পর্ব ১১ (ভালো থাকবেন)
সিঙ্গাপুর থেকে পাথরের মূর্তি অনানো হয়েছে। বাগানে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো বসানো হবে। অতন্দ্রিলা বলে, বাগানটাতে নাকি কোনো সৌন্দর্য নেই। তাই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে ফিরোজার এই আয়োজন।
বাগানের দোলনায় বসে কাজের তদারকি করছেন তিনি। তার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে রোদ।
ফিরোজা ক্ষীণ গলায় বললেন, “কি যেন নাম বললি ইউনিভার্সিটির?”
“মরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটি।”
“লন্ডনের কোন জায়গায় সেটা?”
“মরহেডে।”
“এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি, বৌমা জানে?”
“না, জানাইনি। তোমার অনুমতি পেলে জানাবো।”
“আমার অনুমতির কি আছে? তুই এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছিস, অবশ্যই যাবি। কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা বৌমাকে জানাতে হবে। সে কিন্তু আমাদের পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবি না।”
অতন্দ্রিলা রান্না করছে, চিংড়ি মাছের মালাইকারি। এই খাবারটি আমাদের সংস্কৃতিতে এসেছে মালয়েশিয়ান সংস্কৃতি থেকে। মালয়েশিয়ান মালাইকারির বিশেষত্ব হলো নারকেলের দুধ এবং চিনি।
বেশ উৎফুল্ল লাগছে অতন্দ্রিলাকে।
রান্না শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখে রোদ বসে আছে।
অতন্দ্রিলা উৎসাহিত গলায় বলল,“আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
রোদ গম্ভীর গলায় বলল, “আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সাথে।”
“তাহলে আগে আপনি বলুন।”
“তন্দ্রি, আমি লন্ডনের একটা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করার অফার পেয়েছি। এত বছর আমি মায়ের কথা মত ব্যাবসাটাকে সামলে রেখেছি, এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন আমি চাই আমার স্বপ্ন পূরন করতে, নিজের পছন্দের কাজ করতে।”
অতন্দ্রিলা চমকে উঠল। তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে যাবার উপক্রম। চমকে ওঠার কোনো কারন নেই, রোদের প্রতি তো তার প্রেম নেই। কিংবা থাকতেও পারে। এক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল অতন্দ্রিলা।
স্বাভাবিক গলায় বলল, “কবে যাবেন?”
“আগামী মাসে।”
“আবার আসবেন কবে?”
“আমি ওখানে পার্মানেন্টলি থাকবো, গ্রিন কার্ডের জন্যে অ্যাপ্লাই করবো। মাঝে মাঝে যখন ছুটি থাকবে, তখন আসবো।
অতন্দ্রিলা চুপ করে রইল।
রোদ বলল, “তুমি কিন্তু চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।”
“আমি যাবো কেন? আমি তো আর ইউনিভার্সিটি থেকে কোনো অফার পাইনি! আর পেলেও যেতাম না। দেশ থেকে দূরে কোথাও বেশি দিন থাকতে পারি না আমি।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদ লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীতের কাপড় কেনা হয়েছে। যদিও এসব কাপড়ে সেখানকার শীত মানবে না, সেখান থেকে আবার কিনতে হবে।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এটা যদি নব্বইয়ের দশক হতো তাহলে কি ফিরোজা ছেলের জন্যে সোয়েটার বুনতে বসতেন? নাহ্, ফিরোজা যথেষ্ট আধুনিক।
এক নিমেষেই যেন একটা মাস কেটে গেল।
আজ রাতে রোদের ফ্লাইট। দুপুরের খাবারে করা হয়েছে এলাহি আয়োজন। কোরমা, পোলাও, আস্ত মুরগির রোস্ট। সবকিছু নিজের হাতে রান্না করেছে অতন্দ্রিলা।
ফ্লাইট রাত দশটায়। কিন্তু বোর্ডিং হবে সাড়ে আটটায়। সে অনুযায়ী আগে আগেই বের হতে হবে রোদকে।
দুটো বিশাল আকারের সুটকেস তোলা হয়েছে গাড়িতে। ফিরোজা রোদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবেন। রোদের কিছু দুরসম্পর্কের চাচা মামা জাতীয় লোকও এসেছেন তাকে বিদায় দিতে। তারাও যাবে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।
কিন্তু অতন্দ্রিলা যাবে না। চুপ করে সদর দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে।
রোদ অতন্দ্রিলার কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসলেই পারতে।”
“এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এতে কষ্ট আরও বাড়ে।”
“তার মানে তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
“ঠিক কষ্ট হচ্ছে না, খারাপ লাগছে। আমার সবথেকে কাছের বন্ধু যে দূরে সরে যাচ্ছে।”
“দূরে কোথায় সরে যাচ্ছি। এই যুগে কেউ কি আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা? ফোনে তো কথা হবেই, দেখাও হবে।”
“তাও ঠিক। আচ্ছা আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখনো? সাতটা বেজে গেছে। এখন রওনা না দিলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।”
“ওহ্, হ্যাঁ তাইতো। তাহলে এখন আসি। ভালো থেকো।”
“আপনিও ভালো থাকবেন।”
রোদ যাওয়ার সময় একবার তার তন্দ্রির দিকে ফিরে তাকালো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।
রোদ চলে যাওয়ার পর অতন্দ্রিলা লক্ষ করল, তার চোখে জল। সর্বনাশ!এরমধ্যে রোদের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে গেছে সে?
আচ্ছা রোদ তো এখন বেশি দূর যেতে পারেনি। ফিরিয়ে এনে কি তাকে কথাটা বলবে?
না থাক! যাত্রাপথে পেছন থেকে ডাকা নাকি অমঙ্গলজনক।
পর্ব ১২ – (আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে)
রোদ লন্ডনে চলে গেছে এক সপ্তাহ হলো। অতন্দ্রিলা এসেছে তার বাবা মায়ের বাড়িতে। ফিরোজাকে একা রেখে আসেনি, তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
অতন্দ্রিলার ধারনা ছিল তার বাবা মা আগের মতো সারাদিন পাড় করছেন ঝগড়া করে। কিন্তু তার সেই ধারনা ছিল ভুল।
হামিদ সাহেব এবং শয়লার মধ্যকার সম্পর্ক এখন মধুর, অত্যন্ত মধুর। এতটাই মধুর যে তাদেরকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছে নববিবাহিত দম্পতি ।
প্রতিদিন বিকেলে হামিদ সাহেব, শায়লা এবং ফিরোজা চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় বসেন। মাঝে মাঝে সন্ধ্যা তাদের সঙ্গে যোগ দিলেও, অতন্দ্রিলা এসবের মধ্যে নেই।
আজ বিকেলে সন্ধ্যা এলো অতন্দ্রিলার ঘরে।
ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কিরে মন খারাপ?”
অতন্দ্রিলা বলল, “মন খারাপ হতে যাবে কেন?”
“শোন, জীবন তো আর কারও জন্যে থেমে থাকবে না। রোদের জীবন তোর জন্যে থেমে গেছে? যায়নি তো! তুই কেন খামোখা এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস? নিজের মতো কাজ শুরু করে দে। তোর জীবন ওর জন্যে থেমে থাকবে কেন?”
“আপা, জীবন কারও জন্যে থেমে
থাকে না, এটা আমিও জানি। আমার জীবনও কারো জন্যে থেমে নেই।”
“তাহলে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?”
“আছে একটা কারণ, বলা যাবে না।”
“অতন্দ্রিলা আশরাফ কথা গোপন করছে দেখি? তুই রোদের কথা ভেবে মন খারাপ করছিস, কিন্তু বলতে পারছিস না। দেখলি তো, বিয়ে একটা মেয়েকে কতটা বদলে দেয়!”
অতন্দ্রিলা হাই তুলতে তুলতে বলল, “দেখেছি। দেখে আমার মন ভরে গেছে।”
সন্ধ্যা সাতটায় রোদের টেলিফোন এলো।
এরমধ্যে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। অতন্দ্রিলা এখন আর রোদকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে না।
অতন্দ্রিলার কথা, “এখন সে যেখানে থাকে সেখানে আপনি-তুই বলে কিছু নেই, সবাই তুমি। আমি কেন অযথা তাকে আপনি বলে ডাকতে যাবো?”
অতন্দ্রিলা টেলিফোন তুলে বিনয়ী গলায় বলল, “কি খবর?”
“এইতো ভালো। তোমার খবর কি?”
“ভালো খবর।”
“কি করছিলে?”
“তেমন কিছু না। তুমি?”
“এইতো মাত্র লাঞ্চ সারলাম।”
অতন্দ্রিলা উৎসাহিত গলায় বলল, “কয়টা বাজে জানি ওখানে?”
“২ টা।”
“ওখানে কি অনেক শীত?”
“হুঁ, মোটামুটি ভালোই শীত।”
“বৃষ্টি হয়?”
“বৃষ্টি এখন পর্যন্ত দেখিনি, তবে স্নোফল হয়। বাড়ির সকলে কেমন আছে?”
“ভালো আছে, আনন্দে আছে। গতকাল আপা জাভেদ ভাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে।”
“তুমি ভালো আছো তো তন্দ্রি?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো।”
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “ভালো আছি, অবশ্যই ভালো আছি। তোমাকে আর জিজ্ঞেস করলাম না। কারন আমি জানি তুমিও ভালো আছো।”
আজকাল এগারটার আগে বিছানা থেকে উঠতে অসহ্য লাগে অতন্দ্রিলার। মনে হয়, সর্বশক্তি দিয়ে কেউ যেন তাকে আটকে রেখেছে।
কিন্তু আজ সকাল আটটার দিকেই ঘুম ভেঙে গেল, ছাদ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দে। কেউ অবশ্য ঝগড়া করছে না। অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়ে কথা বললে, খানিকটা চেঁচামেচির মতোই শব্দ হয়।
ট্রাকভর্তি গাছপালা এসেছে। দুজন মালি, একজন রাজমিস্ত্রীও এসেছে। অতন্দ্রিলাদের ছাদে বাগান করা হবে।
অতন্দ্রিলা ছাদে গিয়ে দেখল ফিরোজা অতি যত্ন সহকারে গাছ লাগাচ্ছেন। আর মালিদের অযথা তারা দিচ্ছে জাভেদ।
জাভেদ, সন্ধ্যার স্বামী। মুখ লম্বাটে, গাত্রবর্ণ শ্যামলা, হাসিটা বিশ্রী। জাভেদের ভয়ংকর বাজে স্বভাব হলো প্রতিটা বাক্য দুবার বলা।
এই স্বভাবের কারণেই তিনি অতন্দ্রিলার অপছন্দের ব্যাক্তিদের মধ্যে একজন।
অতন্দ্রিলাকে ছাদে আসতে দেখে জাভেদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আরে অতন্দ্রিলা আসো। আসো অতন্দ্রিলা। দেখো কি সুন্দর বাগান হচ্ছে! কি সুন্দর বাগান হচ্ছে!”
অতন্দ্রিলা হতাশ গলায় বলল, “জাভেদ ভাই, আপনাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে!”
“কেন আমি আবার কি করলাম? কি করলাম আমি?”
“এইযে প্রতিটা কথা দুবার করে বলেন।”
“ঠিকাছে, আর বলবো না। বলবো না আর।”
“এসব কি হচ্ছে একটি সংক্ষেপে বলবেন?”
“বাগান হচ্ছে, বাগান। হরেক রকমের গাছ লাগানো হচ্ছে। হরেক রকমের গাছ। সবই সবজির গাছ। সবগুলো সবজির গাছ।”
এনার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাই অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।
নিচে এসে অতন্দ্রিলা গম্ভীর গলায় বলল, “মা ছাদে এসব কি হচ্ছে?”
শায়লা হাসিমুখে বললেন, “ফিরোজা আপার কান্ড! আমাদের বাড়িতে বলে গাছের বংশও নেই। এজন্যে নিজ হাতে বাগান করছেন।”
“বাগান করছেন ভালো কথা কিন্তু এতগুলো গাছের পরিচর্যা করবে কে? আমার চলে যাওয়ার পর তো গাছগুলো মরে মরে ভূত হয়ে যাবে!”
“ভূত হলে হবে! সেই চিন্তা তোকে করতে হবে না।”
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে জাভেদ উজ্জ্বল চোখে বলল, “অতন্দ্রিলা শোনো একটা দারুন পরিকল্পনা করেছি। দারুন পরিকল্পনা করেছি একটা।”
অতন্দ্রিলা থমথমে গলায় বলল, “শুনতে পারি তবে এক শর্তে। আপনি একটা কথা দুবার বলতে পারবেন না।”
জাভেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই হামিদ সাহেব বললেন, “ও একটা কথা দুবার করে না বললে কথা বলতে পারে না। আমি বলছি শোন। রোদকে একটা ভিডিও বার্তা পাঠানো হবে।”
অতন্দ্রিলা বলল, “কি পাঠানো হবে?”
“ভিডিও বার্তা। সেই ভিডিওতে থাকবো আমরা সবাই। আমরা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে বসে গান গাইবো। সেই গানটাই ওকে পাঠানো হবে।”
“গান গেয়ে সেটা আবার ভিডিও করে পাঠাতে হবে কেন?”
“পাঠাতে হবে। এতে রোদের মনোবল বাড়বে। জানবে যে ও একা নয়। আমরা ওর সাথে আছি।”
“বাবা তার যথেষ্ট মনোবল আছে। গান গেয়ে তার মনোবল বাড়ানোটা অর্থহীন। তাছাড়া তোমাদের সকেলর গানের গলা তো তেমন একটা ভালো না।”
“তোকে গাইতে হবে না। আসলে তোকে বলাটাই ভুল হয়েছে।”
“বলা ভুল হয়নি বাবা। তোমাদের আমার সাহায্য লাগবে। তোমরা গান গাইবে আর আমি ভিডিও রেকর্ড করে দেবো।”
মুক্ত করো ভয়,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়।
হামিদ সাহেব, শায়লা, ফিরোজা, সন্ধ্যা, জাভেদ – সকলে সারিবদ্ধ ভাবে বসে গান গাইছে। এমনকি জরিনাকে দেখা যাচ্ছে সারিতে। তবে সে গানটা গাইতে পারে না, তাই শুধু হাতে তালি দিচ্ছে।
অতন্দ্রিলা ভিডিও রেকর্ড করতে করতে চিন্তা করছে, ভিডিওতে সে একা থাকলে কোন গানটা গাইত।
আজ তোমারে দেখতে এলেম
অনেক দিনের পরে।
ভয় কোরো না, সুখে থাকো,
বেশিক্ষণ থাকব নাকো
এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥
হ্যাঁ, এই গানটাই গাইত।
(চলবে)