পর্ব ১৪ (রাত্রির জন্ম)
শারীরিক অবস্থার অবনতির থেকে মানসিক অবস্থা অবনতির ভয়াবহতা বেশি। আর এই দুই অবস্থার অবনতি যদি একসঙ্গে ঘটে তাহলে একটা মানুষ যে কতটা বিপর্যস্ত হয়ে যায়, তা অতন্দ্রিলা জানে।
রোদ যেদিন উৎফুল্ল গলায় তাকে বলল, “আমি লন্ডনের এক ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করছি” – সেদিন সকালেই অতন্দ্রিলা জানতে পারে সে কনসিভ করেছে।
ব্যাপারটা আনন্দের, যথেষ্ট আনন্দের। কিন্তু রোদের ওই কথা শোনার পর আনন্দটা তার সঙ্গে ভাগাভাগির করার ইচ্ছে হয়নি।
গণিত বরাবরই রোদের অতি আগ্রহের বিষয়। কিন্তু মায়ের কথা রাখতে অনেকগুলো বছর সে গণিতকে ঘিরে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ পায়নি, এবার পেয়েছে।
এত বড় সুযোগ রোদের হাতছাড়া হয়ে যাক, এমনটা কখনোই চায়নি অতন্দ্রিলা।
তাই নিজের প্রেগন্যান্সির খবরটা গোপন রাখে সে।
রোদ যেদিন চলে যাচ্ছিল, সেদিন অতন্দ্রিলার খুব ইচ্ছে করছিল তাকে ডেকে কথাটা বলতে। কিন্তু বলতে পারেনি।
রোদ চলে যাওয়ার পরও টেলিফোনে অনেকবার কথাটা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সাহস করে ওঠেনি।
অতন্দ্রিলা তার প্রেগন্যান্সির কথা সর্বপ্রথম জানায় শায়লাকে।
শায়লা শুনে হতভম্ব গলায় বলেন, “এই তুই কি পাগল? এত খুশির একটা খবর তুই রোদকে জানলি না?”
অতন্দ্রিলা অসহায় গলায় বলে, “মা তুমি তো বুঝতেই পারছো কেন বলিনি। ওনাকে কোনোভাবে আটকে রাখতে চাইনি।”
“বলা মানেই কি আটকে রাখা? তুই আজই ওকে ফোন করে বলবি! এক্ষনি বলবি!”
“আমি পারবো না মা।”
“ঠিক আছে, তুই না জানালে আমরা জানাবো।”
“মা প্লিজ। তোমরা তাকে কিচ্ছু বলবে না। তার স্বপ্ন তাকে পূরণ করতে দাও।”
“আর তোর স্বপ্ন? তোর স্বপ্নের কী হবে?”
“উনার স্বপ্নগুলোর মধ্যেই আমার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে মা।”
“তোর যা ইচ্ছা, তাই কর!”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রোদকে প্রেগন্যান্সির খবরটা জানানোর জন্যে অতন্দ্রিলাকে বহুভাবে জোরাজুরি করা হয়। কিন্তু সে কিছুতেই জানাবে না।
ফিরোজা বেশ কয়েকবার গোপনে রোদকে টেলিফোন করে বিষয়টা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই অতন্দ্রিলার কাছে ধরা পরেন।
একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই এক ধরনের অস্বস্তি হতে লাগল অতন্দ্রিলার।
সমস্ত শরীরে ঝিম ধরে আছে, চোখ কটকট করছে।
অতন্দ্রিলা ঘুম থেকে উঠে বিছানাতেই শুয়ে আছে।
ফিরোজা তার ঘরে এসে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলেন, “নাস্তা করতে আসলে না মা?”
অতন্দ্রিলা ক্লান্ত গলায় বলে, “আমি উঠেতে পারবো না। আপনি আমাকে খাইয়ে দিন।”
ফিরোজা অতন্দ্রিলার কপালে হাত রেখে বলেন, “কেন মা? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
“বুঝতে পারছি না।”
ফিরোজা লক্ষ করলেন অতন্দ্রিলা ঘামছে।
তিনি ভয়ে ভয়ে বলেন, “অত?”
“হুঁ?”
“রোদকে একটা ফোন দেই?”
“না।”
“ঠিকাছে। তুমি শুয়ে থাকো আমি নাস্তা আনছি।”
নাস্তা করার পর কিছুটা ভালো লাগে অতন্দ্রিলার।
বিকেলের দিকে ফিরোজা যান তার ভাইয়ের বাড়িতে। বাড়িতে আছে রোবটের সমতুল্য বেশ কয়েকজন কাজের লোক। কিন্তু তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না। অতন্দ্রিলার এখন দরকার মানসিক সান্ত্বনা।
অস্থিরতা ক্রমেই বাড়তে শুরু করলো। অতন্দ্রিলা চুপ করে শুয়ে আছে।
তখনি জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তার ঘরে ঢুকে বলে, “আফা! ঝড় আসতেছে তো। বৃষ্টি দেখবেন না?”
“না জরিনা, আমার কেমন জানি খারাপ লাগছে। একটু আমার কাছে এসে বসো তো।”
জরিনা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলে, “আফা, আফনের চুল টাইনা দেই?”
“দাও।”
বাইরে তুমুল ঝড় হচ্ছে। জানলার কাঁচ ভেঙে পরছে।
জরিনা আতঙ্কিত গলায় বলে, “আফা, জানলার কাঁচ ভাঙতেছে মনে হয়!”
অতন্দ্রিলা উঠে বসল। তলপেটে একটা তীব্র এবং তীক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করল। এই যন্ত্রণা তো আগে কোনদিনও অনুভূত হয়নি!
ব্যাথার ধাক্কা সামলাতে বিছানা আকরে ধরে বসল সে।
জরিনা বলে, “কি হইছে আফা?”
“মরে যাচ্ছি জরিনা!”
জরিনা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। দ্রুত গিয়ে টেলিফোন করলো ফিরোজকে।
অতন্দ্রিলা জ্ঞান হারাচ্ছে। তবু চিন্তা করছে এই মুহূর্তে কি করা যায়। রোদকে টেলিফোন করতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু রোদকে টেলিফোন করে কি হবে? রোদ তো আর আসতে পারবে না! কিংবা হয়তো চলেও আসবে।
অতন্দ্রিলাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো রাত নয়টায়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থরথর করে কাঁপছেন ফিরোজা। এই অনুভূতিটা তার খুবই চেনা। জীবনে আরও একবার অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাড়িয়ে এভাবে কেপেছিলেন তিনি, ইরার অপারেশনের সময়ে। ফিরোজা বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়লেন।
নয়টা একত্রিশ মিনিটে একজন ডক্টর বাইরে এসে বললেন, “কংগ্রাচুলেশনস! আপনার নাতনি হয়েছে।”
ফিরোজা চোখভর্তি জল নিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ! বৌমা? বৌমা কেমন আছে?”
“মা-মেয়ে দুজনেরই সুস্থ আছে।”
পরেরদিন সকালে অতন্দ্রিলার ঘুম ভাঙলো। তার কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা নাকি তার! অতন্দ্রিলা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
অতন্দ্রিলার সামনে বসা তার পরিবারের লোকজন। তারা কি কি যেন বলাবলি করছে। সেসব কিছুই অতন্দ্রিলার কানে আসছে না।
অতন্দ্রিলার ভাবতেই অবাক লাগছে, সে নাকি এখন একজন মা!
ইশ! রোদকে যদি তার মেয়েটার কথা বলতে পারতো! রোদ নিঃসন্দেহে বোকাদের মতো কেঁদে ফেলতো।
ফুটফুটে বাচ্চাটা তার মুঠোয় অতন্দ্রিলার হাতের একটা আঙ্গুল চেপে রেখেছে।
শায়লা আনন্দিত গলায় বলেন, “কী নাম রাখবি, কিছু ঠিক করেছিস?”
অতন্দ্রিলা পরিষ্কার গলায় বলে, “রাত্রি।”
“বাহ্! চমৎকার! আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলি দেখছি।”
“আমি ঠিক করিনি মা। একজন ওর নাম রেখেছে।”
“কে সে?”
“আমার অনেক কাছের এক বন্ধু, তুমি তাকে চিনবে না। মা একটা কথা বলি?”
“বল!”
“থ্যাংক ইউ।”
“থ্যাংক ইউ কেন?”
“তুমি যে আমাকে পৃথিবীতে এনার জন্যে কতটা কষ্ট করেছ, সেটা আজ বুঝলাম।”
“মাকে থ্যাংক ইউ বললে যে তার কতটা রাগ হয় এটাও তুই একদিন বুঝবি!”
অতন্দ্রিলা ফিক করে হেসে দিল।
বাড়িতে ফিরেই রাত্রিকে নিয়ে ইরার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে
অতন্দ্রিলা বলে, “বুবু দেখো! তোমার রাত্রি। বিশ্বাস হয়? আমার তো হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। জানো, আমি না মাঝে মাঝে তোমাকে স্বপ্নে দেখি। দেখি তুমি হাসছো, আমার সঙ্গে গল্প করছো, আমার চুলে বেণী করে দিচ্ছ। এটাও কি স্বপ্ন বুবু? আমার না খুব আনন্দ হচ্ছে। এত আনন্দ, এত সুখ আমি সহ্য করতে পারছি না।”
রাত্রির জন্মের পর শুরু হলো নতুন সমস্যা। ফিরোজা সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে বিনয়ী গলায় শুধু একটাই কথা বলে অতন্দ্রিলাকে। সেটা হলো, “মা এবার রোদকে দিদিভাইয়ের কথাটা বলো।”
প্রতিবারই অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় জবাব দিয়ে বলে, “না।”
রাত্রির জন্মের পর রোদ অতন্দ্রিলাকে টেলিফোন করেছে ততবারই তার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছা করেছে, “তোমার জন্যে এক টুকরো ভালোবাসা যত্ন করে রেখেছি। প্লিজ এসে গ্রহন করো!”
কিন্তু বলতে পারেনি।
অতন্দ্রিলা তার মেয়েকে যতই দেখে ততই মায়ার জালে আটকা পরে যায়। এই জাল থেকে কোনো দিনও বের পারবে না সে, অবশ্য অতন্দ্রিলা বের হতেও চায় না।
গরম পানির সঙ্গে ঠান্ডা পানি মেশানো যে পৃথিবীর জটিলতম কাজগুলোর মধ্যে একটা, এটা অতন্দ্রিলার আগে জানা ছিল না। রাত্রিকে গোসল করানো হয় ঠিক বেলা দশটায়। গোসলের পরপরই ফিরোজা নাতনি কোলে নিয়ে বাগানে বসে থাকেন। দৃশ্যটা দেখার মতো। ইশ! রোদ যদি দৃশ্যটা দেখতে পেতো, তাহলে নিশ্চয়ই ছবি এঁকে রাখতো।
টুকটুক করে বড় হচ্ছে রাত্রি। ফিরোজা অনেক কষ্ট বসতে শিখেছেন তাকে। অতন্দ্রিলা ঘোষনা দিয়েছে, “রাত্রিকে হাঁটতে শেখাবো আমি!”
প্রতিদিন সকালে রাত্রির দু হাত ধরে বাগানে হাঁটতে নিয়ে যায় অতন্দ্রিলা। রাত্রি মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটে। কিন্তু অতন্দ্রিলা হাত ছেড়ে দিলেই সে পরে যায়।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করে, জীবনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও কি সে হাত ছেড়ে দিলে রাত্রি পরে যাবে? তাহলে তো কখনো মেয়ের হাত ছাড়া যাবে না।
রাত্রির বয়স এখন সাত মাস। এই বয়সে বাচ্চারা মা, বাবা, দাদা ইত্যাদি টুকটাক কথা বলতে পারে।
কিন্তু রাত্রি শুধু বলতে পারে একটি শব্দ – ভাভা। যাই দেখে উচ্ছসিত হয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে ভাভা।
অতন্দ্রিলা রাত্রিকে নিয়ে সোফায় বসল।
পরিষ্কার গলায় বলল, “মা বলতো, বা-বা।”
রাত্রি তার দুটি দাঁত বের করে ফিক করে হেসে বলল, “ভাভা।”
“উহুঁ, হলো না মা। বল বা-বা।”
“ভাভা!”
“আচ্ছা, এখন বলতো মা! মা”
“ভাভা!”
“এই ভাভা আবার কি?
রাত্রি আবার হেসে দিলো।
যেদিন রাত্রি অতন্দ্রিলাকে ‘মা’ বলে ডাকবে, সেদিন নিঃসন্ধেহে তার আনন্দের সীমা থাকবে না। মা শব্দটা এত অদ্ভুত কেন?
একদিন সকালে অনেক সাহস করে অতন্দ্রিলা ঠিক করল, এবার রোদকে তার মেয়ের কথা তাকে জানাতে হবে।
অতন্দ্রিলা রোদকে টেলিফোন করতে যাবে, তখনি রোদ অতন্দ্রিলাকে টেলিফোন করে।
উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “তন্দ্রি! আমি ইউনিভার্সিটির লেকচারার অফ দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।”
মানুষটা এতটাই খুশি ছিলো, যে এবারো অতন্দ্রিলা তাকে রাত্রির কথা বলতে পারলো না। রোদ এতদিন যেটার স্বপ্ন দেখেছিল, এখনো সেটা তার হাতের মুঠোয়।
এমন সময় তাকে বাচ্চার কথা বলে ফিরিয়ে আনার কোনো অর্থ নেই।
মেয়েকে বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা এবং বাবাকে মেয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যে গুরুতর অপরাধ, সেটা অতন্দ্রিলা বুঝতে পারছে। সে অনুতপ্ত।
(চলবে)