অথৈ মহল পর্ব-০৮

0
33


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
সকালে নিবিড়ের ঘুম ভাঙ্গে নীলের ফোন কলে। ঝটপট ওঠে পরে। আজকে ওদের ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হবার কথা। কোথায় কোথায় ঘুরবে সেটা গতরাতেই সব ঠিক করে রেখেছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। অথৈ এর রুমের দরজার কাছে যেয়ে বাইরে থেকে কয়েক বার ডাক দিয়ে ওকে উঠতে বলে। তারপর চলে যায় বাদ বাকি সব গোছাতে।

১ ঘন্টা পর রিদ, নীল, কাব্য চলে আসে। সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। রিদ অথৈ কে দেখতে না পেয়ে ওকে ডাকতে থাকে।

“এই নিবিড় অথৈ কি ঘুম থেকে ওঠেনি নাকি। ডাকছি সাড়া দিচ্ছে না। ”
“ঘুমাচ্ছে হয়তো এখনো। আমিও ডাকলাম। এক্সাইটমেন্টে কাল সারারাত ঘুমায়নি। আমার রুমে ঘুর ঘুর করেছে অনেক্ষণ। তার জন্য হয়তো ঘুম ভাঙ্গেনি। ”

“কিন্তু বের হতে হবে তো। নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। ”

কাব্য উঠে দাঁড়ায়। অথৈ কে ডাকতে উপরে যায়। দরজায় বেশ অনেক্ষণ নক করে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই।

“এই অথৈ, কিভাবে ঘুমাচ্ছিস। ওঠ না এবার। আজকে কিন্তু আর যেতে পারবি না দেরি করলে। ”

তবুও কোন সাড়া নেই। দরজা খোলাই ছিল। কাব্য দরজা টা খুলে ভেতরে যায়। বিছানা এলোমেলো। কিন্তু অথৈ নেই। ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে আছে। কিন্তু ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখে বাইরে থেকে লাগিয়ে দেওয়া। তার মানে এখানে নেই। ও নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে আবার।

“অথৈ তো রুমে নেই। কোথায় গেল? ”
“ওয়াশরুমে হয়তো গেছে। ”
“সেখানে ও তো নেই। বাইরে থেকে দরজা লাগানো। ”
“উফ! এই মেয়েটা কে নিয়ে আর পারি না। দেখ নিশ্চয় ছাদে গিয়ে বসে আছে। ”

কাব্য ছাদে যায়। কিন্তু সেখানে ও অথৈ কে দেখতে পায় না। নিচে নেমে আসে।

“নিবিড়, অথৈ ছাদেও নেই। ”

এবার নিবিড়ের খটকা লাগে। এভাবে সকাল সকাল কোথায় যাবে। না বলে তো কোথাও যায় না। আর কাব্যরা আসলেই যেখানে থাকুন না কেন অথৈ ছুটে চলে আসে। আজকে সাড়াশব্দই নেই।

“এই তোরা একটু বাকি রুম গুলো তে খুঁজে দেখ তো। আমি বাইরে দেখে আসি। ”

রিদ, নীল, কাব্য ভেতরে সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। আর নিবিড় বাইরে যায়। বাসার আশেপাশে একবার ঘুরে দেখে। কিন্তু পায় না। তারপর চা বাগানের দিকে নেমে যায়। সেখানে ও খোঁজ করে। আবার কাব্য কে ফোন দিয়ে শোনে ভেতরে আছে কি না।

কিন্তু আশানুরুপ কোন খবর নেই। নিবিড়ের চিন্তা বাড়ছে। এখানে আসার পর একা একা কোথাও অথৈ এই পর্যন্ত যায়নি। তাই তেমন কিছু চেনেও না। আজকে কোথায় চলে গেল এভাবে না বলে। নাকি ওর বাবা খুঁজে পেয়ে নিয়ে গেছে কিন্তু এমন কিছু হলেও তো ও জানতো। আশেপাশে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে। একে ওকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রাস্তায় দেখেছে কি না।

বাকিরা ও বাইরে আসে। ৪ জন দুটো গাড়ি নিয়ে দুই জায়গায় ভাগ হয়ে আলাদা ভাবে খোঁজা শুরু করে। অথৈ এর ফোন ও বিছানায় ফেলে চলে গেছে। যার ফলে কল দিয়েও লাভ নেই। নিবিড়ের শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। এত চিন্তা শেষ কবে করেছিল ওর মনে নেই। এমন লাগছে যেন, খুব কাছের কেউ হারিয়ে গেছে। যাকে না পেলে ও নিঃস্ব হয়ে যাবে।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মাথাটা পেছনের ছিটে হেলিয়ে দেয়। নীল বুঝতে পেরে নিবিড় কে ওর পাশে রেখে ও ড্রাইভ করতে থাকে। নিবিড়ের চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। আশেপাশের সব জায়গায় খুঁজেও আর পায় না।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, তারপর সন্ধ্যা। সবাই ভয়ে আছে। না জানি ওর কি বিপদ হলো।

রিদ শেষে ওদের কে পুলিশে ডায়েরি করিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়। আপাতত এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারপর ওরা সবাই মিলে পুলিশ স্টেশনে যায়। সেখানে গিয়ে ডায়েরি করিয়ে চলে আসে বাসায়।

৪ জনই অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে।
“তোদের কি মনে হয় অথৈ কোথায় যেতে পারে? ”

নীলের কথা শুনে কাব্য ঘুরে তাকায়।

“কিভাবে বলি বলতো? যদি ওর বাসায় চলে যাওয়ারই থাকে। তবুও তো বলে যেত। এমন তো না এখানে ওকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল আর ও সুযোগ পেয়ে চলে গেছে। আর সব থেকে বড় কথা টমি কে রেখে গেছে। যেই টমি কে ছাড়া অথৈ কিছুই বোঝে না। ”

টমি বোধহয় ওর নাম শুনে ঘার এদিক সেদিক ঘুরায়। মিউ মিউ করে। যতক্ষণ বাসায় ছিল টমি এদিক সেদিক অথৈ কে খুঁজেছে। এখন রিদের কোলের মধ্যে বসে আছে।

রাত বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এবার কি করবে মাথা কাজ করছে না। ওই রাতেই আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যেহেতু বড় গাড়ি নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। সব রাস্তায় ঢুকানো যায় না। তাই বাইক সব থেকে ভালো। টমি কে ঘরে আটকে রেখেছে। নয়তো ওদের যেতে দেখলে পিছু নেবে। আর এই বৃষ্টি তে ও ভিজলে অসুস্থ হয়ে পরবে। কাজেই চার জন বেরিয়ে পড়ে।
রাতের আধারে ঘুটঘুটে অন্ধকারেও প্রতিটা ওলিতে গলিতে খুঁজতে থাকে। বৃষ্টি তে ভিজে সবার যুবুথুবু অবস্থা। ওরা অথৈ কে নাম ধরে বার বার ডাকতে থাকে। সারারাত কোথাও না পেয়ে ভোরের দিকে বাসায় চলে আসে।
_____
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে রোদ উঠে যাচ্ছে। এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশরা ও কোন তথ্য পায়নি। আশেপাশের যত বাজে ছেলেদের গ্যাং আছে। যারা নেশা করে সবাই কে পুলিশ ধরে নিয়ে এসে অথৈ এর কথা জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু ওরা কেউ কিচ্ছু জানে না। মূলত, কেউ ওকে চেনেই না।

নিবিড়ের মাথা ঘুরতে থাকে। চোখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কি করবে, কি বলবে ভেবে পায় না। তখনই চট করে মনে পড়ে অথৈ তো কলে ওর আম্মুর সাথে কথা বলতো। ফোন তো রেখেই গেছে। কল লিস্টে ওর আম্মুর নাম্বার থাকার কথা। সেখানে ফোন দিলেও তো জানা যাবে।

অথৈ এর ফোন টা নীলের কাছে ছিল। নীলের কাছে গিয়ে ফোন টা চায়।
“ওর ফোনটা দে তো নীল। ”
“কি করবি। ”
“দরকার আছে দে। ”

ওর ফোন নিয়ে দ্রুত ওর কল লিস্টে যায়। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও অথৈ এর ফোনে ওর আম্মুর নাম্বার তো দূর কোন নাম্বারই নেই। শুধু কি সব হাবিজাবি সংখ্যা তুলে কল দেওয়া হয়েছে এই ফোন থেকে। কিন্তু এগুলো কারোর নাম্বার না। ছোট বাচ্চাদের হাতে ফোন দিলে যেভাবে এমনি একটা চাপতে চাপতে কল চলে যায় ঠিক সেই রকম।

কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? অথৈ তো প্রায়ই কলে ওর আম্মুর সাথে কথা বলতো। কলে হাসাহাসি করতো। এগুলো তাহলে কি? কার সাথে কথা বলতো ও? নাকি কথা বলা শেষে সব নাম্বার ডিলিট করে দিত। কি এক রহস্য লাগছে সব কিছু। নিবিড়ের মাথা আউলে যাচ্ছে। অথৈ তবে কার সাথে কলে বকবক করতো। এমন তো হবার কথা নয়? চিন্তা টা এবার দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

নিবিড় এই কথা আর কাউকে বলে না। চুপ করে বসে থাকে। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছে। অলরেডি রিদের জ্বরে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। নীলের সর্দি লেগে গেছে। একটু পর পর নাকের পানি মুছতে হচ্ছে। কাব্য আরেক বার পুলিশের কাছে ফোন করে। জানতে চায় কোন খোঁজ পেলো কি না। কিন্তু তারা ও কিছু বলতে পারছে না এখনো।

নিবিড় হুট করে রেগে যায়। চিল্লাচিল্লি করতে থাকে।

“পুলিশরা কোন বাল করছে তাহলে? এতজন মিলেও এখনো একটা মেয়ে কে বের করতে পারছে না। তারা কিসের নিরাপত্তা দিতে ডিউটি করে? বাল ফালাইতে? ”

ওরা সবাই নিবিড়ের এমন আচরণে চমকে যায়। কারণ, সে কখনো রাগে না। আর রেগে গেলেও নিজেকে যথেষ্ট সামলে রাখে। বাজে কোন শব্দ এই পর্যন্ত কেউ নিবিড়ের মুখ থেকে শোনেনি। কিন্তু আজ যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।

কাব্য এগিয়ে আসে।
“শান্ত হ ভাই। রেগে গেলে কোন কাজ হবে না। চল আজকে আশেপাশের সব পর্যটক কেন্দ্র গুলো তে খুঁজে দেখে আসি। হতেও তো পারে ওকে আমরা খুঁজে পেলাম। ”

“আর যদি না পাই? ”

নিবিড়ের এই কথাটা কেমন যেন শোনালো। অনুভূতি শূন্য মানুষের মতো। কাব্যর বুকের মাঝে খচ করে কামড়ে উঠলো। এই একটা কথাতেই ও বুঝে যায় নিবিড় অথৈ কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এতটা ভালোবাসে এটা বোঝেনি। কাব্য নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে। পিঠ চাপড়ে বলে।

“ইন শা আল্লাহ খুঁজে পাবোই। চল তো এখন। ”

ওরা আবার বেরিয়ে পরে নতুন ভাবে। আবার খোঁজ শুরু হয়। এখানে ওখানে। আদৌ কি ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে? এ কেমন চিন্তায় ফেলে গেল মেয়েটা!

কাব্যের ফোন বাজছে। ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই মেয়ে সব সময় এমনি এক সময়েই কল দিয়ে কাব্যর মন মেজাজ খারাপ করে দেবে। কল কেটে দিলে আবার ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কারোর কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আপাতত মাথায় অথৈ এর চিন্তা ঘুরছে। ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। খুব দ্রুত।
____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে