অথৈ মহল পর্ব-০৫

0
68


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
রাত ১১ টা বাজে। নিবিড় পানি গরম করছে। অথৈ সোফায় বসে বার বার হাঁচি দিচ্ছে। নাক পিট পিট করছে একটু পর পর। পাশের সোফায় টমি বসে চিকেন খাচ্ছে। আর অথৈ যখনই হাঁচি দিচ্ছে তখনই সে খাওয়া বাদ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। ওর সামনে এক বক্স টিস্যু নিয়ে বসে আছে নীল। একটু পর পর ওকে একটা করে টিস্যু বের করে দিচ্ছে। অথৈ নাক মুছে টিস্যু শেষ করে ফেলেছে এমন অবস্থা।
শেষে টিস্যু ছিঁড়ে দুই জায়গায় আলাদা গোল করে নাকের দুই ছিদ্রর ভেতর ঢুকিয়ে বসে থাকে। এখন আর নাক দিয়ে পানি আসছে না। অথৈ নিজের এমন বুদ্ধি দেখে নিজেই কয়েক বার প্রশংসা করলো।

রিদ মাত্রই আসলো। কাব্য পাশে থেকে ওর কান্ড কারখানা দেখে যাচ্ছে। অথৈ উঠে গিয়ে কিচেনে উঁকি দেয়। নিবিড় পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি সমস্যা তোমার? এখানে ঘুরঘুর করো কেন? বৃষ্টি তে ভিজে অসুখ বাঁধিয়ে শান্তি লাগছে খুব? ”

অথৈ দু দিকে মাথা ঝাঁকায়। বোঝায় একটু ও শান্তি লাগছে না তার। রিদ ড্রয়িং রুমে আসার আগেই ও দৌড়ে গিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। বাকিরা হঠাৎ ওর এই কাজে হতভম্ব। রিদ রুমে ঢুকেই সবার নাম ধরে ডাকতে থাকে। হঠাৎ সামনে পা বাড়াতেই চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সোফায় গিয়ে নীলের কোলের উপর উঠে বসে।

এতক্ষণে সবাই মিলে বুঝলো অথৈ এর আসল উদ্দেশ্য। এমন অসুস্থ হয়েও মাথা থেকে ফাজলামির ভুত ছাড়েনি। রিদ বেচারা তো এসবের কিছুই জানে না। ওর বুকের ভেতর কেমন ঢিপ ঢিপ করছে এখনো।

“এই কাব্য, ওর কি ভুতে ধরলো নাকি। এভাবে নাকের ভেতরে মরা মানুষের মতো তুলো দিয়ে ওভবে ফ্লোরে পরে আছে কেন? আর তোরা তাকিয়ে দেখছিস সেটা! আশ্চর্য! ”

কাব্য উঠে আসে।
“এই মেয়ের আসলেই ভুতে ধরেছে। নীলেরই বা কি দরকার ছিল ওকে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নামতে দেওয়ার? ”

“অথৈ জেদ ধরলো। আমি মানা করেছিলাম তো। ”

কাব্য ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“এই তুই এখনো এভাবে মরার মতো শুয়ে থাকবি? উঠবি নাকি মা*ইর দিব দুইটা। ”

অথৈ এক লাফে উঠে দৌড়ে গিয়ে আবার সোফায় বসে। বলা বাহুল্য যে, কাব্য সবার থেকে অথৈ কে একটু বেশিই ভালোবাসে। নিজের ছোট বোনের মতো। এজন্য ওকে তুই করেই বলে।

নিবিড় পানি গরম করে একটা বাটিতে ঢেলে অথৈ এর সামনে রাখে। তারপর ওর উপরে একটা চাদর দিয়ে বলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে। গরম ভাবটা যেন ভেতরে যায়।
এভাবে কিছুক্ষণ করার পর। সবার জন্য কফি নিয়ে আসে। অথৈ কে এক মগ চা হাতে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শাসায়। অথৈ মুখ কাচুমাচু করে।

“আমি লাল চা খাব না। কফি বানিয়ে দাও। ”

কিন্তু কথাটা বলার সাথে সাথেই নিবিড় এমন ভাবে তাকালো যে ভয়ে ও চুপচাপ চা’য়ে চুমুক দেয়।

“আর কোনদিন যদি বৃষ্টি তে ভেজার আবদার করেছ। তখন দেখবে কি করি। একদম বাসায় নিয়ে রেখে আসব। এতগুলো কেয়ারিং ভাই পেয়েছ তো তাই বুঝতে পারছ না। নয়তো দেখতে। ”

অথৈ ঠোঁট ফুলিয়ে রিদের দিকে তাকায়।

“দেখলে ভাইয়া? আমাকে সব সময় এভাবে বকে। অসুস্থ মানুষ কে এভাবে বকতে হয় বলো তো? ”

রিদ ও ওর সাথে তাল মেলায়।
“আসলেই তো। এভাবে শুধু শুধু কেন বকছিস ওকে? ওর কি খারাপ লাগে না? ”
“হ্যাঁ, আরও আশকারা দে ওকে। মাথায় তোল। ”

নীল অথৈ এর কানে কানে এসে বলে,
“এই ব্যাটার কথা মাথায় নিও না তো। হুদাই গার্ডিয়ানের মতো ভাব নেয়। ব্যাটা খচ্চর। ”

অথৈ মুখ টিপে হাসে। কাব্য নীলের পিঠে একটা দুম করে মে*রে দেয়।

“তুই আবার ওকে ভুজুং ভাজুং বোঝাচ্ছিস। সব নষ্টের মূল তোরা দুজন। অগত্যা নীল আর অথৈ মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকে। কিন্তু বেশি সময়ের জন্য না। একটু পরেই রুম কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
_____
সকালে নিবিড় খাবার রেডি করে চা বানিয়ে অথৈ এর রুমে রেখে অফিসে চলে যায়।
অথৈ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়। চা যদিও হালকা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবুও শেষ করে খাবার খেয়ে নেয়। ওর পুরো দিনটা কাটে টমি কে নিয়েই। ও গল্প করে। টমি লেজ নাড়ায়, মিউ মিউ শব্দ করে সাড়া দেয়। কখনো ওর গাল চেটে দেয়।

অথৈ নিবিড় কে কল দেয়।

“কিছু লাগবে অথৈ? ”
“ঢং করো? কিছু লাগলেই শুধু তোমায় কল দেই? তাছাড়া দেই না আমি? ”
“ইশ রে! মেয়ে দেখি রেগে যাচ্ছে। আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। ”

অথৈ নাক টানতে টানতে কথা বলছে।
“বাসায় ফিরবে কখন? আমার একা একা ভালো লাগছে না। ”
“কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব। ”
“কখন শেষ হবে? ”
“জানি না। তবে দ্রুত ফেরার চেষ্টা করব আমি। ”

“আচ্ছা, দুপুরে খেয়েছিলে? ”
“হ্যাঁ, তুমি খেয়েছ তো? ”
“খেয়েছি। ”
“ঔষধ? ”
“সব খেয়েছি। ”
“এইতো লক্ষি মেয়ে। ”

আরও কিছু সময় দুজন কথা বলে কল কেটে দেয়। অথৈ উঠে বাসার বাইরে যায়। আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। টমি ওর কোলেই আছে। ঘাসের উপর ওকে নিয়ে শুয়ে পরে। টমি ওর চারপাশে মিউ মিউ করে ঘোরে। আবার একটু পর ওর কাছেই উল্টে শুয়ে থাকে। কখনো ডিগ বাজি দেয়। এটা টমি কিভাবে শিখেছে ও জানে না। ওর কাণ্ড দেখে অথৈ খিলখিলিয়ে হাসছে।

কিছুক্ষণ পরেই নিবিড়ের গাড়ি এসে ওর কাছে থেমে যায়। অথৈ শুয়েই আছে। কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিবিড় গাড়ি থেকে বের হলো। মনে হচ্ছে কোন এক তামিল মুভির হিরো আসছে তার দিকে এগিয়ে।
অথৈ ভাবতে থাকে, পুরুষ মানুষ কেন এত সুন্দর হবে? এমন সুদর্শন কেন হতে হবে? দেখলেই তো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কি আশ্চর্য! তার কি চরিত্রে সমস্যা শুরু হয়ে গেল নাকি।

অথৈ দুই গালে দুটো হালকা করে থাপ্পড় দিয়ে তওবা পাঠ করে। নিবিড় এসে ওকে হাত ধরে তুলে নেয়।

“কি হয়েছে? এভাবে কি বিড় বিড় করছো শুনি? ”
“কিছু না। এমনিতেই। ”
“একা খারাপ লাগছিল তোমার? ”

অথৈ ঠোঁট উল্টে চুপ করে থাকে। নিবিড় হেসে ওকে বলে,

“থাক আর ঠোঁট ফোলাতে হবে না। আসলে ইদানীং কাজের চাপটা বেড়েছে বুঝলে? তাই বেশি সময় অফিসে থাকতে হচ্ছে। কয়টা দিন যাক। তারপর চাপটা কমলে বাসাতেই থাকব বেশি সময়। ততদিনে মা আর নবনী ও বাসায় ফিরে আসবে। কথা হয়েছে ওদের সাথে। ”

অথৈ এর এবার মন খারাপ ভাবটা কেটে যায়। নিবিড় পকেট থেকে দুটো চকলেট বের করে দেয় ওর হাতে। চকলেট পেয়ে ঠোঁটের হাসিটা আরও চওড়া হয়ে যায়।
______
রাত বেড়েছে অনেক। ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কারেন্ট ও চলে গেছে। অথৈর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ভয় লাগছে ওর। আবার জোরে বিকট শব্দ হলো। দূরে কোথাও বাজ পরলো মনে হচ্ছে। অথৈ নিবিড় কে কল দেয়। যদিও ওর পাশের রুমেই নিবিড় থাকে। কিন্তু ওঠে গিয়ে ডাক দিতেও ভয় লাগছে। এদিকে নিবিড় ফোন ধরছে না। নিশ্চয় বৃষ্টির শব্দে শুনতে পাইনি।
অগত্যা অথৈ উঠে নিবিড়ের রুমে নক করে। আজকে আবার টমি ও নিবিড়ের সাথেই ঘুমিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি আর নক করার পর নিবিড় শুনতে পায়। ঘুম ঘুম শরীরে টলতে টলতে চোখ কোচলে দরজা খুলে দেয়। দেখে অথৈ দাঁড়িয়ে আছে।

“কোন সমস্যা হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক আছে? এত রাতে ডাকতে এলে যে। ”
“তুমি কি মানুষ? কিভাবে ঘুমাচ্ছো। কতবার কল দিলাম। তুমি ধরলেই না। ”
“ওহ কল করেছিলে? আমি শুনতে পাইনি। ”

“আমার ভয় লাগছে রুমে একা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি আজকে তোমার সাথে থাকি? ”

এই পর্যায়ে নিবিড়ের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। আঁতকে ওঠে সে। কি বলে এই মেয়ে! এত বড় একটা পুরুষ মানুষের সাথে রাতে ঘুমানোর আবদার করছে। তাও আবার এই বৃষ্টির রাতে। বোধ বুদ্ধি কবে হবে এই মেয়ের?

নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“আমার সাথে থাকবে মানে কি? ভয় নেই তোমার! রুমে গিয়ে ঘুমাও। এখন ২টা বাজে। আর একটু পরেই ভোর হবে। যাও। ”
“না। বললাম তো ভয় লাগছে আমার। ”

অথৈ গিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে পড়ে। নিবিড় ওর কাছে গিয়ে বোঝাতে থাকে।

“শোনো অথৈ, তুমি রুমে যাও। গিয়ে আমায় কল দাও। যতক্ষণ তোমার ঘুম না আসে আমরা কথা বলব কলে। তারপর তুমি ঘুমিয়ে যেও। তোমার ভয় ও লাগবে না। ”

“পাশাপাশি রুমে থেকে কলে কথা বলব সারারাত? ”
“হ্যাঁ, ”
“এখানে আমি থাকলে কি সমস্যা। ”
“অনেক সমস্যা। তুমি এডাল্ট একটা মেয়ে। নিশ্চয় তোমাকে আমার বলে বোঝাতে হবে না সমস্যা টা ঠিক কোথায়। ”

অথৈ এর এবার মাথায় হুশ ফিরল। কিন্তু সেটা বেশি সময় স্থায়ী হলো না।

“তাতে কি? আমি ঘুমাব। তুমি জেগে থাকো এখানেই। বিছানার এক পাশে বসে থাক। ”
“সারারাত বসে থাকব আমি? ”
“চাইলে পাশে ঘুমাতেও পারো। আমার তো কোন সমস্যা নেই। আমার নিজের উপর কনট্রোল আছে। ”

অথৈ চোখ টিপে শুয়ে পড়ে। নিবিড় রুমের মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে। অথৈ কিছু সময় পরেই ঘুমিয়ে যায়। নিবিড় কিচেনে যেয়ে বড় মগে কফি বানিয়ে নিয়ে আসে। মনের ভুলেও বিছানায় ঘুমানো যাবে না আজ।

একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এক মগ শেষ হতেই আরেক মগ নিয়ে আসছে। ঘড়িতে দেখল প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। বিছানার এক পাশে বসে থাকে। পিঠের নিচে বালিশ রেখে বসে আছে। না চাইতেও চোখ বার বার অথৈর দিকে যাচ্ছে। আর যাইহোক, সে পুরুষ মানুষ তো। যতোই ভালো হোক। তবুও এই ওয়েদারে একই রুমে যদি কোন সুন্দরী রমণী শুয়ে থাকে। তবে কার মনের মধ্যে বাজে চিন্তা উঁকি দেবে না? তবুও চোখ বন্ধ করে রাখে। কোন মতেই সে ওর দিকে তাকাবে না। বুঝ হবার পর থেকে কোন মেয়ে কে সে অসম্মান করেনি। আর করবেও না।

চোখ খিঁচে বন্ধ করে থাকতে থাকতে কখন নিবিড় ঘুমিয়ে গিয়েছে বুঝতে পাড়েনি। আর বসে থেকে কি ঘুমানো যায়? ঘুমের মাঝেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
_____
ভোরের আলো হালকা ফুটতে শুরু করেছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করছে। নিবিড়ের ঘুম ভেঙে গেল। প্রায় অর্ধেকের বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থেকে অল্প একটু ঘুমানোর জন্য মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। তবুও উঠে বসতে যাবে তখনি খেয়াল করে কেউ একজন তাকে হাত-পা দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। পাশে তাকায়। অথৈ এক পা তুলে দিয়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।
এই অবস্থা দেখে নিবিড়ের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কি করবে এখন সে? যদি ওর ঘুম ভেঙে যায় এখন? যদি তাকে ভুল বোঝে? নিজের উপর নিজের রাগ উঠছে তার। কেন এমন বেক্কলের মতো ঘুমিয়ে গেল।

বিবাহিত জীবন হলে এই মুহূর্তটা হতো সব থেকে সুন্দর। উদাম শরীরে একজন পুরুষ শুয়ে আছে। তাকে জড়িয়ে রেখেছে একজন সুন্দরী রমণী। দৃশ্য টা অনায়াসেই ভীষণ সুন্দর। কিন্তু এই মুহূর্তে নাউজুবিল্লাহ টাইপ হয়ে গেছে ব্যাপারটা। নিবিড় খুব সন্তর্পণে অথৈ কে সড়িয়ে দিয়ে ও নিজে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাস ও ঠিক ভাবে নিতে পারছিল না। কান দিয়ে গরম ধাপ বেড়িয়ে যাচ্ছে। উফ! কি অসহ্য।

নিবিড় মুখে পানির ঝাপটা দেয়। কোন নারীর সংস্পর্শ পেলে বুঝি আসলেই এমন পাগল পাগল অনুভূতি হয়?
____
চলবেধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে