#অতন্দ্রিলার_রোদ
লেখা : শঙ্খিনী
পর্ব ৬ : (বিবাহ)
পৃথিবীর বড় বড় নাট্যমঞ্চের মধ্যে অন্যতম বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়িতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর সকল বিষয় নিয়ে নাটক হয়।
বিয়ে বাড়ির সবথেকে কমন নাটক হলো বর বা কনের পালিয়ে যাওয়া। কনে পালায় প্রেমিকের হাত ধরে, বর পালায় স্বপ্নের হাত ধরে। অতন্দ্রিলার কোনো প্রেমিক নেই, রোদের স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়ে গেছে। তাই তাদের বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরও একটি কমন নাটক – এক মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এই অন্য মেয়েটি হয় যাকে প্রথমে দেখানো হয়েছে তার জমজ বোন। অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকেরও সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরেক ধরনের মজার নাটক ঘটে ঠিক বিয়ে পড়ানোর পর পর। হঠাৎ পরিবারের মধ্য থেকে গুপ্ত প্রেমিক প্রেমিকার উত্থান ঘটে। প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে কাজী সাহেবকে বলে, “কাজী সাহেব! আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে।”
অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভবনা রয়েছে। মামাতো বোন টিকলি এবং খালাতো ভাই তিশানের ভাবভঙ্গি ভালো মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পরই এরা কানাকানি করছে।
অতন্দ্রিলা ভেবে রেখেছে, যদি সত্যিই এরা এই নাটকটি করে তাহলে সে কঠিন গলায় বলবে, “তোদেরকে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হবে। দয়া করে আমার বিয়েটা নষ্ট করিস না!”
আজ অতন্দ্রিলা এবং রোদের বিয়ে। বাড়িতে বিরাট আয়োজন। আত্মীয় স্বজনেরা সবাই বিভিন্ন আজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। শহর হল থেকে বাড়িতে এসেছে। সেও ছোটাছুটি করছে, তবে সেটা কোনো কারন ছাড়াই।
শায়লা দুদিন আগেই এ বাড়িতে এসেছেন। রান্নাবান্নার দায়িত্বটা তিনি এবং তার বোনেরা নিয়েছেন।
বাড়িতে অন্যরকম একটা খুশির বাতাস বইছে। এমন বাতাস অতন্দ্রিলার বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর আর এ বাড়িতে বয়নি।
অতন্দ্রিলা ঠিক করেছে আজ সেও এক নাটক করবে, ভয়ংকর নাটক। তবে সেই ভয়ংকর নাটকের ফলাফল হবে অসাধারন।
নাটকের পরিচালক অতন্দ্রিলা, মুখ্য চরিত্র শায়লা এবং হামিদ সাহেব।
বিয়ের সময়ে “নইলে আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা” এই বাক্যটি জাদুর মন্ত্রের মতো কাজ করে। বর কনে সুলভ থেকে দুর্লভ যেকোনো বস্তু পাওয়ার জন্যে এই বাক্যটি ব্যাবহার করে থাকে।
অতন্দ্রিলার নাটকে এ বাক্যটা প্রধান সংলাপ।
ভোর ৬ টা। বিয়ের বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শায়লা রান্নাঘরে, হামিদ সাহেব বাগানে।
অতন্দ্রিলা দুজনকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, “কি আশ্চর্য! রান্নাঘরে আমার হাজারটা কাজ, এখানে নিয়ে এলি কেন?”
হামিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “আমারও তো সেই একই কথা! কি ভেবেছিস কি হ্যাঁ? তোর কোনো কাজ নেই বলে অন্য কারোরই কোনো কাজ নেই?”
অতন্দ্রিলা বলল, “তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসবে প্লিজ!”
শায়লা বসলেন। তার থেকে একটু দূরে বসলেন হামিদ সাহেব।
হামিদ সাহেব বললেন, “বসলাম! এখন বল তোর জরুরি কথা!”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা মা দেখো, তোমাদের মধ্যে কি ঘটেছিল তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে আমার ধারনা তোমরা নিতান্তই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভিমান করে আছো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও আজ চলে যাচ্ছি। শহর থাকে হলে। তোমরা এখন কি নিয়ে বাঁচবে? একা একা বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে?
শায়লা বললেন, “কি বলতে চাচ্ছিস অত?”
“বলতে চাচ্ছি যে এখন তোমরা দুজনেই দুজনের বেঁচে থাকার সম্বল। তাই তোমরা সবকিছু ভুলে আবার এক হও, নইলে কিন্তু আমি বিয়ে করবো না।”
কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। তারা এক হলেও অতন্দ্রিলা বিয়ে করবে, এক না হলেও বিয়ে করবে। কিন্তু বাবা মাকে এক করতে কথাটা বলতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
শায়লা বুঝতে পারছেন না কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ, হাসা উচিৎ নাকি রাগ করা উচিৎ।
চোখে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বললেন, “সত্যিই করবিনা?”
“অবশ্যই করবোনা।”
শায়লা হামিদ সাহেবের দিকে তাকালেন। হামিদ সাহেব কাঁদছেন। তার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে খুশির অশ্রু।
শায়লা কন্নামাখা কণ্ঠে বললেন, “তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতই জেদী।”
“কিন্তু তুমি কি করবে আমাকে ক্ষমা?”
“করবো।”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিৎকার করে বলল, “আপা! আমরা আর ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নই!”
অতন্দ্রিলা হাসছে। দু গালে টোল পরেছে। হাসলে তার সৌন্দর্য কয়েক গুন বেড়ে যায়। কিন্তু খুব কম হাসে বলে এই সৌন্দর্য আড়ালে ঢাকা পরে যায়।
দুপুরের দিকে সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এল।
গম্ভীর গলায় বলল, “তার মানে এই কাজটা তুই আগেও করতে পারতিস?”
“কোন কাজটা?”
“এইযে বাবা মায়ের মিল করিয়ে দেওয়ার কাজটা!”
“হ্যাঁ পারতাম তো।”
“তাহলে করিসনি কেন? আজ করলি কেন?”
“কারন হলো আজ আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। আজকের পর বাবা মায়ের ঝগড়া আমাকে আর সহ্য করতে হবে না।”
“তোর ধারনা তারা এক হওয়ার পর আবার ঝগড়া করবে?”
“অবশ্যই করবে।”
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উৎসাহ নিয়ে বলল, “এই এখন তো আর তাহলে তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে না?”
“না।”
“তার মানে এখন আর এই ছেলেটাকে তোর বিয়েও করতে হবে না।”
“আপা বাজে কথা বোলো না তো। যাও নিজের কাজ করো!”
বিকেলের দিকে ঘটলো আরেক নাটক।
অতন্দ্রিলাকে সাজাতে এসেছেন পার্লার থেকে।
হঠাৎ ঘরের সমস্ত লাইট ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল!
শহর দৌড়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেইন সুইচ নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে ঠিক হবে না!”
হামিদ সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছেন। একটু পরে অন্ধকার হয়ে আসবে, বাড়িতে এক ফোঁটাও আলো না থাকলে বিয়েই বা হবে কি করে আর মেহমানরা খাবেই বা কি করে।
শায়লা অন্ধকার নামার আগে রান্না শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
অতন্দ্রিলা সাজগোজ বাদ দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি কি কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তিবর্গের সাহায্য পেতে পারি?”
অতন্দ্রিলার খালাতো বোন নীলা বলল, “কি বিষয়ে আপা?”
“বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হবে, আলো দিয়ে। ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করা হবে। কাজগুলো আমি একা করতে পারবোনা যে তা নয়, কিন্তু কাজগুলো একা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেউ আমাকে সাহায্য করবে?”
অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে পারে এমন সাতজন মানুষ পাওয়া গেল। শহর, সন্ধ্যা, নীলা, তিশান, টিকলি, হামিদ সাহেব এবং জরিনা।
প্রায় পাঁচ ছয়’শ মোমবাতি কিনে আনা হয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মোমবাতি জ্বালানো হচ্ছে। ডেকোরেটরের লোকজন ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করছেন।
ছাদটা সাজানো হয়েছে প্রদীপ দিয়ে। সাথে বেলি ফুল। বেলির ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে।
মেহমানরা হতভম্ব। কনে সাজগোজ বাদ দিয়ে সজ্জাছে ঘর! তাও আবার মোমবাতি দিয়ে।
আলোর সমস্যা মিটে গেলেই আরেক সমস্যা হাজির। সেটা হলো গরম। ব্যাটারি চালিত টেবিল ফ্যান দিয়ে আপাতত কাজ চালান হচ্ছে। কিন্তু ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে কি হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন হামিদ সাহেব।
যখনই ফ্যান চলতে দেখছেন তখনি বলছেন, “আহ্ ফ্যান চালাচ্ছো কেন? বরপক্ষ আসলে কি করবে? বিয়ে পড়ানোর সময় চার্জ ফুরিয়ে গেলে?”
তিন’শ মেহমান দাওয়াত করা হয়েছিল, কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি মানুষ চলে এসেছে। খাবার কম পরে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছেন যাতে প্রয়োজনে খাবার দিয়ে যায়।
বর এল সাতটার দিকে। এবার মেহেমানরা খাওয়া দাওয়া শুরু করতে পারবেন।
বরযাত্রী তো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে অবাক। তাদের ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বরকে দেখার জন্যে সকলের উৎসাহের সীমা নেই।
রোদের মনটা বিপর্যস্ত। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে। তবে তার মুখ দেখে ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে, সকলকে সালাম দিচ্ছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে।
কিছুক্ষণ পর বর কনে একসঙ্গে করা হলো।
অতন্দ্রিলাকে দেখাচ্ছে পুরনো দিনের কনেদের মত। যখন সাজ নয়, সৌন্দর্য ছিল কনেদের মুখ্য বিষয়।
রাত প্রায় একটা। বিয়ে বাড়ি এখন শান্ত। মেহেমানরা চলে গেছেন। অতন্দ্রিলা এখন যাবে রোদের বাড়িতে। শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বিয়ে বাড়ির প্রচলিত নাটক – বিদায়ের সময় মা মেয়ের জড়িয়ে ধরে কান্না। কিন্তু শায়লা কাঁদছেন না। আর অতন্দ্রিলার তো কাঁদার অভ্যেসই নেই!
(চলবে)
Nice Writting!
Thank you
Apu khub sundor hoise. next part koi .R Tomader golpo gula dekhe Ami akta golpo lekher try korechi ami akhon ata kivabe post korbo kindly inform korona please???