অথৈ মহল পর্ব-০৯

0
6


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
______
আজ ৫ দিন ধরে অথৈ নিখোঁজ। নিবিড়ের অবস্থা ভয়াবহ রকমের খারাপ। কাউকে সহ্য করতে পারে না। কেউ সামনে আসলেই চিল্লাতে থাকে। আর রাত বাড়লেই খুঁজতে খুঁজতে না পাওয়ার পর মেয়েদের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনের মধ্যে সব সময় খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আশার আলো না থাকা সত্ত্বেও আশা ছাড়তে কেউ পারছে না।

আজকে পুলিশ জানিয়েছে শ্রীমঙ্গলের ওই দিকে অথৈ এর খোঁজ পাওয়া গেছে কিছুটা। এখন সেখানে পৌঁছাতে পারলেই বাকি খবর জানা যাবে। নিবিড় সবাই কে রেখেই বেড়িয়ে পরেছিল। পরে নীল, কাব্য আর রিদ ওর পিছু নিয়ে ওর সাথে যাচ্ছে আবার। পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছিল। এই অবস্থা দেখে কাব্য ওকে সরিয়ে নিজে ড্রাইভ করতে থাকে।
নিবিড় চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে যাচ্ছে আজকে যেন ওকে নিরাশ হয়ে কোন ভাবেই না ফিরতে হয়।
মনের সকল খারাপ চিন্তা দূরে রেখে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কি হবে ভেবে পাচ্ছে না কেউ।
_____
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ শ্রীমঙ্গল। চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপি। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২শ’ কি.মি. দূরত্বে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রকৃতির আদুরেকন্যা, সুবিশাল পাহাড়ের পাদদেশে আর হাইল-হাওরের পিঠে ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভাসহ উপজেলা শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলের আয়তন ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা বাগান ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল। প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন শ্রীমঙ্গলে দেখার আছে চা বাগানের পর চা বাগান, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়াছড়া ইন্সপেকশন বাংলো, খাসিয়াপুঞ্জি, মণিপুরীপাড়া, ডিনস্টন সিমেট্রি, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নির্মাই শিববাড়ি, টি-রিসোর্ট, ভাড়াউড়া লেক, পাহাড়ি ঝর্ণা, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য আর হাজারো প্রজাতির গাছ-গাছালি। শ্রীমঙ্গলের পাদদেশে অবস্থিত এককালে বৃহত্তর সিলেটের মৎস্যভান্ডার বলে খ্যাত ‘হাইল-হাওর’ এবং শীতের শুরুতে সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী পার হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা শীতের পাখি।

শ্রীমঙ্গলের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত স্বতন্ত্র স্বত্বার উপজাতি জনগোষ্ঠী খাসিয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরা ও গারোদের জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কারণেও এ অঞ্চলের নাম অনেকের কাছে সুপরিচিত। তাছাড়াও চা, রাবার, লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠ ইত্যাদি নানা কারণে শ্রীমঙ্গলের প্রসিদ্ধি রয়েছে সর্বত্র। প্রকৃতিই শ্রীমঙ্গলের প্রাণ। ভ্রমণবিলাসীদের কাছে এ এলাকাটি যেন তীর্থস্থান – প্রকৃতিপ্রেমীদের আপন নীড়। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদভারে বছরের প্রতিটি দিন মুখরিত থাকে শ্রীমঙ্গল। আর এ কারণে শ্রীমঙ্গলে গড়ে ওঠেছে অনেক আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরা। সরকারি, আধা-সরকারি সংস্থার একাধিক রেস্টহাউজ ও চা বোর্ড পরিচালিত একটি ‘টি রিসোর্ট’। এ জনপদের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারাদেশের। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল আকৃষ্ট করেছে অগণিত পর্যটককে।

দেশের পাহারী ও ঘন বনাঞ্চল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় আর শ্রীমঙ্গলে পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও শীত পড়ে। আর চা চাষ উপযোগী অন্যান্য উপাদানের সাথে প্রধান এ উপাদান গুলোর জন্য দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান গড়ে উঠেছে মৌলভীবাজার জেলায়। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে এ জেলায় পড়েছে ৯১ টি চা বাগান।

শ্রীমঙ্গল জায়গাটা ওদের সবার এত পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আজকে কারোর দৃষ্টি এই প্রকৃতি তে নিবন্ধ হচ্ছে না। এই প্রকৃতি আজকে ওদের মুগ্ধ করতে পারছে না কোন ভাবেই।

গাড়িটা মল্লিক বাড়ির সামনে এসে থামলো। ভেতর থেকে একজন লোক এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল কাকে চাই?
কাব্য এসে কথা বলে,

“ধীনেশ মল্লিক কি বাসায় আছেন? আমরা ওনার সাথে দেখা করতে এসেছি। ”
“আজ্ঞে, কত্তা মশাই ঘরেই আছেন। আপনেগো আসার অপেক্ষাতেই তিনি বইসা আছে। ভেতরে আসেন। ”

ওরা সবাই ভেতরে চলে যায়। বারান্দায় একজন ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক লোক বসে আছেন। ওরাও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। ধীনেশ মল্লিক সামনের চেয়ার দেখিয়ে ওদের বসতে বললেন। গৃহকর্মী কে বললেন চা দিয়ে আসতে। ওরা মানা করা সত্ত্বেও তিনি শুনলেন না।

“বাবা, তোমরাও তো সিলেটেরই মানুষ। জানোই তো আমরা আপ্যায়ন করতে ভালোবাসি। প্রথম আসছো। বসো, চায়ে চুমুক দিতে দিতে মূল কথায় আসা যাক। ”

চা নিয়ে আসলো। ধীনেশ মল্লিক চা এগিয়ে দিলেন। তারপর কথা শুরু করলেন।

“গত পরশু খবরের কাগজ খুলে তোমাদের ওই বিজ্ঞপ্তি টা চোখে পরলো বুঝলে? তো মেয়েটার ছবি দেখতেই আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। অনেক্ষণ ভাবলাম কোথায় যেন দেখেছি। পরে মনে পরলো, আমি প্রায়ই পাহাড়ের ওই দিকে যেখানে খাসিয়া, মণিপুরীরা থাকে সেখানে যাই। ওদের সাথে গল্প সল্প করি। আমাকে আবার ওরা খুব সম্মান করে তো এই জন্য। বয়স্ক মানুষ। তাই ওদের সঙ্গ পেলে আমারও খুব ভালো লাগে। ওই সেদিন যখন গেলাম। কিছু মণিপুরী মেয়েদের সাথে আমি আরেকটা মেয়েকে দেখেছি। মণিপুরীদের মতো পোশাক পড়াই ছিল। কিন্তু তবুও এক ঝলক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটা ওদের জাতের কেউ না। খুব ভদ্র, শান্ত একটা সুন্দর মুখশ্রী। এক নজরেই বোঝা যাচ্ছিল শহরের কোন মেয়ে।

তাই ওদের আমি জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা কে। কিন্তু ওরা কোন উত্তর দিল না। মেয়েগুলো এক নজর তাকিয়ে ওকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। পরে আরেকজন কে জিজ্ঞেস করতেই বলল, মেয়েটা নাকি অজ্ঞান হয়ে পাহাড়ের ঢালু তে পড়েছিল কিছুদিন আগে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছিল। পরে ওরা নিয়ে এসে ওদের বিভিন্ন জড়িবটি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছে। দুদিন কোন হুশ ছিল না। আর জ্ঞান ফেরার পর ও কিছু বলছে না। ওদের বললাম পুলিশে জানাতে হবে। কিন্তু কেউ রাজি হলো না সেদিন।

আর পরশুদিন খবরের কাগজ খুলতেই তোমাদের বিজ্ঞপ্তি দেখে বুঝলাম এই সেই মেয়ে। তাই সেখানে দেওয়া নাম্বারে কল করলাম। কল দিয়ে তোমাদের না পেয়ে পুলিশে জানালাম। ”

ধীনেশ মল্লিক কথা শেষ করতেই নিবিড় গিয়ে ওনার হাত চেপে ধরেন। উত্তেজনায় অনেক্ষণ কথাই বলতে পারলো না। চোখের পানি তার হাতের উপর পরলো। মাথাটা তুলে ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“দাদু, আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন ভাবতেও পারছেন না। এভাবে অচেনা হয়েও আমার প্রাণটা ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনি। আমি আমৃত্যু আপনার কাছে ঋণী থাকব। ”

ধীনেশ মল্লিক নিবিড় কে ধরে দাঁড় করালেন। কাধ চাপড়ালেন।

“আরে পাগল, দাদু ডেকেছ না? তবে আর ঋণ কিসের? এটা তো আমার দায়িত্ব ছিল। একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। তাকে দেখে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব না? সেটা কখনো হয়? এখন আমার সাথে চলো। তোমাদের ওদের ওখানে নিয়ে যাই। ”

ওরা সবাই বের হলো। পাহাড়ের এই দিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই হেঁটেই যাচ্ছিল। আর তিনি বললেন বেশি দূরে ও না। নিবিড়ের এখনো উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে।
তারপর আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে ওরা মণিপুরীদের বাসস্থানে চলে আসলো। ধীনেশ মল্লিক একজন কে ডাকলেন। ডেকে বললেন মেয়েটা কে বাইরে নিয়ে আসতে। সেই লোকটা এক নজর ওদের সবাই কে দেখল। তারপর ভেতরে গিয়ে একজন কে বলে আসলো মেয়েটা কে নিয়ে আসতে।

নিবিড় চোখ বন্ধ করে আছে। আবার মনের মধ্যে কু ডাকছে। এটা ওর অথৈ যদি না হয়? কি হবে তখন?

অতঃপর দেখলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো মণিপুরীদের শাড়ি পরা মণিপুরীদের সাঁজের একটা মেয়ে। একটা মিষ্টি পুতুলের মতো দেখতে। নিবিড়ের হার্টবিট কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। গলা শুকিয়ে আসলো।
ওর হঠাৎ কি হয়ে গেল জানা নেই। ছুটে গিয়ে অথৈ কে বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে ধরে। যেন একটু আলগা হলেই ওকে আবার হারিয়ে ফেলবে।

বাকিরা ওদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য কোনদিন দেখা হয়নি।
ছোট ছোট বাচ্চারা ওদের চারপাশে ভীড় জমিয়েছে। এখানে কি হচ্ছে সেটা দেখতে। উঠতি বয়সের কিছু রমণী এই ভাবে জড়িয়ে ধরা দেখে মুখ চেপে হাসছে।

কাব্যদের ও কলিজায় যেন পানি আসলো এতক্ষণে।
কিন্তু! অথৈ আচমকা নিবিড় কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,

“কে আপনি? ”

এই প্রশ্নে উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেল।
____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে