৪
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
প্রায় ১ ঘন্টা পর নিবিড় বাসায় ফেরে। বাসায় ঢুকেই আশেপাশে চোখ বোলায়। অবস্থা খুব খারাপ। চারদিকে সব জিনিস ছাড়ানো ছিটানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছোট খাটো একটা ঝড় হয়ে গেছে। সোফার পেছন থেকে কেমন মৃদু চিৎকার আসছে। গিয়ে দেখে রিদ ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি করছে। আর চিৎকার করছে। কাব্য অন্ধের মতো এদিক সেদিক হাতরিয়ে কি যেন খুঁজছে। আর উপরের সিঁড়ি দিয়ে নীল প্রাণ নিয়ে দৌড়ে নামছে। পেছনে অথৈ চা*কু নিয়ে দৌড়ে আসছে।
নিবিড় দৌড়ে গিয়ে অথৈ কে চেপে ধরে আটকায়।
“হয়েছে টা কি এখানে? কি সব দেখছি আমি অথৈ। ”
“আরে শুনো, এরা সব গুলো ডাকাতি করতে এসেছিল। আমি রুম থেকে পানি নিতে নিচে নামার সময় দেখি এরা তিনজন ড্রয়িং রুমে হাঁটাচলা করছে। তুমি তো জানোই আমি ভীষণ বুদ্ধিমতী। পরে চুপি চুপি একটা লাঠি নিয়ে এসে একটা কে পেছন থেকে মে*রেছি। আরেকটা তেড়ে আসছিল তাই ওটার চোখে মরিচের গুড়ো ছুঁড়ে দিয়েছি। যদিও বেশি লাগেনি। আর এটাকে চা*কু নিয়ে দৌড়ানি দিচ্ছিলাম।
আমাকে এবার ধন্যবাদ দাও। আমার জন্যই আজ তোমার কত বড় বিপদ হতে হতে বেঁচে গেল। এখন এদের পুলিশে দেব। ”
নিবিড় অথৈ এর কথা শুনে মাথা চাপড়ে বসে থাকে। নীল হাপাতে হাপাতে ওর পাশে গিয়ে বসে। রিদ ও উঠে খুঁড়িয়ে ওদের সামনে আসে।
“দোস্ত, এটা কে? বাসায় কি আজকাল লেডি কি*লার পুষতেছিস নাকি। এমন মার মে*রেছে কি বলব। মেয়ে না হলে একদম মে*রে নাকের নকশা পাল্টিয়ে ফেলতাম। ”
“এখানে আসতে আসতে ক্ষিদে পেয়ে গেছিল। কাব্য কে বললাম দেখ ফ্রিজে খাবার আছে কি না। কথা বলতে বলতেই দুম করে হামলা করলো। ”
ওদের কথা শুনে অথৈ বেকুব হয়ে গেছে। এতক্ষণে বুঝে গেছে কি ভুলটা সে করেছে।
নিবিড় রেগে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“অথৈ, তোমার কি একটু ও কান্ড জ্ঞান নেই? কিছু না জেনে না বুঝেই এভাবে আমার বন্ধুদের মা*রলে? ”
“স্যরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। ”
এতক্ষণে কাব্য ওয়াশরুম থেকে চোখ ডলতে ডলতে বের হয়।
“দোস্ত, আমার চোখ বুঝি এবার গেল। জ্বলে যাচ্ছে। ”
নিবিড় আরও রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অথৈ ভয়ে এক দৌড়ে ফ্রিজের কাছে যায়। ফ্রিজ খুলে বরফ বের করে নিয়ে কাব্যর কাছে আসে। কাব্য কে সোফায় বসিয়ে চোখে বরফ লাগিয়ে দেয় হালকা করে।
নিবিড় সবাই কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে অথৈ এর ব্যাপারে। শুনেই নীল বলে,
“কি ডেঞ্জা*রাস মেয়ে রে বাবা। তুই এখন না ফিরলে তো আমার দেহ থেকে মাথাটা আলাদা করে দিত। ”
রিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“অথৈ, তোমার আমাদের দেখে কোন দিক দিয়ে ডাকাত মনে হলো বলো তো দেখি। এত সুন্দর তিনটা হ্যান্ডসাম, স্মার্ট ছেলে। তাদের কিনা তুমি এক চুটকি তে ডাকাত বানিয়ে দিলে? ”
অথৈ রিদের দিকে তাকায়। মুখ কাচুমাচু করে বলে,
“আমি তো তোমাদের কাউকে চিনি না। আর সেভাবে ভালো করে মুখ দেখিনি। নিবিড় ও তোমাদের ব্যাপারে কিছু বলেনি। হুট করে কারোর বাসায় অচেনা তিনটা ছেলে কে দেখলে আমি ডাকাত ভাববো না? ”
ওর কথায় রিদ ভড়কে যায়। এমন পুচকে একটা মেয়ে তাকে কিনা তুমি করে বলছে! তাও আবার প্রথম পরিচয়েই? ”
নিবিড় রিদের ভাবনা টা বুঝতে পেরে বলে,
“আসলে অথৈ সবাই কে তুমি করেই বলে। এটা ওর অভ্যাস। কিছু মনে করিস না। ”
“না না কিছু মনে করছি না। ”
টমি ও সেখানে আসে। অথৈ সবাই কে টমির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। টমি নীলের কোলে বসে আছে। সবাই গিয়ে বাইরে বসে। অথৈ সবার জন্য চা আর হালকা নাস্তা রেডি করে নিয়ে যায়। সবাই মিলে খেতে খেতে আড্ডা দিতে থাকে। অথৈ কাব্যর কাছে যেয়ে পিঠে হাত রেখে নিচে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।
“ভাইয়া, তোমার চোখ কি এখনো জ্বলছে? বরফ নিয়ে আসি? ”
কাব্য মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলো আরেক বার। কি মিষ্টি মেয়ে। কেমন বাচ্চামি দিয়ে ভরা। সেটা দেখলেই বোঝা যায়। ও যে অনুতপ্ত সেটা ওর চোখে মুখেই লেপ্টে আছে। কিভাবে এসে জিজ্ঞেস করছে এখনো জ্বলছে কিনা। তাহলে বরফ লাগিয়ে দেবে। কাব্য মাথা ঝাকালো।
“তেমন জ্বলছে না অথৈ। হালকা। সেরে যাবে এখনি। ”
“স্যরি গো ভাইয়া। এইযে কান ধরলাম। আর জীবনেও এমন করব না প্রমিস। ”
কাব্য ওর মুখ দেখে হেসে ফেলে। বাকিরা তখন ওদের খেয়াল করে। নীল ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস কর,
“এই কাহিনী কি রে? দুটো এমন ফিসফিস করে কি ফন্দি আটছিস? ”
কাব্য ওর হাতে থাকা চামচ দিয়ে নীল কে একটা খোঁচা মারে।
“চুপ কর ব্যাটা। বেশি কথা বলিস। ”
“বেশি কথা কখন বললাম। শুধু একটা প্রশ্ন করলাম। তাতেই এত ক্ষেপে গেলি বাপরে। ”
রিদ দুজনের পিঠ চাপড়ে দেয়।
“দুজনেই চুপ কর ভাই। সব সময় ঝগড়া লাগিয়ে দিস। দেখছিস না মেয়েটা ভড়কে যাচ্ছে। ”
ওরা চার বন্ধু জোরে হেসে ওঠে। অথৈ ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বুঝতে পারছে না। এরা কি নিয়ে হাসছে। এখানে তো হাসার মতো কিছু হয়নি? নাকি এদের পাগলাটে স্বভাব আছে। কে জানে?
বেশ কিছুদিন পর____
এখন অথৈ এর সাথে নিবিড়ের বন্ধুদের ভালো মিল হয়েছে। সবাই একদম ফ্রেন্ডলি মেলামেশা করে। অথৈ যা আবদার করে ওরা তিনজন সব শোনে। আর এক্সট্রা কেয়ার করার জন্য নিবিড় তো আছেই সাথে। এখানের সময় গুলো অথৈ এর কাছে পুরো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কি সুন্দর সব কিছু। জীবনের মানে টা বোধহয় এত বছর পর এখানে এসেই বুঝতে পারছে। উপভোগ করতে পারছে।
যখনি ওরা আসে। রিদ অথৈর পছন্দের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম নিয়ে আসে। নীল এসে ওর সাথে লুডো খেলতে বসে যাবে। কাব্যর সাথে মারামা*রি লেগেই থাকে। নিবিড় ওদের সাথে মাঝে মাঝে খুনসুটি তে মেতে ওঠে।
আর সিগারেট নিয়ে সমস্যা এখনো আছেই। নিবিড় যখনি সিগারেট খায়। আগে অথৈ পেছন পেছন ঘুরতো। এখন সাথে টমি ও যোগ দিয়েছে। এদের যে কেন সিগারেটের ঘ্রাণ এত ভালো লাগে নিবিড়ের বুঝে আসে না। সব পাগল এসে তার ঘাড়েই জুটেছে।
নিবিড় লুকিয়ে ছাদে গিয়ে সিগারেট টানছে। একবার আশেপাশে আবার চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ আছে কি না। কেউ নেই। ও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
হঠাৎ নিবিড় মিউ মিউ শব্দ শুনতে পেল। পেছনে তাকিয়ে দেখে অথৈ টমি কে কোলে নিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। টমি লেজ নাড়িয়ে চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে।
এই দৃশ্য দেখে নিবিড় পারে না ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে। সিগারেট নিচে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে আগুন নেভায়। অথৈ আরও একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হলো নিবিড়, সিগারেট ফেলে দিলে কেন? আরেকটা এনে দেব? ”
“না বাপ। আর লাগবে না। আমি জীবনেও আর সিগারেট মুখে নেব না। শেষ। ”
“বলো কি! আমি ঘ্রাণ নিব কিভাবে তবে? ”
“চুপ করো তুমি। ”
“ওকে চুপ করলাম।
অথৈ ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নিবিড় হুংকার ছাড়ে।
“এই যাবে তুমি এখান থেকে? ”
“যাচ্ছি তো। ”
এক দৌড়ে অথৈ নিচে চলে যায়।
_____
নিবিড় অফিসে গেছে। অথৈ সকাল থেকে বাসায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। নিবিড় কে ফোন করছে কিন্তু ধরছে না। পরে নীল কে ফোন করে।
“হ্যাঁ, হ্যালো অথৈ। ”
“ভাইয়া কোথায় তুমি? ”
“আমি তো অফিসে। ”
“নিবিড় ফোন ধরছে না কেন? ”
“ও এখন ব্যস্ত তাই। কোন দরকার? ”
“আমার এখানে একা ভালো লাগছে না। নিবিড় রুম থেকে বের হতে বারণ করে গেছে। কতক্ষণ এভাবে থাকা যায় বলো তো? ”
নীল ও ওর মতো করেই আহ্লাদি হয়ে বলে,
“নাহ, একদমই একা এত সময় থাকা যায় না। নিশ্চয় তোমার মন খারাপ হয়েছে। দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করছি। ”
খট করে ওপাশ থেকে নীল ফোন কেটে দিল। অথৈ আবার মন খারাপ করে বসে রইলো। ১৫ মিনিট পর বাসার সামনে থেকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়। নীল ফোন করে আবার।
“অথৈ, আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। দ্রুত তুমি ৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে এসো। আমরা ঘুরতে যাব আজ। ”
অথৈ এক দৌড়ে জামা বের করে নিয়ে আসে। চটজলদি পরে নেয়। হাতে থাকা রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলটা পেঁচিয়ে নিয়ে টমি কে কোলে তুলে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামে। তারপর দৌড়ে যায় গাড়ির সামনে। নীল গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। অথৈ আসতেই দরজা খুলে দেয়।
“উফ! ভাইয়া তোমাকে বলা মাত্রই এভাবে অফিস বাদ দিয়ে চলে আসবে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। ”
“এখন বিশ্বাস হয়েছে? ”
“হ্যাঁ, একদম। ”
“তাহলে গাড়িতে উঠে পরো। ”
অথৈ গাড়িতে বসে পরে। নীল ড্রাইভ করছে।
“এই ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”
“তুমি বলো কোথায় যাবে। ”
“লং ড্রাইভ? ”
নীল মৃদু হাসে।
“ওকে। ”
নীল একটা গান ছাড়ে। হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। নীল কিছুটা বিরক্ত হয়।
“সিলেটের এই একটাই সমস্যা যখন তখন বৃষ্টি নামে। ”
“তুমি বিরক্ত কেন হচ্ছো ভাইয়া? বৃষ্টি ভালো লাগে আমার। গাড়ি থামাও না। ”
“মানে কি? গাড়ি কেন থামাবো? ”
“ভিজব আমি। ”
“এই একদম না। নিবিড় আমায় বকবে। ”
“উহু, কিচ্ছু বলবে না। ”
“বলবে। তুমি তো ওকে চিনো না। আমি চিনি। তোমার ঠান্ডা লাগলে আমার খবর করে দেবে। ”
অথৈ ঠোঁট উল্টায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকায় নীলের দিকে। নীল ও অগত্যা মুখ কাচুমাচু করে তাকায়।
“আমায় বিপদে ফেলো না অথৈ। ”
“তবে জানালা খুলে দাও। ”
“একদম না। বৃষ্টির পানি ছিটে লাগবে। ”
শেষে উপায় না পেয়ে নীল গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অথৈ নীল কে টেনে ধরে ওকেও বৃষ্টি তে ভেজায়। রাস্তার দু পাশে ছোট বড় কত পাহাড়। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়। কেমন সুখ সুখ লাগে এগুলো দেখলেই।
“ভাইয়া, এই জায়গা টা কি সুন্দর! ”
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। ”
“আমাকে সবটা ঘুরে দেখাবে প্লিজ? ”
“দেখাব। তবে অন্যদিন। আজকে না। ”
“ঠিক আছে। ”
অথৈ খুশিতে আটখানা হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী এত সুন্দর কেন? নীলের ফোন গাড়িতে রেখে এসেছে। ওর ফোন বাজছে। কিন্তু ওরা বৃষ্টির শব্দে কিছু শুনতে পারছে না। ফোন বেজেই যাচ্ছে বার বার।
“অথৈ এখন চলো। ফিরতে হবে। ”
“আর একটু থাকি না ভাইয়া প্লিজ। ”
“আর এক মুহূর্ত ও না। তুমি মাত্র এসেছ সিলেট। এখনই অসুস্থ হলে একদমই চলবে না। ”
দুজনেই গাড়িতে এসে ওঠে। নীল ফোন ধরেই দেখে নিবিড় ৬ বার কল দিয়েছিল। নিশ্চয় অথৈ এর খোঁজ করতে। এবার আর ওর রক্ষে নেই। নীল ওর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। অথৈ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে ফেলে।
____
চলবে