অথৈ মহল পর্ব-১৮+১৯

0
5

১৮
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকে। দিন, মাস ঘুরে আরেকটা নতুন দিনের শুরু হয় কিন্তু নিবিড়ের কাছে প্রতিটা দিনই সেই এক রকম লাগে। জীবনে কোন নতুন রং নেই, শান্তি নেই। সব কিছু এলোমেলো। মনের সাথে আর কতই বা যুদ্ধ করা যায়?

নিবিড় বেশিরভাগ সময় ক্লিনিকেই পড়ে থাকে। বাইরে থেকে মাঝে মাঝে দেখে। কোন কোন দিন ডক্টরের থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে অল্প কিছু সময় দেখার সুযোগ হয়। নিবিড় তখন শ্বাস নিতেও ভুলে যায়। এই যন্ত্রণা অন্য কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। টমি ইদানীং নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কবে থেকে ও অথৈ কে দেখে না তার হিসেব নেই। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে টমি ও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
দিন কখন কেমন যায় কে বলতে পারে।

নিবিড় নোটপ্যাডে নিয়ে বসে। লিখতে ইচ্ছে করছে কিছু। মনের ভেতর জমানো কথা লিখতে থাকে। যেই কথা গুলো অথৈ কে বলা হচ্ছে না। সেগুলো লিখে রাখে রোজ।

“আমার অথৈ,

কেন যেন আজ তোমাকে নিয়ে লিখতে হাত কাঁপছে, খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে।
হিন্দু ধর্মে সাত জন্মে বিশ্বাস করে অনেকে। কিন্তু আমরা জানি মানুষের কখনো দ্বিতীয়বার জন্ম হয় না। যদি সত্যিই কোন ভাবে এমনটা হতো। তবে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে বসে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করতাম,

হাজার বার জন্ম নিলেও আমার জীবনের প্রথম নারী হিসেবে সাক্ষাৎ টা যেন তোমার সাথেই হয়। আর কোন নারীর দেখা অথবা সাক্ষাৎ আমি চাই না। শুধু এই একটা তুমি ছাড়া।
বারবার জন্ম আমি তোমার জন্যই নিতাম।
এত অল্প তো ভালোবাসিনি যে এই একটা জন্মেই সব ফুরিয়ে যাবে? এক জন্মে বুঝি ভালোবাসা শেষ হয়?
হ্যাঁ, হয়তোবা ভালোবাসা কারও কারও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তুমি তো সেই নারীদের মতো না?
তুমি সেই মানুষ যাকে প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি অনুভব করি। এই অনুভূতিগুলো কি এতোটাই ফিকে? যার জন্য তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যাব?
ভালোবাসা বলতে আমি তোমাকেই বুঝি।
পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করে যাবো তুমি ফিরবেই। বাকি পুরো পৃথিবী আশা ছাড়লেও আমি কখনো ছাড়ব না।

এই যে প্রতি মুহূর্তে ভাবি একদিন তুমি আমার সমানে এসে দাঁড়াবে। তুমি একান্তই আমার হয়ে যাবে। সেই দিনটার জন্যই তো আমার এতো অপেক্ষা। এতো অস্থিরতা।
অপেক্ষা শব্দটা নাকি ভয়ানক।
আমি সেই ভয়ানক শব্দটাই মধুর মতো রোজ পান করি। আমি জানি তুমি একদিন আসবে। আমার জন্য আসবে।
প্রতিটা মুহূর্ত এই অপেক্ষাটা আমার ভীষণ সুন্দর মনে হয়। অপেক্ষা বলতে তো আমি তোমাকেই বুঝি অথৈ।
আমার আঙ্গিনায় একদিন বসন্ত আসবে। গাছে গাছে পাখি কিচিরমিচির করবে। হাজার রকমের ফুল ফুটবে। সেই রঙিন বসন্তটা আমি নিজের চোখে দেখবো।
এই যে এই অপেক্ষাটা? ভীষণ সুন্দর না তুমি বলো?
তুমি তো বলতে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।
তোমার বাচ্চামি আবদার আমি যত্ন করে পূরণ করব। এই অপেক্ষা গুলো কে আমি কিভাবে উপেক্ষা করি বলতো?

এই এতো আকুলতা-ব্যাকুলতা কার জন্য? কিসের জন্য? সবই তো তোমার জন্য।
এই এক জন্মে তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার ফুরাবে কিভাবে বল?
এতো সামান্য ভালোবাসিনি তো আমি?
এতো ঠুনকো ভরসা নিয়ে তোমার সাথে পথ চলার স্বপ্ন দেখিনি তো আমি?
এই ভয়ানক অপেক্ষা কে সুন্দর ভাবে রোজ সাজিয়ে তো এমনি রাখিনি?
ভালো তো এমনি এমনি বাসিনি।
তোমাকে একান্ত নিজের করে পাবো বলেই তো ভালোবেসেছি।

তুমি আমার সারাজীবনের ভালোবাসা।
এই কয়েক বছরেই ছেড়ে দেই কিভাবে বল? ”
______
৩ বছর পর___

রিদ নিবিড়ের জন্য খাবার নিয়ে আসে। নীল ও সাথেই এসেছে। আইসিইউ এর বাইরে থেকে গ্লাসের ভেতর দিয়ে অথৈ কে ওই ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন ওর বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। নিবিড় কে সেখানে না পেয়ে বাইরে খুঁজতে যায়। গিয়ে দেখে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। কাব্য ও সেখানেই দাঁড়িয়ে। নীল গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে। নিবিড় ঘুরে তাকায়।

ওর মুখটা ও কেমন যেন হয়ে গেছে। কি ছন্নছাড়া ভাব। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। কি উদ্ভট চেহারা বানিয়ে ফেলেছে এই কয়েক বছরে। অথচ একটা সময় এই ছেলেটাই ছিল সব থেকে বেশি স্মার্ট। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যথেষ্ট সচেতন ছিল। কি পরিপাটি হয়ে থাকতো সব সময়। আর এখন? মুখের দিকে তাকানোই যায় না।

রিদ ওর কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করে,
“খেয়েছিস কিছু? ”

নিবিড়ের চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলে না। কাব্য ইশারায় রিদ কে বোঝায়, ও কিছু খায়নি সকাল থেকে।

রিদ পাশে থেকে চেয়ার টেনে নিবিড় কে বসিয়ে দেয়।

“হৈমন্তী খাবার পাঠিয়েছে। চুপচাপ খেয়ে নে। মেয়েটা এত ব্যস্ততার মাঝে ও তোর জন্য সময় বের করে রান্না করেছে। আজকে যেন খাবারের বক্সে খাবার ভর্তি ফেরত না যায়। সবটা খাবি এখন। ”

হৈমন্তী রিদের স্ত্রী। গত বছর ঘরোয়া ভাবে ওদের বিয়ে হয়। যদিও নিবিড়ের এই দুঃসময়ে রিদের কোন ইচ্ছেই ছিল না বিয়ে করার। তবুও পরিবারের চাপে করতে হয়েছে। মেয়েটা অনেক ভালো। রিদের কাছে অথৈ এর গল্প শুনেছে অনেক। ওর গল্প শুনেই মায়ায় পড়ে গেছে। ওদের সব ছবি গুলো ও দেখেছে। কি হাস্যজ্বল মেয়েটা! মাঝে মাঝে হৈমন্তী ও ক্লিনিকে আসে। বাইরে থেকে অথৈ কে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। নিবিড়ের এই অবস্থা দেখতে দেখতে মিসেস রেহেনা ও অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই নিবিড়ের খাবার হৈমন্তী নিজে রোজ রান্না করে রিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

নিবিড়ের মাঝে মাঝে অবাক লাগে। ওর চারপাশের মানুষ গুলো এত ভালো কেন? এক নিমিশেই সবাই মায়ায় জড়িয়ে যায়। নাকি অথৈ মেয়েটাই বেশি মায়ার? যেখানে অথৈ থাকবে সেই জায়গায় ভালোবাসা আর মায়ায় ভর্তি থাকবে। সবাই কে নিজের অদৃশ্য মায়া দিয়েই যেন আকড়ে ধরে রাখে। এত ভালোবাসা এত টান ছেড়ে নিবিড় যাবে কোথায়?

নিবিড় কিছু বলে না আর। খাবার হাতে নেয়। খেতে নেবে তখনই বক্স টা ওর থেকে কাব্য নিয়ে নেয়। হাত ধুয়ে নিজেই নিবিড়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। ওদের সবারই চোখে পানি চলে আসে। কে জানতো এমন একটা দৃশ্য একদিন ওদের নিজের চোখে দেখতে হবে?

অল্প খাওয়ানো শেষে নীল পানির বোতল এগিয়ে দেয়।

“এভাবে থাকিস না দোস্ত। অথৈ অবশ্যই সুস্থ হবে। আমাদের এত অপেক্ষা এত যত্ন এত ভালোবাসা, প্রার্থনা সব কখনোই বৃথা যেতে পারে না। ”

নিবিড় তবুও চুপ করে থাকে। ওর এই চুপ করে থাকাটাই যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। এমন নিশ্চুপ কেন হবে সে? এটা তো মানাচ্ছে না?

নিবিড় উঠে চলে যায় অথৈ এর কাছে। হাতের উপর আলতো করে হাত রাখে। ওর হাতের কাছে মাথাটা রেখে চুপ করে থাকে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে অথৈ এর হাতের উপর পরে। নিবিড় নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।

কাব্য, রিদ, নীল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে এই কঠিন দৃশ্যটা অবলোকন করে। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ওদের নেই। অথৈ তো ওদের ও বোন ছিল। কত ভালোবাসতো মেয়েটা কে ওরা। যেন ভাইয়েদের চোখের মণি সে। একটু আঘাত লাগলেই সবাই যত্ন করতো। ভুল করলে বকতো। আবার একটু পরে মাথায় তুলে রাখতো।

ভালোবাসার মানুষ গুলো কেন যে এভাবে দূরে চলে যায়। এ যেন থেকেও নেই। চোখের সামনে আছে। নিবিড় ওকে ছুঁতে পারছে। কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছে না। মৃত মানুষের মতো। যেন প্রাণহীন একটা দেহ পড়ে আছে।

নিবিড় নিজের মনেই জিজ্ঞেস করে, কবে ফিরবে? কবে গলা জড়িয়ে ধরবে? কবেই বা সে তার বাচ্চা বাচ্চা আবদার গুলো করবে?

আরও কতশত অপেক্ষার পর আনন্দ ফিরবে ওদের জীবনে? আরও কত বসন্ত পেরিয়ে গেলে ওদের আঙ্গিনায় ফুল ফুটবে? পাখিরা গান গাইবে? কবে অথৈ খিলখিলিয়ে হাসবে? নিবিড় হাসফাস করে। মনে হচ্ছে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে।

নিবিড় ভাবতে থাকে, অথৈ কে এমন ঝাপসা লাগছে কেন ওর? এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? বুকে ব্যথা হচ্ছে। ও কি মারা যাচ্ছে? কই আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না? সব অন্ধকার। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার সব কিছু।
_____
পুরোনো স্মৃতি থেকে নিবিড় বেড়িয়ে আসে। ৪ বছর নাকি হয়ে গেছে। অথচ নিবিড়ের কাছে এটা ৪ যুগের সমান। মিসেস রেহেনা তো নিবিড়ের মা। অথৈ এর থেকে তার কাছে নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলের চিন্তায় সে এখন বিছানায় পড়ে গেছে।

রোজই তিনি বলেন, অথৈ কে ভুলে যেতে। শুধু শুধু তার ছেলে কেন অন্য মেয়ের জন্য নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করবে? তার নিজের দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের একটা ছোট্ট সংসার ছিল। ছেলে বিয়ে করবে। নাতি-নাতনি হবে। সব মিলিয়ে ঘর ভর্তি দেখবেন। অথচ এই বয়সে এসে তিনি নিজের চোখে ছেলে কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখছেন। তাই না চাইতেও মায়েদের স্বার্থপর হতে হয়। মায়েরা সন্তানের ভালো চায় সর্বদাই।

নিবিড় কারোর কথাই শোনে না। এইযে অথৈ অসুস্থ হলো। বাকি সবাই আশা ছেড়ে দিল। একমাত্র নিবিড় মনের জোর রেখে দিয়েছে। ওর বিশ্বাস অথৈ ফিরবে একদিন। সেই বিশ্বাসের জোরেই গত ২ বছর আগে একটা পাহাড় কিনেছে।
সেখানে বাড়ি করা ও শুরু করেছিল। এখন বাড়ির কাজটা সমপূর্ণ প্রায়। আজকে সেখানেই এসেছে। পাহাড়ের উপর ঝকঝকে একটা কাঠের বাড়ি। আজকে নেমপ্লেট লাগানো হয়েছে একটু আগে। ‘অথৈ মহল’ নামটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আজ। নিবিড় অপেক্ষায় আছে অথৈ কে এই চমৎকার উপহার দিয়ে চমকে দেওয়ার জন্য।

বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো বাকি। তবে আগে থেকেই এখানে দুই পাশে দুটো শিমুল গাছ ছিল। তার মাঝখানেই বাড়িটা। অথৈ এর শিমুল ফুল পছন্দ। একদিন বলেছিল এই কথা। এটা দেখেই এই পাহাড় টা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এখনো ফুল ফোটেনি। নিশ্চয় অথৈ যখন এখানে আসবে। তখন গাছে গাছে ফুলে ভর্তি থাকবে। নিবিড়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে অনেক দিন পর।

রাতের খাবার শেষে হৈমন্তী সব কিছু গোছগাছ করে রুমে আসে। এসে দেখতে পায় রিদ কিছু বাঁধাই করানো ছবি গুলোর প্যাকিং খুলছে। হৈমন্তী এগিয়ে যায়।

“কি করছো তুমি? ”
“অথৈ এবং আমাদের সবার এতদিন যেগুলো ছবি তুলেছিলাম। সেগুলো বাঁধাই করে নিয়ে এসেছি আজ। সেগুলো খুলে দেখছি কেমন হলো। ”

“দাও তো দেখি ছবি গুলো। ”

হৈমন্তী ছবিগুলোর দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে মুগ্ধতা দেখতে পায় রিদ।

“ইশ! আপুটা কি সুন্দর ছিল তাই না? ”
“হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর ছিল। ”
“নিবিড় অথৈ এর জন্য একটা বাড়ি বানিয়েছে পাহাড়ে। এই ছবি গুলো ওদের রুমে সাজিয়ে আসতে হবে। অথৈ সুস্থ হয়ে যেন পুরো একটা সুন্দর মহল দেখতে পায়। ”

“রিদ, ”
“হু, বলো। ”
“নিবিড় ভাইয়া অথৈ আপু কে অনেক ভালোবাসে। এভাবেও ভালোবাসা যায় জানতাম না। ”

রিদ হৈমন্তীর গালে হাত রাখে।
“অথৈ মেয়েটা ভালোবাসার মতোই হৈমন্তী। তুমি ওর সাথে একবেলা কাটালেই মায়ায় পড়ে যাবে। এতটা স্নিগ্ধ, কোমল মনের একটা মেয়ে। ”

“দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক সে। আমি সত্যিই তার সাথে কিছু সময় গল্প করতে চাই। সবার পছন্দের এই মানুষটা কে না দেখতে পেলে আমার জীবনে সত্যিই আফসোস থেকে যাবে রিদ। ”

রিদ শুকনো একটা হাসি দেয়। হৈমন্তী কে নিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

“তুমি ভীষণ ভালো হৈমন্তী। আমি অনেক ভালোবাসি তোমায়। এই এক জীবনে তোমাকে পাওয়া না হলে বোধহয় আমার আর কিছুই পাওয়া হতো না। কতটা বোঝ তুমি আমাকে। আমার জন্য আমার বন্ধুর এতটা খেয়াল রাখছ।
রোজ হাজার ব্যস্ততার মাঝেও রান্না করে পাঠাও। তোমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো বা সহ্য করতো না। তোমার মনটা অনেক বেশি ভালো। ”

হৈমন্তী কিছু না বলে রিদের বুকে মুখ গুজে দেয়। চোখ বন্ধ করে রিদের কথাগুলো শুনতে থাকে।

ভালোবাসার কত রুপ তা সবারই অজানা। নিবিড় একজন কে ভালোবাসে পাগল হয়ে আছে। কাব্য কে পৃথা নামের মেয়েটা এত ভালোবাসার পর ও তার কোন অনুভূতি কাজ করে না তার। নিজেকে একা রাখতেই বেশি পছন্দ করে। কোন নারীর প্রেম তাকে আটকাতে পারে না। আর নীলের তো পুরো জগত তার বন্ধুদের ঘিরেই। এইতো গত বছর নীল কে ওর বাবা বিদেশ পাঠানোর কত চেষ্টা করল। নীল গেলই না। সে তার বন্ধু কে এই অবস্থায় ফেলে যাবে এটা ভাবাও যেন অন্যায়। আর রিদ তো আছেই বন্ধুর দুঃসময়ে সময়ে খেয়াল রাখতে। অথৈ এর স্মৃতিগুলো আগলে রাখতে আর ওর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে হৈমন্তী। এক অথৈ কে কেন্দ্র করে প্রতিটা মানুষের জীবন কোথাও একটা গেঁথে আছে। সেটা সবারই জানা।

_____
কাব্য আধঘণ্টা আগেই নিবিড় কে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে ছিল গোসল করে আসতে। নিবিড় ওয়াশরুমে । তখন ওকে বার বার নীল কল দিচ্ছিল। নিবিড় রিং শুনতে পায়নি। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই শুনতে পায় ফোন বাজছে। কল ধরতে ধরতেই কেটে যায়। কল লিস্ট চেক করে দেখে নীলের ১৭ টা মিসড কল উঠে আছে। আর কাব্যর ৬ টা। হঠাৎ এতগুলো কল দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। মনে কু ডাক দেয়। অজানা ভয়ের আশঙ্কা নিয়ে কাঁপা হাতে নীলের নাম্বারে কল দেয়।

নীল কল রিসিভ করেই একটা জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“দোস্ত জলদি আয়। অথৈ এর রেসপন্স পাওয়া গেছে কিছুক্ষণ আগে ডক্টর জানিয়েছেন। ”

নিবিড় খুশি তে কি করবে বুঝতে পারে না। এত বড় সু খবর পাবে ভাবেনি এখন। আজকে পৃথিবীর সব থেকে বেশি আনন্দের দিন।

কল কেটে দৌড়ে আবার ওয়াশরুমে চলে যায়। ওযু করে দু রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। ওর মা কে গিয়ে খবরটা দেয়। মিসেস রেহেনা খুশি হয় অনেক। নবনী তো খুশিতে আরেক ধাপ এগিয়ে। সে ও তার ভাইয়ের সাথে যাবে ক্লিনিকে।

ডক্টর জানিয়েছেন, এখন আর ভয়ের কোন আশঙ্কা নেই। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এমন একটা মিরাকল হয়েছে। নয়তো এমন পেশেন্ট এত জলদি কোমা থেকে ফিরে আসে না। আর অল্প কিছুদিন ওকে অবজারভেশনে রাখতে হবে। তারপর বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। সময় মতো ঔষধ খাওয়ালে আর যত্ন নিলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।

নিবিড়ের কাছে সব কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। অথৈ কে এখন সে সব সময় নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবে। এই আনন্দটা সে কোথায় রাখবে?

ওকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। নিবিড় টমি কে সাথে নিয়ে এসেছে। এতদিন ধরে টমি দেখতে পায়নি ওকে। আজকে দেখানোর অনুমতি পেয়েছে। টমি কে কোলে নিয়ে অথৈ এর পাশে বসে। টমি খুশি প্রকাশ করছে লেজ নাড়িয়ে। মিউ মিউ করছে। ওর কাছে যাওয়ার জন্য নড়াচড়া করছে শুধু। নিবিড় ধরে রেখেছে। অথৈ হাত দিয়ে ইশারায় নিবিড় কে কাছে ডাকে। নিবিড় একটু এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে চুমু খায়। টমির একটা পা অথৈ এর পেটের কাছে রাখে হালকা করে। টমি কে শান্ত করার চেষ্টা।

“গত ৪ বছরের গল্পটা ছোট ছিল না অথৈ। এই দিনের জন্য প্রতি ন্যানো সেকেন্ড আমি অপেক্ষা করে গেছি। তুমি ফিরবে বলে। তোমাকে ফিরতেই হতো। আমার এই পাগলামি করা মানুষটা ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচি বলো তো? সুস্থ হয়ে যাও। আগলে রাখব কলিজার ভেতর। ”

নিবিড় টমি কে নিয়ে বেড়িয়ে আসার পর নীল আর নবনী ভেতরে যায়। বেশি মানুষ এক সাথে যেতে নিষেধ করেছে। নবনী দাঁড়িয়ে থেকে শুধু দেখে। অথৈ এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। নীল আলতো করে ওর হাতের উপর হাত রাখে।

“তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো অথৈ। আমি অনেক গুলো সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দেব তোমার। একদিন দুপুরের গরম ভাতের সাথে তোমায় পাতিচখা ভর্তা বানিয়ে খাওয়াব। ”

অথৈ হাসার চেষ্টা করে। কতদিন পর যেন সে প্রাণ ফিরে পেল। কাছের মানুষ গুলো কে দেখতে পাচ্ছে।

একটু পর রিদ আর হৈমন্তী আসে। অথৈ তো হৈমন্তী কে চেনে না। রিদ কথা বলে।

“কেমন আছো অথৈ? ”

অথৈ কথা বলার চেষ্টা করে। রিদ থামিয়ে দেয়।

“এই কথা বলার দরকার নেই এখন। আজকে আমরা বলি। তুমি শুনবে। পুরোপুরি সুস্থ হলে অনেক কথা বলবে। তখন আমরা সবাই শুনব। এইযে আমার পাশের মেয়েটা কে দেখছ। ওর নাম হৈমন্তী। আমার বউ। মন খারাপ করবে না কিন্তু তুমি। আমি বিয়ে করতে চাইনি। জোর করে করিয়েছে। তুমি সুস্থ হলে সেসব গল্প হবে। রাগ করবে না আমার উপর। এইযে দেখ কানে ধরলাম। ”

অথৈ শুধু খুশিতে কেঁদেই যাচ্ছে। এই মানুষগুলো তাকে এত কেন ভালোবাসে? হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে খুশি হয় ওদের এক সাথে দেখে।

ওরা বেড়িয়ে গেলে কাব্য একাই ভেতরে আসে। হাঁটু মুড়িয়ে ফ্লোরেই বসে। অথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“তুই জানিস? তুই আমার ছোট্ট কবুতর ছানা। সেই যে প্রথম যেদিন দেখলাম। কাছে এসে বললি, তোমার চোখে কি জ্বলছে ভাইয়া? আরও বরফ নিয়ে আসব কি?

আমি সেদিনই তোর মাঝে এক কোমল মেয়ে দেখেছিলাম। আমার আদরের বোন তুই। একবার সুস্থ হয়ে ফিরে আয়। আমরা আবার ঘুরতে যাব। তুই যা বলবি সব শুনব। যেখানে যেতে চাইবি সেখানেই নিয়ে যাব। পুরো একটা পৃথিবী তোকে এনে দেব অথৈ। ”

কাব্য এতটুকু বলে থেমে যায়। ওর চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। অথৈ ও নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
এতগুলো ভালোবাসার মানুষ কে ফেলে অথৈ কিভাবে চলে যেত? ওকে তো ফিরতেই হতো। এ যেন নতুন এক জন্ম। নতুন এক ভালোবাসার জন্ম। নতুন করে ফিরা আসার এক গল্প।
_____
চলবে

১৯
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ কে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়ে আসার পর বেশ কিছুদিন নিবিড় ওকে বিছানা থেকে নামতেই দেয়নি। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় ওকে ধরে নিয়ে যেত। আবার দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকত নিবিড়। দরজা অথৈ কে লক করতে ও দিত না। চাপিয়ে রাখতে বলত। নিবিড়ের ভয় লাগত, মাথা ঘুরে যদি পড়ে যায় তখন?

যতদিন না সুস্থ হয়েছে ততদিন অফিস বাদ দিয়ে বাসায় ওর সাথে থেকে ওর যত্ন নিত। বাকিরা অবাক হয়ে যেত। নিবিড় দায়িত্ববান এটা সবাই জানে। কিন্তু এতটা দায়িত্ব নিয়ে অথৈ কে এভাবে সুস্থ করে তুলবে এভাবে পাশে থাকবে সেটা কেউ ভাবেনি। এমন কি যখন অথৈ কোমায় ছিল। তখন নিবিড়ের পাগলামি দেখে নার্স, ডক্টররা ও অবাক হতো। এভাবে ও ভালোবাসা যায়? মানুষটা নিবিড় বলেই সম্ভব হয়েছিল হয়তো।

এখন বেশ ভালোই সুস্থ। টমি সারাক্ষণ ওর কোলে ওঠে বসে থাকে। অথৈ সবাই কে এভাবে এত কাছে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।

মিসেস রেহেনা ওর কাছে এসে হাত ধরে পাশেই বসেন।

“অথৈ মা আমার, ভেবেছিলাম হয়তো আর ফিরবে না তুমি। নিবিড় আমার একমাত্র ছেলে। ওর কষ্ট নিজের চোখে দেখতে পারছিলাম না। তাই ছেলেটা কে অনেক বার বলেছিলাম তোমায় ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে। কিন্তু ও তোমাকে এতটা ভালোবাসে যে কখনো আমার কথা পাত্তাই দেয়নি। তুমি আবারও আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছো। আমি অনেক শান্তি পেলাম। আমার ওই সময়ের চিন্তা ভাবনার জন্য আমি লজ্জিত মা। পারলে মাফ করে দিও আমায়। ”

মিসেস রেহেনা চশমাটা খুলে চোখের পানি মুছলেন। অথৈ তাকে জড়িয়ে ধরে।

“এভাবে বলবেন না প্লিজ। আপনি তো আমারও মা। মায়েরা সব সময় সন্তানের ভালোই চাইবে। আপনি ও তার ব্যতিক্রম নন। আমি এতে কষ্ট পাইনি। আপনি আপনার জায়গা থেকে সঠিক ছিলেন। এইযে আল্লাহ সুস্থ করে দিয়েছেন আমায়। আমরা এখন থেকে আগের মতো অনেক আনন্দে সময় কাটাব। ”

মিসেস রেহেনা খুশি হলেন ওর কথায়। মেয়েটার এই সহজ সরল দিকটা সবাই কে মুগ্ধ করে দেয়।

নিবিড় অথৈ কে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বাইরে বাতাস বইছে অনেক। অথৈ এর চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দুজনেই শান্ত পরিবেশে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর এভাবে এক সাথে। ৪টা বছর! ভাবতেই গা কেঁপে ওঠে। বাড়ির আশেপাশে থেকে কিছু পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে।
আচমকা অথৈ নিবিড়ের দিকে ঘুরে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হু হু করে কেঁদে ওঠে। এ যেন নতুন ভাবে পাওয়া। ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে ফেলার পর আবার পাওয়াটা ভীষণ ভাগ্যের। নিবিড় ও শক্ত করে ওকে জড়িয়ে রাখে
ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে আবার।

“এত কেন ভালোবাসলে নিবিড়? ”
“তুমি আমার অভ্যাস হয়েছিলে অথৈ। মানুষ সব ছাড়লেও অভ্যাস কখনো ছাড়তে পারে না। আর যদি ছাড়তেই না পারি তবে ভালো কেন কম বাসব বলতো? ”

“সব পুরুষ যদি তোমার মতো হত! ”
“তোমার মতো নারী যে পাবে সে ও আমার মতোই পুরুষ হবে। দুদিকে না মিললে কিভাবে হয় বল? ”

“আমার প্রতিটা লোমকূপ জানে তোমায় কতটা ভালোবাসি। ”
“আর আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত জানে তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অপূর্ণ। ”

নিবিড়ের কিছু একটা মনে হতেই অথৈ কে হাত ধরে নিয়ে যায় সামনের দিকে। ওর মায়ের রুমের সামনে যেয়ে ডাকতে থাকে। মিসেস রেহেনা উঠে এসে দরজা খোলেন। দুজন কে এভাবে হঠাৎ আসতে দেখে চমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলেনেন।

“কি হয়েছে বাবা? কিছু বলবে? ”

নিবিড় কিছুক্ষণ বোকার মতো মাথা চলকায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা নিচু করে বলে,

“মা, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই এখনি। বিয়ে করিয়ে দাও। ”

মিসেস রেহেনা ছেলের এমন কথায় ঠোঁট টিপে হাসেন। অথৈ ও আচমকা এমন কিছু আশা করেনি। প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও এখন লজ্জা পাচ্ছে। নিবিড় এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে।

মিসেস রেহেনা একটু কড়া করে বলেন,
“দুজন যে যার রুমে যাও এখন। ”
_____
এখন রাত ২টা বাজে। এক ঘন্টা আগেই ওদের বিয়ে হয়েছে। কাব্যদের কল করার সাথে সাথেই ওরা সবাই চলে এসেছিল। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদ ও এসেছিলেন।

এখন ওরা দুজন ছাদে গল্প করছে। ঠিক গল্প নয়। এই মুহূর্তে দুজন রাতের আকাশ দেখছে। রাতের নিস্তব্ধতা, নক্ষত্র, একাকী চাঁদ, রাতের পাহাড় সব কিছু অদ্ভুত মোহময় লাগছে যেন।

“অথৈ ”
“বলো। ”
“বাইরে যাবে? ”
“নিয়ে যাবে? ”
“যাওয়া যায়। ”

নিবিড় অথৈ কে টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকে।

“এই পড়ে যাব তো আমি। ”
“ইশ! যেন আজ প্রথম কোলে নিচ্ছি। ”
“ছাদে থেকে কোলে নিয়ে বাসার বাইরে পর্যন্ত যাবে। ভারি লাগে না? ”
“তোমার যেই ওজন! ছোট্ট একটা পুতুল। এক চুটকিতেও তো তোমাকে তুলে নেওয়া যায়। ”

অথৈ চোখ ছোট ছোট করে নিবিড়ের দিকে তাকায়।
“এটা প্রশংসা ছিল নাকি তিরস্কার? ”

নিবিড় ওর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে আসার সময় কাব্যরা পাশের রুমের বারান্দা থেকে ওদের দুজন কে এভাবে দেখে জোরে শিস বাজাতে থাকে। অথৈ লজ্জায় নিবিড়ের বুকের সাথে মিশে যায় একেবারে। নিবিড় উপরে একবার ওদের দিকে তাকায়। তারপর মুচকি হেসে চলে যায়।

বাইরে যেয়ে নিবিড় ওকে কোল থেকে নামিয়ে নিচে বসিয়ে দেয়। নিবিড় ও বসে। অথৈ এসে নিবিড়ের কোল ঘেঁষে বসে। কি সব পোকা দূরে থেকে অদ্ভুত ভাবে ডাকাডাকি করছে। এখন আর আগের মতো তেমন জোনাকি পোকা দেখা যায় না। তবুও আজ দুয়েক টা করে আশেপাশে জোনাকি পোকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি কিছু প্রাণী নিচের ঝোঁপের মাঝে নড়াচড়া করছে। সেই শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।

অথৈ নিবিড়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। নিবিড় চুপচাপ অনুভব করছে আজকের এই সময়টা। কিভাবে কিভাবে অথৈ কে নিজের করে এতটা কাছে পেল। সবটা ভাবতে গেলে মাথার তালগোল পাকিয়ে যায়। জীবনের এই প্রাপ্তিটা অন্য রকম শান্তির।
নিবিড় নিচের দিকে ঝুঁকে অথৈ এর গালে একটা চুমু দেয়। ও কিছু বলে না। নিবিড় কে আরও গাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরে। ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যাচ্ছে। আজ চাঁদ গোল থালার মতো দেখা যাচ্ছে। আশেপাশের সব কিছু চাঁদের আলোয় আলোকিত।

এই আলোতে অথৈ কে কি যে মায়াবী লাগছে বলার ভাষা নেই নিবিড়ের। ওর বড় চুল গুলো আজ হৈমন্তী সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে দিয়েছে। চুলে আবার বেলি ফুলের গাজরা পরিয়ে দিয়েছে। সেই ফুলের ঘ্রাণ আর অথৈ এর চুলের ঘ্রাণ দুটো এক সাথে মিশে এক অন্য রকম নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। সেই নেশা কিভাবে নিবিড় কে আসক্ত না করে থাকতে পারে?

নিবিড় ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অথৈ মৃদু কেঁপে ওঠে। বাতাস বইছে খানিক জোরে।

“অথৈ? ”
“হু, ”
“আমি যে বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। ”
“হয়ে যাও। বারণ করেছে কে? ”
“তুমি চাও? ”
“বাঁধা দেওয়ার মতো কোন কারণ আছে বুঝি? তোমার ভালোবাসাময় গভীর আদরে আমি পাগল হবো, বেহুশ হবো, বেসামাল হবো। তোমার স্পর্শগুলো আমার লাগবেই এবার। ”
“এভাবে বলতে নেই। সামলাতে কষ্ট হবে। ”

অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নিবিড় ভ্রু উচিয়ে তাকিয়ে থাকে।

“সমস্যা কি হুঁ? হাসছো কেন শুনি? ”
“আমার ইচ্ছে। ”
“আচ্ছা, তুমি মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাও বলো। ”

অথৈ একটু ও সময় না নিয়ে বলে দেয়,
“সাজেক ভ্যালি যাব। মেঘ ছুঁয়ে দেখব। আমার ভীষণ ইচ্ছে মেঘ ছোঁয়ার। ”
“আচ্ছা, যাব। ”
“সত্যি নিয়ে যাবে? ”
“আমার বউ একটা আবদার করেছে। আমি পূরণ করব না সেটা? পুরো পৃথিবী এক করে দেব তোমার আবদার রাখতে। ”

“এহ! আসলেই? ”
“কোন সন্দেহ আছে কি? ”
“উঁহু। ”

“বছর খানেক আগে একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে কি তোমার?
ওই যে বললাম, তোমার আমার একটা অন্যরকম বাসর সাজানোর ইচ্ছে হয়। কিছুটা ব্যতিক্রম। ওইযে তুমি বলতে পাহাড়ে একটা বড়ি হবে। বাড়ির নাম হবে “অথৈ মহল”। দেখা গেল সত্যি সত্যি নতুন করে বাসর সাজেকে করব। যত রোমান্স আদর সব ওখানে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরব, বৃষ্টিতে ভিজব, ঝর্ণা স্নান শেষে আমরা ফিরব আমাদের অথৈ মহলে। ”

হঠাৎ করে এই কথাটা শুনে অথৈ বিষ্মিত হয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের দিকে। কথা বলতে ও ভুলে যায় যেন। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নেয়।

“নিবিড় তোমার মনে আছে অথৈ মহলের কথা! ”
“মনে থাকবে না? আমার বউয়ের ইচ্ছে বলে কথা। ”

“কিন্তু সাজেক গিয়ে থাকব তো অল্প কিছুদিন। এর মাঝে বাড়ি কিভাবে হবে? ”
“আমি বলেছি না? তুমি চাইলে সব হবে। ”
“ম্যাজিক করে? ”

“দরকার পরলে আলাদিনের দৈত্য কে ধরে নিয়ে আসব। দৈত্য এসেই বলবে, ‘হুকুম করুন মালিক। ‘
আমি তখন ভাব নিয়ে বলব, আমার বউয়ের জন্য একটা অথৈ মহল বানিয়ে দাও। দৈত্য চট করে তখন বানিয়ে দেবে। দারুন হবে না ব্যপারটা? ”

অথৈ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে এতক্ষণ নিবিড়ের বলা কথাগুলো শুনছিল। ওর কথা শেষ হতেই হাসতে হাসতে ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ে। হাসিতে ওর শরীর কাঁপছে। ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। যেভাবে অষ্টাদশী তরুণী নতুন চুড়ি পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে হেঁটে বেড়ায়।
নিবিড় তাকিয়ে দেখতে থাকে। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর রমণী তার স্ত্রী। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
_____
ওরা সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। অথৈ টমি কে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা নিয়ে আসতে দেয়নি। টমি এখন কাব্যর সাথে আছে।

সাজেক ১৮০০ ফুট উচুতে, চিটাগাং হতে ১১৪ কি.মি. খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে প্রায় ৭০ কি.মি. দূরে সাজেক। রাঙামাটি জেলায়। পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তা, আঁকাবাঁকা, শেষ তিন কি.মি. রাস্তা সোজা ৪৫ ডিগ্রি হয়ে উঠে গেছে। সেই সাথে বিপজ্জনক বাঁক। তবে রাস্তা ভালো।

চমৎকার রিসোর্ট হলো সর্বাধিক উচ্চতায় আবস্থিত ‘রক প্যরাডাইছ’। এই পুরো ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে নিবিড়ের বন্ধুরা সবাই। আগে থেকে ওরা যোগযোগ করে রেখেছিল তাই রুম পেতে সুবিধা হয়েছে ওদের। আর এখানে নিবিড়ের পরিচিত কিছু লোকজন আছে।

সাজেকে আসার পথে অথৈ শুধু সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। এত মনোমুগ্ধকর জায়গায় না আসলে বুঝতেই পারতো না বাংলাদেশ ও এত সুন্দর হতে পারে।

জার্নিতে যতটা ক্লান্ত লাগছিল রুমে ঢুকে ওদের সব ক্লান্তি চলে গেছে। আশেপাশের জায়গা তো এমনিতেই সুন্দর। তার উপর রুমটা এত সুন্দর ডেকোরেশন করা থাকবে সেটা নিবিড় ভাবেনি। এটাও তার বন্ধুদেরই কাজ। নিশ্চয় বলে রেখেছিল স্পেশাল ভাবে ওদের জন্য রুমটা ফুল দিয়ে সাজাতে। অথৈ এর আফসোস হচ্ছে। এত সুন্দর বিছানায় ঘুমাবে কিভাবে?

নিবিড় অথৈ এর দিকে আড়চোখে তাকায়। ও লজ্জা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই তাড়াহুড়ো করে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। নিবিড় হাসতে থাকে ওর এই লজ্জা পাওয়া দেখে।

দীর্ঘ জার্নিতে শরীরে ধুলাবালি লেগেছিল হালকা। ঘামে ভিজে গিয়ে আবার শুকিয়ে ও গিয়েছে। শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে। তাই বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার নেয়।

টাওয়েল দিয়ে চুল পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিবিড় হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অথৈ ঠোঁট টিপে হাসে। চুল মুছে টাওয়েল টা নিবিড়ের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে।

“অনেক দেখেছেন জনাব। এবার ঝটপট শাওয়ার নিয়ে আসেন। নয়তো মধুচন্দ্রিমায় এসে অসুস্থ হয়ে হাঁচি-খাশি দিতে দিতে আপনার সব আনন্দ ফুস হয়ে যাবে বুঝলেন? ”

“আরে বাহ! তুমি দেখি সত্যি কারের বউ হয়ে গেলে। বউ টাইপ কথা বলছ খুব। ”
“যাবে তুমি? ”
“আরে যাচ্ছি যাচ্ছি। ”

নিবিড় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে, অথৈ সুন্দর একটা কালো ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি পরে চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে রেখে চোখে কাজল দিচ্ছে। নিবিড় চুল মুছে ভেজা টাওয়েল টা ওমনি ছোফায় রেখে দেয়। ব্যাগ থেকে একটা সাদা টি-শার্ট বের করে পরে নেয়। ও ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখ বার বার অথৈ এর দিকে চলে যাচ্ছে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে। আয়নার দিকে দুজনেই তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়ছে। অথৈ এর ঘাড়ে নিবিড় থুতনি রেখে ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।

“আজকে শাড়ি পরলে যে? ”
“কেন পরা যাবে না বুঝি? ”
“যাবে তো। কিন্তু আমার হাসফাস লাগে। ”

অথৈ নিবিড়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রাখে।

“সারা অঙ্গে শাড়ি জড়িয়ে আমার বিধ্বংসী চাহনিতে তোমাকে এলোমেলো করে দেব, বেসামাল করে দেব। আমি চাই এই ঝড় থেমে না যাক। আমার শাড়ির আঁচলের ভাঁজে তোমার জন্য প্রেম লুকিয়ে রাখি। প্রতিটা কুচি তে তোমার স্পর্শ কামনা করি। এই আমি শাড়িতে তোমায় মায়ায় রাখি বুঝলে? ভালোবাসি। ”

নিবিড় আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়। শরীর রিতিমত কাঁপছে। তখনই দরজায় নক করে কেও। নিবিড় বিরক্তি তে কপাল কুঁচকে ফেলে। ওকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে দেখে খাবার নিয়ে এসেছে। এত কিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিল ওদের ক্ষিদের কথা।

নিবিড় খাবার নিয়ে দরজা লক করে দিল। খাবার দেখে নেয়। ভাত, ডাল, ব্যাম্বো চিকেন, খরগোশের মাংস। এতটা জার্নির পর এমন লোভনীয় খাবার দেখে পেটের ক্ষিদেরা এতক্ষণে জানান দিতে লাগল।

অথৈ এসে পাশে বসে দুজনের প্লেটে খাবার সাজিয়ে নেয়। দুজনেই সময় নিয়ে আয়েশ করে দুপুরের খাবার শেষ করল। যদিও বিকেল হয়ে গেছে প্রায়।

খাওয়া শেষ করে নিবিড় বিছানার উপর ছড়ানো ফুলগুলো ঝেড়ে নিচে এক পাশে রেখে দেয়। অথৈ কে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। শরীরে এখনো ক্লান্তি বোধ করছে অনেকটা। আর খাবার খেয়ে ঘুম ও পাচ্ছে অনেক। নিবিড় অথৈ এর চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে যায়।

সন্ধ্যায় নিবিড়ের ঘুম ভাঙ্গে। অথৈ এখনো ওর বুকের মাঝে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুখের উপর চুল এসে পড়েছে। আলতো করে নিবিড় চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দেয়। ও নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। নিবিড়ের আর ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করে না। আবার ওকে রেখে উঠতে ও ইচ্ছে করে না। চুপচাপ ওভাবেই জড়িয়ে শুয়ে থাকে। ওর চুল থেকে এখনো সুন্দর একটা ঘ্রাণ আসছে। ওর শরীর থেকে ও অদ্ভুত এক ঘ্রাণ আসছে। অথৈ পারফিউম দেয়নি আজ। নিবিড় জানে সেটা। তবে এই সুন্দর ঘ্রাণ টা কিসের?

ভাবতে ভাবতেই হুমায়ূন আহমেদ এর একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, প্রত্যেক টা মেয়ের শরীরে নির্দিষ্ট একটা ঘ্রাণ থাকে। ফুলের মতো। একেক জনের শরীরের ঘ্রাণ একেক রকম।

হয়তো তেমন ভাবেই অথৈ এর শরীর থেকে ও সেই ঘ্রাণ টা আসছে। অনেকটা কামিনী ফুলের মতো। নিবিড় জোরে একটা শ্বাস নেয়। সুন্দর ঘ্রাণটা তীব্র ভাবে বাড়তে থাকে। আবারও আচ্ছন্ন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

খানিক পরেই অথৈ এর ঘুম ভেঙে যায়। দুহাতে চোখ কচলায়। দেখতে পায় এখনো ও নিবিড়ের বাহুতে আকড়ে শুয়ে আছে। মুচকি হাসি দিয়ে ওঠে পড়ে বিছানা থেকে।

রাত ৮ টা বাজে প্রায়। ওদের দুজনেরই কফি পছন্দ। অথৈ তাই মনে করে ব্যাগ ভর্তি করে কফি বানানোর জন্য সব কিছু নিয়ে এসেছে আসার সময়। নিবিড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। অথৈ চট করে এক মগ কফি বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ওরা মুগ্ধ হয়ে রাতের দৃশ্য দেখে। এক মগ কফিতেই দুজনে চুমুক দেয়। গল্প করতে থাকে অনেক। কথার ফুলঝুড়ি যেন শেষ হয় না।

সুন্দর জায়গা, চারপাশে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, বাতাসের এলোমেলো হাওয়া, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পাশে সুন্দরী বউ। সব মিলিয়ে এক অপরুপ জাগতিক মোহাচ্ছন্ন প্রেমময় সুখানুভূতি। ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখার মত একটা মুহূর্ত। এমন সুখ কয়জন পায়।
ভালোবাসা মাখানো আরও এক রাত সাক্ষী হয়ে থাকুক আজকের এই গভীর মুহূর্তের। বাতাসের তান্ডব বেড়ে চলেছে। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় কিছু সময়ের মধ্যেই। প্রকৃতি ও চাইছে আজকের রাতটা স্মরনীয় হোক নতুন ভাবে। ভালোবাসার ছন্দে কাব্য গাঁথা হোক আরও একবার। মিশে যাক দুটো মন, শরীর, আত্মা।
_____
নিবিড়ের ফোনে এলার্ম বাজতে থাকে। এখন ভোর ৬ টা বাজে। নিবিড় উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে যায়। অথৈ কে ডাকতে থাকে। ও ঘুম কাতুরে খুব। চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। তার মধ্যে গতকাল জার্নি করে এসেছে। রাতে ঘুম ও হয়নি ঠিক ভাবে। যার ফলে এখন ওর ঘুম ভাঙ্গাতে নিবিড় কে কষ্ট করতেই হবে। আরও কিছু সময় ডাকতে থাকে।

“এই অথৈ, ওঠে পড়ো জলদি। ”

অথৈ ঘুমের মাঝে কিছু একটা বলে আবার ঘুমিয়ে যায়। নিবিড় আবারও ডাকে।

“আরে এখন না উঠলে বিশাল একটা জিনিস মিস করে ফেলবে। ”
“পরে দেখব। ”
“পরে আর পাবে না। উঠো। ”

অথৈ কে টেনে তুলে বসিয়ে দেয়। পানি নিয়ে এসে ওর মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দেয়। এতক্ষণে অনেকটা ঘুম চলে যায়।
চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। কথা বলতেই যেন ভুলে যায়। বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। কয়েকটা ঢোক চেপে নিবিড়ের দিকে তাকায়। নিবিড় হাসছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ওর পায়ের কাছে তুলোর মত এক গুচ্ছ মেঘ ভাসছে। রুমের চারপাশে তাকায়। আরও কয়েক জায়গা মেঘ ভাসছে। বুঝতে পারে বারান্দা দিয়ে মেঘ ভেসে রুমের মধ্যে চলে এসেছে।

অথৈ নিবিড়ের হাত চেপে ধরে।
“নিবিড় এটা কি সত্যি? ”
“সব সত্যি। ”
“আমি কি মেঘ ছুঁতে পারব? ”
“পারবে। ”

অথৈ এগিয়ে যায়। মেঘ ছুঁয়ে দিতেই পানি হয়ে ওর হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। ওর সে কি খুশি!
নিবিড় ফোন নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে রাখে এই মুহূর্তের। এই ছবিগুলোই এক সময় ওদের জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
অথৈ নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে।

“পৃথিবীটা এখানেই থেমে যাক নিবিড়। আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এমন দিন আসবে। দুঃখ দিয়ে ভরা ছিল আমার আগের সেই জীবনটা। চারপাশে শান্তিতে শ্বাস নিতে পারিনি কখনো। দমবন্ধ লাগত। ভাগ্যিস সেদিন পালিয়ে ছিলাম। নয়তো তোমার দেখা আমি কিভাবে পেতাম বলো? আমার গর্ব হচ্ছে জানো তো? আমার একটা নিবিড় আছে। যে আমার সমস্ত আবদার হাসি মুখে পূরণ করে। সেটা ছোট হোক বা বড়। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, পৃথিবী শুনছো? আমার একটা নিবিড় আছে। ”

নিবিড় ওকে বুকে চেপে ধরে রাখে শক্ত করে। দুজনেরই চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে।

“অথৈ, কোনদিন ভাবিনি আমিও কাউকে এভাবে ভালোবাসতে পারব। এই বাচ্চা মেয়েটা আমার মনের এতটা জুড়ে নিয়ে বসে থাকবে সেটা আমি কোনদিন কল্পনাই করিনি। চোখ বন্ধ করলেও তোমায় দেখি। তুমি এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হলে আমি যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যাই। আমার পৃথিবী এলোমেলো লাগে। যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে আগলে রাখতে চাই। এক বিন্দু কষ্ট তোমার হতে দেব না। এইযে তিনবার কবুল বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এই হাত আমৃত্যু ধরে রাখব। তোমার প্রতিটা ইচ্ছে পূরণ করতে আমার পুরো জীবনটা দিয়ে দেব অথৈ। পুরো পৃথিবী কে দেখিয়ে দেব, এভাবে ও ভালোবাসা যায়। ”

এই রিসোর্টে বারান্দায় দাঁড়ালেই সূর্যদয় দেখা যায়। দুজনে দাঁড়িয়ে থেকে সূর্যদয় দেখে।

এরপর ওরা সকালের নাস্তা করে বাইরে বেড়িয়েছে। আশেপাশে ঘুরে দেখবে। এখানে আছে আদিগন্ত উচু নিচু পাহাড়, থরে থরে সাজানো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত কাল ধরে, আর মেঘেরা লুকোচুরি খেলে এরই ফাঁকে ফাঁকে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি, এই আছে এই নেই। এক পলকে গুচ্ছ মেঘ এসে ঢেকে দেয় সবকিছু। কাছের কিছুই দেখা যায় না, ভিজিয়ে দিয়ে হারিয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর আবদুর রহমানের মত বলতে ইচ্ছে হয়, এক নিঃশ্বাস নিলে আয়ু বেড়ে যায় দশ বছর। আর নিশ্বাস ছাড়লে হাজারটা অসুখ বের হরে যায়। হু হু করে বয়ে যায় বাতাস। চুপচাপ বসে কান পাতলে বাতাসের ফিসফিসানি শোনা যায়। এক কথায় নিরেট, অকৃত্তিম, অব্যবহৃত প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া যায় অল্প সময়ের জন্য হলেও। বাংলার এক স্বর্গরাজ্য যেখানে বাসবাস করা যায় মেঘের সাথে।
_____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে