অতন্দ্রিলার_রোদ (পর্ব:৪ – আপত্তি নেই)

1
1715

#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ৪ – (আপত্তি নেই)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলা মানুষটাই নিখুঁত। তার দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দুটো নিখুঁত, লম্বা চুলগুলো নিখুঁত, হাসিটাও নিখুঁত। তবে অতন্দ্রিলা খুব একটা হাসে না আবার কাঁদেও না।
হামিদ সাহেব শেষ বার অতন্দ্রিলাকে কাঁদতে দেখেছিলেন যখন তার বয়স ১৩।
অতন্দ্রিলার কথা, “যুক্তিযুক্ত কারন ছাড়া কোনো মানুষের সামনে হাসি বা কান্নার মত শক্তিশালী অনুভূতি প্রকাশ করার কোনো অর্থ নেই।”

অতন্দ্রিলার হাতে গোণা দু একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের লেখা প্রতিবেদন বারবার পড়া।
আজ সকালে তার ভালোবাসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এবারের প্রতিবেদনটা তুমলামুলকভাবে গুছিয়েই লিখেছে অতন্দ্রিলা। প্রতিবেদনটা এমন –

ভালোবাসা কারে কয়?

অতন্দ্রিলা আশরাফ
৩ জুলাই, ২০২০ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ন

‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। নাটক-সিনেমা দেখতে বসলে অহরহ শব্দটা শুনতে পাই । ছোটবেলায় সমাজ বইতে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে সব মানুষ একই পরিবেশে বাস করে না। সকলেরই বসবাসের পরিবেশ ভিন্ন, তাই ভালোবাসার উপলক্ষটাও ভিন্ন।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মহামানবদের সকলে
একই পরিবেশে বসবাস করেননি। তাই ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের মতামতও ভিন্ন।
চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু উক্তি –
১। ডেভিড রস – “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
২। লা রচেফউকোল্ড – “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
৪। হুমায়ূন আহমেদ – “কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।”
৫। কীটস্ – “যে ভালোবাসা পেলো না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।”
৬। টেনিসন – “ভালবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।”
অনেক তো হলো বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উক্তি, চলুন জেনে আসা যাক ভালোবাসা নিয়ে সাধারন মানুষদের মতামত।
১। হামিদ চৌধুরী, রিটেয়ারপ্রাপ্ত উকিল।
বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, ১৯ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওনার মতে, “ভালোবাসার মত ন্যাকামি জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২। শায়লা হোসেন, পেশায় অধ্যাপক।
বয়স ৫২-৫৪, হামিদ চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।
তার মতে, “একটা মানুষকে যথাযথ সময় দিতে পারলেই তাকে ভালোবাসা উচিত। যে সময় দিতে পারে না, তার ভালোবাসা উচিত নয়।”
৩। রওশন আরা, হামিদ চৌধুরীর মাতা।
বয়স ৭৫। তিনি মনে করেন, “স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যাহা বিদ্যমান, তাহাই ভালোবাসা।”
৪। জরিনা, হামিদ চৌধুরীদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ২১। ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতামত কিছুটা এরকম – “এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”

ভ্রু সামান্য কুঁচকে বারবার প্রতিবেদনটি পরছে অতন্দ্রিলা, কিছুটা চিন্তিত সে। চিন্তার প্রধান কারন তার বাবা, মা এবং দাদীর মতামতগুলো আসল নয়। অতন্দ্রিলার বানিয়ে লেখা।
এই তিনজন মানুষকে ‘ভালোবাসা কি?’ – প্রশ্নটা করে মনের মতো কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অতন্দ্রিলা সেই বৃথা চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করেনি।

দরজায় টোকা পরলো।
অতন্দ্রিলা ভেতর থেকে বলল, “কে?”
“আফা আমি জরিনা!”
“ভেতরে এসো জরিনা।”
জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে ঢুকে বলল, “আফা ঘটনা তো একখান ঘইটা গেছে! শিগগির নিচে আসেন!”
“কি ঘটনা?”
“ওইযে ওইদিন আপনারে দেইখ্যা গেলো যারা! তারা মেলা জিনিস পাঠাইছে। বাসার ঘরে ভাইসা যাইতেসে জিনিসপত্রে!”
“মেলা জিনিস পাঠাবে কেন?”
“অতো কথা বলার টাইম নাই! আফনে নিচে আসেন।”

অতন্দ্রিলা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঠল। প্রতিবেদনটা আর কমপক্ষে দু থেকে তিনশ বার পড়ে উঠতে পারলে এই বিরক্তিটা কাজ করতো না।

জরিনার স্বভাবগত দোষ, সে যেকোনো বিষয়কেই বাড়িয়ে বলে।
কিন্তু আজ জরিনা সত্য কথাই বলেছে। বসার ঘর প্রায় ভেসেই যাচ্ছে উপহারে। ঝুড়ি ভর্তি শাক-সবজি, ফলমূল। মাটির হাঁড়িতে বিভিন্ন ধরনের মাছ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি নানা প্রকারের মসলা। আম, জলপাই ইত্যাদির আচার। সেগুলো অতি আগ্রহ নিয়ে ঘটাঘাটি করছেন হামিদ সাহেব।
অতন্দ্রিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“ফিরোজা আপা পাঠালো!”
“ফিরোজা আপাটা কে?”
“এরমধ্যে ভুলে গেলি? ওইযে সেদিন
তোকে দেখতে এলো, ছেলের মা!”
“ওহ আচ্ছা! তা এরমধ্যে আপা বাঁধিয়ে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ ফেলেছি। তোর কোনো সমস্যা আছে?”
“একদম না, আমার সমস্যা থাকতে যাবে কেন? আচ্ছা হঠাৎ তোমার ফিরোজা আপা এত কিছু পাঠালো কেন?”
“ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আগামী বুধবারই বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার খবর।”
“তুই বিয়েতে রাজি তো?”
“অবশ্যই রাজি বাবা।”
“আমি মুগ্ধ! আমি আনন্দিত!”
“বাবা আমার ধারনা, আমার রাজি হওয়াটা তোমার আনন্দের প্রধান কারন না। আনন্দের প্রধান কারন এতগুলো উপহার। তাইনা?”
“আমার আনন্দের কারন যাই হোক, তাতে তোর কি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিসব প্রতিবেদন লিখিস, সেগুলো লেখ গিয়ে যা!”
“অনেক ধন্যবাদ বাবা।”

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হামিদ সাহেব ব্যাংকে যান। সামনে মেয়ের বিয়ে। আর বিয়ের ওপর নামই যেন খরচ।
অতন্দ্রিলার জন্মের পর পরই তার বিয়ের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখে দেন তিনি। এত বছর ব্যাংকে থেকে থেকে সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

অতন্দ্রিলা প্রতিদিন দুপুরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে, গুনগুন করে গান গায়। এই সময়টায় কেউ তার আশেপাশে থাকলে নাকি খুব অসহ্য লাগে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
হঠাৎ জরিনা দৌড়ে ছাদে এলো।
“আফা!”
“জরিনা, তোমাকে না মানা করেছি আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় বিরক্ত করতে!”
“দুনিয়া উল্টায় যাইতেছে আর আফনে হাঁটতেছেন?”‌‌
“দুনিয়া উল্টানোর মত কি ঘটেছে?”
“খালাম্মা আসছে, সাথে বড় আফা! দুইজনেই খেইপ্পা আছে। আমারে বলে, যাও অতরে ডাইককা আনো। আমি বলছি, আফা ডিস্টাব করতে মানা করছে। আমারে ধমক দিয়া কয়, চাকরি বাঁচাইতে চাইলে অতরে ডাকো!”
“এত বেশি কথা বলো কেন জরিনা? বেশি কথা বললে তো তুমি বিপদে পরবে!”

অতন্দ্রিলা নিচে নেমে এলো। শায়লা ও তার বড় মেয়ে সন্ধ্যা দুজন বসার ঘরের দুই সোফায় বসে আছেন।
শায়লা প্রচন্ড রেগে আছেন। অতন্দ্রিলাকে দেখা মাত্র এমন একটা ভাব যেন এখনি তাকে আস্ত গিলে খাবেন।

অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কি ব্যাপার মা?”
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, “কি ব্যাপার মানে? তুই কি ভদ্রতা বলতে কিছুই শিখিসনি? এত দিন পর দেখা, না সালাম দিলি, না হাই হ্যালো বললি। সোজা, কি ব্যাপার!”
অতন্দ্রিলা বসতে বসতে বলল,“সালাম দিতাম যদি তুমি আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতে। কিন্তু তুমি তো আমার দূরসম্পর্কের মা, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছে। তোমাকে আবার সালাম দেওয়ার কি হলো?”
“জ্ঞান দিবি না। তোর এসব জ্ঞান আমার একদম অপছন্দের।
বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেলো, আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!”
“কি ঘটেছে?”
“তোকে নাকি গত সপ্তাহে দেখতে এসেছিলো? বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
এত বড় একটা কথা আমাদের না জানিয়ে কিভাবে পারলি তুই? আচ্ছা, তোর বাবা আর দাদি না হয় কোনো দিনও আমাদের বলবে না, কিন্তু তুই তো বলতে পারতিস? নাকি আমাদের জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিসনি? আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেছি তোর কাছে?”
সন্ধ্যা আহত গলায় বলল, “পরই তো ভাবে মা। মনে নেই, ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো আর আমাদের জানিয়েছিল এক মাস পর। আজকে যদি জরিনা ওর বিয়ের কথাটা না বলতো, তাহলে তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জানতে পারতাম না।”
অতন্দ্রিলা বলল, “আপা দুটো ঘটনা পুরোপুরি ভিন্ন। এইচএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়েছিল তখন দাদি ভীষন অসুস্থ, হসপিটালে ছিলো। ওই অবস্থায় আমি নিজের রেজাল্টে নিজেই খুশি হতে পারিনি। একমাস পর যখন দাদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন, তখন আমি খুশি হয়েছি। এবং খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের টেলিফোন করে জানিয়েছি।
আর এই ব্যাপারটা কেন এখনো জানাইনি তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে পারি।”
শায়লা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন, “দে, দে তোর গঠনমূলক ব্যাখ্যা!”
“গত বৃস্পতিবার রাতে বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন, কাল বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।
বিনা নোটিশে দেখতে আসার কথা শুনে আমিও খানিকটা ধাক্কা খাই। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। এক বেলার মধ্যে তোমাদের খবর দেওয়াটাও বোকামি হতো।
তারা দেখে যাওয়ার পরও আমি তোমাদের কিছু বলিনি তার কারণ হলো তখনো বিয়ে হবে কি হবে না সেই ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু আজ সকালেই সে অনিশ্চয়তা দূর হয়। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এক সমুদ্র উপহার পাঠান এবং বলেন আগামী বুধবার বিয়ে ফাইনাল করতে আসবে। আমি আজ বিকেলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে এই খবরটা নিয়ে যেতাম।”

শায়লাকে দেখে এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
তিনি একটা মৃদু্ হাসি নিয়ে বললেন, “তুই তাহলে রাজি এই বিয়েতে।”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারন যেহেতু নেই, সেহেতু আমি রাজি।”
“ছেলের নাম কি?”
“রোদ। রোদ আহসান।”
“দেখতে কেমন?”
“রাজপুত্রের মতো।”
“পড়াশুনা?”
“গণিতে এম এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“করে কি?”
“বাবার বিজনেস দেখাশুনা করে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে নেই, তাই বলা যায় নিজের বিজনেস দেখাশুনা করে।”
“গণিতে পড়াশুনা করে আবার বিজনেস সামলায় কিভাবে?”
“সেটা আমি কিভাবে বলতে পারি? তোমার সঙ্গে যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর বাবা ঠিকই বলে, তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ! আচ্ছা, এখন বল ছেলের কোনো খুঁত আছে?”
“অবশ্যই আছে। খুঁত ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি?”
“কি খুঁত? একটু ঝেরে কাঁশ তো!”
অতন্দ্রিলা কাঁশল।
“কি ব্যাপার কাঁশছিস কেন?”
“তুমিই তো বললে কাঁশতে!”
“ফাজলামো করবি না! ফাজলামো জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না। সত্যি করে বল ছেলের খুঁতটা কি?”
“তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমার চোখে ব্যাপারটা খুঁত না হলেও সমাজের চোখে খুঁত।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে বললেন, “একবার বিয়ে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ মা। আমি তো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সমাজের চোখে নিখুঁত কোনো ছেলের পরিবার আমাকে পছন্দ করবে না। তারা ভাববে আমিও হয়তো আমার বাবা-মায়ের ঝগড়া করার গুন পেয়েছি, বিয়ের পর তাদের ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করবো। এজন্য বাবা একটা খুঁতসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“কেন আমার মেয়ে কি ভেসে এসেছে নাকি যে ওকে এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? তোর বাবা কি ভেবেছে? তোর বাবা আসুক আজকে, তার সঙ্গে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”
“আহ্ মা, এভাবে বলছো কেন? তুমি নিজেও তো একজন ডিভোর্সি। তাছাড়া ছেলেটা ডিভোর্সি…”
অতন্দ্রিলাকে থামিয়ে দিয়ে শায়লা বললেন, “তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। থাম তুই!”
“ঠিক আছে থামলাম। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থাকো, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। আমার কিছু কাজ আছে।”

অতন্দ্রিলা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

সন্ধ্যাতারা, অতন্দ্রিলার বড় বোন। অতন্দ্রিলার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বছর। তাই বোধহয় দুজনের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুরই মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষগুলোর একজন হলো সন্ধ্যা। যেকোনো বিষয়েই সে মানুষকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে, এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীর সবকিছু তার জানা। কিন্তু এটা বিরক্ত করার মত কোনো বিষয় নয়। বিরক্তিকর বিষয়টা হলো সন্ধ্যার দেওয়ার জ্ঞানের কোনোই যুক্তি নেই।

অতন্দ্রিলা ঘরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ঝড়ের গতিতে সন্ধ্যা তার ঘরে ঢুকে।
“কি ব্যাপার আপা দৌড়াচ্ছো কেন?”
সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমার কথা বাদ দে। আগে বল তো, কয় বছর আগে ছেলেটার ডিভোর্স হয়েছে?”
“ডিভোর্স? না, না আপা। তার ডিভোর্স হয়নি তো!”
“ডিভোর্স হয়নি? হায় আল্লাহ! তার মানে তুই এ যুগে সতীনের সংসার করবি?”
“আপা কি যাতা বলছো বলতো? সতীনের সংসার আবার কি? উনার আগের স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছেন।”
সন্ধ্যা হতভম্ব গলায় বলল,“মারা গেছে? সর্বনাশ! তাহলে তো তুই শেষ!”
“শেষ মানে?”
“শেষ মানে ফিনিসড!”
“আহ্ আপা! তোমার কাছে বঙ্গানুবাদ চাইনি। পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাচ্ছ!”
“দেখ ডিভোর্সি হলেও একটা কথা ছিল। আগের স্ত্রীর উপর ছেলেটার ঘৃণা থাকতো আর তাকে ভুলে তোর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যেহেতু আগের স্ত্রী মারা গেছে, তার মানে ছেলেটা তাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই তোর সাথে সুখে সংসারও করতে পারবে না। বারবার আগের স্ত্রীর সাথে তোর তুলনা করবে, তোকে ভালোবাসবে না। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর?”
“আর আপা তুমি কি বুঝতে পারছো যে তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই?”

সন্ধ্যা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি নিচ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ শুনে থেমে গেল।

বসার ঘরে চলছে শায়লা এবং হামিদ সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া।
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে ভেবেছোটা কি হ্যাঁ? আমার মেয়ে জলে ভেসে এসেছে? ওর কি একটা হাত বা পা নেই? নাকি ও চোখে দেখতে পারে না? আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েটার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ের দেবার কথা ভাবলে কিভাবে?”
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে করছো কেন? উনিশ বছর আগে যখন জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই মাতৃত্ব?”
“বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না!”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে নিচে এসে বলল, “আহ্ মা,বাবা! কি শুরু করলে তোমরা?”
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “অত তুই চল তো! আজকেই আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো! ওই ডিভোর্সি ছেলেটাকে তোর বিয়ে করতে হবে না। আমি অনেক ভালো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব!”
“মা তুমি শান্ত হয়। প্রথমত, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও অনেক ভালো একটা ছেলে। আর ছেলেটা ডিভোর্সি না, তার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বিপত্নীক হওয়ার পিছনে তার কোনো দোষ নেই।”
“সে রসগোল্লা পন্তুয়া যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব না!”
“এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? বিয়েটা তো আমি করবো নাকি? আমারই যখন কোনো আপত্তি নেই তখন তুমি এত রাগ করছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো গলায় বললেন,“তোর কোনো আপত্তি নেই?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,“না নেই মা।”

শায়লা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

(চলবে)#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ৪ – (আপত্তি নেই)

লেখা : শঙ্খিনী

অতন্দ্রিলা মানুষটাই নিখুঁত। তার দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দুটো নিখুঁত, লম্বা চুলগুলো নিখুঁত, হাসিটাও নিখুঁত। তবে অতন্দ্রিলা খুব একটা হাসে না আবার কাঁদেও না।
হামিদ সাহেব শেষ বার অতন্দ্রিলাকে কাঁদতে দেখেছিলেন যখন তার বয়স ১৩।
অতন্দ্রিলার কথা, “যুক্তিযুক্ত কারন ছাড়া কোনো মানুষের সামনে হাসি বা কান্নার মত শক্তিশালী অনুভূতি প্রকাশ করার কোনো অর্থ নেই।”

অতন্দ্রিলার হাতে গোণা দু একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের লেখা প্রতিবেদন বারবার পড়া।
আজ সকালে তার ভালোবাসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এবারের প্রতিবেদনটা তুমলামুলকভাবে গুছিয়েই লিখেছে অতন্দ্রিলা। প্রতিবেদনটা এমন –

ভালোবাসা কারে কয়?

অতন্দ্রিলা আশরাফ
৩ জুলাই, ২০২০ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ন

‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। নাটক-সিনেমা দেখতে বসলে অহরহ শব্দটা শুনতে পাই । ছোটবেলায় সমাজ বইতে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে সব মানুষ একই পরিবেশে বাস করে না। সকলেরই বসবাসের পরিবেশ ভিন্ন, তাই ভালোবাসার উপলক্ষটাও ভিন্ন।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মহামানবদের সকলে
একই পরিবেশে বসবাস করেননি। তাই ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের মতামতও ভিন্ন।
চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু উক্তি –
১। ডেভিড রস – “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
২। লা রচেফউকোল্ড – “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
৪। হুমায়ূন আহমেদ – “কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।”
৫। কীটস্ – “যে ভালোবাসা পেলো না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।”
৬। টেনিসন – “ভালবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।”
অনেক তো হলো বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উক্তি, চলুন জেনে আসা যাক ভালোবাসা নিয়ে সাধারন মানুষদের মতামত।
১। হামিদ চৌধুরী, রিটেয়ারপ্রাপ্ত উকিল।
বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, ১৯ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওনার মতে, “ভালোবাসার মত ন্যাকামি জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২। শায়লা হোসেন, পেশায় অধ্যাপক।
বয়স ৫২-৫৪, হামিদ চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।
তার মতে, “একটা মানুষকে যথাযথ সময় দিতে পারলেই তাকে ভালোবাসা উচিত। যে সময় দিতে পারে না, তার ভালোবাসা উচিত নয়।”
৩। রওশন আরা, হামিদ চৌধুরীর মাতা।
বয়স ৭৫। তিনি মনে করেন, “স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যাহা বিদ্যমান, তাহাই ভালোবাসা।”
৪। জরিনা, হামিদ চৌধুরীদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ২১। ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতামত কিছুটা এরকম – “এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”

ভ্রু সামান্য কুঁচকে বারবার প্রতিবেদনটি পরছে অতন্দ্রিলা, কিছুটা চিন্তিত সে। চিন্তার প্রধান কারন তার বাবা, মা এবং দাদীর মতামতগুলো আসল নয়। অতন্দ্রিলার বানিয়ে লেখা।
এই তিনজন মানুষকে ‘ভালোবাসা কি?’ – প্রশ্নটা করে মনের মতো কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অতন্দ্রিলা সেই বৃথা চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করেনি।

দরজায় টোকা পরলো।
অতন্দ্রিলা ভেতর থেকে বলল, “কে?”
“আফা আমি জরিনা!”
“ভেতরে এসো জরিনা।”
জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে ঢুকে বলল, “আফা ঘটনা তো একখান ঘইটা গেছে! শিগগির নিচে আসেন!”
“কি ঘটনা?”
“ওইযে ওইদিন আপনারে দেইখ্যা গেলো যারা! তারা মেলা জিনিস পাঠাইছে। বাসার ঘরে ভাইসা যাইতেসে জিনিসপত্রে!”
“মেলা জিনিস পাঠাবে কেন?”
“অতো কথা বলার টাইম নাই! আফনে নিচে আসেন।”

অতন্দ্রিলা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঠল। প্রতিবেদনটা আর কমপক্ষে দু থেকে তিনশ বার পড়ে উঠতে পারলে এই বিরক্তিটা কাজ করতো না।

জরিনার স্বভাবগত দোষ, সে যেকোনো বিষয়কেই বাড়িয়ে বলে।
কিন্তু আজ জরিনা সত্য কথাই বলেছে। বসার ঘর প্রায় ভেসেই যাচ্ছে উপহারে। ঝুড়ি ভর্তি শাক-সবজি, ফলমূল। মাটির হাঁড়িতে বিভিন্ন ধরনের মাছ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি নানা প্রকারের মসলা। আম, জলপাই ইত্যাদির আচার। সেগুলো অতি আগ্রহ নিয়ে ঘটাঘাটি করছেন হামিদ সাহেব।
অতন্দ্রিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“ফিরোজা আপা পাঠালো!”
“ফিরোজা আপাটা কে?”
“এরমধ্যে ভুলে গেলি? ওইযে সেদিন
তোকে দেখতে এলো, ছেলের মা!”
“ওহ আচ্ছা! তা এরমধ্যে আপা বাঁধিয়ে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ ফেলেছি। তোর কোনো সমস্যা আছে?”
“একদম না, আমার সমস্যা থাকতে যাবে কেন? আচ্ছা হঠাৎ তোমার ফিরোজা আপা এত কিছু পাঠালো কেন?”
“ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আগামী বুধবারই বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার খবর।”
“তুই বিয়েতে রাজি তো?”
“অবশ্যই রাজি বাবা।”
“আমি মুগ্ধ! আমি আনন্দিত!”
“বাবা আমার ধারনা, আমার রাজি হওয়াটা তোমার আনন্দের প্রধান কারন না। আনন্দের প্রধান কারন এতগুলো উপহার। তাইনা?”
“আমার আনন্দের কারন যাই হোক, তাতে তোর কি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিসব প্রতিবেদন লিখিস, সেগুলো লেখ গিয়ে যা!”
“অনেক ধন্যবাদ বাবা।”

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হামিদ সাহেব ব্যাংকে যান। সামনে মেয়ের বিয়ে। আর বিয়ের ওপর নামই যেন খরচ।
অতন্দ্রিলার জন্মের পর পরই তার বিয়ের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখে দেন তিনি। এত বছর ব্যাংকে থেকে থেকে সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

অতন্দ্রিলা প্রতিদিন দুপুরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে, গুনগুন করে গান গায়। এই সময়টায় কেউ তার আশেপাশে থাকলে নাকি খুব অসহ্য লাগে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
হঠাৎ জরিনা দৌড়ে ছাদে এলো।
“আফা!”
“জরিনা, তোমাকে না মানা করেছি আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় বিরক্ত করতে!”
“দুনিয়া উল্টায় যাইতেছে আর আফনে হাঁটতেছেন?”‌‌
“দুনিয়া উল্টানোর মত কি ঘটেছে?”
“খালাম্মা আসছে, সাথে বড় আফা! দুইজনেই খেইপ্পা আছে। আমারে বলে, যাও অতরে ডাইককা আনো। আমি বলছি, আফা ডিস্টাব করতে মানা করছে। আমারে ধমক দিয়া কয়, চাকরি বাঁচাইতে চাইলে অতরে ডাকো!”
“এত বেশি কথা বলো কেন জরিনা? বেশি কথা বললে তো তুমি বিপদে পরবে!”

অতন্দ্রিলা নিচে নেমে এলো। শায়লা ও তার বড় মেয়ে সন্ধ্যা দুজন বসার ঘরের দুই সোফায় বসে আছেন।
শায়লা প্রচন্ড রেগে আছেন। অতন্দ্রিলাকে দেখা মাত্র এমন একটা ভাব যেন এখনি তাকে আস্ত গিলে খাবেন।

অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কি ব্যাপার মা?”
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, “কি ব্যাপার মানে? তুই কি ভদ্রতা বলতে কিছুই শিখিসনি? এত দিন পর দেখা, না সালাম দিলি, না হাই হ্যালো বললি। সোজা, কি ব্যাপার!”
অতন্দ্রিলা বসতে বসতে বলল,“সালাম দিতাম যদি তুমি আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতে। কিন্তু তুমি তো আমার দূরসম্পর্কের মা, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছে। তোমাকে আবার সালাম দেওয়ার কি হলো?”
“জ্ঞান দিবি না। তোর এসব জ্ঞান আমার একদম অপছন্দের।
বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেলো, আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!”
“কি ঘটেছে?”
“তোকে নাকি গত সপ্তাহে দেখতে এসেছিলো? বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
এত বড় একটা কথা আমাদের না জানিয়ে কিভাবে পারলি তুই? আচ্ছা, তোর বাবা আর দাদি না হয় কোনো দিনও আমাদের বলবে না, কিন্তু তুই তো বলতে পারতিস? নাকি আমাদের জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিসনি? আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেছি তোর কাছে?”
সন্ধ্যা আহত গলায় বলল, “পরই তো ভাবে মা। মনে নেই, ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো আর আমাদের জানিয়েছিল এক মাস পর। আজকে যদি জরিনা ওর বিয়ের কথাটা না বলতো, তাহলে তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জানতে পারতাম না।”
অতন্দ্রিলা বলল, “আপা দুটো ঘটনা পুরোপুরি ভিন্ন। এইচএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়েছিল তখন দাদি ভীষন অসুস্থ, হসপিটালে ছিলো। ওই অবস্থায় আমি নিজের রেজাল্টে নিজেই খুশি হতে পারিনি। একমাস পর যখন দাদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন, তখন আমি খুশি হয়েছি। এবং খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের টেলিফোন করে জানিয়েছি।
আর এই ব্যাপারটা কেন এখনো জানাইনি তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে পারি।”
শায়লা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন, “দে, দে তোর গঠনমূলক ব্যাখ্যা!”
“গত বৃস্পতিবার রাতে বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন, কাল বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।
বিনা নোটিশে দেখতে আসার কথা শুনে আমিও খানিকটা ধাক্কা খাই। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। এক বেলার মধ্যে তোমাদের খবর দেওয়াটাও বোকামি হতো।
তারা দেখে যাওয়ার পরও আমি তোমাদের কিছু বলিনি তার কারণ হলো তখনো বিয়ে হবে কি হবে না সেই ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু আজ সকালেই সে অনিশ্চয়তা দূর হয়। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এক সমুদ্র উপহার পাঠান এবং বলেন আগামী বুধবার বিয়ে ফাইনাল করতে আসবে। আমি আজ বিকেলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে এই খবরটা নিয়ে যেতাম।”

শায়লাকে দেখে এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
তিনি একটা মৃদু্ হাসি নিয়ে বললেন, “তুই তাহলে রাজি এই বিয়েতে।”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারন যেহেতু নেই, সেহেতু আমি রাজি।”
“ছেলের নাম কি?”
“রোদ। রোদ আহসান।”
“দেখতে কেমন?”
“রাজপুত্রের মতো।”
“পড়াশুনা?”
“গণিতে এম এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“করে কি?”
“বাবার বিজনেস দেখাশুনা করে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে নেই, তাই বলা যায় নিজের বিজনেস দেখাশুনা করে।”
“গণিতে পড়াশুনা করে আবার বিজনেস সামলায় কিভাবে?”
“সেটা আমি কিভাবে বলতে পারি? তোমার সঙ্গে যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর বাবা ঠিকই বলে, তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ! আচ্ছা, এখন বল ছেলের কোনো খুঁত আছে?”
“অবশ্যই আছে। খুঁত ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি?”
“কি খুঁত? একটু ঝেরে কাঁশ তো!”
অতন্দ্রিলা কাঁশল।
“কি ব্যাপার কাঁশছিস কেন?”
“তুমিই তো বললে কাঁশতে!”
“ফাজলামো করবি না! ফাজলামো জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না। সত্যি করে বল ছেলের খুঁতটা কি?”
“তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমার চোখে ব্যাপারটা খুঁত না হলেও সমাজের চোখে খুঁত।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে বললেন, “একবার বিয়ে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ মা। আমি তো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সমাজের চোখে নিখুঁত কোনো ছেলের পরিবার আমাকে পছন্দ করবে না। তারা ভাববে আমিও হয়তো আমার বাবা-মায়ের ঝগড়া করার গুন পেয়েছি, বিয়ের পর তাদের ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করবো। এজন্য বাবা একটা খুঁতসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“কেন আমার মেয়ে কি ভেসে এসেছে নাকি যে ওকে এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? তোর বাবা কি ভেবেছে? তোর বাবা আসুক আজকে, তার সঙ্গে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”
“আহ্ মা, এভাবে বলছো কেন? তুমি নিজেও তো একজন ডিভোর্সি। তাছাড়া ছেলেটা ডিভোর্সি…”
অতন্দ্রিলাকে থামিয়ে দিয়ে শায়লা বললেন, “তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। থাম তুই!”
“ঠিক আছে থামলাম। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থাকো, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। আমার কিছু কাজ আছে।”

অতন্দ্রিলা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

সন্ধ্যাতারা, অতন্দ্রিলার বড় বোন। অতন্দ্রিলার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বছর। তাই বোধহয় দুজনের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুরই মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষগুলোর একজন হলো সন্ধ্যা। যেকোনো বিষয়েই সে মানুষকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে, এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীর সবকিছু তার জানা। কিন্তু এটা বিরক্ত করার মত কোনো বিষয় নয়। বিরক্তিকর বিষয়টা হলো সন্ধ্যার দেওয়ার জ্ঞানের কোনোই যুক্তি নেই।

অতন্দ্রিলা ঘরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ঝড়ের গতিতে সন্ধ্যা তার ঘরে ঢুকে।
“কি ব্যাপার আপা দৌড়াচ্ছো কেন?”
সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমার কথা বাদ দে। আগে বল তো, কয় বছর আগে ছেলেটার ডিভোর্স হয়েছে?”
“ডিভোর্স? না, না আপা। তার ডিভোর্স হয়নি তো!”
“ডিভোর্স হয়নি? হায় আল্লাহ! তার মানে তুই এ যুগে সতীনের সংসার করবি?”
“আপা কি যাতা বলছো বলতো? সতীনের সংসার আবার কি? উনার আগের স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছেন।”
সন্ধ্যা হতভম্ব গলায় বলল,“মারা গেছে? সর্বনাশ! তাহলে তো তুই শেষ!”
“শেষ মানে?”
“শেষ মানে ফিনিসড!”
“আহ্ আপা! তোমার কাছে বঙ্গানুবাদ চাইনি। পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাচ্ছ!”
“দেখ ডিভোর্সি হলেও একটা কথা ছিল। আগের স্ত্রীর উপর ছেলেটার ঘৃণা থাকতো আর তাকে ভুলে তোর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যেহেতু আগের স্ত্রী মারা গেছে, তার মানে ছেলেটা তাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই তোর সাথে সুখে সংসারও করতে পারবে না। বারবার আগের স্ত্রীর সাথে তোর তুলনা করবে, তোকে ভালোবাসবে না। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর?”
“আর আপা তুমি কি বুঝতে পারছো যে তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই?”

সন্ধ্যা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি নিচ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ শুনে থেমে গেল।

বসার ঘরে চলছে শায়লা এবং হামিদ সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া।
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে ভেবেছোটা কি হ্যাঁ? আমার মেয়ে জলে ভেসে এসেছে? ওর কি একটা হাত বা পা নেই? নাকি ও চোখে দেখতে পারে না? আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েটার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ের দেবার কথা ভাবলে কিভাবে?”
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে করছো কেন? উনিশ বছর আগে যখন জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই মাতৃত্ব?”
“বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না!”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে নিচে এসে বলল, “আহ্ মা,বাবা! কি শুরু করলে তোমরা?”
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “অত তুই চল তো! আজকেই আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো! ওই ডিভোর্সি ছেলেটাকে তোর বিয়ে করতে হবে না। আমি অনেক ভালো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব!”
“মা তুমি শান্ত হয়। প্রথমত, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও অনেক ভালো একটা ছেলে। আর ছেলেটা ডিভোর্সি না, তার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বিপত্নীক হওয়ার পিছনে তার কোনো দোষ নেই।”
“সে রসগোল্লা পন্তুয়া যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব না!”
“এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? বিয়েটা তো আমি করবো নাকি? আমারই যখন কোনো আপত্তি নেই তখন তুমি এত রাগ করছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো গলায় বললেন,“তোর কোনো আপত্তি নেই?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,“না নেই মা।”

শায়লা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

(চলবে)

1 মন্তব্য

  1. API really love this story But I think you are really hummain Ahmed’s big fan bcoz jai story tumi likhecho ta hummain Ahmed er RUPA boier Copy but I like it keep it up waiting for next part?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে