৬
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গে। নিবিড় অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। হাত ঘড়িটা পরতে পরতে আয়নায় ভেতর বিছানার দিকে তাকায়। অথৈ চোখ পিটপিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নিবিড় ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ঘুম ভাঙ্গলো? উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। ”
অথৈ চোখ কোঁচলে তাকায়।
“আমিও আজকে যাব তোমার সাথে। ”
নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়।
“তুমি যেয়ে কি করবে? ”
“আমি বসে থাকব তোমার কাছে। ”
“সারাদিন? ”
“হ্যাঁ, ”
“জলদি রেডি হয়ে নাও তবে। আমার সময় নেই কিন্তু। ”
নিবিড়ের পারমিশন পেয়ে এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামে। দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ফ্রেশ হয়ে আরেক দৌড়ে যায় জামা বের করতে। নিবিড় ওর দৌড়াদৌড়ি দেখে চিল্লাতে থাকে।
“এই অথৈ আস্তে। পরে গেলে কিন্তু কোমরটা যাবে। ”
বলতে না বলতেই অথৈ ধপাস। জোরে চিৎকার করে ওঠে। নিবিড় দৌড়ে যায় ওর কাছে।
“বললাম না পড়ে যাবে? বেশি ছটফট করো তুমি। এবার ঠিক হয়েছে একদম। আরও লাফাও। ”
অথৈ ছলছল চোখে তাকায়।
“নিবিড়, আমি ব্যথা পেলাম। তুমি কোথায় হিরোর মতো আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে কোমরে ম্যাসাজ করে দিবে। তা না করে দাঁড়িয়ে থেকে উপদেশ বানী শোনাচ্ছ? ”
নিবিড় এবারও ভিমড়ি খায় ওর কথায়। এত বড় মেয়ের কোমরে নাকি সে হাত দেবে। ভাবতেই তো ওর হাসফাস লাগা শুরু হয়ে যায়।
“দেখি আমার হাত ধরো। ”
নিবিড় ওকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয়। অথৈ মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে।
“কি? ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। তোমাকে আজকে নিয়ে যাচ্ছি না। রেস্ট নাও তুমি। বেশি ব্যথা লেগেছে? ডক্টর ডাকব? ”
“লাগবে না। ”
“এইযে দেখ, আবার মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। ”
নিবিড় চলেই যাচ্ছিল। অথৈ আবার পিছু ডাকে।
“নিবিড় শোন। ”
“বলো। ”
“কোলে নাও আমায়। ”
কি নিঃসংকোচ একটা আবদার। কিন্তু নিবিড় বার বার বিপাকে পরে যাচ্ছে। এই মাথা পাগল মেয়ে কে নিয়ে সে করবে টা কি? অগত্যা ওর কাছে যায়। অথৈ হাত বাড়িয়ে রেখেছে। নিবিড় গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। অথৈ ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। নিবিড় ওর চোখের দিকে তাকায়।
“এবার হয়েছে? তুমি শুয়ে থাক। আমি অফিসে যাই? দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। খাবার ও দিয়ে যাচ্ছি। ”
অথৈ আবার ঠোঁট ফোলায়। গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“তুমি কোথাও যাবে না। ”
“অফিসে যাব না? ”
ও মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে।
“আমার কাজগুলো কে করে দেবে শুনি? ”
“তোমার ম্যানেজার করে দেবে। ”
“সবারই আলাদা কাজ আছে গো। ”
“এত কিছু আমি বুঝি না। তুমি যাবে না ব্যস। ”
“আচ্ছা। তাহলে এখন আমি কি করব মহারাণী? ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হাসে।
“আমাকে কোলে নিয়ে পুরো বাসা ঘুরে বেড়াবে এখন। ”
“বাপরে! কি আবদার। ”
“জিম করে এত সুন্দর বডি বানিয়েছ। আর আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পাড়বে না? ”
“হাহ! তোমার যে স্বাস্থ্য। তোমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরতে পাড়ব। ”
“আচ্ছা তাই? ”
“হ্যাঁ তো। ”
“তাহলে চলো। ”
নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অথৈ পুরো সময় টা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন ওর চেহারা টা মুখস্থ করে রাখছে। নিবিড় ব্যপার টা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসে। একটু দুষ্টুমি করে বলে,
“কি হচ্ছে শুনি? এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো যে? আমি পুরুষ বলে কি আমার লজ্জা টজ্জা নেই নাকি হুঁ? ”
এই কথা শুনে অথৈ লজ্জায় একদম নিবিড়ের গলায় মুখ গুজে দেয়। এবার বোধহয় নিবিড় নিজের কথার প্যাচে নিজেই ফেসে গেল। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? শেষে না পেরে ওর দিকে তাকায়।
“এইযে মেয়ে, এভাবে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে টালমাটাল করে দিয়েন না। তার থেকে বরং আপনি আমাকে মুখস্থ করতে থাকুন। সেটাই ভালো। ”
অথৈ এই কথা শুনে আরও লজ্জা পায়। মুখ তুলে ওর দিকে তাকায় তবুও। আরও একটা আবদার করে।
“আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। পাহাড় দেখব। তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরবে। ”
নিবিড় ওর কথা মত বাইরে নিয়ে যায়। কোলে নিয়েই হাঁটছে এখনো। দূরে দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের গাড়িটা এদিকেই আসছে। গাড়িটা ওদের সামনে এসে থামে। অথৈ গাড়ি দেখেই চিল্লাতে থাকে।
“ইয়েএএএএ! নীল ভাইয়াআআ। ”
অবশেষে গাড়ি থেকে শুধু নীল না। কাব্য আর রিদ ও বের হয়ে আসে। কাব্য এসে অথৈ এর মাথায় চাটি মা*রে।
“কি রে, কি এমন অকাজ করলি যে তোকে এই সাত সকালে নিবিড়ের কোলে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে? ”
রিদ সামনে চলে আসে।
“নিশ্চয় পড়ে গিয়ে হাত-পা মচকে ফেলেছে। কি অথৈ? ঠিক বললাম তো? ”
নিবিড় অথৈর দিকে তাকায়।
“দেখেছ? তুমি যে কি কি অকাজ করো সেটা সবাই বুঝে গেছে। ”
নীল হো হো করে হেসে ওঠে। অথৈ এর কাছে গিয়ে বলে,
“এই অথৈ, এদের কথা কানে দিও না তো। তোমার যখন খুশি লাফাবে, ঝাঁপাবে। পরে গিয়ে হাত-পা ভাঙ্গবে। বাকিটা আমি দেখে নেব চাপ নিও না তুমি। ”
অথৈ হেসে নিবিড়ের দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, “দেখলে তো আমার টিমেও একজন আছে। ”
নিবিড় নীল কে আরও এক ধাপ বকাবকি করে।
“তুই ওকে এমন বানিয়েছিস। এখন আরও অকাজ শেখাতে থাক। শেষে আমাকেই ওকে নিয়ে ঘুরতে হবে। ফাজিল একটা। ”
সবাই হেসে ওঠে। তারপর এক সাথে সকলে বাসার ভেতর চলে যায়। অথৈ কে সোফায় বসিয়ে দেয়। দুই পা সে কাব্যর পায়ের উপর তুলে রাখে। নিবিড় খাবার নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছে। নীল অথৈ কে দুনিয়ার সব অকাজ শেখাচ্ছে।
রিদ দ্রুত ফোন বের করে এই সুন্দর মুহূর্তটা ক্যাপচার করে ফেলে।
কিছু সুন্দর মুহূর্ত গুলো বাঁধাই করে রেখে দিতে হয়। তবেই না পরবর্তীতে এগুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে। এমন কিছু মানুষ যাদের জীবনে আছে তারাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে,
“সুখ শান্তি গুলো তারাই উপভোগ করছে ভীষণ ভাবে। ”
রিদ প্রশান্তির শ্বাস নেয়। ওদের ৪ জনের মধ্যে ছোট বোন বলতে শুধু নিবিড়ের আছে। ওদের তিন জনের বোন নেই। নবনী কে ওরা ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে এই মেয়েটা। রিদ ওকে ছোট বোনের মতোই ভালোবেসে ফেলেছে। এমন মায়া মায়া আদুরে মুখটা দেখলে কার না শান্তি লাগবে।
_____
অথৈর মাথা খারাপ করতে নীল এবার ভয়ানক আইডিয়া দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। মুখ খুলতেই যাবে সেই মুহূর্তে নিবিড় ওকে শাসায়।
“নীল, একটা কথা ও মুখ দিয়ে বের করবি না। তোর খবর আছে কিন্তু। ”
নীল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অথৈ চোখ কান খাড়া করে থাকে। কখন নীল পেটে চেপে রাখা কথা টা বলবে সেই অপেক্ষা করে। কাব্য তুলো নিয়ে এসে অথৈ এর কানে গুজে দেয়। অথৈ কাব্যর দিকে তাকায়।
“ভাইয়া, এইটা কি হলো? কানে তুলো গুজলে কেন? ”
“কানে তুলে গুজে দিলাম এই কারণে। যেন তুই নীলের কোন কথা শুনতে না পাস। ”
অথৈ শুনতে না পেয়ে কাব্যর দিকে আরেকটু কান এগিয়ে দেয়। কাব্য ওর মাথায় একটা গাট্টা মা*রে।
“সর ওই দিকে। ”
ও চুপ করে বসে থাকে। রিদ নিবিড়ের সাথে কথা বলে,
“অনেক দিন থেকে ট্যুরে যাওয়া হয় না। তাই ভেবেছিলাম এবার একটু ট্যুরে যাব। সেই প্ল্যান করতেই এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি এই মেয়ে কোমড়ে ব্যথা পেয়ে বসে আছে। তাই আপাতত এই টপিক বাদ দিচ্ছি। ”
কাব্য অথৈ এর কানে তুলো গুজলে কি হবে? নীল সবার চোখ এড়িয়ে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ঠিক সময় ওর কান থেকে তুলো খুলে নিয়েছে। যার ফলস্বরূপ, অথৈ পুরো কথা শুনে ফেলেছে। রিদের কথা শেষ হতেই ও চিল্লিয়ে ওঠে।
“রিদ ভাইয়াআআ! তোমরা ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করতে এসেছিলে? ইশ! আগে জানলে কি আমি এমন ঝাঁপাঝাঁপি করতাম? ”
কাব্য বুঝতে পারলো তুলো খুলে দিয়েছে নীল। রুমের মধ্যেই ওকে এক প্রকার দৌড়ানি দেয়। টমি মিউ মিউ করে অথৈর কোলে গিয়ে বসে। নিবিড় অথৈর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়।
“এইযে মহারাণী, এই ছোট মাথায় কি সব বুদ্ধি আটছেন বলুন তো? কোন ভাবেই ট্যুরে যাওয়া যাবে না। ভুলেও নীলের সাথে তালে তাল মেলাবেন না। বোঝা গেছে? ”
অথৈ মুখ ভেংচিয়ে অন্য দিকে তাকায়। ভাবখানা এমন।
যেন সে বলছে, “তোমার কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে। ”
কাব্য আর নীল হাপিয়ে গিয়ে এসে আবার সোফায় বসে পরে।
অথৈ মন খারাপ করে বসে থাকে। নিবিড় বুঝে ও কিছু বলছে না। বেশ অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও নিজেই কথা বলে।
“নিবিড়, চলো না কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমি বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি একদম। ”
“সেদিন না নীল তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসলো? ”
“একবারে কোনদিন হলো? তাও তো নীল ভাইয়া রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। দূরে কোথাও ঘুরে আসি প্লিজ। আমি কখনো এভাবে ট্যুরে যাইনি। আব্বু-আম্মুর সাথে যেই কয়বার গিয়েছি। ওদের সাথে সাথেই থাকতে হয়েছে। কোন মজা আছে বলো? ”
নীল ও সায় দেয়।
“অথৈ তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। এরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে। তোমার তো তেমন কিছু হয়নি। তাই না বলো? ”
অথৈ ও উঠে দাঁড়ায়। সুস্থ হবার ভান ধরে।
“দেখ, আমি দাঁড়িয়েছি। একদম সুস্থ আমি। চলো না যাই প্লিজ। ”
কাব্য নীল কে আরও কিছু বলতে যেয়ে ও থেমে যায়। অথৈ কে বোঝাতে থাকে।
“শোন, জেদ করিস না। কোমরে বেশ ব্যথা পেয়েছিস। কয়টা দিন রেস্ট নিয়ে সুস্থ হ। তারপর এক সাথে সবাই হৈহৈ করতে করতে যাব। শেষে এই অবস্থায় গিয়ে যদি আবার অসুস্থ হয়ে যাস? ঘুরতেই পারবি না। আনন্দ ও করতে পারবি না। মাথায় কিছু ঢুকল কি? ”
অথৈ মাথা নাড়ায়। বিজ্ঞদের মতো একটা ভাব নেয়। যেন সে বুঝে একদম উদ্ধার করে ফেলেছে।
“আচ্ছা, যাও। আমি সুস্থ হলেই যাব। কিন্তু সত্যি যাবে তো তখন? ”
“হ্যাঁ, যাব। ”
“প্রমিস? ”
“পাক্কা প্রমিস। ”
____
চলবে