অথৈ মহল পর্ব-১২+১৩

0
11

১২
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
৯ টায় ওরা বেরিয়ে পড়ে মণিপুরীদের থেকে বিদায় নিয়ে। শ্রীমঙ্গলটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলেও নিবিড় রাজি হচ্ছে না। নবনী আর অথৈ জেদ ধরেছে ওরা ঘুরবেই।

নীল এসে নবনীর গাল চেপে ধরে কটমট করে বলে,
“তুই না এতদিন চট্টগ্রাম ঘুরে আসলি? তবুও ঘোরা হয়নি তোর? ”

নবনী ভেংচি কাটে। নিবিড়ের কাছে বিচার দেয়।
“ভাইয়া, নীল ভাইয়া আর একবার আমার গাল চেপে ধরলে কিন্তু আমি হাতে কামড়ে দিব বলে দিলাম। ”

“এহ! আমি বুঝি চুপ থাকব? আমিও তোর মুখে পানি দিয়ে মেকআপ নষ্ট করে দেব। ”
“আমি মেকআপ করি না তুমি জানোই। ”
“মেকআপ দিলেও কি আমাদের বলবি? ”

ওদের ঝগড়া দেখে সবাই হেসে ফেলে। কাব্য এসে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে এর সমাধান দেয়।

“শোন সবাই, আমরা শ্রীমঙ্গল এসেছি অল্প সময় নিয়ে। তাই ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু অথৈ আর নবনী যেহেতু এত করে চাইছে। সেহেতু আমরা চাইলে ওদের হাম হাম ঝর্ণা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতেই পারি। আর টমি ও তো আসেনি। তাই সমস্যা ও হবে না আপাতত। কি বলিস তোরা? ”

নিবিড় রাজি হয়। নবনী অথৈ খুশিতে দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে। অথৈ গিয়ে কাব্য কে জড়িয়ে ধরে।

“এই জন্যই তোমাকে আমি এত ভালোবাসি ভাইয়া। ”

কাব্য মুচকি হাসলেও রিদ আর নীল তীব্র প্রতিবাদ জানায়।নীল অভিমানী কন্ঠে বলে,

“মানে কি অথৈ? আমি আর রিদ কি দোষ করলাম বলতো। তোমার জন্য কত কি করি। আর তুমি আমাদের পাত্তাই দিলে না। ”

অথৈ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়।
“ভাইয়া, একদম ন্যাকামি করবে না। আমি সবাই কেই ভালোবাসি। ”

কাব্য সুযোগ বুঝে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“আর নিবিড় কে? ”

নিবিড়ের নাম শুনে অথৈ খানিকটা লজ্জা পায়। কথা এড়িয়ে যায় সুক্ষ্ম ভাবে। নিবিড় বুঝতে পারে সেটা।
_____
প্রথমে ওরা শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে যায়। তারপর সেখানে থেকে একটা জীপ ভাড়া করে নেয়। জীপ নিয়ে যেতে হবে কলাবাগান পর্যন্ত। রিদ একটা জীপ ভাড়া করে। তারপর সবাই কলাবাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সবাই হাসি-ঠাট্টা, হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে পুরোটা সময়।

এরপর ওরা কলাবাগান পৌঁছে যায়। অনেকেই কলাবাগানে এসে গাইড ঠিক করে নেয়। কারণ, ঝর্ণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও সরকারি ভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। তাই সাধারণত স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে পর্যটকরা ঝর্ণা ভ্রমণ করেন।
কিন্তু কাব্যরা এর আগেও অনেক বার এখানে ঘুরতে এসেছিল বিধায় ওদের সব চেনা জানা আছে। তাই কেউ আর গাইড নেয়নি।

হামহাম বা চিতা ঝর্ণা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত এই প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা।

অথৈ নিবিড় কে এই জলপ্রপাত নিয়ে অনেক প্রশ্ন করে। ওর আগ্রহের যেন শেষ নেই। আশেপাশে যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। অজানা জিনিসগুলো জানার আগ্রহ দেখাচ্ছে। নিবিড়ের ওর এই ব্যাপার গুলো ভালো লাগছে। সব কিছুতেই আগ্রহ থাকা ভালো। বিশেষ করে প্রকৃতি নিয়ে। কয়জন মানুষই বা এখন প্রকৃতি কে এতটা ভালোবাসে।
নিবিড় ওকে এই জলপ্রপাত নিয়ে আরও অনেক তথ্য জানায়। এই জলপ্রপাত এর নামকরণ কেন এটা হলো। কে এই পর্যটন কেন্দ্র আবিষ্কার করলেন। আরও বিভিন্ন ধরনের কথা।

“জানো অথৈ? জলপ্রপাতটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝর্ণাটি ১৩৫ মতান্তরে ১৪৭ কিংবা ১৭০ ফুট উঁচু। কেউ কেউ ঝর্ণার সাথে গোসলের সম্পর্ক তুলনা করেন।
“হাম্মাম” (গোসলখানা) শব্দটি থেকে “হাম হাম” হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সিলেটি উপভাষায় “আ-ম আ-ম” বলে বোঝানো হয় পানির তীব্র শব্দ, আর ঝর্ণা যেহেতু সেরকমই শব্দ করে। তাই সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষান্তরে তা “হাম হাম” হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি “চিতা ঝর্ণা” হিসেবে পরিচিত। কেননা একসময় এ জঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ পাওয়া যেত। ”

চিতাবাঘের কথা শুনে অথৈ চমকে তাকায়। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।

“কি বলছো তুমি! চিতাবাঘ আছে আগে বলবে না? তবে আমি ভুলেও এখানে আসতে রাজি হতাম না। ”

নিবিড় হাসতে থাকে ওর কথা শুনে।
“আরে এখন নেই। এগুলো আগে মানুষ বলতো তখন নাকি ছিল। এখন কই পাবে এখানে। ”

অথৈ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় এবার।

হাম হাম যাবার পথ এবং হাম হাম সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রজাপতি। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমাপড়া হনুমানের। এছাড়াও রয়েছে ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি ইত্যাদি বিচিত্র নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।

ঝর্ণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচন্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝর্ণাধারায় এসে ঠেকে। ঝর্ণার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হয়। তাছাড়া ঝর্ণাকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো সরকারি অবকাঠামোও।

ঝর্ণায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা-বাগান থেকে ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরিপথে কদাচিৎ চোরাবালুও তৈরি হয়। কিন্তু সে সকল স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়।

জঙ্গলের মধ্যে এসে অথৈ শুনলো এখানে সাপ আর জোঁক আছে অনেক। এই কথা শুনে সেখানে দাঁড়িয়েই কান্না শুরু করে দিয়েছে। কান্না কারার আগেই চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে পানি। নবনীর কেন যেন মজা লাগছে এই ব্যাপার গুলো।
ও এসে সাহস দেয়।

“আরে অথৈ আপু, একদম ভয় পেয়ো না। জোঁক তোমায় ধরবেই না। ভয় পাওয়ার ও কিছু নেই। আমি কিন্তু ভয় পাই না। ”

তবুও অথৈ এর ভয় কাটে না। নিবিড় জানে এই মেয়ের ছিঁচকাদুনে স্বভাব আছে। আর ভীতু ও অনেক। নিবিড় এসে ওর হাত চেপে ধরে। ওর চোখে চোখ রাখে।

“তাকাও আমার দিকে। ”

অথৈ বাধ্য মেয়ের মতো ওর দিকে তাকায়।

“কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না? ভয় কিসের তোমার? সেই শুরু থেকেই সব কিছু থেকে তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছি আমি। তোমাকে আমি কষ্ট পেতে দেব বুঝি? এভাবে কাঁদতে হয় না। চলো। ”

আচমকা নিবিড়ের কথা শুনে ওর কান্না থেমে যায়। নিবিড়ের হাত চেপে ধরে হাঁটতে থাকে। এই সামান্য কথাতেই যেন ও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মনে মনে ভাবতে থাকে, নিবিড় কি ম্যাজিক জানে? কি সুন্দর ওকে সব সময় সামলে নেয়।

ভাবতে ভাবতেই নাবনীর চিৎকারে সবাই থমকে দাঁড়ায়। ওর পায়ের আঙ্গুলে একটা জোঁক ধরেছে। যদিও নবনী ভয় পায় না। তবে আচমকা পায়ের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেছে। রিদ এসে নবনীর পায়ের কাছে বসে জোঁকটা টেনে ছাড়িয়ে নেয়। কিছুটা রক্ত গড়িয়ে পরে ওর পা থেকে।

নিবিড় এগিয়ে আসে,
“ব্যথা লাগছে তোর? হাঁটতে পারবি কি? নাকি কোলে নিয়ে যাব তোকে। ”
“সমস্যা নেই ভাইয়া। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে না। আমি যেতে পারব। ”
“না না ব্যথা লাগলে বল। রক্ত আসছে তো। ”

কাব্যর পকেটে রুমাল ছিল একটা। সেটা ছিঁড়ে নবনীর পায়ের আঙ্গুলে বেঁধে দেয়। এখন আর রক্ত পরছে না।
নবনী হেঁটেই যাবে তবুও। কিন্তু অথৈ এবার চিল্লানো শুরু করেছে। সে আর এক পা ও নড়বে না কোনভাবেই। নবনীর পায়ে জোঁক ধরা দেখে ভয় আরও বেড়েছে।

নিবিড় অথৈ এর কানের কাছে এসে আস্তে করে বলে,
“আপনার কি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে ওঠার শখ হয়েছে ম্যাম? কোলে নেব? ”

অথৈ লজ্জা পায় খানিকটা। গাল লাল হয়ে যায়। কান দিয়ে গরম ভাব বের হচ্ছে যেন। মুখটা নিচে নামিয়ে নেয়।
নিবিড় ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর অথৈ কে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে আবার।
অথৈ তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের মুখের দিকে। নিবিড় ও তাকায়।

“এইযে, তোমার কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে? ”
“লাগে তো। ”
“কেন ভালো লাগে? ”
“সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে যে কারোরই ভালো লাগবে। ”
“আচ্ছা তাই? ”
“সন্দেহ আছে কোন? ”
“যেহেতু তুমি বলেছো। তাই আর সন্দেহ নেই। ”

নিবিড় ওর সাথে দুষ্টুমি করে ও সেটা বুঝতে পারে। কিছু বলে না। নিবিড়ের সাথে আজকাল কথা বলতে অন্য রকম ভালো লাগে। কেমন যেন একটা প্রশান্তি আছে ওর মাঝে। সারাক্ষণ ওর সাথেই গল্প করে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

ওদের কে এক সাথে এভাবে দেখে নবনী কাব্যর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এই ভাইয়া, অথৈ আপু আর নিবিড় ভাইয়ার মধ্যে কি কিছু চলছে? ”
“এখনো কিছু চলছে না। তবে শীঘ্রই প্রেম হয়ে যাবে বোধহয় বুঝলি? ”
“ইশ! বলো কি। আমার তো দারুণ লাগছে। ওদের দুজন কে এক সাথে কি সুন্দর মানায় তাই না বলো? ”

কাব্য ওর মাথায় একটা গাট্টা দেয়।
“গাধী, ওদের নিয়ে তোর এত ভাবা লাগবে না। তোর পায়ে আরেকটা জোঁক ধরেছে নিচে তাকিয়ে দেখ। ”

নবনী তাকিয়ে দেখে বাম পায়ের এক পাশে জোঁক ঝুঁলছে। এটা দেখে ওর হাসি পেয়ে যায়। কাব্য অবাক হয়।

“হ্যাঁ রে নবনী, তোর কি কিছুতেই ভয় লাগে না? জোঁক ঝুঁলছে তোর পায়ে আর তুই হাসছিস? ”

নবনী আরও হাসে। শরীর কাঁপিয়ে হাসতেই থাকে। ওর পাগলামি দেখে কাব্য ও আর কিছু বলে না। এবার ও জোঁক টা টান দিয়ে ছাড়িয়ে রুমালের আরেক অংশ দিয়ে ওই পা ও বেঁধে দেয়।

অবশেষে ওরা চলে আসে ওদের গন্তব্যে।
বর্ষাকালে হাম হামে যাবার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝর্ণার। কিন্তু এখন তো বর্ষাকাল নেই। হাম হামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে।

অথৈ এখনো নিবিড়ের কোলে। নিবিড় ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে যায় আবার ও।

“আপনি কি নামবেন ম্যাম? নাকি কোলে নিয়েই ঝর্নার নিচে চলে যাব? ”

অথৈ ও নিবিড়ের সাথে দুষ্টুমি ভরা চাহনি নিয়ে ওভাবেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আপনি চাইলে আমাকে সারাদিন কোলে নিয়েও ঘুরতে পারেন জনাব। আমি একটু ও বারণ করব না। ”
“বাপরে! কি আবদার। যাই তবে ঝর্নার নিচে? ”
“চলো। ”
“এভাবে কোলে নিয়েই ভিজবো? ”
“হ্যাঁ, এভাবেই। পারবে না? ”
“সন্দেহ আছে? ”

অথৈ এই কথার উত্তরে কিছু বলে না। চোখ বুজে ফেলে। নিবিড়ের ঘাড়ের পাশে মুখ লুকিয়ে নেয়। দুপুরের তপ্ত রোদে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে।
নিবিড় ধীর পায়ে পানি পেরিয়ে এগিয়ে যায় ঝর্নার নিচে।

ঝর্নার জলরাশি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একটা সুদর্শন পুরুষের কোলে উঠে বুকে মুখ লুকিয়ে একটা উঠতি বয়সী রমণী ঝর্নার পানিতে ভিজছে। এই দৃশ্যটা দেখা কেউ মিস করে কি? আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই।

কাব্য, নীল, রিদ এবং নবনী ৪ জনেই জোরে উল্লাস করে ওঠে। তারপর সবাই মিলে ছুটে যায় ঝর্নার নিচে।
____
চলব

১৩
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
নবনী নীল কে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। নীল ও পাল্টা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয় ওকে। কাব্য আর রিদ গেছে অন্য পাশে ওরা ঝর্ণার নিচে একটা পাথরের উপর বসে গল্প করছে।
নিবিড় এখনো অথৈ কে কোলে নিয়ে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

“নিবিড়। ”
“বলো। ”
“এবার নামিয়ে দাও আমায়। ”
“শিওর? ”
“হ্যাঁ, ”

নিবিড় ওকে নিচে নামিয়ে দেয়। কিন্তু অথৈ ওকে ছাড়েনি। গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবিড় এক হাত ওর কোমরে রাখে। অবিরাম গতিতে পানির ধারা বইছে। ঝুমঝুম পানিতে ওরা ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। চুল গড়িয়ে পানি পরছে। নিবিড় তাকিয়ে আছে এক ভাবে। অথৈ যেন এখন ততটা ও লজ্জা পাচ্ছে না। দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড়ের কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। শরীর ঝিম ধরে আসছে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পরছে ধীরে ধীরে।

“অথৈ শোনো। ”
“বলো। ”
“আফিমের চাইতেও ভয়ানক নেশা বোধহয় তোমার মাঝেই আছে। নয়তো আমার এমন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো লাগছে কেন? ”
“নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছো বুঝি? ”
“হয়ে গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে কি? ”

অথৈ লাজুক হাসে। নিবিড় জোরে কয়েক বার শ্বাস নেয়। তারপর আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে খানিক দূরুত্বে গিয়ে দাঁড়ায়। অথৈ ও কিছু বলে না। ও জানে নিবিড়ের মনের সাথে বুঝতে সময় প্রয়োজন। ওকে সময় দেওয়া উচিত।
_____
রাত ২ টা বাজে। নিবিড়ের ডাকে অথৈ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে বসে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। অথৈ কিছুক্ষণ চোখ কচলায়। নিবিড় রুমের কোথাও নেই। কিন্তু একটু আগেই ও স্পষ্ট শুনেছে নিবিড় ছাদে যাওয়ার জন্য ডাকছিল।

মনে মনে ভাবে, নিবিড় হয়তো ডাক দিয়ে চলে গেছে আগেই।

অথৈ টমির দিকে তাকায়। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। টমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। টমির জন্য রাখা ছোট কম্বলটা ওর উপর হালকা ভাবে ছড়িয়ে দেয়। তারপর উঠে যায় বিছানা থেকে। পা টিপে টিপে ছাদে চলে যায়।
ছাদে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। নিবিড় নেই। ভালো করে পুরো ছাদে খুঁজে দেখে। কোথাও নেই। অথৈ বেকুব হয়ে যায় যেন। মনে মনে নিবিড় কে বকতে থাকে। ওকে আসতে বলে সে নিজেই আসেনি। এটা কোন কথা? মাঝরাতে এমন ফাজলামি করার কোন মানে হয়?

কিছুক্ষণ বিষন্ন হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। যেহেতু এখন ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আপাতত আর ঘুম হবে না এখনই। তাই চুপচাপ দূরের পাহাড় দেখে। গুনগুন করে একটু গান গায়। শীত এখন আর নেই। তবুও বাইরের শোঁ শোঁ বাতাসে হালকা শীত লাগছে। রুম থেকে চাদর টা নিয়ে আসলে বোধহয় ভালো হতো।

ঠিক সেই সময় নিবিড়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওর ঘুম ভাঙ্গলে যত রাতই হোক না কেন এক কাপ চা অথবা কফি বানিয়ে নিয়ে ছাদে চলে যায়। মাঝরাতে ছাদে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে একাকিত্ব ভীষণ সুন্দর মন হয় ওর। ঝটপট এক কাপ চা বানিয়ে ফেলে। দ্রুত চলে যায় ছাদে। ছাদের দরজায় পা রাখতেই হঠাৎ চমকে যায়। নিবিড় ভাবে, এত রাতে কে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে? ভুত বলতে কিছু নেই সেটা ও জানে। ভুতে বিশ্বাস ও করে না। কিন্তু এই মাঝরাতে কে এমন চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এভাবে?

নিবিড় পা টিপে টিপে আরেকটু কাছে যায়। ট্যাঙ্কির পাশে গিয়ে উঁকি দেয়। তখনই অথৈ পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়।
আচমকা দুজনের চোখাচোখি হতেই অথৈ ভয়ে একটা চিৎকার দেয়। ওর চিৎকার শুনে নিবিড় ও ভয়ে কেঁপে ওঠে। চা ছলকে কাপ থেকে অল্প পড়ে গিয়ে নিবিড়ের শার্ট ভিজে যায়। গরম চা ছিল তাই কিছুটা বুকে লেগে জ্বালাপোড়া শুরু করে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।

“এই অথৈ, সমস্যা কি তোমার? এত রাতে ভুতের মতো ছাদে কি করো তুমি? এসেছো ভালো কথা। এভাবে আমাকে দেখে চিৎকার করতে বলেছে কে তোমায় হু? ”

“আরে থামো। আমাকেও একটু বলতে দাও। ”
“বলো। ”
“তুমি নিজেই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললে ছাদে আসতে। তোমার কথা শুনে আমি চলে আসলাম। এসে দেখি তুমি নেই। আর এখন জিজ্ঞেস করছো আমি এত রাতে ছাদে কি করি? ”

“আজব কথা বার্তা তো! আমি কেন এত রাতে তোমায় ছাদে আসতে বলব? ”
“তুমি না বললে কি আমি একা আসব? ”
“আমার ও তো সেম কথা। আমি কেনই বা এত রাতে তোমায় ছাদে আসতে বলব। আমি তো তোমার ঘরে যাইনি। মাত্র ঘুম ভাঙ্গলো আমার। ”

অথৈ খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবে। তারপর নিবিড়ের দিকে তাকায়।
“আচ্ছা, আমারই বোঝার ভুল। ঘুমের মাঝে কোন স্বপ্নে দেখে হয়তো ভেবেছি তুমি ডাকছো। ”
“হ্যাঁ, তাই হবে। ”
“যাক গে সেসব কথা। তোমার জন্য শুধু চা নিয়ে আসলে? ”

“হ্যাঁ, আমি তো জানতাম না ভুত ও আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে। ”
“এই একদম মজা করবে না বলে দিলাম। ”
“ইশ! একটু ও মজা করছি না আমি। যাইহোক, চা টা তুমিই নাও। ”
“আমি একা কেন খাব? ”

নিবিড় দুষ্টু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“তবে কি এক কাপ চা’য়ে দুজনে চুমুক দিতে চাও? ”

অথৈ গলার স্বর টা একটু নিচু করে বলে,
“এমন হলে কি মন্দ হবে জনাব? ”
“উম্ম, একদমই না। ”

চা’য়ে প্রথম চুমুক টা অথৈ দেয়। তারপর নিবিড়। দুজনে মিলে চা শেষ করে। অথৈ আবদার করে ছাদের রেলিং এ বসবে। নিবিড় যদিও বারণ করে অনেক বার। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। রেলিং এ সে বসবেই। অগত্যা নিবিড়ের রাজি হতে হয়। অথৈ কে কোমর ধরে উঁচু করে বসিয়ে দেয় রেলিং এর উপর। যেন পড়ে না যায় সেই জন্য নিবিড় ওর কোমর জড়িয়ে রাখে।

“নিবিড়। ”
“বলো। ”
“তুমি ভীষণ ভালো। ”
“এতটাও ভালো নই কিন্তু আমি। ”
“তোমার বলার প্রয়োজন নেই। বুঝি তো আমি। ”
“কি বোঝো? ”

অথৈ নিবিড়ের চোখের দিকে তাকায়। ওই চোখে তাকিয়ে কি যেন একটা খোঁজে। তারপর একটা প্রশ্ন করে,

“আচ্ছা, তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসে ছিলে? ”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন? ”
“এমনিই। বলো না। ”

“হ্যাঁ, সেই ছোটবেলায়। স্কুলে একবার একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল। কয়েক মাস একটু চোখাচোখি, তারপর প্রপোজ করলাম। দুইমাস লুকিয়ে প্রেম করতে না করতেই ওর বাবা-মা জেনে গেল। তারপর ওকে নিয়ে ওদের পরিবার ঢাকা শিফট হলো। তখন তো ফোন ও ছিল না আমাদের। যোগাযোগ করার কোন উপায় ও ছিল না। কিছুদিন বিষন্ন ছিলাম। তারপর সব ভুলে গেলাম। কবেই সেসব ভুলে গেছি। তুমি এখন জিজ্ঞেস করলে দেখে মনে পড়ল। ”

কথা শেষ করে নিবিড় মৃদু হাসে। সেই হাসির দিকে অথৈ তাকিয়ে থাকে কিভাবে যেন।

“এই তোমার কি হলো শুনি? ”
“কই, কিছু না তো। ”
“তুমি কি প্রেম-টেম করেছিলে কখনো? ”
“আরে ধুর। আমি হলাম বাচ্চা মানুষ। এগুলো কখন করব। ”
“আমিও তো বাচ্চা কালেই প্রেম করেছিলাম। ”

নিবিড় আবার ও হাসে। এখন ওর সাথে অথৈ ও হেসে ফেলে।

“নিবিড় শোনো না। ”
“বলো না। ”

নিবিড়ের “বলো না” কথাটা শুনে অথৈ জোরে হেসে ওঠে। কেমন একটা সুর টেনে কথাটা বলে।

“একি! হাসছো কেন এভাবে? ”
“তোমার কথা শুনে। ”
“আমি কি ফানি কিছু বলেছি? ”
“আরে না। বাদ দাও। আরেকটা কথা। ”
“কি কথা? ”

“এখন কাউকে ভালোবাসো কি? ”
“উম্ম, কঠিন প্রশ্ন। ”
“বলো প্লিজ। ”
“এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানি না অথৈ। ”
“ধরো কোন মেয়ে তোমাকে মনে মনে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সে কোন এক অজানা কারণে বলতে পারছে না। সেক্ষেত্রে মেয়েটার কি করা উচিত বলে তোমার মনে হয়? ”

“বলে দেওয়া উচিত। ভালোবাসা কখনো ভেতরে চেপে রাখতে নেই। চেপে রাখলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভালোবাসা কে দ্রুত নিজের করে নেওয়া উচিত। বুঝলেন ম্যাম? ”
“জ্বি, জনাব। বুঝলাম। ”

“অনেক সময় ধরে তুমি রেলিং এ বসে আছো। এবার নামো। ”
“নামিয়ে দাও আমায়। ”

নিবিড় ওকে নিচে নামায়। অথৈ দূরের পাহাড় দেখে। আনমনেই বলে দেয়।

“দূরের ওই পাহাড় ছুঁতে চাই। ”
“কোনটা? ”
“ওইযে সামনের উঁচু পাহাড় টা। ”
“যাবে এখন? ”
“কি বলো! এত রাতে? ”
“যদি তুমি চাও তবে কোন অসম্ভব আবদার ও আমি অপূর্ণ রাখব না। আর এটা তো মামুলি ব্যাপার। ”

অথৈ এর চোখে হঠাৎ পানি জমে। এত সুন্দর কথা বোধহয় আগে কোনদিন শোনেনি কোথাও। এভাবে ও কেউ বলতে পারে? ওর সব আবদার রাখবে এমন মানুষ যে পৃথিবীতে আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিল সেই কবে।

নিবিড় অথৈ এর দুই বাহুতে হাত রাখে।
“এই মেয়ে, কাঁদছো কেন শুনি? ”
“আমি যদি তোমায় একবার জড়িয়ে ধরি। তবে কি রেগে যাবে? ”
“বোকা মেয়ে। বললাম না তোমার কোন আবদার আমি অপূর্ণ রাখব না। ”

অথৈ পা উঁচু করে নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। নিবিড় ও আলতো ভাবে ওর কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবেই। নিবিড়ের কাঁধে চোখের পানি পড়ে শার্ট ভিজে যাচ্ছে।

“করছো কি অথৈ? শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছো একেবারে। এভাবে কেউ কাঁদে? ”

অথৈ কান্নার দমকে নাক টেনে টেনে কথা বলে,
“হ্যাঁ, আমি এভাবে কাঁদি। কথা বলবে না তুমি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। ”
“তখন ও কিন্তু তোমার চিৎকারে গরম চা পড়ে আমার পেট হালকা পুড়ে গেছে। ”

“যাক পুড়ে। তুমি ভুতের মতো পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? ”
“ইশ! একটু ও মায়া নেই মেয়েটার। ”
“উঁহু, নেই। ”
“পঁচা মেয়ে একটা। ”
“যা মন চায় বলো। ”
“নাহ। লক্ষী একটা মেয়ে তুমি। ”

অথৈ ওকে ছেড়ে দেয়। নাক দিয়ে পানি আসছে। নিবিড়ের শার্ট টেনে ওর নাক মুছে নেয়। নিবিড় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।

“কি করলে এটা! আমার শার্টে আর কিছু ফেলার আর মোছার বাকি আছে তোমার? ”
“আবার মুছবো? ”
“পুরো শার্ট টাই খুলে দেই? ”

অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
“চলো বাসার ভেতর চলে যাই। রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল। ”
“চলো যাই। ”

অথৈ রুমে ঢুকতে যাবে তখনই নিবিড় ওর হাত টেনে ধরে।

“কিছু বলবে? ”
“হ্যাঁ, ”
“জলদি বলো। ”

“ভালোবাসলে কেন মুখে বলেই প্রকাশ করতে হবে অথৈ? ভালোবাসি না বলেও তো ভালোবাসা যায়। পুরুষ মানুষের ভালোবাসা অদ্ভুত বুঝলে? পুরুষ তার শখের নারীর অসুস্থতায় যেভাবে যত্ন করে। ঠিক ওই যত্নটার মাঝেও ভালোবাসা থাকে।
প্রিয় মানুষটা নিখোঁজ হয়ে গেলে পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে যেভাবে খুঁজতে থাকে। ওই দিশেহারা হবার মাঝেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।
মেয়েটা এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হলে চিন্তায় অস্থির হয়ে যেভাবে বার বার কল দেয়। ওই কল দেওয়ার মাঝে সেই অস্থিরতাই আসলে ভালোবাসা।
বন্ধুদের মাঝে ব্যস্ততার সময়ে ও প্রিয় মানুষের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে দেওয়ার সময় কফিতে কয় চামচ চিনি মেশালে মেয়েটা তৃপ্তি পাবে সেই ধারণা রাখাটাই ভালোবাসা।

আমি না হয় আমার ভালোবাসা টা অন্য ভাবেই প্রকাশ করলাম। তাতে ক্ষতি কি বলো? ”

অথৈ আর কিছু বলতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের মুখের দিকে। ও বুঝে যায় কোন কারণে নিবিড়ের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।

নিবিড় ওর গালে আলতো করে হাত রাখে।
“অনেক রাত অথৈ। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কোন দরকার হলে আমায় ডেকো। আমি আছি। ”

এইযে সে বলল “আমি আছি”। এই কথাটাই তো সব। কয়জন পুরুষ এভাবে বলতে পারে সে পাশে আছে?
____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে