অথৈ মহল পর্ব-০২

0
5


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
দুজনেই চুপ করে বসে আছে। নিবিড় মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকায়। ওর মাথার উপরের দোপাট্টা টা খুলে ফেলেছে। চুল গুলো খোঁপা করা। খোঁপায় এক গাদা গোলাপ ফুল দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাউন কালার চোখের মণি। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে সেই চোখ দুটো। একদম বিড়ালের মতোই আদুরে লাগছে। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক। গায়ের রং টা ধবধবে ফরসা হওয়ায় লাল বেনারসিতে দারুণ মানিয়েছে। আর নাকের নোলক টা তো সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এক কথায় যাকে বলা হয় অপ্সরী।

দীর্ঘ জার্নির পর ওরা সিলেট পৌঁছায়। অথৈ শুধু চারপাশের দৃশ্য গুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ১৫ মিনিট পর ওরা বাসায় যায়। অথৈ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিবিড়ের বাসাটা পাহাড়ের উপর। সুন্দর করে পাহাড় কেটে সামনে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়েই উপরে ওঠে যেতে হয়। বাসার চারপাশে চা বাগান।

“বাহ! তোমার বাসাটা কি সুন্দর। কত সুন্দর জায়গা এটা। চারপাশে চা বাগানে ঘেরা। একদম সবুজে সবুজময়। মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ। আচ্ছা, এই চা বাগান গুলো কার? ”

“আমাদের। ”
“সব গুলো তোমাদের? ”
“হ্যাঁ, সব গুলো আমাদের। আগে অন্যজনের ছিল। পরে বাবা কিনে নিয়েছেন। ”

ওরা কথা বলতে বলতে বাসার ভেতর যায়। অথৈ আবার কথা বলা শুরু করে।

“জানো? আমি এর আগেও একবার আব্বু-আম্মুর সাথে সিলেটে এসেছিলাম। কিন্তু তখন রিসোর্টে উঠেছিলাম। তাও আবার ২ দিনের জন্য। তাই সেভাবে কিছু দেখা হয়নি। ”

“এখন সব দেখে নিও। ”
“তোমার বাসাটা অনেক সুন্দর। আমাদের বাসাটা এর থেকেও অনেক বড়। কিন্তু এত সুন্দর না। আচ্ছা, তোমার বাসায় আর কাউকে দেখছি না তো? বাকিরা কোথায়? ”

“কেউ নেই এখন। আপাতত আমি একাই। ”
“কেন তোমার বাবা-মা কোথায় থাকে? ”
“মা আর ছোট বোন গিয়েছে চট্টগ্রাম। খালামণির বাসায়। আর বাবা অস্ট্রেলিয়া থাকেন। পরে বলব সেসব কথা। ”

অথৈ কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়ায়। নিবিড় ওকে নিয়ে উপর তলায় যায়। নিবিড়ের রুমের বিপরীতেই আরেকটা রুম আছে। সেই রুমেই অথৈ কে থাকতে দেয়।

“রুম পছন্দ হয়েছে তো? ”
“হ্যাঁ, একদম রিসোর্ট এর মতো। অনেক সুন্দর। খুব গোছানো তোমাদের বাসাটা। কিন্তু এই বাসায় তোমাদের একা থাকতে ভয় লাগে না? আশেপাশে কোন বাসা নেই। কেমন মরুভূমি টাইপ। ”

নিবিড় বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
“আমাদের তো ভয় করে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। তোমার ভয় করছি নাকি হু? ”
“আরে না, অথৈ কখনো কাউকে ভয় পায় না বুঝেছো? ”

“বুঝলাম দুঃসাহসী রমণী। ওয়াশরুমটা ডান দিকে। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও। আমি খাবার রেডি করি। ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়। ”

অথৈ ফ্রেশ হয়ে ওর মা কে কল দেয়। তারপর এদিকের সব কথা তার মা কে জানায়।
বেশ খানিকক্ষণ কথা বলে এলোমেলো ভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে যায় ওভাবেই।
_____
ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গে। কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে থেকে ভাবার চিন্তা করে সে এখন কোথায়। এখন কি রাত নাকি দিন। অনেক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর সব কিছু মাথায় আসতেই লাফিয়ে ওঠে ফ্রেশ হতে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমে টমি কে দেখতে পায় না।

অথৈ নিচে নামে। কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। ও সেদিকে যায়। নিবিড় রান্না করছে কিছু একটা। আর টমি ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। দুজনের বেশ ভালোই মিল হয়েছে।

অথৈ উঁকি দেয়।
“ভেতরে আসো। উঁকি দিতে হবে না। ”

অথৈ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। ভাবতে থাকে, কি দরকার ছিল চোরের মতো উঁকি দিয়ে দেখার? মাথায় একটা চাটি ও মারে। তারপর ভেতরে ঢুকে যায়। আড়চোখে নিবিড় ওকে দেখে ঠোঁট চেপে হাসি থামায়।

“এই তুমি রান্না করতে পারো? ”
“হ্যাঁ, পারি তো। রান্না করতে ভালো লাগতো টুকটাক। তাই মায়ের কাছে সব রান্না শিখে নিয়েছি। ”

“একটা কাজের লোক রাখলেই পারো। তাহলেই তো আন্টি চলে গেলে তোমার রান্না করতে হতো না। ”
“রেখেছিলাম। কিন্তু তার রান্না আমি আর নবনী খেতে পারতাম না। তাই পরে আর কাজের লোক রাখা হয়নি। ”

“নবনী তোমার বোন? ”
“হ্যাঁ, ”
“বেশ সুন্দর নাম তো। তোমার নামটা ও অনেক সুন্দর। এই প্রকৃতির মতোই। ”

নিবিড় হেসে ফেলে।
“তোমার নামটা ও কিন্তু অনেক সুন্দর। অথৈ, তোমার নামের অর্থ টা- খুব গভীর বোঝায় তাই না? ”
“হুম, যাকে কখনো ছোঁয়া যায় না। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ”

নিবিড় ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আসলেই কি তুমি ধরা ছোঁয়ার বাইরে? এই তুমি আবার সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসোনি তো? মায়াবী মৎসকন্যা তুমি? ”

নিবিড়ের কথার ধরনে অথৈ জোরে হেসে ওঠে। গা কাঁপিয়ে হাসতে থাকে। ওর হাসি দেখে নিবিড় ও হেসে ফেলে। হাসি অনেক টা ছোঁয়াচে রোগের মতোই।

“আমি তো মৎস্যকন্যা। সমুদ্রের তলদেশে থাকি বুঝলে? ”

নিবিড় মাথা নাড়িয়ে স্বায় দেয়,
“হুম বুঝলাম। তোমার মাধ্যমে তবে বোধহয় আমার সমুদ্রের তলদেশ দেখার সুযোগ হবে। দেখাবে তো আমায়? ”

অথৈ নিবিড়ের দুষ্টুমি কথাগুলো তে খুব মজা পায়।

“আচ্ছা, আমি যে তোমাকে তুমি করে বলি। তুমি কি কিছু মনে করো? আসলে আমি কারোর সাথে আপনি করে বলতে পারি না। তুমিতেই কমফোর্ট ফিল করি। ”

নিবিড় রান্নার ফাঁকে ফাঁকে অথৈ কে খেয়াল করছে। এই মেয়ে এক জায়গায় চুপ করে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাঁটাচলা ওকে করতেই হবে। ওর থেকে টমি বেশ শান্ত।

নিবিড় উত্তর দেয়।
“প্রথমে একটু অদ্ভুত মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে,তোমাকে এভাবেই মানায়। কিছু মানুষের জন্য বাকি সব নিয়ম থাকতে নেই। তাদের কে নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া উচিত। সেই তেমন মানুষ টা তুমি। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। ”

“ইশ! তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো তো। আমার অনেক ভালো লাগছে। ”
“তাই? ”
“হ্যাঁ, এই কি রান্না করছো তুমি? চিকেন ফ্রাই বানালে? ”
“হ্যাঁ, আর সাথে পরোটা। পছন্দ তোমার? ”
“ইশ! ভীষণ। দেখো আমার জিভে পানি এসে গেছে। ”

অথৈ কথাটা বলেই জিভ টা সুন্দর করে ঠোঁটের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। নিবিড় ওর এমন বাচ্চামি দেখে হেসে ফেলে জোরে। অথৈ ও ওর দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে হেসে ফেলে। টমি অথৈ এর পা চাটতে থাকে আর মিউ মিউ করে। টমিকে কোলে তুলে নেয়।

নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে,
“ওকে খেতে দিয়েছিলে? ”
“হ্যাঁ, দুধ ভাত দিয়েছিলাম। এক বাটি পুরো দুধ খেয়েছে। ”

অথৈ খুশি হয়। টমি কে আদর করে দিয়ে মাথায় একটা চুমু দেয়। নিবিড় অথৈ কে ডাকে।

“ম্যাম, টেবিলে আসুন। খাবার রেডি। প্লিজ খেয়ে বলবেন রেস্টুরেন্টের শেফ হওয়ার যোগ্যতা রাখি কি না। ”

নিবিড়ের বলার ভঙ্গিমায় অথৈ হেসে ওঠে। তারপর পরোটা অল্প একটু ছিঁড়ে নিয়ে চিকেনসহ মুখে নিয়ে চিবিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মুখের খাবার টুকু শেষ করতেই অথৈ লাফিয়ে ওঠে। নিবিড় ভড়কে যেয়ে আরও দু কদম লাফিয়ে পেছনে চলে যায়। টমি ও জোরে মিউ মিউ করে ওঠে।

তারপর অথৈ বলে,
“আরে বাহ! তুমি তো বেশ দারুণ রান্না করো। একদম দুর্দান্ত। রেস্টুরেন্টের শেফদের থেকে তুমি বেস্ট। ”

নিবিড় বুকে কয়েক বার থুতু দিয়ে বলে,
“অথৈ, ধীরে খাও। ধীরে কথা বলো। আশেপাশের মানুষদের কি হার্ট অ্যাটাক করে মেরে ফেলবে নাকি। একটু হলেই তো আমার অ্যাটাক-ফ্যাটাক হয়ে যেত। ”

অথৈ শুধু হাসে। যাই হয়ে যাক না কেন এই মেয়ে শুধু হাসতেই থাকে। বাকি খাবার টুকু চুপচাপ বসে খায়। নিবিড় ও খেয়ে নেয়। অবশ্য নিবিড় ওর খাওয়া দেখছিল। কি মজা করে খাচ্ছিল।

রাত বাড়তে থাকে। ওরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। তারপর দুজন যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। টমি ও অথৈ এর কোলের মাঝে গিয়ে ঘুমায়।
_____
সকালে সূর্যের আলো মুখে পরতেই অথৈর ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সকালের মিষ্টি রোদটা উপভোগ করতে থাকে।

একটু পর দরজায় নিবিড় নক করে।
“অথৈ, উঠেছো?
“হ্যাঁ, ”
“আসব কি? ”
“এসো। ”

নিবিড় দুই মগ কফি নিয়ে এসেছে। সকাল সকাল মৃদু একটা হাসি অথৈ কে উপহার দিয়ে একটা মগ ওর হাতে দেয়।

“সুপ্রভাত ম্যাম। ”
“সুপ্রভাত। ”
“নতুন জায়গায় ঘুম কেমন হলো তোমার? ”
“দারুন। এক ঘুমে রাত শেষ। ”

অথৈ হাসলো। নিবিড় ও হাসি দেয়।

“তুমি চাইলে আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো কিন্তু। ”
“আসলেই? ”
“হ্যাঁ। ”

নাম ধরে ডাকার অনুমতি পেয়ে অথৈ খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। নিবিড় এটাও খেয়াল করেছে, এই মেয়ে অতিরিক্ত খুশি হলে সেটা লাফিয়ে উঠে প্রকাশ করে। বাচ্চারা যেমন নতুন খেলনা পেলে খুশি হয়। ঠিক তেমন।

“তোমার টমি কই? ”
“কি জানি। নতুন জায়গা পেয়ে সে আমাকে রেখেই কোথায় কোথায় যেন একা একা চলে যাচ্ছে। ”
“তাহলে জায়গা টা ওর ও নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে অনেক। ”
“হ্যাঁ, এত সুন্দর জায়গা। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে বলো? ”

নিবিড়ের ওর বাকবাকুম করা কবুতরের মতো কথা শুনতে ভালো লাগছে। মন ভালো করার মতো মেয়ে। অনেক্ষণ বিরক্ত ছাড়াই আড্ডা দেওয়া যায়। বাচ্চাদের সাথে থাকতে যেমন বিরক্ত লাগে না। এই মেয়েটা ও তেমন। অনেকটাই বাচ্চা বাচ্চা টাইপ।
_____
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে