(১)
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
মন খারাপ যেভাবে পাল্লা দিয়ে ভারি হয়ে আসে। তুমি ও ঠিক সেই ভাবে মন খারাপের দিনে হুড়মুড়িয়ে চলে এসে ছিলে নীলাভ এক রাত্তিরে। যেভাবে ভোরে সূর্যের সূচনা হতেই রোদেরা ঝুপ করে জানালার থাই গলিয়ে বিছানায় এসে শরীরের আনাচে কানাচে ভরিয়ে দেয়। ঠিক সেই ভাবেই তুমি ঝুপ করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে চলে এসে ছিলে হৃদয় গলিয়ে। যেভাবে টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ে। মনে হয় যেন অষ্টাদশী তরুণী নূপুর পায়ে রিনিঝিনি শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক সেই ভাবেই রুমঝুম করে তোমার আগমন আমায় রাঙিয়ে দিয়েছিল। যেভাবে ষোড়শী রমণী প্রেমে পরলে গাঢ় করে পায়ে আলতা রাঙায়।
তুমি আমার সমুদ্রের বিশাল জলরাশি,
আর আমি তোমার আসমানের নীল।
৪ বছর হয়ে গেল! অথচ আজও অথৈ কোমা থেকে ফেরেনি। বার বার মনে হয় এই বুঝি অথৈ আমাকে ‘নিবিড়’ বলে বলে ডাক দেবে। কিন্তু সেটা এই ৪ বছরে একবার ও হয়নি। যেই মেয়েটা সারাদিন বকবক করে সবার মাথা খারাপ করে দিত। আজ সেই মেয়েটাই আইসিইউ এর ভেতর নিথর হয়ে পড়ে আছে। বাইরের আলো বাতাস না পেয়ে মেয়েটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকালেই বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে।
আচ্ছা, অথৈ তুমি যখন কোমা থেকে ফিরে আসবে তখন তোমার পাশে আমাকে দেখে কি আনন্দে কেঁদে ফেলবে? নাকি ভীষণ ভাবে চমকে যাবে? আমি জানি, রোজকার সেই ভুবন ভোলানো হাসি টা দেবে তুমি। অথৈ একবার তোমার চোখ খুলে দেখ, টমি তোমার অপেক্ষায় রোজ বসে তোমার ফেরার দিন গুনছে। সে ও তোমার অপেক্ষায় আছে এত গুলো বছর ধরে। জানো তো? আমাদের বাচ্চা টমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তুমি কবে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে বলো তো? তুমি জানো তো, আমার তোমাকে ছাড়া কত কষ্ট হয়। খুব মিস করি তোমার দুষ্টুমি গুলো।
সেই দিনটার কথা সব সময় মনে পড়ে। যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। একদম নাটকীয় সাক্ষাৎ তাই না বলো?
‘ফিরে দেখা’__
______
নিবিড় ট্রেনে উঠে ব্যাগটা কামরায় রেখে বাইরে যায় সিগারেট কিনতে। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে স্টেশনেই একটা সিগারেট ধরায়। কয়েক বার সুখ টান দেয়। দুই আঙ্গুলের ভেতর জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সিগারেট। একটা করে টান দিয়ে মুখ দিয়ে একেক সময় একেক স্টাইলে ধোঁয়া ছাড়ছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে চেইন স্মোকার। শেষ টান টা দীর্ঘ করলো। তারপর নিচে ফেলে পা দিয়ে আগুন টা নিভিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে।
ওর কামরায় পা দেওয়া মাত্র ভুত দেখার মতো চমকে উঠে দু কদম লাফিয়ে পেছনে চলে যায়। সচরাচর নিবিড় এভাবে ভয় পায় না। কিন্তু এখন হঠাৎ আচমকা ভয় পেয়ে গেছে। তার কামরায় বসে থাকা মেয়েটা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোলের মধ্যে একটা বিড়ালছানা। বিড়ালটা ও গোল গোল চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।
বউ সাঁজ! নিশ্চয় বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে। এইটুকুনি মেয়ে তার কি সাহস বাবা!
মেয়েটাই কথা শুরু করে,
“কি সমস্যা? ওই ভাবে লাফিয়ে গেলে কেন? আমি কি ভুত? ”
নিবিড় চোখ কচলায়। কিছু একটা ভাবে। কি বলবে ভাবছে।
“ম্যাম, আপনি এখানে! এই ভাবে? ”
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকায়।
“আমি আবার তোমার ম্যাম হলাম কিভাবে? আমার তো মনে পড়ছে না আমি কোনদিন কোনো স্কুলের টিচার ছিলাম। ”
নিবিড় এবার থতমত খায়। তারপর চুপচাপ সামনের সিটে গিয়ে বসে।
“না মানে, অপরিচিত তো। তাই ম্যাম বলে সম্বোধন করলাম। ”
“থাক এত ভদ্রতা দেখাতে হবে না। আমি অথৈ। অথৈ জাফরিন। নাম ধরে ডাকবে বুঝলে? ”
“জি। ”
নিবিড় আর কিছু বলে না। এই বয়সের মেয়েরা একটু চটপটে স্বভাবের হয়। অথৈ মেয়েটাও ঠিক তেমন। এই বয়সের মেয়েরা নিজেদের সব কিছু থেকে আলাদা ভাবে। আরও অনেক অনেক পরিবর্তন আসে। যাইহোক, নিবিড় কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে রাখে। গান শুনছে না। এমনিতেই।
এর মাঝেই অথৈর কল আসে।
“আম্মু, আমি ট্রেনে উঠে পরেছি। তুমি কোন চিন্তা করো না। আব্বু কেও সামলিও। ”
“______”
“আমার থাকা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না তুমি আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নেব। ”
“______ ”
“আল্লাহ হাফেজ আম্মু। ”
অপর পাশের কোন কথা নিবিড় শুনতে পায়নি। শুধু মেয়েটার বলা কথা গুলো শুনতে পায় সে। নিবিড় যা বুঝলো, মা-মেয়ের কথা শুনে সে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। মা তার মেয়ে কে পালাতে সাহায্য করছে। এটাও কি সম্ভব? কি দুনিয়া আসলো!
অথৈ নিবিড়ের সামনে আঙ্গুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“এইযে শুনছো? ”
নিবিড় আরও একবার ভড়কায়। এই পুচকে মেয়ে সেই তখন থেকে তাকে তুমি করে বলছে? তাও আবার অচেনা একজন মানুষ কে। এমন ভাবে ডাকছে যেন ওর বিয়ে করা বউ। তবুও নিবিড় বিস্মিত ভাবটা চেপে রেখে উত্তর দেয়।
“জি, বলুন। ”
“ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে? ”
“কেন আপনি জানেন না? ”
অথৈ দু দিকে মাথা নাড়ায়। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে।
“নাহ তো। আমি দৌড়ে এসে শুধু টিকেট কেটেই ট্রেনে উঠে পরেছি। ”
নিবিড় কপাল চাপড়ায়। এমন মহা পাগল সে আগে কোনদিন দেখেনি।
“ট্রেন টা এখন সিলেট যাচ্ছে। ”
“ওহ, তোমার বাসা কি সিলেট? ”
“হ্যাঁ, আচ্ছা ম্যাম আপনার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে কি? জানতে পারি সেটা? মানে একা ছোট একটা মেয়ে তাই জানতে চাইলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ। ”
অথৈ কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ হেসে তারপর হাসি থামিয়ে বলল,
“আমার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে না। আব্বু আমাকে তার এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগে ছিল। কতবার আব্বু কে বললাম, আমি ওই ছেলে কে বিয়ে করব না। কিন্তু আব্বু আমার কথা শুনছিলই না। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে সিনেমাটিক ভাবে বউ সাঁজে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। আর এই পুরো ব্যাপার টা তে আম্মু আমাকে সাহায্য করেছে। কারণ, আম্মুরও ওই ছেলে কে পছন্দ না। ”
কথা শেষ করেই অথৈ বিশ্ব জয় করা হাসি দিল। যেন সে মস্ত বড় একটা কাজ করে ফেলেছে। তার কথা শেষ হতেই নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
“সে কি! এত ছোট মেয়ে কে কেউ বিয়ে দেয়? পুলিশে খবর দিলেই তো হয়ে যেত। তাহলে আপনাকে আর এভাবে পালাতে হতো না। ”
অথৈ চিন্তিত হয়ে পড়ে। মাথা চুলকায়। গালে হাত দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর নিবিড়ের দিকে তাকায়।
“এভাবে চিন্তা করিনি জানো? কিন্তু পুলিশে জানালে ও কিছু হতো না। আমার আব্বুর অনেক টাকা তো। পুলিশ কে চুপ করিয়ে দিত। ”
নিবিড় বুঝতে পারে ব্যপার টা। তাই ওই সম্পর্কে আর কিছু বলে না।
“তাহলে আপনি এখন কোথায় থাকবেন? ”
“বলব না। ”
অথৈ মুখ ভেংচি দিল। নিবিড় কিছু বলল না।
“বলব, তাহলে আমাকে তুমি ‘আপনি’ করে বলা বাদ দাও। ”
একদম বাচ্চামি আবদার। নিবিড়ের কেন যেন ভালো লাগল।
“আচ্ছা, তুমি করেই বলছি। তো এখন তুমি কোথায় থাকবে? মানে কার বাসায় গিয়ে উঠবে। ”
“তোমার বাসা কত বড়? ”
নিবিড় আরও একবার অবাক হয়। সে কি জিজ্ঞেস করল। আর এই মেয়ে কি বলল।
“কি হলো, বলছো না কেন? ”
“আমার ডুপ্লেক্স বাসা। কিন্তু অনেক বড়। ”
“রুম খালি আছে? ”
“হ্যাঁ, আছে। ”
“তাহলে আমি তোমার বাসায় থাকব। আমি যদি তোমার বাসায় থাকি। তাহলে কি তোমার কোন সমস্যা হবে? ”
একদম নিঃসংকোচ আবেদন। অচেনা একটা ছেলে কে বলছে তার সাথে তার বাসায় থাকবে। নিবিড় ভাবলো, মেয়েটার এখন অনেক বিপদ। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কাউকে চেনে ও না। ও সাহায্য না করলে নিশ্চয় অন্য কোন ছেলের কাছে যেয়ে সাহায্য চাইবে। সব ছেলেই তো আর ভালো নয়। মেয়েটার সরলতার সুযোগ নিতে পারে।
নিবিড়ের উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে।
“কিছু বলছ না কেন? আমি তোমার বাসায় থাকলে তোমার কোন সমস্যা হবে? ভয় পেয়ো না। ফ্রি তে থাকব না। তোমাকে প্রতি মাসে ভাড়া দেব। জানো? আমার কাছে ২ লাখ টাকা আছে। আর অনেক গুলো গয়না ও আছে। ”
নিবিড় আচমকা অথৈ এর মুখ চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলে,
“পাগল তুমি? এগুলো কথা কেউ এত জোরে বলে? চুপ করো। শরীরে একটু ও ভয় নেই। আমার বাসায় থাকতে চাইছো। আবার আমাকে এগুলো বলছো। যদি বাসায় নিয়ে গিয়ে তোমায় খুন করে সব কিছু আমি নিয়ে নেই? ”
অথৈ আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। ওর হাসি এবার আর থামছে না। গা কাঁপানো হাসি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কথা বলা শুরু করে।
“আমি ছোট থেকেই কারাতে, কুংফু সব ধরনের মারামা*রি শিখেছি। ”
তারপর সে তার ব্যাগ খুলে নিবিড় কে দেখায়। নিবিড়ের এবার বিষ্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ব্যাগের ভেতর মরিচের গুড়ো, ছুড়ি, কাঁচি, দাঁ, ছোট চাকু, হারপিক ইত্যাদি।
“আচ্ছা, হারপিক কেন? টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য? ”
“আরে ধুর, যদি কোন ছেলে বাজে কিছু বলে তবে মেরে একদম হারপিক খাইয়ে দেব। ”
“আমি কিন্তু তোমাকে একদম সহজ-সরল মেয়ে মনে করেছিলাম। কিন্তু তুমি ডেঞ্জা*রাস!
“হি হি, মানুষ যা দেখায়। মানুষ কিন্তু আসলে তা না। ভেতরে ভেতরে অন্য কিছু আছে। ”
নিবিড় এতক্ষণে মেয়েটার মুখে একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা শুনতে পায়।
এতক্ষণে “মিউ মিউ” শব্দ শুনে দুজনে উপলব্ধি করে ওদের মাঝে আরও একজন আছে। নিবিড় জিজ্ঞেস করে,
“তোমার পোষা বিড়াল? অনেক সুন্দর কিন্তু। নাম কি ওর? ”
“টমি। ”
“বাহ! সুন্দর নাম তো। আমি ওকে কোলে নিলে কি আমায় খাঁমচি দেবে? ”
“আরে না। বাচ্চাটা আমার ভীষণ শান্ত। ”
নিবিড় টমি কে কোলের মধ্যে নেয়। টমি ও ওর শরীরের ওম পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে। মনে হচ্ছে ও ক্লান্ত। ঘুমাবে।
কিন্তু ঘুমায় না। টমি একটু পর পর লেজ নাড়ায়। আবার মিউ মিউ করে। নিবিড় ওর মাথায় আর গলায় হালকা সুড়সুড়ি দেয়। টমি আরও গা ঘেঁষে মিউ মিউ করে।
অথৈ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে। ট্রেন তার গতিতে চলে যাচ্ছে। আশেপাশের সব কিছু পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। মৃদু বাতাস বইছে। কিছুটা ভালো লাগা অনুভব হচ্ছে। কি সুন্দর এক প্রশান্তি!
অথৈ গুনগুন করে গান গায়। যদিও তার গানের কন্ঠ ভালো না। তবুও চেষ্টা করে। গান গাইতে ভালো লাগে। বেশিরভাগ সময় একা থাকলেই গায়। এখন অবশ্য জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে ভুলেই গেছে ওর পাশে আরও একজন মানুষ আছে।
_____
চলবে।