১০
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
নিবিড় চমকে অথৈ এর দিকে তাকায়। অথৈ ও তাকিয়ে আছে। আশেপাশের লোকজন ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ধীনেশ মল্লিক ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
নিবিড় অথৈ এর দিকে আরেকটু এগিয়ে আসে। গালে হাত দিতেই আবার অথৈ ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। কাব্য এগিয়ে আসে। হাত চেপে ধরে।
“এই অথৈ তুই আমাদের চিনতে পারছিস না? আমি তোর কাব্য ভাইয়া। আর ও নিবিড়। চিনছিস না তুই? আমাদের না ট্যুরে যাবার কথা ছিল? ”
অথৈ কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথা ঝিম ঝিম করছে বেশ কিছুদিন ধরে। জ্ঞান ফেরার পর এখানে কিভাবে আসলো। এরা কারা কোথায় ও। কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু কিছু মনেও করতে পারছিল না। এখন আচমকা এতগুলো ছেলে কে এক সাথে এভাবে কাছে আসতে দেখে আরও ভয় পেয়ে যাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করছে ভীষণ ভাবে।
নীল রিদ সবাই মিলে ওকে রিল্যাক্সে ভাবতে বলছে। নীল ওর ফোনের ছবিগুলো দেখাল।
পাশে থেকে একজন লোক কয়েকটা মোড়া এনে বসতে দিলেন সবাই কে। নিবিড় মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। অবচেতন মন বলছে, ওর কি স্মৃতি হারিয়ে গেছে? কিন্তু এভাবে কি আদৌ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়?
নিবিড় পুলিশে কল করল। জানানো হলো অথৈ কে পাওয়া গেছে। ধীনেশ মল্লিকের সাথে ও বেশ খানিকক্ষণ এই বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করলো।
অথৈ এর কিছু মনে পরছে না এখনো। কিন্তু চুপচাপ শান্ত হয়ে ওদের পাশেই বসে আছে। কিছু বলছে না।
রিদ গিয়ে মণিপুরীদের সবাই কে ধন্যবাদ জানালো। ওদের মধ্যে বিষ্ণু নামের এক লোক আর দুটো মহিলা বেশ জোড়া জুড়ি করল আপ্যায়নের জন্য। যেন আজ রাতটা ওখানেই থাকে। নিবিড় কোন ভাবেই রাজি না। ওকে ডক্টর দেখানো জরুরী ভিত্তিতে দরকার।
কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। এভাবে খালি মুখে কোন ভাবেই বের হতে দেবে না। আর দুদিন পর ওদের রাসপূর্ণিমা উৎসব। কার্তিকের পূর্নিমা তিথিতে ওরা রাসপূর্ণিমা উৎসব পালন করে। এই সময়ে কেউ আসলে তাকে ফেরত পাঠানো ওদের কাছে অমঙ্গলের দেখায়।
আর যেহেতু এটা ওদের সব চেয়ে বড় উৎসব তাই অনেক বড় করেই পালন করা হবে। ওদের ধারণা অনুযায়ী অথৈ কে দেবতারা কল্যাণকর হিসেবে ওদের কাছে নিয়ে এসেছে। নয়তো বিপদে পড়া একটা মেয়ে ওদের সন্ধানেই কেন আসবে? নিশ্চয় ওদের দেবতা চায় এই উৎসবে এই মেয়েটা ওদের সাথেই উপস্থিত থাকুক। তবেই সবার মঙ্গল।
ধীনেশ মল্লিক কে মণিপুরীদের একজন তাদের এই ধারণা টা জানালো। তিনি আবার কাব্য কে ডেকে নিয়ে অনুরোধ করলেন উৎসব পর্যন্ত একটু কষ্ট করে ওদের সাথে থেকে যেতে। অগত্যা ওরা সবাই রাজি হলো উৎসবে থাকার। কিন্তু এই দুদিন এখানে থাকা সম্ভব নয়। আজকে ওরা ফিরে যাবে। আগামীকাল বিকেলে সবাই মিলে এক সাথে আসবে।
তারপর এক সাথে উৎসবে আনন্দ উপভোগ করবে।
মণিপুরীদের ওদের এই কথার বিপরীতে আর কিছু বলার রইল না। ওরাও মেনে নিল। উৎসবে উপস্থিত থাকলেই হবে। এতেই বাকিরা খুশি।
____
কেউ কেউ গল্পে মশগুল। নিবিড় এক ভাবে অথৈ এর দিকে তাকিয়েই আছে। রিদ অথৈ এর সাথে অনেক গল্প জমিয়ে ফেলেছে। দুই তিন জন মেয়ে একটু পর আসলো বিভিন্ন রকমের খাবার আর পিঠে নিয়ে। ওরা সবাই খেলো। খাওয়া শেষে আরও কিছু সময় বসে থাকলো সেখানেই। তারপর সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেল বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে।
নিবিড় গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে রিদ, পেছনে নীল আর কাব্য। কাব্যর কাঁধে মাথা রেখে অথৈ ঘুমিয়ে গেছে। জানালা খোলা ছিল। সাঁই সাঁই করে বাতাস আসছিল। জানালা লাগিয়ে দিল। পাহাড়ের আঁকে বাঁকে রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে।
বাসার কাছে আসতেই অথৈ এর ঘুম ভেঙে যায়। গাড়ি থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে সোফায় ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। নিবিড় কফি বানাতে যায়। সবার জন্য কফি নিয়ে আসে। এক মগ অথৈ এর দিকে এগিয়ে দেয়।
বাকিরা কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর অথৈ এর সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করছে।
নিবিড় বলল, আগামীকাল ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। এই কথা শুনে অথৈ মুখ তুলে চাইলো।
“কি বললে তুমি? ডক্টরের কাছে কেন নিয়ে যাবে আমায়? ”
“কারণ, তুমি আমাদের কাউকে চিনতে পারছ না। নিশ্চয় মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছিলে। ”
“আমি একদম ঠিক আছি। এতটাও চোট লাগেনি। আমি ডক্টরের কাছে যাব না। নেহাত তোমাদের সাথে আমার ছবি ছিল। নিশ্চয় আমরা পরিচিত সেজন্য তোমাদের সাথে আসতে রাজি হয়েছি। নয়তো আমি কখনোই আসতাম না। ”
রিদ আরেকটু বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“সেটাই তো অথৈ। তুমি আমাদের ভুলে গেছো। এজন্য ডক্টরের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কেন ভুলে গেলে সেটা তো আমাদের জানতে হবে নাকি? ”
অথৈ চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। মাথা যন্ত্রণা করছে। কিন্তু কিছু বলছে না।
“আমি ডক্টরের কাছে যাব না বললাম তো। ”
“কেন যাবে না? এমন জেদ করছো কেন তুমি? ”
নিবিড়ের কথা শুনে অথৈ এর মাঝে কি হয় ওর বুঝে আসে না। রাগে কফির মগটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। আশেপাশে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলছে। আচমকা ওর এই আচরণে সবাই ভয় পেয়ে যায়।
কাব্য এগিয়ে যেতে চাইলে নিবিড় ওকে থামিয়ে দেয়। উদাস নয়নে তাকিয়ে বলে,
“যাস না ওর কাছে। ভাঙ্গতে থাকুক যতক্ষণ ওর মন চায়। ”
কাব্য অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের দিকে। এই ছেলেটা কেমন ভাবে ভালোবাসে অথৈ কে ওর বোঝার আর বাকি নেই। ভেতরে ওর রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে। সেটাও ও বুঝতে পারছে।
অথৈ আরও কিছু জিনিস ভাঙ্গে। তারপর চিল্লাচিল্লি করতে থাকে।
“আমি বলেছি ডক্টরের কাছে যাব না। মানে যাব না। জোর করলে আমি আবার যেখানে মন চায় চলে যাব। বুঝেছো তোমরা? ”
অথৈ চিল্লাচিল্লি করে একটা রুমে চলে যায়।
ওরা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নীল আফসোস করতে থাকে।
“এই হাসি খুশি মেয়েটার হঠাৎ কি হয়ে গেল বলতো? এবার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার। ”
রিদ আর কাব্য মিলে রুমের ভাঙ্গা সব কাঁচ আর জিনিস গুলো তুলে ফেলে দিয়ে আসে।
রাতে সবাই চিন্তায় চিন্তায় জেগে থেকে ভোরের দিকে সোফাতেই ঘুমিয়ে যায়।
_____
অথৈ এর ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৯টায়। উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গে। হাই তুলে পাশে তাকিয়ে দেখে টমি পিট পিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ওকে কোলে তুলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমু খায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। নিবিড় আর রিদ রান্নায় ব্যস্ত। কাব্য সোফায় এখনো ঝিমাচ্ছে। নীল বসে বসে কি সব ভাবছে। অথৈ এসেই একদম স্বাভাবিক ভাবে সবাই কে গুড মর্নিং জানায়।
সবাই হকচকিয়ে যায় এমন স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে। ওদের কে আরেক দফা চমকে দিয়ে অথৈ সোফায় ধপাস করে বসে নিবিড় কে চিল্লিয়ে ডাকে।
“নিবিড় এক কাপ চা দিয়ে যেও প্লিজ। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে আমার। ”
নিবিড় আর রিদ এই কথা শুনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে।
“এই অথৈ, তোমার সব কিছু মনে পড়ে গেছে? আমাদের চিনতে পারছো তুমি? ”
অথৈ যেন ওদের কথা শুনে আকাশ থেকে পরলো।
“চিনতে পারছি মানে কি? এমন অদ্ভুত কথা বলছো কেন? ”
কাব্যর ঘুম ছুটে গেছে। ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
“আশ্চর্য! কাব্য ভাইয়া, তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তোমাদের মাথা কি খারাপ হয়ে গেল? ”
“মানে কি? গতকালকের কথা তোর মনে নেই? তুই রাতে ভাঙ্গচুড় করলি কিচ্ছু মনে নেই? এটা কিভাবে সম্ভব? ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।
“তোমাদের সবারই কি হয়েছে বলো তো। কি সব বলে যাচ্ছো আবোল-তাবোল। আমাদের না ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল? কবে যাবে শুনি? ”
ওর এমন স্বাভাবিক আচরণ দেখে নিবিড় সবাই কে এই টপিক বাদ দিতে বলে। সবাই এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায় আপাতত। অথৈ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আদৌ কি গতকাল এমন কিছু হয়েছিল? কই, ওর তো মনে পড়ছে না কিছু?
কাব্য এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“এখন কেমন আছিস তুই? ”
“অনেক ভালো আছি ভাইয়া। কিন্তু হঠাৎ এভাবে বলছো যে? ”
কাব্য কিছু বলে না। শান্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। অথৈ ও আর কিছু বলে না।
রিদ এসে জিজ্ঞেস করে,
“এই অথৈ, তোমার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে হলে বলো আমি ঝটপট এখনি বানিয়ে দেব। ”
রিদের কথা শুনে অথৈ খুশি হয় ভীষণ। খুশিতে চোখ মুখ চিকচিক করে ওঠে।
“সত্যি খাওয়াবে? ”
“তোমায় কখনো মিথ্যে বলেছি বুঝি? ”
“উঁহু, একদমই না। ”
“কি খাবে বলো। ”
“পাতিচখা ভর্তা দিয়ে গরম ভাত। ”
কথাটা শেষ করেই অথৈ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
ওর দিকে তাকিয়ে সবাই এক সাথে হেসে ফেলে। রিদ ও রাজি হয়ে যায়।
“পাতিচখা ভর্তা খেয়েছো তবে? তোমার যেহেতু ভালো লেগেছে আমি অবশ্যই বানিয়ে খাওয়াবো। আজকেই খাবে? ”
“হ্যাঁ, দুপুরে খাব। ”
“ঠিক আছে। ”
নিবিড়ের এবার শান্তি লাগছে অনেক টা। মনে হচ্ছে কলিজাটা ফিরে আসলো। অথৈ এখন আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে। এটা ভালো দিক। তবুও একদিন ওকে রাজি করিয়ে ডক্টর দেখানো দরকার। সমস্যা টা আসলে কি সেটা জানা প্রয়োজন। আর অথৈ রোজ ওর মায়ের সাথে কথা বললেও ফোনে কোনো নাম্বার কেন ছিল না। এই রহস্যটা জানা প্রয়োজন।
____
চলবে
১১
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
ভোরের দিকেই নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা এবং ওর ছোট বোন নবনী চলে আসে বাসায়। অনেক দিন পর মনে হচ্ছে বাসাটা একটু ভর্তি ভর্তি। নিবিড়ের মা আর বোনের সাথে রোজই ভিডিও কলে অথৈ এর কথা হতো।
বেশ ভালো সম্পর্ক ওর সবার সাথেই। মিসেস রেহেনা কে অথৈ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
নবনী তো অথৈ কে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি। ওদের গল্পের ভান্ডার শেষ হচ্ছে না কোন ভাবেই। নিবিড়ের ও সবাই কে এতদিন পর কাছে পেয়ে ভালো লাগছে।
মিসেস রেহেনা ছেলে কে জড়িয়ে ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। কপালে চুমু খেলেন আলতো করে।
“আমার আব্বা, ভালো আছো তুমি? ”
“এইযে দেখ, ভীষণ ভালো আছি মা। তোমরা এসেছ না? ”
ওর মা হাসলেন ছেলের কথা শুনে। নবনী এসে ভাই কে বলল,
“এই ভাইয়া, তোরা নাকি মণিপুরীদের রাস উৎসবে যাবি? ”
“যাব তো। তুই খুশি হচ্ছিস কেন? তোকে তো নেব না। ”
“মানে কি ভাইয়া? আমাকে নিবি না কেন? ”
নিবিড় হাসতে থাকে। নবনী আরও রেগে যায়।
“এই অথৈ আপু, দেখো ভাইয়া কি বলে। আমাকে নাকি নেবে না তোমাদের সাথে। ”
“তোমার ভাইয়ের কথা শুনছে কে শুনি? আমরা সবাই যাব। তোমার ভাইয়াকেই নেব না। ”
এগুলো নিয়েই ওরা অনেক্ষণ মজা করে সময় পাড় করে দেয়।
_____
কাব্যরা সবাই বিকেলের দিকে চলে আসে নিবিড়দের বাসায়। নীল আসার সময় নবনী আর অথৈ এর জন্য দুটো মণিপুরী শাড়ি ও কিনে নিয়ে এসেছে। শাড়ি পেয়ে তো ওরা দুজন ভীষণ খুশি। রেহেনা ওদের দুজন কে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। শাড়ি পরা শেষে দুজন কে একদম মণিপুরীদের মতো করে সাজিয়ে দেন তিনি। রুম থেকে ওরা দুজন নিচে নেমে আসে। কাব্য, নীল, রিদ সবাই অনেক প্রশংসা করলো। এত প্রশংসা পেয়ে তো নবনী আর অথৈ আইসক্রিমের মতো গলে যাচ্ছে।
নবনী নিবিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
“এই ভাইয়া বল তো আমাকে কেমন লাগছে? ”
নিবিড় বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সুন্দর করে হেসে উত্তরে বলল,
“চাঁদ কিন্তু একদম তোর মতো সুন্দর। ”
নবনী এই কথায় এত খুশি হয় যা বলার মতো না। ওর ভাইটা আসলেই সবার থেকে আলাদা। কি সুন্দর করে সব সময় প্রশংসা করে। নিবিড় জানে তার বোনের কিসে আনন্দ। এত সুন্দর কথা শুনে নবনীর আনন্দে শেষই হচ্ছে না।
তবুও সে বাকিদের সামনে গিয়ে ও বলে,
“এই ভাইয়া তোমরা বলতো আমাকে সুন্দর লাগছে
না? ”
রিদ ওর মাথায় দুম করে একটা মেরে দেয়।
“কখন থেকে বলছি তোকে সুন্দর লাগে। তবুও আবার জিজ্ঞেস করছিস। কি ন্যাকা রে তুই নবনী। ”
নবনী খিলখিলিয়ে হাসে। বাকিরা ও হাসে। নিবিড় সবার অগোচরে অথৈ এর দিকে তাকায়। কি সুন্দর মেয়েটা! অথৈ ও যেন আজ একটু অন্যদিনের তুলনায় লাজুক ভাবে তাকিয়ে আছে। বেশি কথা বলছে না। আগের সেই চটপটে স্বভাব টা আজকে ঠিক নেই। সারা মুখ জুড়ে লজ্জা লজ্জা একটা আভা ছড়িয়ে আছে। সবার সাথেই সে হাসি মুখে কথা বললেও নিবিড়ের দিকে ঠিক ভাবে তাকাচ্ছে না।
এই বিষয়টা কাব্য ও খেয়াল করে। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে ওর ঠোঁটে ও একটা হাসির রেখা দেখা দেয়।
সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়ে বাসা থেকে।
রাসলীলা উৎসবের দুটি পর্ব। দিনের বেলায় রাখালরাস আর রাতে মহারাস। ওরা ভেবেছিল সকালে যাবে। কিন্তু সকালে আর যাওয়া হয়নি। তাই রাতের মহারাস দেখার জন্য বিকেলে বের হয় সবাই মিলে।
রাখালরাস উৎসবে মূলত, কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখালরাস’ বলা হয়ে থাকে। রাখালরাসের শুরুতে বালক কৃষ্ণ, বলরাম আর সখাদের গোচারণে যাবার অনুমতি দিতে গিয়ে মায়েদের অশ্রুমাখা বিলাপ গীত-মুদ্রায় রূপায়িত হয়।
রাসলীলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও মুদ্রা সমন্বয়ে নৃত্যে ব্যাপকতা ও সাবলীলতা থাকে। এ নৃত্যে পোশাকের মধ্যে তেমন কোনো বাহুল্য থাকে না। গোপীরাও শ্রীরাধার পোশাক, মাথায় চূড়ার ওপর ‘ককনাম’, মুখে পাতলা সাদা কাপড়ের ঢাকনা ‘মেইকুম’, গায়ে রেশমি ব্লাউজের ওপর জড়ানো সাদা লংকথ ‘থারেং’ ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া ছোটখাট বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বিশেষ করে চন্দন, ধূতিসহ পায়ে নূপুর ব্যবহার নৃত্যকে কমনীয়, আকৃষ্ট ও মোহাবিষ্ট করে তোলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে স্বর্ণালংকারও ব্যবহার করা হয়।
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানান,
“মহারাস লীলার মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলার কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা। ”
ওরা সবাই সেখানে পৌঁছাতেই মণিপুরীদের এক দল ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসলো। ওরা এসেছে দেখে সবাই খুব খুশি। দুটো ছেলে ছুটে গিয়ে মোড়া নিয়ে আসলো। ওদের কে বসতে দিল। ৩-৪ জন মেয়ে ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই হরেক রকমের পিঠা সাজিয়ে নিয়ে এসে ওদের সামনে দিল। আপ্যায়ন এর কোনো ত্রুটি তারা রাখছে না। অথৈ আর নবনীর এই ব্যাপার গুলো অনেক ভালো লাগছে।
একটু পর পরই অথৈ নীল কে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। নীল সুন্দর করে সব কিছু ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
রাতের দিকে শুরু হলো রাসনৃত্য। অনেক কিশোরীরা দল বেঁধে সুন্দর করে নৃত্য করছে। বাকিরা দেখছে। আশেপাশেই খাবারের দোকান বসেছে বেশ কিছু। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা আশেপাশের অনেক পর্যটকরা এই উৎসব দেখতে চলে এসেছে এখানে। সবাই বেশ ভালোই মজা করছে। সুন্দর মূহুর্তটা উপভোগ করছে।
তিনটা মেয়ে এসে অথৈ আর নবনী কে ওদের সাথে টেনে নিয়ে গেছে নৃত্য করার জন্য। সুন্দর ভাবে সবাই হাতে হাত ধরে, মাঝে মাঝে আরও অন্য রকম ভাবে নৃত্য করছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। এখানকার মেয়ে না হয়েও অথৈ নিজেকে সব সময় সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে। ওর এই স্বভাবটাই বাকিদের মুগ্ধ করে ফেলে।
নিবিড় পুরো সময়টুকু শুধু অথৈ এর দিকেই তাকিয়ে আছে। অথৈ ও কখন বেখেয়ালি হয়ে নৃত্য করতে করতে এক সময় সবার মাঝে থেকে এসে নিবিড়ের এক হাত চেপে ধরে রেখেছে ওর খেয়াল নেই সেটা।
কাব্য নিবিড়ের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“দোস্ত, তুই কিন্তু প্রেমে উল্টে পরেছিস সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। এবার প্রপোজটা করে ফেল ঝটপট। বেশি সময় নিস না। ”
কথা শেষ করেই কাব্য মুখ টিপে হেসে অন্য পাশে চলে গেল ফোন টিপতে টিপতে। নিবিড় অবাক হয়ে কাব্য কে দেখে। এই ছেলেটা কিভাবে যে ওকে এতটা বোঝে নিবিড়ের মাথায় আসে না। পরক্ষণেই কাব্যর কথা গুলো সে ভাবে। আসলেই কি ওর বলে দেওয়া উচিত এবার?
_____
কাব্য কল রিসিভ করেই ধমকে ওঠে,
“পৃথা, সমস্যা কি তোমার? বার বার কল দিয়ে এত বিরক্ত করো কেন আমায়? ”
“তোমার খোঁজ নিতেই কল দেই। একটু ভালো করে কথা বললে কি হয় বলো তো। সব সময় এমন কেন করো আমার সাথে তুমি? ”
“কেন এমন করি সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। আমি আগেও বলেছি এখন ও বলছি আমি কখনো বিয়ে করব না। আমার বিয়ে করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে কখনোই হয়নি। আর যদি আমি বিয়েই না করি। তবে তোমার সাথে এমনি প্রেম করে আমার লাভটা কি? আমি এসব টাইম পাসের মতো স্টুপিড কাজে নেই। ”
“কাব্য, আমি তো তোমাকে বলিনি আমায় বিয়ে করতে। টাইপ পাস ও করতে বলছি না। আমাকে শুধু একটু সময় দিও মাঝে মাঝে। তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে আমার। নিঃসঙ্গ মুহূর্ত গুলো আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। প্লিজ আমায় এতটা অবহেলা করো না তুমি। ”
“আমি চাইছি না তোমাকে কষ্ট দিতে। তাই ভালো হয় যদি শুরুতেই তুমি আমাকে ভুলে যাও। বোঝার চেষ্টা করো পৃথা। ”
“আমাকে নিয়ে তোমায় ভাবতে বলিনি আমি। ভালোবাসতে ও বলিনি। শুধু একটু সময় চাই। মাঝে মাঝে কল দিলে ৫ মিনিট কথা বলবে। এতটুকুই তো। বেশি কিছু তো চাইছি না। ”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নারী সঙ্গ তার কখনোই পছন্দ ছিল না। প্রেম থেকে সব সময় দূরে থেকেছে। অনেক মেয়েরাই তাকে চাইলেও কখনো সে পাত্তা দেয়নি। তবে পৃথা মেয়েটা বাকিদের থেকে আলাদা। ওর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। চাওয়া বলতে একটু সময়। তাতেই সে সন্তুষ্ট। এমন মেয়েদের আসলে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। পুতুলের মতো সাঁজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাব্যর ঠিক সেই অনুভূতি টা কাজ করে না। আর অনুভূতি ছাড়া কখনো কোন সম্পর্কে জড়ানো ও যায় না। জোর করে গেলানোর মতো অবস্থা।
_____
ওদের জন্য আবার রাতে খাবারের আয়োজন করে কয়েকজন। এত মানুষ আর উৎসবের মধ্যে ও ওদের কথা যে এরা মনে রেখেছে সেটা ভাবতেই অথৈ এর ভালো লাগছে। সব ব্যস্ততার মাঝেও আপ্যায়ন এর কমতি রাখছে না। মণিপুরীদের এই আতিথেয়তা বেশ চমৎকার।
কাব্যরা এগুলো সম্পর্কে জানলেও অথৈ এর এসব জানা নেই। তাই ও একটু বেশিই অবাক হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আনন্দ ও লাগছে অনেক।
চাকমাদের মতো মণিপুরীরাও খাবারে তেল ও মশলার ব্যবহার করে না বললেই চলে। প্রাত্যাহিক জীবনে মণিপুরীরা আঠালো ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ সবজি এবং বিভিন্ন রকমের ডাল দিয়ে তৈরি ‘খার’ খায়। খার তৈরিতে ডালের সঙ্গে আদা পাতা, হলুদ পাতা, লেবু পাতা দেওয়া হয়। এরপর তাতে কলাগাছ পুড়িয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ছাই দেওয়া হয়, যা খারে ব্যতিক্রমধর্মী এক ফ্লেভার যোগ করে। তাদের প্রতিবেলা ভাতের সঙ্গে থাকা আরেকটি সবজি তরকারি হচ্ছে ‘পালটৈ’।
মণিপুরীদের খাদ্য তালিকায় মাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।
পরবর্তীতে চৈতন্যের আদর্শে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তারা তা পরিহার করে। মণিপুরীদের যেকোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই খাওয়া-দাওয়ার একটি পর্ব থাকে। যাকে ‘বান্দারা’ বলে। বান্দারায় মণিপুরীদের বিশেষ সালাদ ‘চিনচু’ বেশ সমাদৃত। এছাড়াও ভর্তা ও ডাল জাতীয় খাবার এদের বিশেষ পছন্দের। বিভিন্ন উৎসবে মণিপুরীরা এক বিশেষ মাছের তরকারি রান্না করে, যা ‘নাগা’ বলে পরিচিত।
নীল অথৈ কে জিজ্ঞেস করে,
“খাবার মুখে দিয়ে বলতো কেমন মজা? ”
অথৈ অল্প ভাতের সাথে এক টুকরো মাছ মুখে নেয়। ধীরে চিবিয়ে সুন্দর করে ওইটুকু শেষ করে। তারপর সেদ্ধ সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে নেয়। এরপর মিষ্টি মুখ করে। সব একটু একটু করে খেয়ে একদম মুখের ভাবভঙ্গি সুন্দর ভাবে প্রকাশ করে। এর মানে সবাই বুঝে যায়। খাবার টা ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
ওরা রাতের খাবার শেষ করে দেখতে পায় আরও কিছু ভিন্ন রকমের উৎসবের আমেজ। এগুলো করতে করতে রাত প্রায় শেষের দিকে। তখন একজন আসলো নিবিড়দের আজকের রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। পরেরদিন সকালে উঠে ওরা এখানে থেকে চলে যাবে।
একটা ঘরে নবনী আর অথৈ। আরেক ঘরে ছেলেরা।
ওরা দুজন তো গল্পে মশগুল হয়ে গেছে। সারাদিনে কত মজা করলো। এই নৃগোষ্ঠীদের উৎসব আয়োজন সব মিলিয়ে গল্প যেন শেষই হচ্ছে না ওদের। রাত পেরিয়ে কখন ভোর হয়ে যায় কারোর খেয়ালই নেই।
____
চলবে