#অতঃপর_সন্ধি (০১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘আজ আন্টিকে নাস্তায় চা-বিস্কুট না দিয়ে আমাকে ভাত দিতে বলবে ফারদিন?’
টিউটরের মুখ নিঃসৃত কম্পয়মান কথা শুনে কলম থেমে গেল ফারদিনের।ভ্রু যুগল কুঁচকে নেত্রপাত করল টিউটরের অভিমুখে। মস্তিষ্ক তখনো সারমর্ম বুঝেনি। এক লাইনের বাক্যটা বুঝতেই খাতায় করতে থাকা সরল অংকটা অসমাপ্ত রেখে একছুটে ভেতরে চলে গেল।
অগোছালো চুল, গায়ে জড়ানো কুঁচকানো শার্ট। দূর্বলতায় চোখজোড়া মুঁদে আসছে। শরীরের তাপমাত্রা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে যেন। চেয়ারে বসে থাকা দায় হয়ে পড়েছে মায়ানের। জ্বরের কারণে বাদে বাদে কেঁপে ওঠছে শরীর । ফারদিনকে কথাগুলো বলার সময় বলে তো দিয়েছে। এখন ভীষণ লজ্জা করছে তার । আদৌও কি ভাতের কথা বলা ঠিক হয়েছে? বড্ড দ্বিধায় পড়ে গেল। এইদিকে খুদাও বেড়েছে ভীষণ।
____________
‘দেখ তানজিফ তুই যদি ভেবে থাকিস এইভাবে আমার পিছে পড়ে থাকলে আমি তোকে ভালোবাসবো তাহলে ভুল ভাবছিস।’
‘আপু ভাত দাও।’
ফারদিনের আওয়াজ পেয়ে ভড়কে গেল পুষ্পিতা। দ্রুত কান থেকে মোবাইল নামিয়ে বালিশের তলায় রেখে দিল। ফাইভে পড়ুয়া ইঁচড়ে পাকা ছেলেটা কিছু টের পায় তাহলে তিল থেকে তাল করবে। ঝেড়ে কেশে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করল সে।
‘একটু আগেই তো খাবার খেয়েছিস। টিচার এসেছে বাহানা না করে পড়তে যা। জ্বালাবি না একদম। না হলে আম্মু আসলে বিচার দিবো।’
দৃষ্টি সূঁচালো করলো ফারদিন।
‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমার মতো রা’ক্ষ’স? টিচারের জন্য খাবার।’
‘মিথ্যে বলবি না একদম।’
ফারদিন নাক ফুলালো।
‘আমি মিথ্যে বলছি না একদম।’
চাপা রাগ দেখালো পুষ্পিতা।
‘আমি কিন্তু এখন গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করবো।’
‘ওকে আসো।’
বলে দেরি না করে আবারও চলে গেলো ফারদিন। ফারদিন প্রস্থান করতে পুষ্পিতা বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করে। তানজিফ এখনো লাইনে। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো পুষ্পিতার।
‘তুই এখনো কল কাটিসনি?’
ওপাশ থেকে শোনা গেলো মৃদু পুরুষালি গলার আওয়াজ।
‘তুই তো আমাকে বিদায় দিস নি?’
চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার প্রয়াস চালালো পুষ্পিতা। ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো। তারপরও রাগ কমলো না।
‘হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছিস তো তাই বিদায়ের অপেক্ষায় ছিলি। নাম্বারে কল দিলে আর থাকতি না। চাল ফোন রাখ।’
ওপাশের উত্তরের আশা না করে তাড়াতাড়ি কল কে’টে দিল পুষ্পিতা।
‘সেই কলেজ লাইফ থেকে জীবনটা আমার তামা তামা করে দিল। কবে এই প্যারা থেকে মুক্ত হবো আল্লাহ জানে।’ বিড়বিড় করতে করতে ফারদিনের রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হতে ফারদিন আর মায়ান মাথা উঁচিয়ে নেত্রপাত করলো দরজা বরাবর। মাথায় ওড়না চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। পুষ্পিতার আসার কারন বুঝতে পেরে ঘোরতর ত্রপায় মাথা নুইয়ে ফেলে মায়ান।
পরিপাটি, ফিটফাট আর ছিমছাম গড়নের ছেলেটাকে হঠাৎ করে অগোছালো আর চক্ষু জোড়া লাল দেখে আঁতকে ওঠে পুষ্পিতা। বিলম্ব না করে প্রশ্ন করে বসল।
‘আপনি কি অসুস্থ?’
কিয়ৎক্ষণ স্থির আর নিশ্চুপ থেকে মাথা ঝাঁকায় মায়ান। অসুস্থতার বিষয়টা বোধগম্য হতে ব্যতিব্যস্ত স্বরে পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,
‘মেডিসিন নিয়েছেন?’
পীড়িত চক্ষে ক্ষণিকের জন্য পুনর্বার পুষ্পিতার অভিমুখে চাহনি নিক্ষেপ করে মায়ান। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করে ফেলে। তপ্ত শ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে আওড়ালো,
‘না।’
এবারে পুষ্পিতার কন্ঠে শোনা গেল হাজারো আকুলতা। কাতর স্বরে বলল,
‘আপনি এতো কেয়ারলেস কেন? নিজের যত্ন নিতে জানেন না একদম।’
আরো কয়েকটা লাইন কন্ঠনালী দিয়ে বের করতে গিয়েও করল না পুষ্পিতা। তার আগেই ফারদিনের তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ চাহনি নজরে পড়ল তার। নিজেকে সংযত করে নিলো সে। ব্যগ্র কন্ঠে পুনশ্চ বলল,
‘আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন। আসলে আম্মু বাসায় নেই তো। আজ পড়ানোর দরকার নেই। আপনি তো অসুস্থ।’
সেখানে আর দাঁড়িয়ে রইলো না পুষ্পিতা। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
চেয়ারের অগ্রভাগে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে রইলো মায়ান।
‘টিচার?’
ফারদিনের ডাকে চোখ মেলে তাকায় সে। চোখ খুলে রাখা দায়।
‘তোমাকে না বলেছি আমাকে টিচার বলবে না। ভাইয়া বলে ডাকবে।’
মিষ্টি হাসলো ফারদিন। অধরে হাসিটা বজায় রেখে বলল,
‘আপনি আমার বেডে শুয়ে রেস্ট নেন। এভাবে থাকলে ঘাড় ব্যথা করবে আপনার।’
________________
‘ফারদিন খাবার রেডি।’
চেয়ারের একটা কোণা শক্ত হাতে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো পুষ্পিতা। মিনিট সাতেক বাদে ফারদিন আর মায়ান এলো ডাইনিং এ। মায়ান চোখে মুখে পানির ছাট দিয়ে এসেছে। সম্মুখের চুলগুলো আধভেজা। কপাল আর ভ্রুর উপর পড়ে থাকা আধভেজা চুলের কারনে মায়ানের চোখমুখের মায়া যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায় পুষ্পিতা। এই মায়ায় ডুবেছে সে আরো আগে।আরো ডুবলে হয়তো তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হারিয়ে যাবে অতল গহীনে।
টেবিলের উপর সাজানো এক প্লেট গরম ভাত, মাছ ভুনা, ঘন ডাল, একটা ডিম ভাজা আর শুঁকনো মরিচের ভর্তা।
পুষ্পিতা কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। মায়ান চেয়ারে বসে তার পাশে দাঁড়ায় ফারদিন। সে এক পিস মাছ মায়ানের প্লেটে তুলে দিতেই পুষ্পিতা নত স্বরে বলল,
‘আম্মু আমার ওর জন্য মাছ আর ডাল করে দিয়ে গিয়েছিল। আমি ডিমটা ঠিকঠাক ভাজতে পারি। আর ভর্তা শর্টকাটে ইউটিউব দেখে পিষনিতে বানিয়েছি। অন্যকিছু রান্না করলে আপনি মুখেও নিতে পারতেন না। তাছাড়া সময়ও পাইনি। কষ্ট করে এগুলো দিয়ে খেয়ে নিন।’
‘আরে না না সমস্যা নেই। মেসে তো শুধু মাছ আর ডাল দেয়। তাও মাঝে মাঝে মুখে তোলা যায় না। জ্বরের জন্য এখন ওগুলো বি’ষ মনে হচ্ছে।
এক লোকমা মুখে দিয়ে মুখ বিকৃতি করে ফেলে মায়ান।
‘এভাবে আছেন কেন ভাইয়া?’
ফারদিনের কথায় মাথা উঁচু করে মায়ানের অভিমুখে চাহনি নিক্ষেপ করে পুষ্পিতা। মায়ান কোনো রকমে মুখের খাবারটা গিলে নেয়।
‘জ্বরের জন্য খাবার নিম পাতার মতো তিতা মনে হচ্ছে।’
‘তাহলে ভর্তা দিয়ে খান।’ মায়ানের কথা শেষ করার আগেই বলল পুষ্পিতা।
শুকনো হেসে মাথা ঝাঁকায় মায়ান। আবারও মনযোগ দেয় খাবারে। এবারে এক লোকমার পর আরেক লোকমা মুখে তুলতে নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেলো তার। ঝালে চোখের জলে আর নাকের জলে একাকার। পুষ্পিতা দৈবাৎ এক গ্লাস পানি মায়ানের মুখের সামনে তুলে ধরে। দিশা না পেয়ে তাড়াতাড়ি পানিটা শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
‘বেশি ঝাল হয়েছে? আসলে আমি এসব আন্দাজ করতে পারি না। কতটুকু লাগবে। বেশি ঝাল লাগলে এটা আর খাওয়ার দরকার নেই। অন্যগুলো দিয়ে খান।’
‘না না ঠিক আছে। ঝাল হলেও এটাই বেশ লাগছে।’
প্রখর, বিদ্রূপপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে ফারদিন। ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ তুমি তো অখাদ্য খাইয়ে মানুষ মে’রে ফেলবে।’
পুষ্পিতা কিছু বলার আগে মায়ান ধমকে উঠে। কন্ঠে সামান্য তেজ নিয়ে বলল,
‘বড় বোনের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? স্যরি বলো।’
_______________________
লিফট বাটনে চাপ দেওয়ার আগেই লিফটম্যান বলল,
‘ছাত্রছাত্রীরা এহন লিফট দিয়া যাইতো পারবো না। আজকের জন্য বড় স্যার নিষেধ কইরা গেছে।’
কথা শুনে কাঁদো কাঁদো চেহারা হয়ে গেলো পুষ্পিতার। পাশে থাকা জারিন উত্তেজিত, আক্রোশপূর্ণ গলায় বলল,
‘স্যার যে মাঝে মাঝে এমন কেন করে সেটাই বুঝি না। লিফট তো না মনে হয় স্বর্ণের খনি।’
পুষ্পিতার কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো।
‘সিঁড়ি বেয়ে এখন চার তলায় উঠবো? আমি তো অল্প বয়সে পঙ্গু হয়ে যাবো রে। ফাজিল পোলাপান গুলো প্রত্যেক ফ্লোরে বাটন চেপে রাখে আর রেগে যায় স্যার রা। বেগ পোহাতে হয় আমাদের মতো অসহায়দের।’
অকস্মাৎ কারো মুখে নিজের নাম শুনে চোখমুখের অসহায়ত্ব সরে গিয়ে কঠোরতা দেখা দিল। না শোনার ভান করে জারিনের হাতটা ধরে সিঁড়িতে পা রাখতেই তানজিফ দৌড়ে পুষ্পিতার পিছনে দাঁড়ায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?’
ঘুরে দাঁড়ায় পুষ্পিতা আর জারিন।
‘না শুনতে পাইনি।আমি বয়রা। কে কি বললো কিছুই আমার কান অবদি আসে না।’
তানজিফ একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
‘তুই বয়রা হলেও আমার সমস্যা নেই। তুই কানা হলেও আমার সমস্যা নেই। আমি তোকেই বিয়ে করবো।’
এবারে পুষ্পিতার রাগ যেন আসমান ছুলো। আশেপাশে তাকালো। যে যার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে ব্যস্ত।
‘এই তোর লজ্জা সরম নেই? এতোবার রিজেক্ট করার পরও আমার পিছনে এভাবে ছ্যাচড়ার মতো পড়ে আছিস কেন? ‘না’ এই শব্দটার মানে বুঝিস না? শুধু তোর জন্য ভার্সিটি আসতেও ইচ্ছে করে না।’ চাপা রাগ আর ক্রোধ পুষ্পিতার কন্ঠে।
জারিন পুষ্পিতার হাতটা শক্ত করে ধরে।ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তুই এসব কি বলছিস? নিজেকে সামলা।রাগে, ক্ষোভে অযাচিত কিছু বলিস না প্লিজ। পরে কিন্তু আফসোস করবি। কথার আ’ঘা’ত কিন্তু সবচেয়ে বড় আ’ঘা’ত।’
জারিনকে হাত দিয়ে থামায় পুষ্পিতা।
‘তোদের কাছে ও কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে যেটা বলেছি সেটাই। ওর এসব কর্মকান্ড আমাকে আকৃষ্ট করার বদলে বিরক্ত করছে। ও এই সহজ কথাটা কেন বুঝে না?’
বিষন্ন, ক্লেশিত চোখে পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো তানজিফ।
‘আমি তোকে বিরক্ত করি? আমি ছ্যাচড়া? যা আমি আর তোকে বিরক্ত করবো না। ইভেন তোর সামনেও আসবো না।’ বেদনার্ত কন্ঠে বলে উঠলো তানজিফ।
‘তুই আর আমার সামনে আসিসও না। তোর উপস্থিতি আমার অসহ্য লাগে।’
‘ পুষ্পিতা মুখে লাগাম দে প্লিজ। আশেপাশে সবাই দেখছে।’
তানজিফ আর কিছু না গটগটিয়ে উপরে চলে গেল।
‘যেগুলোকে আজ বিরক্তি হিসেবে ধরে নিচ্ছিস। সেগুলো তোর বিষন্ন মুখে আবার হাসির কারন না হয়ে দাঁড়ায়। এই বিরক্তিকর কাজ গুলোকে না আবার মিস করিস।’
‘এমন দিন আমার না আসুক।’
#চলবে
#অতঃপর_সন্ধি (০২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
প্রচন্ড পেট ব্যথায় কুঁজো হয়ে শুয়ে আছে পুষ্পিতা। ভার্সিটি থেকে আসার পথে অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে ফুচকা খেয়েছিল। সারা রাস্তা নাকের জলে চোখের জলে একসাথে করে বাসায় এসেছে। দরজা খুলে আফসানা হক মেয়ের এমন ভয়ার্ত মুখমন্ডল দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বুকে আগলে নিয়ে শঙ্কিত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করেন,
‘কি হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন? রাস্তায় কেউ বাজে কথা বলেছে?’
পুষ্পিতা নাক টানতে টানতে জবাব দেয়,
‘ঝাল দিয়ে ফুচকা খেয়েছিলাম মা।তাই,,,,,,,,, ‘
বাকি কথা শেষ করতে পারলো না পুষ্পিতা তার আগেই হুঙ্কার দিয়ে উঠেন আফসানা হক।
‘ফাজিলের বাচ্চা, আমার সামনে আসবি না আর।সর সামনে থেকে।’
বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে এসে ব্যাগটা ছুঁড়ে মা’রে পুষ্পিতা। কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে। পোশাক না বদলে সেভাবেই শুয়ে পড়লো। এখনো সেভাবেই আছে।
‘পেটে ব্যথা কমেছে?
আফসানা হক প্রশ্ন করলেন পুষ্পিতাকে। নিভু নিভু চোখে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে সে। অর্থাৎ এখনো কমেনি। দাঁতে দাঁত পিষেন আফসানা হক।
‘ফাজিলের বাচ্চা, আর খাবি ফুচকা? কত নিষেধ করি বাইরের কিছু খাওয়ার দরকার নেই। আমার কথা শুনলে তো। দুইদিন পরে বিয়ে দিবো কিন্তু এখনো জানে না কোন খাবার কি পরিমাণে খেতে হবে।’
কাঁথার নিচ থেকে কুমিরের মতো মাথা বের করে সে। ভ্যাবলাকান্তের মতো হাসি দেয় আফসানা হককে রাগানোর জন্য।
‘সন্ধ্যায় আবারও ফারদিন কে নিয়ে যাবো ফুচকা খাওয়ার জন্য।’
বলতে দেরি আর আফসানা হকের পা থেকে জুতো খুলে পুষ্পিতার দিকে ছুঁড়ে মা’রতে দেরি হলো না।
‘আহ! মা লাগলো তো।’
আফসানা হক মৃদুস্বরে রোদন শুরু করলেন।
‘দুইটা আমাকে একবারে জ্বালিয়ে শেষ করে দিলো। ছোটোটা তো জ্বালায় জ্বালায় সাথে বড়টা আরো বেশি জ্বালায়। একশো বাচ্চাও এমনে জ্বালায় না। আধঘন্টা সময় দিলাম। গোসল শেষ করে যদি ভাত খেতে না আসিস খবর আছে। বাপের মতো খবিশ হয়েছে। সাতদিনে একবার গোসল করে। সাথে গন্ধের জন্য টিকা যায় না।’
‘আম্মু কি শুরু করছো? পাশের রুমে তোমার ছেলের টিচার এসেছে। তুমি আমার মান সম্মানের পিন্ডি চটকাচ্ছো কেন?’ বিরক্তি নিয়ে বলে পুষ্পিতা।
‘তোর আদৌও মান সম্মান আছে? আধঘন্টার মধ্যে গোসল শেষ না করলে আমার জুতা তোর গাল। একটা বারিও মাটিতে পড়বে না।’
পুষ্পিতা ধ্যাৎ বলে বিছানা ছাড়লো।
______________________
‘দেখ, এইভাবে সরল অংক করলে তো মিলবে না কখনো। আগে প্রথম বন্ধনীর কাজ করতে হবে তারপর দ্বিতীয় বন্ধনী।’
ফারদিনকে অংক করাতে ব্যস্ত মায়ান।মুখাবয়বে গম্ভীরতা বিদ্যমান। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা।
‘আসবো বাবা।’
মেয়েলি গলার স্বর শুনে দরজার দিকে তাকাল মায়ান। মুখের গম্ভীরতা সরিয়ে নিঃশব্দে ওষ্ঠ জোড়া প্রসারিত করল। বিনীত স্বরে বলল,
‘অনুমতি নিচ্ছেন কেন আন্টি।’
প্রশ্নের জবাব না পড়ার টেবিলে কাছে এসে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন আফসানা হক।
‘রাতে আর জ্বর আসেনি তো বাবা?’
‘না আন্টি, আর আসেনি।’
আফসানা হক মায়াভরা কন্ঠে বললেন,
‘আজ আর পড়ানোর দরকার নেই।’
‘কিন্তু আন্টি এখনো তো একঘন্টাও হয়নি।’
‘তাতে কি? কাল কি খেয়েছো না খেয়েছো৷ আমি তো আর বাসায় ছিলাম না। আজ তোমার জন্য হালকা রান্না করেছি। চলো ডাইনিংএ।’
‘আন্টি,,,,,,’
‘কোনো কথা না। তাড়াতাড়ি এসো।’
গতকালের সেই কথাটার জন্য নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগছে মায়ানের। জ্বরের ঘোরে এমন একটা কথা বলে ফেলবে বুঝতেই পারেনি। একেবারে জড়বস্তুর ন্যায় সেখানেই বসে রইলো সে। মেঝেতে ফাঁক হলে হয়তো টুকুস করে লাফ দিয়ে দিতো।
____________
মাথা নুইয়ে খেয়ে চলেছে মায়ান। ভয়ঙ্কর লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে সে। পাশে আফসানা হক খালি গ্লাসটায় পানি ঢেলে বললেন,
‘প্রতি শুক্রবার আমাদের বাসায় তোমার দাওয়াত। না শুনবো না। আসতে হবে মানে আসতেই হবে। প্রতিদিন তো বিকেলে আসো সেজন্য দুপুরের খাবারের কথা বলতে পারি না। শুক্রবার দিন নামাজ পড়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে আসবে।’
এবারে লজ্জা যেন জেঁকে ধরলো মায়ানকে। প্লেটে আঙ্গুল নাড়াচাড়া করতে লাগে। আফসানা হক মায়ানের অবস্থা বুঝতে পারলেন। মায়ানকে একটু স্বাভাবিক করতেই বললেন,
‘তোমাকে এই কথাটা আরো আগেই বলে দিতাম। আসলে আমার ইঁচড়ে পাকা ছেলের টিচার তিন থেকে চার মাসের বেশি টিকে না। তুমি আমার ছেলের কাছে পাশ করছো।তাছাড়া আমার মেহমানদারি করতে ভালো লাগে। মনে করো, একজন মা একটুখানি ভালোবাসা দিচ্ছে তোমায়। তুমি পড়ানোর পর থেকে আমি ফারদিনের পার্থক্যটা দেখি তো। ও একটু একটু করে পড়ায় মনযোগী হচ্ছে।কোনো মায়ের ভালোবাসা নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিবে না?’ পানি পূর্ণ গ্লাসটা মায়ানের মুখের সামনে ধরে পুনশ্চ বলল,
‘আসবে তো?’
টলমল চোখে তাকাল মায়ান।
‘তুমি ভেবোনা কালকের ইন্সিডেন্টের আমি এসব বলছি। আজকাল গার্ডিয়ানদের নিয়ে হোম টিউটরের অনেক অভিযোগ থাকে।’
তারপর হাসিমুখে বললেন,
‘তোমাকে না হয় সেই অভিযোগ করা থেকে অব্যহতি দিলাম।’
__________________
‘রাতে একটা কল করে আপনার শারীরিক অবস্থার কথা বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?’
বাসা থেকে মাত্রই বের হয়েছে মায়ান। আকষ্মিক কথায় হকচকিয়ে গেল। এক পলক তাকাল পুষ্পিতার চোখের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে সে। জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে কিছুটা কর্কশ গলায় বলে,
‘আন্টি কল করাতে আমি বলে দিয়েছি। তাই আলাদা করে কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করিনি।’
এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে পুষ্পিতা তাকিয়ে আছে মায়ানের দিকে। মায়ানের দৃষ্টি অন্যদিকে। সিঁড়ির কাছে যেতেই বিকট শব্দে দরজা আঁটকে দিল। পা থেমে যায় মায়ানের। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। সে অভিমান বুঝে। অভিমানী চোখের ভাষা বুঝে। তবে নিম্নবিত্ত ছেলেদের ভালোবাসতে মানা। পা চালিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে। রিক্সা ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। ওয়ালেটে একশো টাকা আছে। টিউশনির বেতন পেতে আরো তিনদিন। এই তিনদিন এই একশো টাকা দিয়েই চলতে হবে। মেসের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো সে।
_________________
কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে মায়ান। দরজা ভেরানো। আতিক রুমে ঢুকেই মায়ানের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো।
‘কিরে জ্বর কি আবার আসলো?’
কপাল থেকে হাত নামিয়ে আতিকের দিকে তাকাল মায়ান। বিষন্ন স্বরে বলল,
‘না।’
‘তাহলে এই অসময় শুয়ে আছিস যে?’
উঠে বসে সে।
‘আজ মেয়েটাকে কঠোর গলায় কতগুলো কথা বলেছি।’
আতিক গায়ের শার্ট খুলে স্ট্যান্ডে রাখল। মায়ানের দিকে মুখ করে বলল,
‘অস্বীকার করতে পারবি, মেয়েটাকে তোর ভালো লাগে না?’
বুক গলিয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
‘গরীবদের ভালোবাসায় জড়াতে নেই। টাকা থাকেনা। মেয়ের বাপ মাও বিয়ে দিতে চায় না। পড়াশোনার জন্য শুধু আমিই শহরে।আমার পরিবার গ্রামে। নিজেদের একটুকরো জমিও নেই। মানুষের জমি বর্গা চাষ করে আব্বা। বছরে দুইবার ধান তুলে উঠানে। কোনো মেয়ে এসব করতে চাইবে না। আর শহরের মেয়েরা গ্রামে গিয়ে মানিয়ে চলতে পারে না।’
‘কেন ভাই তুই কি চাকরি বাকরি করবি না? আর তুই কি বিয়ে করবি মেয়েটাকে দিয়ে ধানের কাজ করানোর জন্য?’
‘অবশ্যই করবো৷ তবে আমার বাবা মায়ের পছন্দ গ্রামের সবকাজ জানা নিপুণা মেয়ে। শহরে বউ রাখার পারমিশন তারা কখনো দিবে না। তারাও শহরে এসে থাকবে না। সেজন্য মনের চাহিদা মনেই চাপা দিয়ে দিয়েছি। আমি মেয়েটার অব্যক্ত কথাগুলো চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই।’
বিছানা ছেড়ে দাঁড়ায় মায়ান। চেয়ার টেনে বসে বইয়ের একটা পাতা উল্টালো। বইয়ের ভাঁজে থাকা কলমটা হাতে নিয়ে চেয়ে রইলো কলমটার দিকে। কন্ঠে মায়া ঢেলে আওড়াল,
‘মেয়েটার চাহনি মারাত্মক। ঘায়েল করতে সক্ষম। আমি ডুবেছি সেই মায়ায়। তবে বলতে বারণ। দারিদ্র্যতার যাতাকলে চাপা পড়ে থাকুক আমার অনুভূতি। পারিবারিক চাপ নিয়ে আছি। অন্য চাপ নেওয়ার সাহস নেই।’
আতিক মায়ানের কাঁধে হাত রাখতেই তপ্ত শ্বাস ফেলল সে। আতিক নমনীয় স্বরে বলল,
‘অনুভূতির কথা চেপে রাখতে নেই। যখন দিন বদলে যাবে একটু প্রতিষ্ঠিত হবি তখন বড্ড আফসোস হবে। বার বার মনে হবে, ‘ইশ! বলে দিলে হয়তো মেয়েটা আমার হতো। নিজেদের সুন্দর একটা পৃথিবী হতো।’ ভালো কথা বলছি হয় তুই বলে দে না হয় তাকে বলার সুযোগ দে। আফসোসের রাস্তা তৈরি করিস না।’
#চলবে