শেষ পর্ব
লেখা : শঙ্খিনী
দেশের মানুষ, দেশের রাস্তাঘাট, দেশের যানজট সবকিছুই অসাধারন লাগছে রোদের কাছে। রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও যেন খুঁজে পাচ্ছে আপার আনন্দ।
রিকশায় রোদের পাশে বসে থাকা অতন্দ্রিলাও আনন্দ পাচ্ছে। তবে তার আনন্দের কারনটা একটু হয়তো ভিন্ন।
রোদ অন্যরকম গলায় বলল, “একটা ভাবের কথা শুনবে?”
অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় বলল, “নাহ্!”
“না কেন?”
“আমি ভাবের কথা পছন্দ করি না।”
“আমারটা শুনে দেখো, পছন্দ হতেও পারে।”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলল, “বলো।”
“সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে ভালোবাসতে বাধ্য করে।”
“তুমি কাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছো? আমাকে?”
“এমন কেন মনে হলো তোমার? আমি কি অন্য কারো প্রেমে পরতে পারি না?”
“না। তোমার ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
রোদ চুপ করে বসে রইল।
অতন্দ্রিলা বলল, “ভালো কথা! তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।”
“কি?”
অতন্দ্রিলা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা খাম বের করে রোদের হাতে ধরিয়ে দিল।
রোদ কৌতুহলী হয়ে বলল, “কী এটা?”
“তোমার ফ্লাইটের টিকিট। আগামী মাসে তুমি লন্ডনে ফিরে যাচ্ছ না? সেটার টিকিট এসেছে আজ সকালে।”
“তো এটা হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে ঘুরছো কেন?”
“এটা হাতে পাওয়ার পর, এই পরিস্থিতিতে তুমি কি করবে সেটা দেখার জন্যে।”
রোদ খাম থেকে টিকিটটা বের করে কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলল। অতন্দ্রিলা চমকে গেল, বেশ চমকে গেল। কিন্তু চমকে উঠে এক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নেওয়া অতন্দ্রিলার পুরনো অভ্যেস। এবারো তাই করলো।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ গম্ভীর গলায় বলল, “দেখলে কি করলাম?”
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
“অবাক হলে না?”
“না।”
“কেন?”
“কারন আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই করবে।”
“জানতে?”
“হুঁ! আমার ধারনা প্রকৃতির সঙ্গে আমার মনের একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। তাই প্রকৃতি কি করবে আমি আগে থেকেই টের পাই। জানো, আমাদের বিয়ের সময় আমার পরিবারের অনেকেই তোমাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে, আমরা বাকি জীবন একসঙ্গে থাকবো।”
“তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানতে, আমার এতো ফুটফুটে একটা মেয়েকে রেখে আমি কখনই লন্ডনে ফিরে যাবো না!”
“হুঁ।”
“তোমার যুক্তি কিন্তু এবার হেরে গেলো। তুমি চেয়েছিলে আমি যাতে আমার স্বপ্ন পূরণে মনোযোগী হই। কিন্তু তোমার মাথায় এ বিষয়টা ছিলো না যে রাত্রির কথা একদিন না একদিন আমি জানতে পারবোই। জানতে পেরে আমি কখনোই ওকে ফেলে রেখে যাবো না।”
“ভুল করেছি, আমি তো স্বীকার করেছি যে ভুল করেছি।”
“ভালো, ভুল স্বীকার করে নেওয়াটা ভালো।”
অতন্দ্রিলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মনে আছে আমরা যেবার কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। বন্ধু হতে পারি কিনা। আজ সে ধরনের আরেকটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।”
“করো?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “এখনকার সময় এবং পরিস্থিতি তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। কিন্তু আমাদের বিয়ের আগেকার পরিস্থিতি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল। আমি কি তোমার হতে পারি, রোদ?”
রোদ চুপ করে বসে আছে। চিন্তা করছে এই প্রশ্নের জবাবে কি বলা যায়। এই প্রশ্নের সুন্দর একটা উত্তর দেওয়া দরকার।
পরিশিষ্ট –
রাত্রির বয়স এখন সাড়ে চার। এবছর তাকে ভর্তি করানো হয়েছে ইরাবতীর ইশকুলে।
আজ সকালে ক্লাসে আসার পর থেকেই তার মনটা খারাপ, বেশ খারাপ। সবথেকে প্রিয় বন্ধুদেরও কেন যেন আজ বিরক্ত লাগছে।
টিফিন ব্রেকে ছোট ছোট পা ফেলে রাত্রি গেল প্রিন্সিপালের অফিসে, মায়ের কাছে।
অস্পষ্ট গলায় বলল, “বাবা কোথায় মা?”
অতন্দ্রিলা নিচু গলায় বলল, “যেখানে থাকার কথা সেখানে।”
“কোথায় থাকার কথা?”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অফিসে। কেন? তোর বাবাকে দিয়ে এখন কী কাজ?”
“বাবা বলেছিল আজকে স্কুলের পর শপিংয়ে নিয়ে যাবে।”
“তো যাবে। এখন কী?”
“বাবা তো আজকে, আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে গেল। তুমি বাবাকে ফোন দাও, আমি কথা বলি!”
“রাত্রি! একদম ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবি না তো। তুই ক্লাসে যা আমি দেখছি।”
রাত্রির বয়সে ছোট হলেও খুব ভালো করে জানে, তার মায়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ হবে না। তাই অসহায় মুখ করে ক্লাসে চলে গেল।
রাত্রি যাওয়ার পরপরই অতন্দ্রিলা টেলিফোন করল রোদকে।
ক্ষীণ গলায় বলল, “এই তোমার মেয়েকে কী সব উল্টা পাল্টা প্রমিজ করো বলোতো? সে তো ক্লাস না করে শপিংয়ের টেনশন করছে!”
রোদ শান্ত গলায় বলল, “উল্টা পাল্টা কেন হতে যাবে? অফিস থেকে এসে নিয়ে যাবো তো শপিংয়ে!”
“তুমি সকাল সকাল চলে গেছো দেখো তোমার মেয়ে ভাবছে, তুমি তাকে নিয়ে যাবে না।”
“আমার সকালে একটা কনফারেন্স ছিল তাই আগে আগে বেরিয়ে গেছিলাম। এখন তুমি একটু ওকে ম্যানেজ করবে?”
“উহু, মোটেও না! তোমাদের বাবা মেয়ের ঝামেলার মধ্যে আমি আর নেই।”
“তন্দ্রি,প্লিজ!”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল, “আচ্ছা বলো। কি করতে হবে?”
“স্কুল ছুটি হলে তুমি রাত্রিকে নিয়ে শপিং মলে চলে যেও। আমিও তিনটার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাবো!”
“তিনটা। মনে থাকে যেন।”
“অবশ্যই থাকবে ম্যাডাম!”
অতন্দ্রিলা মুচকি হেসে টেলিফোন রেখে দিল।
বেলা তিনটা আটচল্লিশ মিনিট। অতন্দ্রিলা মেয়েকে নিয়ে শপিং মলে পৌঁছেছে অনেক্ষণ হলো। রোদের কোনো নামগন্ধ নেই।
আরও কিছুক্ষণ পর রোদ দৌড়ে এসে রাত্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “স্যরি মা। অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। আই অ্যাম সো স্যরি।”
রাত্রি অস্পষ্ট গলায় বলল,“আমি তোমার স্যরি নিব না বাবা!”
“কেন?”
“যে প্রমিজ রাখতে পারে না, তার স্যরি নিতে হয় না।”
রাত্রির এ কথা শুনে অতন্দ্রিলা ও রোদ ফিক করে হেসে দিলো।
রোদ বলল, “তোমার মেয়ে একদম তোমার মতো হয়েছে।”
“আমি তো আগে থেকেই জানতাম যে ও আমার মতো হবে।”
“কিভাবে জানতে? তোমার প্রকৃতি বলেছিল?”
“অবশ্যই।”
শপিং করতে করতে রাত্রি বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে বলে, ওরা বাসায় চলে আসলো।
রাত্রিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে অতন্দ্রিলা এসে বসে বাগানের দোলনায়।
কিছুক্ষণ পর রোদ এসে অতন্দ্রিলার পাশে বসে তার ডান হাতটা ধরল।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হাত ধরাধরি করতে যেও না, আশেপাশে কিন্তু তোমার মা আছে।”
“থাকুক। উনার তো কিছু মনে করার কথা না। তুমিই তো বলে, মা আমাদের সবার থেকে অনেক বেশি আধুনিক!”
“ওহ্ হ্যাঁ তাইতো! তাহলে ধরে থাকো।”
রোদ আরও শক্ত করে অতন্দ্রিলার হাতটা চেপে ধরল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রোদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “এই তন্দ্রি তোমার আছে, কিভাবে আমাদের বাসর রাতে তিনটা পর্যন্ত জেগে তুমি বই পড়েছিলে?”
অতন্দ্রিলা ইতস্তত বোধ করে বলল, “ওসব মনে করিয়ে দিও না তো। তখন বাচ্চা ছিলাম, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় তা জানতাম না।”
“এখন খুব জানো, না?”
“এখন মোটামুটি জানি।”
“আসো তোমাকে বিভ্রান্ত করি!”
“আমাকে বিভ্রান্ত করে লাভ কি?”
“মানুষকে বিভ্রান্ত করে আমি মজা পাই। এটা এক ধরনের খেলা বলতে পারো।”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলল, “ঠিকাছে, করো বিভ্রান্ত।”
“বলোতো, ২+২-২+২ কত হয়?”
“এই বাচ্চাদের প্রশ্নটা আমাকে করছো কেন?”
“একটু আগে কিন্তু তুমি নিজেই বললে, তুমি বাচ্চা।”
“সেটা তো আগে ছিলাম!”
“এখনো আছো! এখন তর্ক না করে প্রশ্ন তার উত্তর দাও।”
অতন্দ্রিলা একটু ভেবে বলল, “চার?”
“হয়নি, উত্তর হবে শূন্য।”
“কিভাবে?”
“স্কুলে বদমাস নিয়ম শিখেছিলে না? সেই নিয়মে রাশিটা (২+২)-(২+২) – এরকম। এভাবে করে দেখো।”
“ওহ্ হ্যাঁ, তাইতো!”
“এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ধরন। এখন যদি তুমি শূন্য বলতে তাহলে আমি বলতাম চার।”
“জানো আমি আগে ভাবতাম, ভালোবাসা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি হলো ভালোবাসা।”
“আর এখন কি ভাবো?”
অতন্দ্রিলা রোদের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “এখন মনে হয়, ভালোবাসা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি।”
রোদ মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল, “আমি জীবনে হয়তো কোনো মহাপুন্য করেছিলাম। তাই প্রকৃতি তোমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে।”
(সমাপ্ত)