাখতে বলেছে। অথৈ কে সারপ্রাইজ দেবে বলে এই দিনের জন্য কয় বছর কিভাবে অপেক্ষা করেছে সেটা শুধু নিবিড় জানে। আজকে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা। গাড়ি থেকে কিছুটা দূরের রাস্তায় ওরা নেমে যায়। নীল এগিয়ে এসেছে। বাকিরা নিবিড়ের কথামত সব কিছু রেডি করে সেখানেই অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।

নিবিড় একটা কালো কাপড়ে অথৈ এর চোখ বেঁধে দেয়। ও চুপচাপ নিবিড়ের কর্মকাণ্ড দেখছে। একটু একটু করে দুজন এগিয়ে যায় সামনের দিকে। নিবিড় অথৈ এর চোখের বাঁধন খুলে দেয়। অথৈ ধীরে চোখ খুলে সামনে তাকায়। বিষ্ময়ে হা হয়ে যায় ঠোঁট দুটো।
এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি! যেন একটা আস্ত স্বর্গরাজ্যের সামনে ও এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা সবুজ পাহাড়। দুই পাশে শিমুল গাছ। লাল রঙা ফুল ফুটে আছে। গাছের নিচে ফুল পড়ে আছে অনেক। ঠিক দুটো গাছের মাঝের ফাঁকা জায়গা একটা কাঠের বাড়ি। যেমনটা অথৈ কল্পনা করত। চারপাশে ফুলের বাগান। নিবিড় ওর হাত ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বাড়ির নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম। ‘অথৈ মহল’।

কাব্য, নীল, রিদ এবং হৈমন্তী ওর উপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়ে জোরে এক সাথে বলে ওঠে।

“তোমার অথৈ মহলে তোমাকে স্বাগতম অথৈ। ”

অথৈ এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে গিয়ে কাব্য, নীল, রিদ,হৈমন্তী কে জড়িয়ে ধরে। নিবিড় সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের এই আনন্দ। আজকে বোধহয় সব পূর্ণতা পেল। নিবিড়ের মা এখানে আসেনি। ছেলে-ছেলের বউ একান্তে সময় কাটাবে সেখানে সে কিভাবে আসবে?
নবনী এসেছে টমি কে কোলে নিয়ে।

নিবিড় নবনীর কাছে থেকে টমি কে নিয়ে অথৈ এর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে ডাকতেই অথৈ ঘুরে তাকায়।

“আমি কি আমার কথাটা রাখতে পেরেছি অথৈ? তোমার আবদার কি আমি পূরণ করতে পেরেছি? খুশি হয়েছো তুমি? সবটা তোমার মনের মতো হয়নি? ”

অথৈ কথা বলতেই পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে। নিবিড় ওকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলে।

“পাহাড় শুনছ? আমি আমার বউ কে ভীষণ ভালোবাসি। যেই ভালোবাসা তোমার সৌন্দর্যের থেকে ও স্নিগ্ধ। ”

অথৈ কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলে ওর পাগলামি দেখে। অথৈ চারপাশে ঘুরে দেখে। রুমের ভেতরে যায়। এক পাশে একটা সুন্দর বিছানা। সাদা চাদর বিছানো সেখানে। চারপাশে সাদা পর্দা দেওয়া। দক্ষিণ দিকে একটা বড় জানালা। সেই জানালা গলিয়ে বাতাস আসছে রুমের ভেতর। জানালার পাশেই বেশ কিছু ল্যাভেন্ডার কালার অর্কিড ফুল। অথৈ মুগ্ধ হয়ে চারপাশে দেখছে। দেয়ালে ঝুলছে গোল নকশা করা একটা আয়না। একটা বুকশেলফ। সেখানে কিছু বই সাজিয়ে রাখা। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ফুলের টব।

পূর্ব পাশের দেয়ালে চোখ যেতেই অথৈ আরও একবার চমকে ওঠে। সিলেট আসার পর থেকে যত ছবি তুলেছিল। সব এই দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছে। একেকটা ছবির সাথে দারুণ কিছু কথা ও লেখা।

অথৈ সবগুলো ছবি একটা একটা করে দেখতে থাকে। প্রথম ছবিটার দিকে তাকায়। অথৈ বউ সাঁজে ট্রেনের জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই ছবি কখন নিবিড় লুকিয়ে তুলেছিল ও জানতেই পারেনি। এখন দেখল।

এই ছবির পাশে লেখা, “আমার দেখা পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর একটা না হওয়া বউ। ”

অথৈ হেসে ওঠে এই লেখা দেখে। আরেকটা ছবি তে অথৈ ঝুঁকে চা পাতা তুলছে। ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।

এখানে লেখা, “এক চিলতে রোদে ভয়ানক সুন্দর হাসির এক সুন্দরী রমণী। ”

অথৈ অবাক হবার ভাষা ও হারিয়ে ফেলেছে যেন। আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অথৈ কাব্যর দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

এখানে লেখা, “একটা ঠোঁট ফোলানো বাচ্চা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাব্যর দুষ্ট হাসি। ”

অথৈ দেখল, আরও একটা সুন্দর ছবি। এই ছবিটা যখন পড়ে গিয়ে ওর কোমরে ব্যথা পেয়েছিল। ঠিক সেই সময়ের।

ছবিতে, অথৈ সোফায় বসে কাব্যর পায়ের উপর ওর দু’পা তুলে রেখেছে। নিবিড় মুখে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। রিদ হাত নাড়িয়ে কিছু বলছে।

এই ছবিতে লেখা, “আমাদের আদরের ননীর পুতুল কে যত্ন করা হচ্ছে। ”

অথৈ খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। আরেকটা ছবি দেখতে পায়। এটা তোলা হয়েছিল যখন ওরা আদিবাসীদের রাসলীলা উৎসবে গিয়েছিল।

লেখা, “আমার দেখা এক অনন্য সুন্দর আদিবাসী সাঁজ কন্যা। যাকে দেখে প্রথম আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেগে বেড়ে গিয়েছিল। যার হাসিতে আমি আরও একদিন বাঁচার ইচ্ছা রাখি। ”

অথৈ বিষ্মিত হয়, পুলকিত হয়ে যায়। এরপর আরও আরও অসংখ্য ছবি দিয়ে ভর্তি। একটা ছবি তে টমি কে কোলে নিয়ে চুমু দিচ্ছে।

সেখানে লেখা, “দুটো আদুরে বিড়ালছানা। ”

যেদিন ওদের বিয়ে হয় সেই ছবিটা ও দেখতে পায় এখানে।

লেখা ছিল, “অবশেষে না হওয়া সুন্দর বউটা আমার হয়েই গেল। ”

যখন সাজেক গেল। মেঘ ছুঁয়ে দিচ্ছিল অথৈ। সেই ছবিটা ও এখানে।

লেখা, “স্বর্গরাজ্যে আমার ব্যক্তিগত মেঘপরী। ”

অথৈ পেছনে তাকায়। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিদের চোখে ও পানি চিক চিক করছে। এদের না দেখলে বুঝতেই পারত না যে, ভালোবাসা কত রকমের সুন্দর হয়। এইযে সামনে হৈমন্তী মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ওকে তো সেভাবে দেখেনি অথৈ। তবুও মেয়েটার চোখে অথৈ নিজের জন্য একটা মায়া দেখতে পায়।

একটা জীবনে হাজার রকম ভাবে অথৈ ওদের কাছে ভালোবাসা পেয়েছে। ভালোবাসতে শিখেছে। কিভাবে আগলে রাখতে হয় সেটা জেনেছে। ভালোবাসার মানুষ কে ছেড়ে না গিয়ে অপেক্ষায় থাকতে শিখিয়েছে। আর কি চাই জীবনে? আফসোস বলতে আর কিছুই নেই। ছোট্ট জীবনে না চাইতে সব কিছু পেয়ে গেছে।

অথৈ ওদের দিকে এগিয়ে যায়। সবাই এক সাথে জড়িয়ে থাকে অনেক্ষণ।
_____
বারান্দায় একটা দোলনা রাখা ছিল। এই পাশের দেয়ালে একটা পাহাড়ের ছবি লাগানো। অথৈ দু মগ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দোলনায় বসে। এক মগ নিবিড় কে দেয়। টমি নিচে ঘুরাঘুরি করছে। চারপাশে ফুলের গাছ থেকে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। নিবিড় তাকিয়ে দেখছে অথৈ কে। শাড়িতে ওকে সুন্দর লাগে। ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি পরেছে আজ।

“নিবিড়, ”
“হ্যাঁ, বলো। ”
“এমন একটা বাড়ির খুব ইচ্ছে ছিল আমার। তুমি আমার মতো করেই বানিয়েছ। শান্তি তে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় এখানে। ”

“যেখানে তুমি থাকবে। সেখানে শান্তি তো থাকবেই অথৈ। ”
“তুমি আমার সুখ নিবিড়। ”

নিবিড় মুচকি হাসে।
“শিমুল গাছ দুটো সুন্দর লাগছে না? ”
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। আমার পছন্দের ফুল। ”
“তুমি এখানে একটু বসো। আমি দৌড়ে আসছি। ”

নিবিড় জলদি বাইরে চলে যায়। ফিরে আসে অনেকগুলো শিমুল ফুল নিয়ে। সুঁচ, সুতো নিয়ে এসে ফুল গুলো গেঁথে ফেলে। অথৈ অবাক হয়ে নিবিড় কে দেখছে।
একটু পর একটা ক্রাউন বানিয়ে ফেলে শিমুল ফুলের। তারপর সেটা অথৈ এর মাথায় পরিয়ে দেয়।

“ইশ! আমার শিমুল রাণী। ”

অথৈ জড়িয়ে ধরে নিবিড় কে। জোরে শ্বাস নেয়। বুক ভোরে নিবিড়ের শরীরের ঘ্রাণ নেয়। চোখ বন্ধ করে রাখে। নিবিড় ওর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে কপালে চুমু দেয়।

“নিবিড়, তুমি আমার। আচ্ছা? ”
“হ্যাঁ তোমারই ”
“আমায় কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখবে বলো। ”
“হুঁ, একদম। ”

“অনেক অনেক ভালোবাসবে বলো? ”
“আচ্ছা বউ, অনেক ভালবাসবো। ”
“বুকে জড়িয়ে রাখবে? ”
“এইযে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আর ছাড়ছি না। যেন বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে শান্তি পাও। ”

“আমি ঝগড়া করলে এসে চুমু খাবে? ”
“সব অভিমান ভুলে এসে কপালে, ঠোঁটে চুমু খাব। ”
“কোলে নিয়ে রুমের মধ্যে ঘুরবে? ”

“হ্যা ঘুরব তো। কোলে নিয়ে হুটহাট চুমু খাব। তুমি গলা জড়িয়ে ধরে রাখবে। তারপর তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাব আবারও কোন এক পাহাড়ে। নয়তো সমুদ্র স্নানে। ”

“বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে? ”

“হ্যাঁ মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিব। তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি তোমার সামনে একটা চেয়ার পেতে সারারাত বসে তোমার নিষ্পাপ মুখটা দেখব। ”

“উহু, বুকের মধ্যে থাকব।”
“আচ্ছা, বুকের ভেতর রাখব সারারাত। ”
“তুমি অন্য পাশে ঘুরলে। আমাকেও সেই পাশে ঘুরিয়ে বুকের মধ্যে চেপে রাখবে। ”
“আচ্ছা রাখব। সব সময় আমার বুকেই রাখব। ”

“নিবিড়, জানো তো তুমি আমার অজানা এক প্রাণোচ্ছল অনুভূতি । ”

“আর তুমি আমার দৈনন্দিন অভ্যাস। এই অভ্যাস একেবারে রক্তের সাথে মিশে আছে। ”

“ভালোবাসি বর।”
“ভালোবাসি বউ। ”
_____
রাতে নিবিড় বারান্দায় বিছানা পাতে। আজকে প্রথম ‘অথৈ মহলে’ জ্যোৎস্না বিলাস করবে ওরা। বিছানা করে অথৈ কে ডাকে। দুজনে শুয়ে থাকে সেখানে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। চাদের আলো পুরোটা বারান্দায় ঝপ করে নেমে এসেছে। টমি মাথার পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে।

ওরা দুজনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। বাইরে এখন আচমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। খানিক পরেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বাতাসের দমকে বৃষ্টির পানি এসে ওদের গায়ে পড়ছে। কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা অথৈ এর গালে এসে লাগে। নিবিড় নেশাতুর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

নিবিড় অথৈ এর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“বাইরে যাওয়ার কথা শুনলেই তুমি যেভাবে চট করে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিতে পারো।
সেভাবেই টুপ করে তুমি একটা শাড়ি পরে নেবে। তোমাকে তো যেকোন শাড়িতেই মানায়। আমিও ঝটপট একটা পাঞ্জাবি পড়ে নেব।
তারপর একদিন দুজন যেদিকে খুশি হারিয়ে যাব বন্য পাখি হয়ে। রইবে না কোন পিছুটান। তোমাতে আমি হারিয়ে যাব অজনা এক গন্তব্যে। ”

রুমে মিউজিক বাজছে হালকা ভাবে। পুরো আবহাওয়া টা রোমাঞ্চকর আবহ এনে দিয়েছে। গা কাঁপানো শিরশিরে অনুভূতি।

এর মাঝেই নিবিড়ের ফোনে টুং করে একটা ম্যাসেজের শব্দ আসে। কাব্য পাঠিয়েছে।

লিখেছে, “দোস্ত চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞাটা আর রাখতে পারলাম না বুঝলি? ভাবছি পৃথা কে বিয়েটা এবার করেই ফেলব। ”

নিবিড় ম্যাসেজ টা পড়ে প্রশান্তি তে ঠোঁট কামড়ে হাসে। অথৈ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

“শুনো অথৈ। ”
“বলো। ”
“সব স্মৃতিই তো স্মরণীয় করে রাখলাম। ‘অথৈ মহলে’ আজকের রাতটা ও না হয় ভালোবাসায় আদরে স্মরণীয় করে রাখি। ”

অথৈ লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। পর্দা ফেলে দেয় চারপাশে।

ঝুম বৃষ্টি তে চারপাশে তীব্র বর্ষণ হচ্ছে। দুটো মানব-মানবী এক আদিম লিলায় মত্ত হয়। মাতাল হয়, বেসামাল হয়। যেই এক হওয়ায় রয়েছে বৈধতা। এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রকৃতির মাঝে এই সুন্দর রাতটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। ভালোবাসার নতুন এক সূর্যদয় হবে আরও একবার। আদর আদর এক সুন্দর সকালে রমণীর ঘুম ভাঙ্গুক তার প্রিয় পুরুষের বাহুডরে। সেই সকালটা হোক শুধুমাত্র ভালোবাসার।
_____
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে