১৬
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
সকাল ৯ টায় খাবার খেয়ে রিদ আর নিবিড় বেড়িয়ে পড়ে উত্তরার ৭ নাম্বার সেক্টরের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি থেমে যায় ৫ তলার এক আলিশান বাড়ির সামনে। ওরা গাড়ি থেকে নামে। নিবিড় বাড়ির নেমপ্লেটের দিকে তাকায়। বাড়ির নাম “অলিন্দিতা ম্যানসন”
জানতে পারে এটা অথৈ এর মায়ের নাম। তার নামেই এই বাড়িটা। বাসার ভেতরে ঢোকে। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদের সাথে আগেই কলে কথা হয়েছিল। উনি এগিয়ে এসে ওদের কে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসায়। কাজের লোক এসে সবাই কে চা নাস্তা দিয়ে চলে যায়।
নিবিড় প্রথমে কথা শুরু করে,
“মামা, আপনাকে কলে সংক্ষেপে মূল বিষয়টা জানিয়েছি। এখন আপনি যদি আমাকে বাকিটা জানাতেন তবে অনেক উপকার হতো। ”
“হ্যাঁ, বলব বলেই তোমাদের এই সময়ে আসতে বলেছি। আমার মিসেস বাসায় নেই। সে থাকলে হয়তো বা ভালো করে কিছু বলতে পারতাম না। ”
“ঠিক আছে। শুরু থেকে বলবেন প্লিজ। ”
“এটা তো আমার বোনের বাসা। বোনের নাম অলিন্দিতা। বাসায় ঢোকার সময় নেমপ্লেটের নামটা দেখেছো হয়তো। আমার বোনের ছিল প্রেমের বিয়ে। দুজন দুজন কে এত ভালোবাসতো যা বলার বাইরে। এই বাড়িটা করার পর তাই অথৈ এর বাবা রিয়াদ চৌধুরী আমার বোনের নাম বাড়ির নেমপ্লেটে ঝুলিয়ে দেয়। দুজনের ভীষণ মিল ছিল। একটা দিন ও কেউ আলাদা থাকতে পারত না। যাক গে, সেসব কথা। এত কিছু না বলি। আসল কথায় আসি।
অথৈ তখন খুব ছোট। ৬ বছর বয়স। একদিন বিকেলে বায়না ধরেছে আইসক্রিম খাবে। অলিন্দিতার হালকা জ্বর তখন। ফ্রিজে আইসক্রিম নেই। ওর উঠতে ও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মেয়ের জেদ। তার আইসক্রিম লাগবেই সেই সময়। ওর বাবা ও তখন বাসায় ছিল না। অফিসে ছিল।
অলিন্দিতা তখন জ্বরের শরীর নিয়েই উঠে বাইরে যায় আইসক্রিম কিনতে। শরীর টলছিল হালকা। কখন যে গাড়ি আসছে খেয়াল করেনি। ওর মাথা ঘুরে গেল সেই মুহূর্তে একটা মাইক্রো এসে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। গাড়ি টা ভয়ে আর দাঁড়ায়নি। চলে গেছে। রাস্তার কিছু মানুষ জন ধরে হসপিটালে নিয়ে যায়। আমরা সবাই জানতে পেরে তখনই চলে যাই। অথৈ এর বাবা ও অফিস থেকে চলে যায় হসপিটালে। তার অবস্থা তখন পাগল প্রায়। অলিন্দিতা কে আই সি ইউ তে রাখা হলো। দুদিন পর ডক্টর জানালো বোনটা মারা গেছে।
ওর বরের অবস্থা তখন কি বলব। একদম পাগলের মতো হয়ে গেল। কাজের মেয়ের থেকে শুনেছে মেয়েটার আইসক্রিমের আবদার রাখতেই সে গিয়েছিল। তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই কথা শোনার পর ওই ছোট বাচ্চাটা কে অনেক মারলো। রোজ সারাক্ষণ অথৈ কে ওর বাবা বকতো। বার বার বলত,
“তুই তোর মা কে খু*ন করেছিস। তোর জন্য তোর মা মারা গেছে। সব তোর দোষ। কেন করলি এমন? আমার অলিন্দিতা কে কেন মা*রলি তুই? ”
ওই ছোট বাচ্চাটা এত কঠিন কথা বুঝতো না। ও শুধু বুঝতো ওর বাবা ওকে বকছে। একা একা কাঁদতো। ওর বাবা কখনো ভালো করে কথা বলত না ওর সাথে। ওকে দেখলেই ওই কথা বলত। আমি দেখলাম অথৈ মানসিক ভাবে ভেঙে পরছে। ছোট মেয়ে কতটাই বা বোঝে। যেই বয়সে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গ দরকার ছিল। খেলাধুলার দরকার ছিল। সেই বয়সে ওকে সারাক্ষণ মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে। আমার খারাপ লাগত। তখন ওকে নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়। আমার দুটো মেয়ে ছিল। ওদের সাথে খেলতো। কিছুদিন ভালোই কাটছিল। ওর মানসিক অবস্থা ও একটু ভালোর দিকে আসছিল। কিন্তু সেখানে ও বেশিদিন ভালো থাকল না। আমার স্ত্রী ওকে সহ্য করতে পারত না। বুঝতেই পারছো সব মামিরাই তো ভালো হয় না। সে ও অথৈ কে বকাঝকা করত।
আমি আমার স্ত্রী কে কোনভাবেই শান্ত করতে পারতাম না। অথৈ এর এখানে অবস্থা আরও ভয়ানক হতে শুরু করল। তবে আমি যতক্ষণ বাসায় থাকতাম ওকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতাম। ওকে নিয়ে খেলতাম। বাইরে মাঝে মাঝে ঘুরতে নিয়ে যেতাম। এভাবেই দুই বছর কেটে গেল।
এর মধ্যেই একদিন শুনলাম অথৈ এর বাবা হঠাৎ করেই স্ট্রক করে মারা গেছেন সকালে।
আমরা ওই বাসায় গেলাম। জানাযা হলো। বাসার সামনেই অলিন্দিতার কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হলো। তারপর আমরা সবাই এই বাসায় চলে আসলাম। তখন থেকে এখানেই থাকি। ধীরে ধীরে অথৈ এই মানসিক অবস্থায় বেড়ে যেতে থাকলো। একা একা আবল-তাবল বলত। কি সব যেন শুনে বিড় বিড় করতো। তারপর কান চেপে ধরে চিৎকার করতে করতে সেন্সলেস হয়ে যেত।
ভেতরে ভেতরে ততদিনে ও শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েক বার সুই*সাইডের চেষ্টা করেছে। তারপর সাইকোলজিস্ট দেখালাম। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকল।
একদিন আমার স্ত্রীর মাথায় ভুত চাপলো। ওকে বিয়ে দিয়ে দেবে। নয়তো পরবর্তীতে মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হলে কে বিয়ে করবে সেটা নিয়ে তার চিন্তা বেড়ে গেল। বিয়ে না হলে পাগল মেয়ে কে সে ঘরে রাখবে না। অথচ আমরা কিন্তু ওদের বাসাতেই থাকি। মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ ভাবতে পারছো? যেদিন বিয়ে ঠিক হচ্ছিল। ওকে সাজানো হয়েছিল। ঠিক তখনই ও হারিয়ে গেল। কত খুঁজলাম আর পেলামই না। আমার স্ত্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ও আর আমাকে খুঁজতে দিল না। তবুও লুকিয়ে আমি খোঁজ করেছি। পুলিশে জানিয়েছিলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। যখন জানলাম তোমার কাছে ও এতটা ভালো আছে বিশ্বাস করো আমার এত ভালো লেগেছে। আমি সত্যিই আমার ভাগ্নিটা কে আমার নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য বেশি সাহস পাই না। ”
হানিফ আহমেদ কথা শেষে চোখ মুছলেন। নিবিড় হতবাক হয়ে যায় সবটা শুনে। এতটুকু তো শুধু শুনলো। না জানি মেয়েটা ছোট থেকে কতটা আঘাত পেতে পেতে বড় হয়েছে। অল্পতেই তো কারোর এত বড় মানসিক সমস্যা শুরু হয়নি। কত বছর ধরে নিজের মধ্যে এই রোগটা পুষে রেখেছে।
পরিবারের মানুষ গুলো এমন কেন? এই মৃত্যু তে আদৌ কি ওই বাচ্চা মেয়ের কোন দোষ ছিল? একটা ছোট মানুষের যা বৈশিষ্ট্য থাকে সেটা ওর মধ্যে ও ছিল। আইসক্রিমের বায়না ধরেছিল। নিয়তি ওর মায়ের মৃত্যু ওভাবেই রেখেছিল। এতে ওর তো কোন দোষ নেই। কিন্তু শাস্তি টা ওই মেয়েটাই পাচ্ছে এখনো। যার ফলস্বরূপ, সে সুন্দর একটা জীবন কখনোই পায়নি।
নিবিড় উঠে দাঁড়ালো।
“মামা আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, অথৈ কে আমি সুস্থ করে তুলবো ইন শা আল্লাহ। সুন্দর একটা জীবন ওকে আমি দেবই। আপনি দোয়া করবেন। ”
হানিফ আহমেদের খুশিতে বুক ভরে গেল। নিবিড় কে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিনের জমানো পাথরের মতো কষ্ট গুলো যেন বুক থেকে নেমে গেল।
“ভালো থেকো তোমরা। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোমাদের দেখতে আসব একদিন। ”
“জ্বি, মামা অবশ্যই আসবেন। ”
_____
অথৈ রাতের অন্ধকারে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় টমি কে নিয়ে। পেছনেই নিবিড় শব্দহীন পায়ে এগিয়ে আসে। অথৈ পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারে নিবিড় এসেছে এখানে। নিবিড়ের শরীরের স্মেলটা অথৈ এর ভীষণ পরিচিত।
ও অন্ধকারে দূরের কালচে পাহাড় গুলো দেখতে থাকে। যদিও কুয়াশায় তেমন কিছু চোখে পরছে না। ঠান্ডায় শরীর হিম হয়ে আসছে। একটু পর পর দমকা বাতাসে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাতাল করা যেন পরিবেশটা। এত সুন্দর কেন পৃথিবী? কেউ কোন কথা বলছিল না।
অথৈ নিজেই কথা শুরু করে।
“নিবিড়? ”
“হু, ”
“জানো আমার একটা স্বপ্ন আছে? ”
“কি স্বপ্ন? ”
“কোন এক জায়গায় আমার একটা উচু পাহাড় থাকবে। সেই পাহাড়ের উপর আমার একটা কাঠের বাড়ি থাকবে। ছোট্ট একটা কুড়েঘর। দুজনের সংসার হবে। একটা বিছানা থাকবে শুধু। আর প্রয়োজনীয় যতটুকু দরকার। ঠিক ততটুকুই। ঘরের দেয়াল ভর্তি আমাদের কিছু সুন্দর মুহূর্তের ছবি।
ঘর থেকে বের হলেই চারপাশে শুধু সবুজ পাহাড়ের দেখা মিলবে। বাড়ির আঙ্গিনায় বাহারি ফুলের গাছ থাকবে। ফুলের গন্ধে ভ্রমর আসবে। আমি দেখব।
উপরে নীলাকাশ। সাদা মেঘ ভেসে বেড়াবে। আমি পাখির ডানার মতো দু হাত মিলে দাঁড়িয়ে থাকবো। আকাশ, বাতাস, পৃথিবী আমায় দেখবে। আমি যেন সুখের এক অন্য সাগরে ভাসবো। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত হবে।
বলো তো আমার ইচ্ছে টা কেমন? ”
নিবিড় এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনছিল ওর কথা গুলো। যেন ও মুখস্থ করে নিচ্ছিল সব। অথৈ এর ডাকেই ওর ঘোর কাটে। এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে বলে,
“তোমার স্বপ্নটা তোমার মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ। ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
“সত্যি বলছো? ”
“হ্যাঁ, ”
“বলো তো আমার এই স্বপ্ন কি কোনদিন পূরণ হবে? ”
“ইনশাআল্লাহ একদিন হবে। ”
অথৈ চোখ বন্ধ করে প্রশান্তি তে। নিবিড় কিছু কথা বলে।
“আমি তোমার নামে একটা পাহাড় কিনব প্রমিস করলাম। সেই পাহাড়ে একটা কাঠের বাড়ি বানাবো।
যেই পাহাড়ে বসে মেঘ ছোঁয়া যায়।
মেঘের সাথে মিতালী করা যায়।
নীলাকাশ দেখা যায়।
এমন একটা পাহাড়সহ বাড়ি আমি তোমাকে দেবই ইন শা আল্লাহ।
শুধু একবার তোমাকে আমি পেয়ে নেই।
বাড়িটার নাম দেব ‘অথৈ মহল’। ”
অথৈ বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের দিকে।
“কি বলছো তুমি এসব! আমার নিজস্ব বাড়ি? নাম হবে অথৈ মহল? উফ! এত সুন্দর নাম! আমি খুশিতে বোধহয় মরেই যাব নিবিড়। ”
“আমি তোমাকে বলেছি তো তোমার ছোট থেকে বড় সব স্বপ্ন পূরণ আমি করব। পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের নিচে আমি এনে দেব যতক্ষণ আমার সামর্থ্য থাকবে। ভালো তো এমনি এমনি বাসিনি অথৈ। ভালোবেসে যদি তোমার স্বপ্নের সাথে তোমায় আগলেই না রাখতে পারি তবে প্রেমিকের খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছি কোন সাহসে বলো তো? ”
অথৈ নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে। ওর কান্না পাচ্ছে প্রচন্ড। কোনদিন কি ভেবেছিল ওর জীবনে এমন সুখ ধরা দেবে এভাবে? কখনোই তো ভাবেনি। দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী ছিল। এত সুখ তার কিভাবে সইবে? এক জীবনে এই মানুষটাই তার জন্য আশির্বাদ। নয়তো ওর সাথেই কেন আচমকা এভাবে এমন মানুষের পরিচয় হবে?
নিবিড় ঘাসের উপর বসে পড়ে। অথৈ কে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে দেয় ঘাসের উপর। টমি ও সেখানেই শুয়ে পড়ে। নিবিড় অথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মাথার উপর নক্ষত্র ভরা জ্বল জ্বল করা আকাশ। ওরা ছাড়া আশেপাশে আর কেউ নেই। নীরব এই পরিবেশে শুধু দুটো মানুষ মনে মনে কথা আদান প্রদান করে যাচ্ছে। প্রকৃতি সাক্ষী এই দুই যুগলের প্রেমের।
“অথৈ। ”
“হু? ”
“তুমি তো তোমার ইচ্ছেটা বললে। আমি এবার আমার ইচ্ছাটা বলি। শুনবে কি? ”
“উম্ম, শুনবো। ”
“তোমার আমার একটা অন্যরকম বাসর সাজানোর ইচ্ছে আছে। একটু ব্যতিক্রম। এইযে তুমি বললে পাহাড়ে একটা বাড়ি হবে। বাড়ির নাম দেব আমি ‘অথৈ মহল’। তোমার তো পাহাড়, সমুদ্র পছন্দ। দেখা গেল সত্যি সত্যি আমরা বিয়ের পর বাসর সাজেকে করব। যত রোমান্স আদর সব ওখানে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরব, বৃষ্টিতে ভিজব, সমুদ্র দর্শন শেষে আমরা ফিরব আমাদের অথৈ মহলে। দারুন হবে না ব্যাপারটা। ”
অথৈ খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। চোখ চিকচিক করে ওঠে।
“দারুন হবে মানে কি? একদম অপূর্ব হবে। ইশ! তুমি এত ভালো কেন? আমার স্বপ্ন গুলো সব চোখে ভাসছে। ওই দিন গুলো কি আমি সত্যিই দেখতে পারব নিবিড়? ”
“অবশ্যই দেখবে। আমি আছি তোমার সাথে, তোমার পাশে। আমাদের সমস্ত ভালো লাগা সব তোমার। আর তোমার সব খারাপ লাগাগুলো একান্তই আমার। ”
“না নিবিড়। আমরা সব কিছুই ভাগ করে নেব। সুখ-দুঃখ সবটা। তুমি আমি তো আলাদা না। ”
“অথৈ আরেকটা কথা বলি? ”
“বলো। ”
“আমার আল্লাহ তোমাকে খুব যত্ন করে বানিয়েছেন জানো? ”
অথৈ আর কিছু বলে না। নিবিড়ের দিকে ঘুরে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে দেয়। নিবিড় অথৈ এর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। এক সময় অথৈ ঘুমিয়ে যায়। ওর ঘুমন্ত ঘন শ্বাস ছাড়ার শব্দটা শোনা যাচ্ছে। নিবিড় চোখ বন্ধ করে রাখে। ও নিজেও ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে। অথৈ কে তুলে ওর বাহুর উপর মাথা রেখে শুইয়ে দেয়। মাথার উপর দিয়ে রাত জাগা কিছু পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেল। টমি মিউ মিউ করে নিবিড়ের বুকের উপর এসে শুয়ে থাকে।
____
চলবে
১৭
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
নবনীর পরীক্ষা শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। তাই সকালে তাড়াহুড়া করে রেডি হচ্ছিল। মিসেস রেহেনা এক গ্লাস জুস আর ওমলেট বানিয়ে নিয়ে মেয়ের সামনে রাখলেন।
“উফ! মা, খাওয়ার সময় নেই এখন। ”
“বেশি কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নে। তারপর কলেজে যা। ”
নবনী মুখ কাচুমাচু বানিয়ে সবটা খেয়ে নিল। অথৈ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।
“মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিও কেমন? ”
“আচ্ছা আপু। তুমি নিজের খেয়াল রেখ। ফিরে এসে অনেক গল্প করব কিন্তু। ”
“ঠিক আছে। ”
নবনী কলেজে চলে যায়। মিসেস রেহেনার ও আজকে ডক্টর দেখাতে যেতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরে পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে অনেক। ঔষধ খেয়ে ও কাজ হচ্ছে না। তাই নিবিড় ভেবেছে, ওর মা কে ডক্টর দেখিয়ে তারপর অফিসে চলে যাবে।
কিন্তু সমস্যা অথৈ কে নিয়ে। বাসায় ওরা কেউ থাকবে না। যদিও কয়েক দিন ধরে একটা কাজের লোক রাখা হয়েছে। তাকে বলে দিয়েছে বাসায় কেউ না থাকলে যেন অথৈ এর খেয়াল রাখে ভালো ভাবে। তবুও নিবিড়ের চিন্তা হয় ভীষণ। বাইরের লোকের উপর ভরসা করে রেখে যাওয়ার সাহস পায় না।
অথৈ কে কাছে ডাকে।
“তুমি ও চলো আমাদের সাথে। ”
“কোথায় যাব। ”
“মা কে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ও চলো। বাসায় কেউ নেই তোমার একা ভালো লাগবে না। ”
“না সমস্যা নেই। আমি থাকতে পারব। আর ডক্টরের কাছে যেতে আমার ভালো লাগে না। ”
অথৈ হালকা ঠোঁট ফুলায়। নিবিড় আর কিছু বলে না। হাত দিয়ে ওর সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো কানের পাশে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“শুনো, রিদ আর নীল অফিসের কাজে ব্যস্ত অনেক। কাব্য গিয়েছে চট্টগ্রাম। ওইযে পৃথা নামের মেয়েটা আছে না? কাব্য কে প্রায়ই ফোন করতো। ওকে পছন্দ করে। কাব্য পাত্তা দিত না। ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। দেখা যাক ওদের প্রেম-টেম হয় কি না। যেহেতু সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তাই কেউ এখন বাসায় আসতে পারবে না। তবুও নীল আর রিদ কে বলে রাখব। এর মধ্যে কেউ ফ্রি হলে চলে আসবে। তুমি চুপ করে টমির সাথে খেলবে ঠিক আছে? বাইরে একা বের হবে না। ছাদে ও যাওয়ার দরকার নেই। মৌটুসি আছে না? ওর সাথে গল্প করবে খারাপ লাগলে আচ্ছা? ”
অথৈ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। নিবিড় হালকা হেসে ওর কপালে বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে চুমু খায়। অথৈ নিবিড়ের মুখের দিকে কেমন যেন একটা মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।
“আসি অথৈ। নিজের খেয়াল রেখো। একদম দুষ্টুমি নয় কিন্তু। ”
অথৈ শুধু হাসে। ও মনে মনে ভাবে, যেন ও বাচ্চা মেয়ে। সবাই কতটা খেয়াল রাখে। মিসেস রেহেনা ও যাওয়ার সময় বার বার সাবধানে থাকতে বলে গেছেন সবাই ওকে কত্ত ভালোবাসে ভাবা যায়?
অথৈ ঘুমিয়ে গিয়েছিল শুয়ে থাকতে থাকতে। হঠাৎ স্বপ্ন দেখছে, একটা চলন্ত মাইক্রো ছুটে আসছে। ওর মা রাস্তা পার হচ্ছে। ঠিক সেই সময় মাইক্রোটা ওর মা অলিন্দিতা কে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। তারপরই একটা গগন কাঁপানো চিৎকার। তার শরীর টা রাস্তায় ছিটকে পড়ল। র*ক্ত দিয়ে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে।
অথৈ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড়ফরিয়ে উঠে বসে। বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এসির পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। কোন কাজ হচ্ছে না। তার পর পরই কানে আবার সেই শব্দ আসতে থাকে।
“তুই খু*নি। তুই খু*ন করেছিস। মরে যা তুই। বেঁচে আছিস কেন? ”
এক ভাবে এই কথাগুলো কানের কাছে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে শব্দ বেড়ে যায়। অথৈ সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতে থাকে। আশেপাশে কেউ নেই এখন। কাজের মেয়েটা ও কোথায় যেন চলে গেছে। ও মাথা চেপে ধরে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। গলা কাটা পশুর মতো ছটফট করতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণায় যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।
_____
নীলের কাজ শেষ করে নিবিড়দের বাসার উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ে। কাজ শেষেই নিবিড় যেতে বলেছিল ওদের বাসায়।
নীল বাসায় গিয়েই অথৈ কে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। পুরো বাসা খোঁজে কোথাও অথৈ কে পায় না। শেষে চলে যায় ছাদে। সেখানে ও নেই। চিন্তায় ওর শরীরে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ওরা সবাই অথৈ এর রোগ সম্পর্কে জানে। তাই না চাইতে ও মনের মধ্যে কু ডাক দিচ্ছে। কি মনে করে যেন নীল ছাদের নিচের দিকে তাকায়। তখনই চমকে যায়।
কিভাবে যে দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে বাসার উত্তর দিকে ছুটে যায়। অথৈ নিচে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। র*ক্তে নিচে ভেসে যাচ্ছে। কোন রকমে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে তুলে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘুরায়।
নিবিড় কে শুধু কল দিয়ে বলল ক্লিনিকে যেন চলে যায় দ্রুত। তারপরই কল কেটে দেয়। নিবিড় বুঝতে পারে না কার কি হয়েছে। বার বার কল দেওয়ার পর ও নীল কল ধরছে না। অগত্যা নিবিড় ওর মা কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় ক্লিনিকের দিকে।
নিবিড় পৌঁছে দেখে রিদ ও সেখানে চলে এসেছে। দৌড়ে যায় ওদের কাছে।
“এই কি হয়েছে? সবটা না বলেই কল কাটলি কেন? তোরা দুজন এই জায়গায়। কাব্যর কিছু হয়েছে? ও কোথায়? কাব্যর না আজ চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল? ”
ওরা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। নিবিড় আরও রেগে যায়।
“সমস্যা টা কি তোদের? কথা বলিস না কেন? আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি। কার কি হয়েছে বলবি প্লিজ? আঙ্কেল আন্টির কিছু হয়েছে কি? আরে ভাই, টেনশন হচ্ছে তো আমার। বোবা হয়ে গেছিস তোরা? ”
এর মাঝেই একজন নার্স আসেন।
“পেশেন্ট এর বাসার লোক না আপনারা? ওনার ৩ ব্যাগ এ+ ব্লাড লাগবে এখনি। অনেক ব্লাড চলে গেছে শরীর থেকে। প্লিজ ব্যবস্থা করুক আপনারা। হাতে বেশি সময় নেই কিন্তু। রোগীর অবস্থা বেশি ভালো না। ”
নিবিড় জিজ্ঞেস করে,
“পেশেন্ট টা কে? ”
“অথৈ জাফরিন লেখা ছিল নাম। ”
নার্সের কথা শুনে নিবিড় থমকে যায়। বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নার্সের দিকে এগিয়ে যায়।
“এগুলো কি বলছেন আপনি? ”
নার্স নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি তো অথৈ নাম লিখলেন। ”
নিবিড় কথা খুঁজে পায় না যেন। হাত-পা কাঁপছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে মনে হয়। নীলের দিকে ঘুরে তাকায়। রিদ ওকে ধরে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। তারপর শর্টকাটে ওকে সবটা বলে।
নিবিড় চুপ হয়ে যায় একদম। কাব্য গাড়িতে। ওর আসতে কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা লাগবেই। কাব্যর ব্লাড গ্রুপ এ+। আশেপাশে এখন ডোনার খুঁজতে হবে। নিবিড় কে আর যেতে দেয়নি ওরা। রিদ আর নীল আশেপাশের হসপিটালে খুঁজতে থাকে। একে ওকে ফোন করে ও খোঁজ নেয় কার ব্লাড গ্রুপ সেম হবে। কোথাও পায় না। নিবিড় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয় ব্লাড লাগবে। সেখানে একজন ছেলে কমেন্ট করেছে। তার সাথে ব্লাড গ্রুপ মিলেছে। কিন্তু ওনার বাসা অনেক দূর। তার আসতে তবুও ৩ ঘন্টা লাগবে। নিবিড় কি করবে বুঝতে পারে না আর।
এর মধ্যে ডক্টর আসেন। নিবিড় উঠে দাঁড়ায়।
“ডক্টর ও কেমন আছে? সুস্থ হবে তো? ”
“আপনি ওনার সম্পর্কে কি হন? ”
“হাসবেন্ড। ”
নিবিড় কেন এটা বলল ওর জানা নেই। হুট করেই মুখ দিয়ে এই একটা শব্দ বেড়িয়ে যায়।
“শুনুন মিস্টার, পেশেন্ট এর অবস্থা ভীষণ খারাপ। শুনেছি দোতলা থেকে লাফ দিয়েছে। এরপরেও যে উনি জীবিত আছেন এটাই শুকরিয়া। তবে মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে প্রচণ্ড। মাথার ভেতর ছোট ছোট কিছু টুকরো চলে গেছে। সেগুলো বের করতে হবে। কপাল ফেটে গেছে। নাক দিয়ে ও ব্লাড এসেছে অনেক। হাতের বিভিন্ন জায়গায় ছিলে গেছে। মানে যা তা অবস্থা। ব্রেইনে সার্জারি করাটা জরুরি। যত দ্রুত ব্লাডের ব্যবস্থা করতে পারবেন আমাদের তত তাড়াতাড়ি সবটা হয়ে যাবে। ”
“আমরা ব্লাড খুঁজছি ডক্টর। কিন্তু সার্জারি করলে কি ও সুস্থ হয়ে যাবে? ”
ডক্টর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলেন।
“দেখুন মিস্টার নিবিড়, এটা কিন্তু পুলিশ কেইস। তবুও আমি ঝামেলা করিনি। পুলিশে ও কল করিনি। শুরু থেকেই ট্রিটমেন্ট করে যাচ্ছি। এর একটা কারণ আছে। আমাদের ডক্টরদের কাছে সব পেশেন্ট একই সমান। তবে ওর ব্যাপারটা আলাদা ভাবে নিয়েছি। গত বছর আমার মেয়েটা ও সুই*সাইড করে মারা গেছে। ওর বয়সী হবে হয়তো। ওকে দেখেই আমার মেয়ের কথা মনে পড়ল। আমি পুরোপুরি চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহ জানেন। আমরা তো শুধু মাত্র অজুহাত একটা। আল্লাহ কে ডাকুন। আর ব্লাড খুঁজে বের করুন। নয়তো কিছু বলতে পারছি না। ”
১ ঘণ্টার মধ্যে দুজন ডোনার পেয়ে যায় রিদ। অথৈ কে ওটি তে নেওয়া হয়। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। নিবিড়ের মা আর বোন চলে আসেন। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদ শোনার পর তিনি ও চলে এসেছেন। কাব্য এখনো পৌঁছাতে পারেনি। একটু পর পর ও কল দিয়ে রিদের থেকে সব আপডেট নিচ্ছে। কাব্যর দূরে থেকে কিছু তেমন জানতে পারছে না। এতটুকু শুনেই ওর পাগল পাগল লাগছে। ও তো কম ভালোবাসে না অথৈ কে। নিজের ছোট বোনের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করত। কিসে ওর ভালো লাগা সব দেখত। সেই মেয়েটার এমন অবস্থা মেনে নেওয়ার মতো নয়। তবুও এই সময়েই ও পাশে নেই। পৃথার উপর রেগে যাচ্ছে। কেন আজ ওকে ডাকলো দেখা করার জন্য? আজকেই কেন? রাগ টা ঠিক কোথায় দেখাবে বুঝতে পারে না।
নিবিড় অপারেশন থিয়েটারের বাইরে চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথা বলে না। হানিফ আহমেদ এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। নিবিড় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে ওনার দিকে তাকায়। হাতটা চেপে ধরে।
“আমি পারিনি মামা। আমি ওকে আগলে রাখতে পারলাম না। ব্যর্থ আমি। ”
“এতটা ভেঙ্গে পড়ো না নিবিড়। অথৈ সুস্থ হবে দেখে নিও। আর কে বলল তুমি পারনি? ব্যর্থ কেন হবে। তুমি তোমার সাধ্য মত চেষ্টা করেছো। আল্লাহর চাওয়ার বাইরে কিছুই হয় না। নিশ্চয় এর পেছনে কোন কারণ আছে। আল্লাহ দুঃসময় দিয়েছেন। তিনিই আবার সু সময় দেবেন। বিপদে ধৈর্য রাখতে হয়। ”
মিসেস রেহেনা বসে থেকে দোয়া পড়ছেন। নবনী মায়ের পাশে বসে কাঁদছে। রিদ, নীল তখনো দাঁড়িয়ে চুপচাপ। এর মধ্যেই কাব্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।
“এই নীল, কি অবস্থা এখন? আর কত সময় লাগবে কিছু বলেছে কি? ”
“না দোস্ত। এখনো কিছু বলেনি। সার্জারি চলছে। দেখা যাক। ”
কাব্য নিবিড়ের কাছে এগিয়ে যায়। নিবিড় ওকে জড়িয়ে ধরে কিভাবে যেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। শুনেছি পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। কতটা কষ্ট পেলে তবে নিবিড় এভাবে কাঁদছে? এতক্ষণ ওর বুক ভার হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল সবাই কাছে থেকে ও নেই। বুকটা হালকা করার মতো কাউকে যেন পাচ্ছিল না। কাব্য কে পেয়ে মনে হলো এবার বোধহয় বুকের ভারি বোঝাটা কমানো যায়।
কাব্যর চোখ থেকে ও কয়েক ফোঁটা পানি বেড়িয়ে আসে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
“শান্ত হ দোস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙ্গে পরিস না তুই প্লিজ। ”
“ওকে সুস্থ করে দে না কাব্য। আমি মরে যাব সত্যি সত্যি। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব আমি? আমার কলিজা ছিঁড়ে যাবে না? আমার অথৈ কে এনে দে না ভাই। ও এমন কেন করল? আমারই দোষ। আমি কেন ওকে এভাবে রেখে গেলাম। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা। নয়তো আমার অথৈ এর তো এই অবস্থা হতো না আজ? আমি কিভাবে সহ্য করব? ”
কাব্য আর কিছু বলে না। রিদ আর নীল ও এসে ওদের দুজন কে জড়িয়ে ধরে। ৪ বন্ধুর এই করুণ দৃশ্য যেন চোখে দেখা যায় না। ভেতরটা মুচরে যাচ্ছে সবার। একটা মেয়ে সবাই কে কতটা মায়ায় ফেলে দিয়েছিল হুট করেই। কাব্য, নীল, রিদ ওদের ৩ জনের যেন একটাই বোন ছিল। আদরে মাথায় তুলে রাখার মতো। সেই মেয়েটাই এতক্ষণ ধরে চোখের আড়ালে সবার।
_____
দীর্ঘ ৫ ঘন্টা পর সার্জারি শেষ হয়। ডক্টর ওটি থেকে বেড়িয়ে আসেন। কাব্য এগিয়ে আসে।
“অপারেশন তো সাকসেসফুল হয়েছে। তবে আঘাতটা গুরুতর ছিল। আর সময় মতো ব্লাড না পাওয়ায় অপারেশন করতে বিলম্ব হয়েছে। তাই ৭২ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে পেশেন্টের কথা কিছু বলতে পারছি না। কোমায় ও চলে যেতে পারে। সব পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুন আর আল্লাহ কে ডাকুন। ”
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় এই কথা শুনে। কি বলবে ভেবে পায় না। নিবিড় পাথরের মতো হয়ে গেছে। ৭২ ঘন্টা কিভাবে কাটবে? এতটা সময়!
নিবিড় অথৈ এর কাছে থেকে এক পা ও নড়ে না। সারাক্ষণ ওর কাছেই বসে থাকে। মিসেস রেহেনা বাসায় গিয়ে রান্না করে রাখে। ওদের ৩ বন্ধুর মধ্যে যে কেউ খাবার নিয়ে এসে ওকে খাওয়ায়। রাতে ঠিক মতো ঘুমায় না। দিনে ও ঘুমায় না। মনে হয় ঘুমালে যদি ওর জ্ঞান ফেরে? তখন যদি ওর কিছু প্রয়োজন পড়ে? অথৈ তো অসুস্থ নিবিড় কে ডাকতে ও পারবে না। এই ভেবে দিন রাত জেগে থাকে। কাব্য ওর সাথেই থাকে। এই কেবিনে দুটো বেড আছে। কাব্য ওকে একটু ঘুমাতে বললে ও শোনে না কথা।
নিবিড় শুধু অথৈ এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা কে এমন নীরব একদমই মানায় না। বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে ভিজে আসে ওর। কষ্ট হয় ভীষণ। বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। অথৈ কে কথা দিয়েছিল ওকে একটা পাহাড়ে বাড়ি বানিয়ে দেবে। একটা ‘অথৈ মহল’ উপহার দেবে। সেটা কবে দেবে আর? মেয়েটার সুস্থ হতে হবে তো। যেভাবেই হোক।
৭২ ঘন্টা হতে আর মাত্র ৩ ঘন্টা বাকি। এই কয়দিনেই নিবিড়ের অবস্থা পুরোপুরি পাগলের মতো। চুল উষ্কো-খুষ্কো, দাড়ি কিছুটা বড় হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। ডক্টর যেই কয়বার অথৈ কে দেখতে আসে। সেই কয়বার নিবিড় কে ও বকে যায় এভাবে না ঘুমিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু নিবিড় এই মুহূর্তে আর কারোর কথাই শুনবে না। ওর মনেই তো শান্তি নেই। ওর ভালো থাকাটা আর হবে কিভাবে? ওর বেঁচে থাকার আনন্দই তো মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
____
৭২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেক্ষণ আগে। ডক্টর মুখ অন্ধকার করে জানিয়েছেন অথৈ কোমায় চলে গেছে। আইসিইউতে রাখা হয়েছে এখন ওকে। নিবিড়ের ও এখন হুশ নেই। কিছুক্ষণ আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। অতিরিক্ত দুর্বলতা, ঘুম না হওয়া, বিষন্নতা আর দুঃচিন্তায় ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেছে। বাকিরা এখন নিবিড় কে নিয়ে ব্যস্ত আপাতত। কারোর যেন কোন খেয়াল নেই। সব কেমন হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। এমন তো হবার কথা ছিল না?
সবাই হাসি-খুশি ভাবে জীবন পাড় করে দিচ্ছিল। সুন্দর কত মুহূর্ত ছিল! এখন সেসবই ধোঁয়াশা মাত্র।
____
চলবে