পর্ব ৯ – (বন্ধু হবে বলে যাও)
লেখা : শঙ্খিনী
শীতের সকাল। চারিদিকে বইছে দমকা হাওয়া। সমুদ্রের তীরে থাকা সাত-আট জন মানুষ ঠকঠক করে কাঁপছে।
কিন্তু অতন্দ্রিলা কাঁপছে না। কফির মত রঙের একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে আছে সমুদ্রের তীরে। অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এই সুবিশাল সমুদ্রে ভয়ংকর এক পাপীকে যদি চুবিয়ে আনা হয় তাহলে কি হবে? তার সব পাপ ধুয়ে যাবে? নাহ্! ত্বকে এসিডের দাগ আর মনের পাপ কখনই সম্পুর্নভাবে ধোয়া যায় না। কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়।
অতন্দ্রিলার পাশে বসে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে রোদ, চাটা বেশ ভালোই লাগছে তার।
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “অতন্দ্রিলা, তুমি কি গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে জানো?”
অতন্দ্রিলা ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কি সম্পর্কে?”
“গুগলপ্লেক্স।”
“সেটা কি? গুগলের নতুন কোনো অ্যাপ?”
রোদ ঠোঁটের কোনো হাসি নিয়ে বলল, “না। গুগলপ্লেক্স হলো একটা সংখ্যা।”
“সংখ্যা? সংখ্যার এমন নাম কেন?”
“এই সংখ্যাটি এত বড় যে, তা লিখে রাখার মতো জায়গা এই মহাবিশ্বে নেই। ১০ হিসাবে ১০ এর শক্তি হিসাবে ১০০ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 10(¹⁰^¹⁰⁰)।”
“আসলেই কি এই সংখ্যা লিখতে গেলে মহাবিশ্ব সমান জায়গা লাগবে?”
“কিছুটা সেরকমই। গুগলপ্লেক্স সংখ্যাটি শুনতে তোমার ৩১,০০০ বছর সময় লাগবে।”
“অসাধারন ব্যাপার তো! ভালোবাসার পরিমাণ বোঝাতে,গুগলপ্লেক্স উদাহরন হিসেবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেমন, আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ভালোবাসি।”
রোদ কোনো জবাব দিলো না। এতে অতন্দ্রিলা কিছুটা বিব্রত বোধ করল। ভালোবাসার প্রসঙ্গ তোলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি।
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আবার ঘৃণার কথাও বলা যায়। আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ঘৃণা করি।”
“গুগলপ্লেক্স অনেক বৃহৎ, অনেক। একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের এতটা ঘৃণা থাকতে পারে না।”
“ভালোবাসা থাকতে পারে?”
“পারে।”
“কেন?”
“কারন ভালোবাসা মানুষকে আনন্দ দেয়। মানুষ ভালোবাসতে ভালোবাসে, তাই ভালোবেসে যায়। কিন্তু ঘৃণা মানুষকে আনন্দ দেয়, বরং তার দুঃখকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। তাই একপর্যায়ে ঘৃণা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা ফুরোয় না।”
মূল কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ইনানী বীচ। এই বীচ অন্যান্য বীচের থেকে যে আলাদা তা নয়। তবুও মানুষ কক্সবাজারে বেড়াতে এলে সেখানেই যাবেই।
অতন্দ্রিলা এবং রোদও যাচ্ছে।
অতন্দ্রিলার ধারনা, মানুষ ইনানীতে যায় বীচটাকে উপভোগ করার জন্যে নয়। বরং সেখানে যাওয়ার রাস্তাটাকে উপভোগ করার জন্যে।
রাস্তার ডানদিকে সমুদ্র এবং বামদিকে পাহাড়। প্রকৃতির দুই আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য মুখোমুখী। তবে প্রকৃতির এই দুই সৌন্দর্যকে মুখোমুখি দেখা যাচ্ছে মানুষের কারনেই। মানুষ যদি বুদ্ধি করে পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে রাস্তা তৈরি না করতো, তবে এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে হতো না।
সেই রাস্তা দিয়ে চলছে অতন্দ্রিলাদের জিপ গাড়ি। অতন্দ্রিলা বসেছে রোদের সামনে।
অতন্দ্রিলা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আপনার কোনটা পছন্দ, পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
“যখন যেটার কাছাকাছি থাকি, তখন সেটাই প্রিয়।”
“এখন তো দুটোরই কাছাকাছি আছেন!”
“তাহলে এখন দুটোই প্রিয়। তোমার পছন্দের কোনটা?”
“সমুদ্র।”
“কেন?”
“কারন ঢাকায় সমুদ্র নেই। সমুদ্র দেখতে আসতে হয় কক্সবাজারে। তাই সমুদ্রের প্রতি অন্যরকম একটা টান আছে।”
“ঢাকায় পাহাড়ও তো নেই!”
“পাহাড় নেই কিন্তু আপনাদের বাগান আছে। সবুজে ঘেরা ওই বাগানটা আমাকে পাহাড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।”
রোদ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “ইরাও একই কথা বলত।”
“আপনার এই ব্যাপারটা না আমার অনেক ভালো লাগে।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এইযে বারবার ইরাবতীর কথা বলা এবং আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া যে আপনি তাকে ভোলেননি, এখনো তার জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাতে আমি আপনার মনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করি।”
রোদ চুপ করে রইল।
ইনানী বীচে পৌঁছে গেছে তারা। অতন্দ্রিলা এখন সমুদ্রের জলে পা ভেজাচ্ছে। অতন্দ্রিলার দেখাদেখি রোদও স্যান্ডেল জোড়া খুলে হাতে নিয়েছে, পা ভেজাতে।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “রোদ সাহেব?”
“হুঁ।”
“আপানার ধারনা ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। আমি ইরাবতীর জায়গা নিতে চাই না।”
“আমার এমন কোনো ধারনা নেই।”
“আমি আপনার স্ত্রী হতে চাই না। আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।”
রোদ নিশ্চুপ। অতন্দ্রিলাও কথা বলছে না।
নীরবতার সঙ্গে পা ভেজাচ্ছে।
সূর্যাস্ত হয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল।
রোদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “চল এবার যাই।”
“যাচ্ছি। তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?”
“কি প্রশ্ন?”
“বন্ধু হতে পারি?”
রোদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “পারো, চাইলেই পারো।
“ধন্যবাদ।”
“তাহলে আমিও কি তোমাকে আমার বন্ধু ভাবতে পারি?”
“ভাবতে পারেন না। আপনি আমার বন্ধু, আমিও আপনার বন্ধু। এর মধ্যে ভাবাভাবির কি আছে?”
ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর নাস্তা তেমন একটা ভালো লাগে না অতন্দ্রিলার। নাস্তায় এত আয়োজন অসহ্য লাগে। তার মতে, “দিনের প্রথম আহারটি হওয়া উচিত সাদামাটা ধরনের। যা দেখে চোখ শান্তি পাবে, যা খেয়ে মন শান্তি পাবে।”
আজ অতন্দ্রিলাকে একাই নাস্তা করতে হচ্ছে। রোদ গেছে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করতে।
সন্ধ্যা ফোন করেছে, অতন্দ্রিলা নিতান্ত অনিচ্ছায় টেলিফোন তুলল।
সন্ধ্যা উৎসাহিত গলায় বলল, “কিরে তোদের হানিমুন কেমন চলে?”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল,“কি কেমন চলে?
“হানিমুন! আরে শোন না আমাদের হানিমুনের সময়ে কি হয়েছে। আমরা গিয়েছিলাম সিলেটে। কনকনে ঠান্ডা! তোর জাভেদ ভাইয়ের মাথায় সারাক্ষণ কমলা রঙের মাফলার পেছানো। ছবি তোলার সময়ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখেছিল। তাই রাগে, দুঃখে হানিমুনের ছবিগুলো আর প্রিন্টই করিনি। রোদ আবার সেরকম কিছু করছে না তো?”
“তোমার কি মনে হয় আপা?”
“আমার তো মনে হয় করছে না।”
“তাহলে করছে না!”
“আচ্ছা তোকে একটা কাজের কথা বলি! শোন সবসময় রোদের কাছাকাছি থাকবি, বিশেষ করে বিয়ের প্রথম বছরটা। কখনো ওকে চোখের আড়াল করবি না। পারলে ওর কাছে ঘেঁষে থাকবি। এতে হবে কি, ও আর অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপা তোমার তো খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই, তুমি গিয়ে জাভেদ ভাইয়ের কাছে ঘেঁষে থাকো। আমি রাখলাম।”
সন্ধ্যাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা টেলিফোন রেখে দিল।
রাতে সমুদ্রের তীরে ক্যাম্প ফায়ার করা হয়েছে, তাবু খাটানো হয়েছে। তাবুর পাশে আবার রয়েছে বারবিকিউয়ের ব্যাবস্থা।
তাবু খাটানোর কোনো অর্থ নেই, রোদ অতন্দ্রিলা কেউই রাতে সেখানে থাকবে না।
তবুও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে খাটানো।
অতন্দ্রিলা সেখানে বসে আছে। রাতের সমুদ্রে এক অন্যরকম রহস্য রয়েছে। সমুদ্রের জলকে জল মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পারদ। পারদ দেখতে চকচকে তবে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে ধরতে গেলেই ছুটে পালায়।
সমুদ্রের জলও কি এখন ধরতে গেলে ছুটে পালাবে? ব্যাপারটা পরীক্ষা করা দরকার।
রোদ এসে অতন্দ্রিলার পাশে বসল।
আনন্দিত গলায় বলল, “আয়োজন কেমন হয়েছে অতন্দ্রিলা?”
“এই অর্থহীন তাবুটাকে বাদ দিলে, ভালো।”
“আচ্ছা তোমার নামটা কে রেখেছে?”
“আমার বাবা। আমাদের তিন ভাইবোনের নামই উদ্ভট। আমার বাবা মনে করেন, উদ্ভট নামের অধিকারীকে মানুষ মনে রাখে। সাধারন নামের অধিকারীদের মানুষ অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।”
“অতন্দ্রিলা নামের অর্থ কি?”
“যাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না।”
“তোমাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না?”
“এখন পারে কিন্তু হয়তো আমার জন্মের পরপর পারতো না। তাই এমন নাম রাখা হয়েছে আমার। তা, হঠাৎ এই নামের প্রসঙ্গ?”
“না মানে, বারবার তোমার নামটা উচ্চারন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।”
“কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও কিছু করার নেই। অতন্দ্রিলা বলেই ডাকতে হবে।”
রোদ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা তুমি তো আমাকে অত ডাকতে মানা করেছো। কিন্তু অ-তন্দ্রি-লা থেকে যদি শুধু ‘তন্দ্রি’ ডাকি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
অতন্দ্রিলা ঠোঁটভর্তি হাসি নিয়ে বলল, “আপত্তি থাকবে কেন? আমার নামের ভেতরেই যে এত সুন্দর একটা নাম লুকিয়ে আছে, তা আগে খেয়ালই করিনি!”
রোদ আজ প্রথম অতন্দ্রিলাকে হাসতে দেখছে। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে, তখন কেবল তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। অতন্দ্রিলার চোখ এবং ঠোঁট একসঙ্গে হাসছে।
অতন্দ্রিলা বলল, “আপনার দেওয়া নামটা আমার অস্বাভাবিক পছন্দ হয়েছে। এই পৃথিবীতে আমাকে ‘অত’ নামে ডাকার অধিকার আছে ছয়জন মানুষের। তারা হলেন আমার বাবা, মা, দাদি, আপনার মা, শহর এবং জরিনা। কিন্তু আমাকে ‘তন্দ্রি’ নামে ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আপনার। কারন এই নামটা আপনি দিয়েছেন।”
“তাহলে তো আমি ধন্য, তন্দ্রি।”
“বেশিবেশি তন্দ্রি ডাকবেন। যতবার শব্দটা শুনি, আমার ভালো লাগে।
আমি এতটাই আনন্দিত যে এখন আপনাকে গান শোনানো হবে। আমি যখন কারও ওপর অনেক বেশি খুশি হই, তখন তাকে গান শোনাই।”
“গান পারো নাকি?”
“যে মানুষ কথা বলতে পারে, সে গানও গাইতে পারে। গুনুন তো এখন।”
এতদিন যে বসেছিলেম
পথ চেয়ে আর কাল গুনে,
দেখা পেলেম ফাল্গুনে।
স্বর্গে মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট সুকন্ঠী গায়িকাদের বলা হয় কিন্নর। এদের থাকে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। অতন্দ্রিলা জন্মেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে।
রোদ আজ দেখল অন্য এক অতন্দ্রিলাকে। খুশি হলে যে একটা মানুষ এতটা বদলে যেতে পারে তা রোদের জানা ছিল না।
রোদের খুব ইচ্ছে হচ্ছে অতন্দ্রিলাকে বলতে, “তুমি কি সারাক্ষণ এভাবে হেসে গেয়ে থাকবে?”
অতন্দ্রিলা মুখের ওপর “না” বলে দিবে অথবা সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আবার গোমড়া করে ফেলবে ভেবে, রোদ আর বলল না।