অথৈ মহল পর্ব-১৪+১৫

0
68

১৪
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
নবনী ওর বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেছে। অথৈ এর একা একা ভালো লাগছিল না। ড্রয়িং রুমে টমির পিছনে ছুটোছুটি করছিল। নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা অথৈ কে ডাকলেন।

“এইযে, এদিকে আসো তো। ”
“জ্বি আন্টি। ”
“চা’য়ের আড্ডা জমাতে ইচ্ছে করছে। দুই মা-মেয়ে মিলে চা বানিয়ে ফেলি কি বলো? ”

অথৈ খুশিতে বাকবাকুম করে ওঠে।
“দারুন হবে। চলো বানিয়ে ফেলি। ”

মিসেস রেহেনা অথৈ কে সুন্দর ভাবে যত্ন করে চা বানানো শিখিয়ে দিলেন। গল্প করলেন টুকটাক। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চা কাপে ঢেলে দুজনে চলে গেলেন বারান্দায়। মা-মেয়ের গল্প জমে গেল একদম। অথৈ এর মনেই হয় না এরা ওর দূরের কেউ। মনে হয় সবাই যেন কত কাছের।
নবনীর আহ্লাদি কথা, ওর মায়ের আদর, নিবিড়ের যত্ন। সব কেমন অন্য রকম ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে চার পাশে।

অথৈ এর আলুথালু চুল গুলো ছড়িয়ে ছিল পিঠময়। মিসেস রেহেনা চিরুনি নিয়ে আসলেন। চুল গুলো আচড়ে দিলেন। তারপর যত্ন করে খোঁপা করে দিলেন।

“কি সুন্দর চুল তোমার। এমন করে রাখো কেন? চুলের যত্ন নিতে হয় তো মেয়ে। ”
“আমার চুল আচড়াতে ইচ্ছে করে না। খোঁপা করতেও পারি না। ”

“দেখ তো মেয়ের কান্ড। কি বলে এগুলো। খোঁপা করা একদম সহজ তো। আসো আমি শিখিয়ে দেই। ”
“আচ্ছা। ”
“মাঝে মাঝে চুল বিণুনী ও করবে। তাহলে আর চুল ছিঁড়বে না। ”

অথৈ এর এত ভালো লাগে কথা গুলো। একদম মা মা ব্যাপার। চুলে খোঁপা করা ও শিখে গেল।

নিবিড় আজ দুপুরে ফিরেছে অফিস থেকে। ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে যায়। দুপুরে সবাই এক সাথে খাবার খেয়ে যার যার মতো ঘুমিয়ে যায়।
_____
রাত বেড়েছে অনেকটা। ঘড়ির কাটা প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই। নিবিড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরায়। সামনে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টি তে। সিগারেটের ধোঁয়া কিছু টা উড়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সিগারেটের শেষ টান টা দীর্ঘ সময় ধরে নেয়। তারপর অল্প অল্প করে বেশ খানিকক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ে। আরও ১ ঘন্টা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বুকশেলফ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বৈকুন্ঠের উইল” বইটা নিয়ে চেয়ারে বসে। কয়েক পাতা পড়ে ফেলে।

সম্ভবত তখন রাত ৩ টা হবে। নিবিড় অথৈ কে চুপিচুপি ডাকতে থাকে। ঘুম জড়ানো চোখে অথৈ ওর দিকে তাকায়। ঘোর লাগা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, এখন ডাকার মানে টা কি?

অথৈ আবার ঘুমিয়ে যায়। খানিকক্ষণ পরেই বুঝতে পারে ও শূন্যে ভাসছে। আতঙ্কে চোখ মেলে তাকায়। দেখলো নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। কথা বলতে যেয়েও থেমে যায়। ওই চোখে যেন কিছু একটা আছে। নিবিড় কি ওকে সম্মোহন করে ফেলল? এমন লাগছে কেন তবে?
নিবিড় হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট একটা পাহাড়ে চলে যায় অথৈ কে নিয়ে। তারপর ওকে নিচে নামিয়ে দেয়।

“অথৈ? ”
“হু? ”
“এত কাছে থেকে রাতের পাহাড় দেখেছিলে কখনো? ”
“উহু, তবে দেখার ইচ্ছে ছিল।বলেছিলাম তোমায়। ”
“হ্যাঁ, ”
“সেই আবদার পূরণ করতেই বুঝি এই মাঝরাতে আমায় তুলে নিয়ে আসলে? ”

নিবিড় ঠোঁট কামড়ে হাসে। বাঁকা চোখের চাহনি তে ওর দিকে তাকায়। এইযে এই চাহনি তে অথৈ শেষ হয়ে যায়। সেটা কি নিবিড় বোঝে না?
অথৈ এর ঘোর এখনো কাটেনি। ও কি পাহাড় দেখবে নাকি কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা কে দেখবে? এমন বুকের ভেতর অশান্ত হয়ে যাচ্ছে কেন আজ? বুক ধরফর যেন বেড়েই যাচ্ছে তীব্র গতিতে।

তারারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চাঁদটা যেন মিটিমিটি হাসছে। নিবিড় বুক ভরে আরও একবার শ্বাস নেয়।
“বাতাসের ঘ্রাণ টা কি দারুণ। ”

অথৈ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“বাতাসের আবার ঘ্রাণ আছে নাকি! কি বলো। ”
“হ্যাঁ, আছে। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর ঘ্রাণ আছে। রাতের, বাতাসের, আকাশের, মাটির, গাছের, বৃষ্টির আরও অনেক কিছুর। একদম অন্যরকম এক ঘ্রাণ। মাতাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে এই ঘ্রাণে। ”

অথৈ আনন্দে আটখানা হয়ে যায়।
“সত্যি বলছো! ”
“হু, সত্যি। তুমি কি একবার চেষ্টা করতে চাও? ”
“অবশ্যই। প্লিজ শিখিয়ে দাও আমায়। ”
“কিসের ঘ্রাণ নিতে চাও? ”
“পাহাড়ের। ”

“ওকে, চোখ বন্ধ করো। ”
“করলাম। ”
“প্রথমে অনুভব করো তুমি একা একটা পাহাড়ে আছো এখন। সবুজ পাহাড়টা রাতের নিস্তব্ধতায় নীরব হয়ে আছে। তোমার সাথে যেন পাহাড় টা মিশে যেতে চাইছে। শান্ত বাতাস তোমার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। অনুভব করো তুমি। ”

“করছি। ”
“এবার ধীরে ধীরে শ্বাস নাও। অনুভব করতে পারবে পাহাড়ের এই অন্যরকম ঘ্রাণ। ”

অথৈ ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়। অনুভব করে একটা শীতল ঘ্রাণ।

“কিছু অনুভব করলে তুমি? ”

নিবিড় দেখলো অথৈ এর চোখ ভর্তি পানি।

“নিজেকে আজ অনেক টা হালকা লাগছে নিবিড় জানো? সত্যি তুমি দারুণ একটা মানুষ। তোমার জন্য আমি এত কাছে থেকে প্রকৃতি কে অনুভব করতে পারছি। আগে কখনো কেউ আমাকে এমন ভাবে বলেনি। ”

“তুমি পাহাড়ের ভাষা বুঝতে পারো? ”
“পাহাড়ের ভাষা ও আছে নাকি! ”
“পাহাড়ের ও একটা নীরব ভাষা আছে। ”
“তাহলে আমি বুঝতে পারছি না কেন? ”

“আবার চোখ বন্ধ করো। মনটা কে শান্ত করো। এই নীরব পাহাড় কে অনুভব করো গভীর ভাবে। ”

অথৈ চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকে। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সারা শরীর শির শির করতে লাগলো।
নিবিড় খেয়াল করলো অথৈ এর গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে। অজানা এক অনুভূতি হচ্ছে। ওর চোখের পানি দেখে নিবিড়ের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখের পানি মুছে দেয় আলতো করে।

“পৃথিবীতে এত সুখ কেন? বেশি সুখ পেলে আমার চোখে আনন্দে পানি চলে আসে। পাহাড় এভাবে আমাকে তার কাছে টানছে কেন বলো তো? ”

“তুমি সবার থেকে আলাদা এজন্য। ”

নিবিড় আচমকা অথৈ এর হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। দুজন দুজনের দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

~ অথৈ, তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গাঢ় এক চুম্বন একে দিয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে যদি বলি, ভালোবাসি? তুমি কি আনন্দে চোখ দিয়ে নোনা জল ফেলবে? নাকি দূরে ঠেলে দেবে আমায়? ~

আকষ্মিক এই কথা শুনে অথৈ এর শরীর কেঁপে ওঠে। বাকহারা হয়ে যায়। নিবিড় কি ওকে ভালোবাসে সেটা বলল? ওর গলা শুকিয়ে আসছে হঠাৎ করেই। পা অবস হয়ে আসছে। এখনই বোধহয় ঢোলে পড়ে যাবে নিচে।

এই কথাই তো সে কবে থেকে শুনতে চাইছিল। এতদিনে বলার সময় হলো? কিছুটা অভিমান, ভালো লাগা মিশিয়ে অথৈ চুপ করেই থাকে।

নিবিড় কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে রেখে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরায়। সিগারেটে কয়েকটা টান দেয়। অথৈ পেছন থেকে শুধু দেখে যাচ্ছে। কি বলা উচিত এখন তার? নিবিড় একবার অথৈ এর দিকে ঘুরে তাকায়। ও দেখল নিবিড়ের চোখ লালচে হয়ে আছে। আচ্ছা, নিবিড়ের কি কষ্ট হচ্ছে? বুক জ্বালাপোড়া করছে?

অথৈ ধীর পায়ে নিবিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর ঠোঁটে থাকা সিগারেট টা নিয়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে আগুন নিভিয়ে দেয়। চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে একটা অন্যায় আবদার করে ফেলে।

“নিবিড়, তোমার এই সিগারেটে পোড়া ঠোঁট দিয়ে আমাকে একটা চুমু খাবে প্লিজ? ”

নিবিড় ভেজা চোখে তাকায় পূর্ণ দৃষ্টিতে। সুখে চোখ বুজে আসতে চাইছে। তবুও তাকিয়ে থাকে। শান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়।

“কলঙ্ক লেগে যাবে তোমার পবিত্র শরীরে।
“লাগুক না একটু কলঙ্ক। চাঁদের ও তো কলঙ্ক আছে। আমার হলে ক্ষতি কি? ”
“ক্ষতি আছে তো। তুমি চাদের থেকে ও বিশেষ কিছু আমার কাছে। ”
“আমিও তো আবদার টা আমার বিশেষ মানুষের কাছেই করলাম নিবিড়। ”

“তুমি যেমন পবিত্র। আমার ভালোবাসা তার থেকে ও পবিত্র অথৈ। ”
“শুধু একবার। ”

নিবিড়ের নিঃশ্বাস আটকে যায়। স্থির হয়ে যায় চাহনি। কয়েক বার ঢোক চাপে। তারপর____তারপর কেটে যায় অনেকক্ষণ। নিবিড় নিজের ওষ্ঠ দিয়ে অথৈ এর আরেক জোড়া ওষ্ঠ নিজের করে নেয়। পাগলের মতো শুষে নিতে থাকে সেই জ্বালাময়ী অমৃত। তারপর আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাশে ঘুরে দাঁড়ায়।

“চলো বাসায় ফিরে যাই অথৈ। ”
“আর কিছু সময় থাকি। ”

নিবিড় আর কিছু বলে না। কি বলা উচিত ওর এই মুহূর্তে সেটা জানা ও নেই। দুজন হাত ধরে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে।
_____
বাসায় কেউ নেই আজ। অথৈ একা আজ। ওর কানের কাছে কিছু আওয়াজ আসছে ভেসে ভেসে। অনেক্ষণ ধরেই এমন হচ্ছিল। তবে হালকা। এখন আবার বেড়েছে সেই শব্দ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কথা গুলো। দুজন মানুষ ঝগড়া করছে কিছু একটা নিয়ে। ঝগড়ার কথা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী তারা। এক পর্যায়ে মহিলা চিল্লাতে থাকে জোরে।

কিন্তু এই শব্দের উৎসটা ঠিক কোথায়। সেটা অথৈ বুঝতে পারছে না। বাসায় এখন কেউ নেই। আশেপাশে ও কোন বাসা নেই। টিভি ও অফ করে রাখা। তবে?
নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। শব্দগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কানের পর্দা ফেটে কথা বেড়িয়ে আসছে মনে হচ্ছে। অথৈ কান চেপে ধরে থাকে।
শেষের কথা গুলো শুনে ও আরও অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এখন একজন পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসছে।

সে জোরে জোরে বলছে,
“অথৈ তুই অপয়া। তুই মেরেছিস। তোর জন্য সব শেষ হয়ে গেছে। হ্যাঁ, তুই-ই। সব তোর দোষ। কেন করলি এমন? কেন করলি? তুই খু*ন করেছিস। মরে যা তুই। এখনো বেঁচে আছিস কেন? লজ্জা লাগে না তোর? ছিঃ! ”

অথৈ জোরে চিৎকার করে ওঠে কান চেপে ধরে।
“আমি কিছু করিনি। তুমি ভুল বুঝছো। কেন এত জ্বালাও আমায়? আমি কিছু জানি না। আমি খু*ন করিনি। আমাকে শান্তি দাও। বাঁচতে দাও আমায়। ”

তবুও থামছে না। এখনো সেই শব্দ গুলো জোরে জোরে শোনা যাচ্ছে। অথৈ ফোন খুঁজতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণায় হাতের কাছে যা পাচ্ছে সব ছুঁড়ে ফেলছে। টমি অথৈ এর এমন অবস্থা দেখে মিউ মিউ করে ওর চারপাশে ঘুরছে। অথৈ সহ্য করতে না পেরে টমি কে তুলে ছুঁড়ে ফেলে বিছানার আরেক পাশে। টমি ছিঁটকে পড়ে বিছানার পাশে। দেয়ালে মাথা লেগে কুকিয়ে ওঠে মিউ মিউ করতে করতে এক সময় নিশ্চুপ হয়ে যায়।

যেই টমি কে ও এত ভালোবাসে। সেই টমি কে এভাবে আঘাত করেও ওর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। যেন মানসিক ভাবে শেষ হয়ে গেছে। নিবিড় কে কল করে দ্রুত। নিবিড় ওপাশ থেকে “হ্যালো, হ্যালো” করতে থাকে।
তখনই অথৈ লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে।

টমি চোখ মেলে তাকায় হালকা ভাবে। অথৈ কে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে ওমনি বিছানা থেকে খুঁড়িয়ে নামে নিচে। টমির মাথায় আঘাত লেগে হালকা রক্ত আসছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। অথৈ কে পড়ে থাকতে দেখে বুকের উপর যেয়ে পা দিয়ে খামচি দিচ্ছে। জিভ দিয়ে গাল চেটে দিচ্ছে। অথৈ এর জামা ধরে টানতে থাকে। জোরে মিউ মিউ করে।

পোষা প্রাণীটা ও বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে গেছে। নয়তো ওকে এভাবে মারবে কেন? টমি ছটফট করছে ওখানেই। চারপাশে দৌড়াচ্ছে। আবার ছুটে যাচ্ছে অথৈ এর কাছে। আবার জামা ধরে টানতে থাকে। এভাবেই ছুটোছুটি করতে থাকে টমি।
____
চলবে

১৫
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ এর যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখতে পায় ও ক্লিনিকে। বেডে শুয়ে আছে। উঠে বসতে যাবে তখনই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। নিবিড় একটু বাইরে গিয়েছিল। অথৈ কে উঠে বসতে দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে ওকে আবার শুয়ে দেই। বিছানার এক পাশে টমি ঝিম মেরে বসে আছে। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। অথৈ হঠাৎ ওকে এই অবস্থায় দেখে চমকে যায়। নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে এসব কিভাবে হলো।

নিবিড় নিজেও জানে না এসব কিভাবে হয়েছে। ও নিজেই তো বাসায় ফিরে দেখে অথৈ অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। পাশেই টমি মিউ মিউ করছে। ওর ও মাথা থেকে হালকা রক্ত আসছে। পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তখনই ওদের দুজন কে নিয়ে আসে ডক্টরের কাছে।

তবে ডক্টর সেলিম রানা যা বললেন সেটা নিবিড়ের ও সঠিক মনে হচ্ছে। তার ধারণা অথৈ এর মানসিক কিছু সমস্যা আছে। তাই নিবিড় যেন দ্রুত কোন সাইকোথেরাপিস্ট কে দেখায়।

সেদিন বিকেলেই ওরা বাসায় ফিরে যায়। কাব্য, নীল, রিদ সবাই ওকে দেখতে আসে। নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। অথৈ কে যত্ন করে স্যুপ খাইয়ে দেয়। নবনী এসে ওর মাথার কাছে বসে। মজার মজার কথা বলে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করতে থাকে।

কাব্য ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি শেষ করে অথৈ এর নাক টেনে দেয়। ও চোখ পাকিয়ে তাকায়।

“উফ! ভাইয়া, এমনিই আমার নাকটা পাকিস্তানিদের মতো লম্বা। তুমি টেনে আরও লম্বা বানিয়ে দিও না। ”

ওর এই কথা শুনে সবাই জোরে হেসে ওঠে।

“বলিস কি! তোর নাকটাই তো সুন্দর। এখনকার মেয়েরা কি করে জানিস? বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে নিচু নাক সরু বানিয়ে ফেলে। বুঝছিস? ”

অথৈ আড়চোখে কাব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে। কাব্য ঠোঁট টিপে হাসে। নীল এসে জানতে চায়।

“এই তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? চাইলে বলো কিছু বানিয়ে দেই অথবা কিনে নিয়ে আসি? ”
“আমি এখন কিচ্ছু খাব না ভাইয়া। ”
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। ”
“তোমরা এমন করছো কেন হুঁ? আমি তো সুস্থ। ”

নিবিড় এগিয়ে এসে অথৈ এর পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“তুমি সুস্থ সেটা আমরা সবাই জানি অথৈ। তবুও আগামী কাল একবার ডক্টরের সাথে দেখা করে আসতে হবে। মাথায় বেশি চোট লেগে থাকলে তো পরে সমস্যা হবে তাই না? তুমি তো সব বোঝো। ”

অথৈ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। তার মানে আগামী কাল ডক্টরের কাছে যাওয়া নিয়ে ওর কোন আপত্তি নেই।
_____
মেডিকেল রোড, কাজলশাহ, সিলেটে একজন ব্রেইন-মাইন্ড স্পেশালিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট আছেন। ডঃ রাশিদ চৌধুরী। তিনি চেম্বারে থাকেন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

নিবিড় অথৈ কে নিয়ে ৫ টার দিকে বেড়িয়ে যায়। ডক্টর কে দেখানো হলো। তিনি অথৈ এর সাথে প্রায় ৫০ মিনিট সুন্দর ভাবে কথা বললেন। সহজ ভাবে কিছু প্রশ্ন করলেন। যখন অথৈ স্বস্তি বোধ করা শুরু করল তখন ওর যতটুকু মনে আছে নিজেই ডক্টর কে সব বলল।

কিছুক্ষণ পর ডক্টর নিবিড় কে একা ডাকলেন।

“মিঃ নিবিড় বসুন এখানে। ”
“ডক্টর কি বুঝলেন কথা বলে? ”
“আমি যা বুঝলাম, পেশেন্ট মেন্টাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে। সেটা কিছুদিনের নয় কিন্তু। প্রায় ১১-১২ বছর ধরে। কাজেই এটা এখন আর সামান্য কোন পর্যায়ে নেই। ভয়ানক ভাবে ওকে এই মানসিক রোগটা ঘিরে ধরেছে। এটা মারাত্মক চিন্তার বিষয় কিন্তু। ”

“অথৈ আমাদের সাথে বেশ অনেক দিন ধরে আছে। সেটা আমি আপনাকে আগেই জানিয়েছি। কিন্তু এর মাঝে এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু বোঝা যায়নি। মনে হয়েছে একদম সুস্থ একটা প্রাণোচ্ছল মেয়ে। ”

“হ্যাঁ, ও মাঝে মাঝে সুস্থ থাকবে। হঠাৎ করেই আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে যাবে। আর সেটা তখনই হবে যখন ও একা থাকবে কোথাও। আপনি তো বললেন বেশ কিছু দিন আগে হঠাৎ করেই অথৈ লাপাত্তা হয়ে যায়। তারপর ওকে আপনারা মণিপুরীদের বাসস্থানে পেয়েছেন। ও কিন্তু এমনি এমনি বাসা থেকে চলে যায়নি। ওর প্রধান সমস্যা কানে আওয়াজ আসা। ওর কানে এমন কিছু শব্দ আসে যা ওকে স্থির রাখতে দেয় না। চলে যায় যেকোন জায়গায়। এমন কি ওর মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে অনেক বেশি। এমন কিছু শব্দ ওর কানে আসবে যা এক সময় সহ্য করতে না পেরে ও সুই*সাইডের চেষ্টা করবে।
এমন কি গতকাল ও অথৈ এর কানে কিছু অপ্রকাশিত শব্দ অথবা কথা এসেছিল। যেটা সহ্য করতে না পেরে সেন্সলেস হয়ে যায়।

যেমন ধরুন আপনি বললেন প্রথম দেখেছিলেন বউ সাঁজে ট্রেনে। তারপর আপনি আপনার সাথে নিয়ে এসেছেন আপনার বাসায়। আপনাকে অথৈ যেই গল্প টা শুনিয়েছে সেটা সত্যি নয়। এর পেছনে অন্য কিছু একটা আছে। কি কারণে ও চলে এসেছে বাসা থেকে সেটা আপনার খোঁজ করা উচিত। ওর পরিবার কোথায়? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। অথচ ওর বাবা-মা কোন খোঁজ করবে না? আদৌ কি ওর বাবা-মা আছে?

আরেকটা কথা। আপনি বললেন অথৈ কে খুঁজে না পেয়ে আপনি ওর ফোনের কল লিস্ট চেক করেছেন। কিন্তু কোন নাম্বার পাননি। অথচ আপনি আগে শুনেছেন সে তার মায়ের সাথে কলে কথা বলতো। এখানে আমার অভিজ্ঞতা যা বলে সেটা হচ্ছে, মেয়েটা কারোর সাথেই কথা বলতো না। ওর মায়ের সাথে ও না। কিন্তু ও মনে মনে এটা ভেবে নিয়েছিল নিজের অজান্তেই। এই মানসিক সমস্যায় এমন হয়। কল্পনা শক্তি তাদের বেড়ে যায়। নিজের মনের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা গন্ডি বানিয়ে ফেলে। ওরা যা ভাবে সেটাকেই সঠিক মনে করে। আশা করি আপনি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন।

আর এই রোগের সাথে ওর অতীতের কোন সংযোগ আছে। আপনি ভালো করে খোঁজনিন। তারপর আমাকে জানাবেন। আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি আপাতত সেই অনুযায়ী ঔষধ খাওয়াবেন। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকুক। সাধারণত শুরুর দিকে হলে কাউন্সিলিং এর মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু ওর কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে কিছুই হবে না। রোগটা বেড়ে গেছে অনেক। মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে এটাই শুকরিয়া। ওকে কখনো একা রাখবেন না। চোখে চোখে রাখুন। বুঝতে দেবেন না সে অসুস্থ। আপনারা আগের মতোই ওর সাথে কথা বলুন, মিশুন, ঘুরতে যান। হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করুন। ইন শা আল্লাহ ঠিক মতো ট্রিটমেন্ট চললে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। ”

নিবিড় অথৈ কে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। ডক্টরের কথা শোনার পর থেকে ওর মনটা অশান্ত হয়ে আছে। এতদিনে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই মেয়েটার মাঝে এত বড় রোগ বাসা বেঁধে আছে। কি এমন হয়েছিল অতীতে? জানতে তো হবেই তাকে।

আজ থেকে রাতে মিসেস রেহেনা থাকবে অথৈ এর সাথে। ওকে একা রুমে রাখার সাহস কারোর হচ্ছে না। অথৈ কে অবশ্য এগুলো বুঝতেও দিচ্ছে না। মিসেস রেহেনা ওর সাথে থাকবে শুনে সে মহাখুশি। রাতে তিনি ওকে গল্প বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলেন
_____
মেঘ ডাকছে প্রচন্ড জোরে। এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।অথৈ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। মেঘের ডাক শুনে মনের ভেতর আকুপাকু শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টি নামলে ভিজতে যাবে কি না দ্বিধায় আছে। নিবিড় দেখলে বকবে। সেই ভয়েই আছে। চুপিচুপি নিবিড়ের রুমে উঁকি দেয়। তখনই নিবিড় দরজা ঠেলে বেড়িয়ে আসে। দুজনের জোরে একটা ধাক্কা লাগে। “আউচ” বলে চিল্লিয়ে অথৈ উল্টে যাচ্ছিল। নিবিড় দ্রুত ওর হাত ধরে ফেলে।

অথৈ এর বাহু ধরে দাঁড় করায়। হাতটা চেপে ধরে। তখনই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়। হাতটা ছেড়ে দেয়। গভীর দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

“অথৈ যদি বলি, চলো ভিজি আজ বৃষ্টি তে।
ধরবে কি তুমি আমার হাত?
ভিজবে কি তুমি আমার সাথে? ”

নিবিড়ের কথা শেষ করার আগেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে।

“উম্ম, ভিজবো। চলো যাই। ”

নিবিড় একটা স্নিগ্ধ হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে ওকে নিয়ে চলে যায় ছাদে। অথৈ নিবিড়ের পায়ের উপর উঠে দাঁড়ায়। নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে। নিবিড় ওর কোমর ধরে থাকে যেন পড়ে না যায়। তারপর বৃষ্টির মাঝে এভাবেই ছাদে ওকে পায়ের উপর নিয়ে হাঁটতে থাকে। নিবিড় ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অথৈ কেঁপে ওঠে। চোখ নামিয়ে নেয়।

একটু পর ওর পায়ের উপর থেকে নামে। ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে পাখির ডানার মতো দু হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির প্রতিটা কণা ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম বৃষ্টির পানি কে নিবিড়ের হিংসে হচ্ছে।

অথৈ পেছনে ঘুরে তাকায়। নিবিড় কে ডাকে। নিবিড় ওর কাছে গেলে ওকেও ওই ভাবে দুদিকে হাত মেলে দাঁড়াতে বলে। দুজনেই দাঁড়ায় এক রকম ভাবে।

বেঁচে থাকা অনেক সুন্দর অনেক। যদি ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকে এভাবে। একটা আকড়ে ধরার মানুষ থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা তাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে এক জীবন পার করেছে। এই শহরে তো শুধু মন ভাঙ্গার গল্প লেখা হয়। মন গড়ার গল্প খুব কমই হয়। ওই অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝে ওরাও হলে মন্দ কি তবে?

অথৈ ঘুরে দাঁড়ায়। নিবিড় কে ডাকে।

“এই শোনো ? ”
“বলো। ”
“আমি তো আহামরি কেউ না। তবে আমাকে এত ভালোবাসলে কেন তুমি? ”

“তুমি আমার কাছে অন্যরকম। আমার ভালোবাসা। আমি জানি, সহজে কারোর প্রেমে পড়ব না। কিন্তু একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারব না। এইযে, প্রেমে পড়ব না পড়ব না করেও গভীর ভাবে প্রেমে পড়লাম। কিন্তু মেয়েটা অনেক জ্বালায় আমায়। ”

অথৈ ঠোঁট টিপে হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে,
“শুধু জ্বালায়? ”

নিবিড় আরেকটু আহ্লাদ করে বলল,
“নাহ। ভালো ও বাসে। ”

অথৈ এক বুক প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওকে আবার জিজ্ঞেস করে,
“ভালোবাসা এত সুন্দর কেন বলো তো? ”

নিবিড় শান্ত চোখে তাকায়। এর উত্তর ওর কাছে আছে। চট করে সেই উত্তর দিয়ে দেয়।

“তুমি সুন্দর তাই। ”
“ইশ! বলে কি এই লোক। ”
“ভুল বললাম বুঝি? ”
“কি জানি। ”
“সত্যি টা কি তবে? ”

অথৈ নিবিড়ের সামনে দাঁড়ায়। ওর বুকে পিঠ দিয়ে গা এলিয়ে দেয়।

“তুমি যা বলবে তাই পরম সত্য নিবিড়। ”
“আমার মাঝেও মিথ্যা আছে অথৈ। ”
“ওই এতটুকু মিথ্যা সবার মাঝেই থাকে। ”

নিবিড় ওকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়।

এইযে জড়িয়ে নিল। আর কখনো আলাদা হতে দেবে না। এই মেয়েটার কোন ক্ষতি ও হতে দেবেই না। ওকে সুস্থ করার পুরো দায়িত্ব নিবিড়ের। বাকি ১০টা মেয়ের মতো স্বভাবিক করে তুলবেই।
_____
নিবিড় ঢাকা গিয়েছে আজ। অথৈ এর পরিবার কে খোঁজার চেষ্টা করছে। সাথে আছে রিদ। বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। একটা রেস্তোরাঁয় বসে কিছু খেয়ে নেয়। আজকের রাতটা থাকার জন্য একটা ভালো হোটেল বুক করে। বাসায় ওর মা আর নবনী কে বার বার করে বলে এসেছে অথৈ কে যেন কেউ চোখের আড়াল না করে। শিঘ্রই ফিরে আসবে কাজ শেষে।

নিবিড়ের পরিচিত অনেকেই ছিল ঢাকায়। তাদের ও খোঁজ করতে বলেছে। আর পরিচিত কয়েক জন পুলিশ কে ও কাজে লাগিয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে যেভাবেই হোক সব জানার চেষ্টা করবে।

রাত ১১ টায় নিবিড়ের একটা কাজিন কল করে জানায় অথৈ এর পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি। তবে ওর মামার ঠিকানা পেয়েছে। নিবিড়ের মনে আশার আলো চলে আসে। আগামীকাল জানা যাবে বাকিটা।
____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে