অটবী সুখ পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
779

অটবী সুখ

শেষ পর্ব.
বিশ্বে এমন কিছু মানুষও আছেন, যারা মানুষের রক্ত পান করতে ভালোবাসেন। তাদের দাবি, রক্ত পানের মাধ্যমে তাদের মাথাব্যথা, পেটের জ্বালাপোড়া, ক্লান্তি ভাব দূর হয়। তারা এও বিশ্বাস করেন, রক্ত পান তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তি জোগায়। নাহ্! এটা কোনো ড্রাকুলা কিংবা ভ্যাম্পায়ার ঘটিত কাল্পনিকতা নয়। মানুষের এই রক্ত পান করাটা আসলে এক ধরণের রোগ। আমার মা, সিন্ড্রেলা স্টিফেনও এরোগে আক্রান্ত ছিলেন।

বাবা এ কথা জানতেন না। পড়ালেখার সূত্রে বিদেশে যাওয়ার পরই মায়ের সঙ্গে তার দেখা, প্রণয়, প্রেম। পাঁচ বছর জমিয়ে প্রেম করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ে করবেন। নানাবাড়ির সবাই মেনে নিলেও আপত্তি জানালেন দাদাবাড়ির মানুষ। আমার দাদা উচ্চবংশের জমিদার। বিশাল ফ্যাক্টরির মালিক। তাদের একটা সুনাম আছে, নামডাক আছে। একে তো বিদেশিনী, তারওপর বিধর্মী! এমন মেয়েকে তারা কিভাবে নিজের বড় ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেবেন? তারা মানলেন না। বাবা শত চেষ্টা করার পরও দাদার মন গলেনি। বাবা ভাবলেন, হয়তো বিয়ে করে ফেললে দাদার এই মান অভিমান, অভিযোগ নিঃশেষ হবে। কিন্তু কই? পরিস্থিতি যেন তখন আরও খারাপের দিকে ধাপিত হলো, আরেকধাপ খাদে নামলো। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবেই বাবাকে তেজ্যপুত্র ঘোষণা করলেন দাদা।

বাবা তখন মোটামোটি স্ট্যাবলিশ। বিদেশ থেকে মাত্র পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। ব্যাগ ভর্তি তাজা সার্টিফিকেট। টাকাও ছিল চলার মতো। মাকে নিয়ে বাবা নতুন জীবন শুরু করলেন। বাসা ভাড়া নিলেন। চাকরী শুরু করলেন। আস্তে আস্তে তাদের ছোট্ট সংসারটা একটু জমিয়ে, একটু হিসেবি হয়ে বড় হতে লাগলো। আমার মায়ের অতশত চাওয়া পাওয়া ছিল না। একটুতেই তাকে খুশিতে আত্মহারা হতে দেখছি আমি। দেখেছি, বাবার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। বাবাকে ভালোবাসেন বলেই হয়তো তাকে হারানোর ভয়ে কখনো নিজের অসুস্থতার কথা বাবার সামনে প্রকাশ করেননি তিনি। কাউকে করতেও দেননি। শুরু থেকেই বিষয়টা চেপে গেছেন। প্রেমের সম্পর্কে থাকাকালীন লুকিয়েচুকিয়ে রক্ত পান করলেও বিয়ের পর রক্তপান প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন মা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো তখন… যখন আমি আসলাম আমার মায়ের গর্ভে।

শুনেছি, গর্ভবর্তী মায়েদের অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করে। টক, ঝাল, মিষ্টি! কিন্তু আমার মায়ের ইচ্ছে করতো, মানুষের তাজা রক্ত পান করতে। আমার বাবা কাজ পাগল মানুষ। প্রায়ই বাসার বাহিরে থাকতেন। আমার অসুস্থ মা তখন সারাবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা করতেন, অনেক কিছু ভাবতেন। তার মনের দৃঢ় বিশ্বাসটা তখন আবারও জাগ্রহ হতে লাগলো, রক্ত পান করলে বোধহয় তার মানসিক, দৈহিক শক্তিটা ফিরে আসবে। তাকে এভাবে বিছানায় আর শুয়ে বসে থাকতে হবে না। তিনি আবারও হাসি খুশি হয়ে যাবেন।

সারাদিন বিশাল বড় ফ্ল্যাটে একা থাকা আমার মা এসব চিন্তায় যত না অসুস্থ ছিলেন, তারচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পরছিলেন। একটুখানি রক্তের তৃষ্ণায় তার বুকটা হাহাকার করে উঠছিল। বুক থেকে গলা অব্দি চৌচির হয়ে গিয়েছিল নিঃশব্দ কান্নায়, চিৎকারে। এজন্যই হয়তো বাবাকে বলেই ফেলেছিলেন, তাকে যেন একটু রক্ত এনে দেওয়া হয়… তিনি যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছেন।

মায়ের বর্ণনাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিছানায় অসুস্থতায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি তখনো বাবার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এত মায়া তার পুরো মুখশ্রীতে! কিন্তু কথাগুলো তো মধুর ছিল না। আমার, সুখনীল ত্রিস্তানের নামের মতোই তার মা বাবার জীবনটাও ত্রিস্তান সাগরের স্রোতে ডুবছিল। আমি তাদের জীবনে আসার পর থেকেই তাদের সুখ সুখ সংসারে ফাটল ধরে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমিই দায়ি। আমিই সব করেছি। সব দোষ একান্তই আমার।

মা বাবার কাছে রক্ত চাওয়ার পর বাবা কি করেছিলেন আমি জানি না। মা সেসব বলেননি। তাদের প্রেমের কোনো কিছুই আমার আর জানা নেই। তবে বাবাকে ছোটবেলায় দেখেছি, মায়ের অনেক যত্ন নিতে। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। ঘরের কাজ, রান্নাবান্না, তনয়া আর আমাকে সামলানো প্রায় সব কাজই বাবা একা হাতে সামলাতেন। মাঝে মাঝে দেখতাম, কোথা থেকে লাল রঙের পলিথিন ভর্তি কি যেন ফ্রিজে রাখছেন। কৌতূহল বশত আমি খেয়েও ফেলেছিলাম ওগুলো। বাবার তখন সে কি রাগ! মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, জানি না। সম্ভবত আমাদের জঙ্গলের বাড়িটায় দু’রাত কাটিয়ে এসেছিলেন। তারপর… তারপর সব শান্ত! বাবা ফিরে এলেন। সব আগের নিয়মে চলছিল। মায়ের নিয়ম করে অসুস্থ হওয়াটা বেড়ে গিয়েছিল অবশ্য। আমিও বড় হলাম। সবে কলেজে উঠেছি। বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘর সামলাচ্ছি, তনয়ার খেয়াল রাখছি। তখন বোধহয় প্রতিবেশী সবাই আমার মাকে ‘সুখী নারী’ বলে হিংসে করতো। আমাদের দেখলে বলতো, “অ্যা হেপি ফ্যামিলি”

আসলেই কি হ্যাপি ফ্যামিলি? যারা আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি বলতো তারাই তো আমাদের পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। মায়ের অসুখ… আরো কি কি বিশ্রী কথা রটিয়ে খবরে ছাপিয়ে দিলো, “বাংলাদেশে মিলল বাস্তবিক ভ্যাম্পায়ার! মানুষ হয়েও ভ্যাম্পায়ারের মতো রক্ত পান করেন যারা”
সাথে মায়ের শাড়ি পরা হাস্যোজ্জ্বল ছবি! আমার দাদাবাড়ির মানুষ তখন সবে আমাদের মেনে নিতে শুরু করেছিলেন। এরমধ্যে… এই খবর… এসব… সব তছনছ করে দিলো! দিনে দিনে এই একটা খবর সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরলো। লাখ লাখ লাইক, কমেন্ট, ভিউ-র মাঝে কিভাবে যেন আমাদের পারিবারিক একটা ছবিও ভাইরাল হয়ে গেল। ছবিটা পুরোনো বলে আমি আর তনয়া মোটামোটি বেঁচেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বাঁচতে পারেননি। তিনি গুণী বলে তাকে চাকরি থেকে বিদায় না করলেও বুলিং জিনিসটা কম হয়নি। পাঁচ দিনের ভেতর আমাদের এলাকা ছাড়তে নোটিশও দেওয়া হলো। কিন্তু আমরা কোথায় যাবো? অনেক সখ করে বাবা ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ফ্ল্যাট ছাড়া যদিও আমাদের অন্য একটা বাড়ি আছে। কিন্তু ওটা জঙ্গলে। ওখানে গেলে আমরা খাবো কি? তাছাড়া অন্য কোথাও যে বাসা ভাড়া নেব, তারও উপায় নেই। পুরো দেশ যে আমার মাকে চেনে! আমাদের চেনে!

বাবা সেই ফ্ল্যাটে, সেই এলাকায়, সেই চাকরি নিয়েই রয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে আনন্দ ফুর্তি করা আমার বাবাটা কেমন যেন পালটে গেল। আমাদের কারো সঙ্গেই তেমন কথা বলতেন না। বললেই রেগে যেতেন। মায়ের সঙ্গে তার ঝগড়া হতে লাগলো প্রচুর! মা কাঁদতেন, আমি দেখতাম। কেন যেন আমারও তখন মন মেজাজ ভালো ছিল না। এসবের জন্য মাকেই দোষী করতাম কতশত বার! স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো আমাকে আর তনয়াকে চিনে ফেলেছিল। বেশি বুদ্ধীমান কিনা! সবাই যা-তা ব্যবহার করতো। স্যার-ম্যাডাম পর্যন্ত! কলেজে যেতে ইচ্ছে করতো না। এদিকে কলেজে না গেলে সারাদিন মায়ের কান্না দেখতে হতো। আমার ভালো লাগতো না। অসহ্য লাগতো।

ভালো ছেলেমেয়েগুলো আমার সঙ্গে না মিশলেও খারাপ ছেলেরা আমার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইতো খুব। কারণটা আমার জানা নেই। কখনো জানতে চাইনি। ওরা কি কি যেন খেত। সিগারেট, আফিম আরও কত কি! আমাকেও জোড় করতো। খেতে না চাইলে বন্ধুত্ব ভেঙ্গে দিবে বলে হুমকি দিতো। আমার তখন কথা বলার কোনো মানুষ ছিল না। ওদের সাথে কথা বললে আমার একটু হালকা লাগতো। বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়েই আমি ওগুলো খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর কেউ না থাকলেও ওরা আমার সঙ্গে সবসময় থাকবে। কি বোকা আমি!

আমি মাদকাসক্ত হয়ে পরলাম। ড্রাগস ছাড়া আমার চলতো না। সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে সিগারেট ফুঁকতাম। ড্রাগস নিতাম। বাহিরে গেলেও তাই! এসবের মাঝে আমার যে একটা বোন আছে, আমি সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবা তো সেই কবেই আমাদের দায়িত্ব নেওয়া ভুলে গেছেন। বোনটা আমার সারাদিন একা একা থাকতো। বাসা থেকে কলেজ! আবার কলেজ থেকে বাসা……. ওর তো কোনো দোষ ছিল না! সব দোষ আমার, আমার মায়ের, আমার বাবার। তাহলে ওকে কেন শাস্তি পেতে হলো? নিষ্পাপ মেয়েটা কেন শাস্তি পেল?

আমার বোন, তনয়া সিন্ড্রেলা সুখনীল! আমার কারণেই আমার বন্ধুদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল। আমার অসুস্থতার কথা বলে কলেজ থেকে আসার পথে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমার বোনকে। দুদিন আমার বোন বাসায় ফিরেনি। বাবা পাগলের মতো পুলিশের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরিছিলেন শুধু। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। এরপর… এরপর আবারও খবরের নিউজ! আবারও বিশ্রী এক শিরোনাম! বিভৎস লাগছিল টিভিতে আমার বোনকে। জানোয়ারগুলো এমন ভাবে আমার বোনকে আঘাত করেছিল যে ওর চেহারা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছিল না। বোন আমার তখন আধা পাগল। আমি সারাক্ষণ নেশায় বুদ! বাবার ঝগড়া করাটা যেন হাজারগুণ বেড়ে গেলে। এত বাড়লো যে, একদিন ঝগড়ার মাঝে রাগের মাথায় মাকে ধাক্কা দিয়ে বসলেন তিনি। বোধহয় একটু বেশি জোড়েই। দূর্বল মা আমার ধাক্কা সামলাতে পারলেন না। কাঁচের টেবিলের উপর পরে গেলেন। কাঁচ বিঁধলো, মায়ের গলায়! শরীরে! মাথায়! মরে গেছে জেনেও বাবা ছুটলেন হস্পিটালে। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি তো তখনো নেশায় বুদ ছিলাম, যতটুকু শুনেছি, রং রোডে গাড়ি চালানোতে এক্সিডেন্ট হয়েছে।

বলা হয়নি, তনয়া তখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। ঝগড়া করে বাবা যখন আমার মাকে মেরে ফেললো, ও আমাকে ডাকতে এসেছিল। আমি নিজের মাঝে ছিলাম না। ঘুমাচ্ছিলাম। ওর ডাকে উঠিনি। বাবার এক্সিডেন্টের খবর শুনে ও যখন আবারও আমাকে ডাকতে এলো, আমি তখনো ঘুমাচ্ছিলাম। এরপর যখন চোখের পাতা মেলি, অঘোষিত উৎফুল্ল তন্দ্রা ঘোর যখন কাটে, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবনের মূল্যবান দুটি মানুষ। আর তনয়া… আমার কারণে, আমার জন্যই ওর পেটের সন্তানটা হারিয়ে ফেলেছিল ও। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে।
সেই থেকেই বোধহয় তনয়ার কিছু মনে নেই। বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। ঠিক ছোটবেলার আমার সেই ছোট্ট পুতুলটার মতো! মাঝে মাঝে বলে, ওর নাকি বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা ছিল! আসলেই কি তাই? আচ্ছা! এমনও তো হতে পারতো। হলো না কেন?
১২ই মার্চ।

আমি এই ডায়েরীটা কেন লিখেছি কিংবা লিখছি, আমি জানি না। আমার ডায়েরী লেখার অভ্যেস কোনো কালেই ছিল না। ইদানিং সবকিছু ভুলে যাচ্ছি বলেই হয়তো। এত এত মানসিক চাপ আমি নিতে পারছি না। মাদক, বিড়ি, সিগারেট— এসব ছাড়তে চাচ্ছি। কিন্তু হচ্ছেই না! একা একা এসব ছাড়া সম্ভব নয়। পাশে কাউকে দরকার হয়। কিন্তু আমার তো কেউ নেই। নানাদের আমি কখনো দেখিনি। দাদা সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন! বাবা মারা যাওয়ার পরও তাকে একবার দেখতে আসেননি। আমি যদি আমার চিকিৎসা করাতে কোথাও চলে যাই, তাহলে আমার বোনকে কে দেখবে? ভাবছি, জঙ্গলের বাড়িটায় চলে যাবো। এখানে থাকা আর সম্ভব না। প্রতিবেশীরা এখন ঘর অব্দি চলে আসতে শুরু করেছে। ওদের কাছে যেগুলো আশ্বস্ততা, আমাদের কাছে সেগুলো তিক্ততা। ওরা সেটা কেন বোঝে না?
৩০শে মার্চ

আমার ভুলে যাওয়ার রোগ বেড়েছে। বাবা মা ঘটিত অনেক কিছুই মনে পরে না। মাঝে মাঝে তনয়াকে দেখে চমকে উঠি। ওকে চিনতে পারি না। ও যখন আমার সাথে ভাব জমাতে আসে, খেলতে চায়, আমার তখন এত বিরক্ত লাগে! আমি বুঝতে পারছি, আমার অসুস্থতা কোনো স্বাভাবিক অসুস্থতা না। অতি রঞ্জিত ভয়াবহ কিছু। আমি অবশ্য ভালো কিছু আশাও করি না। আমার জীবনটাই যেখানে দুঃক্ষের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত, আমি সুখ খুঁজে পাবো কোত্থেকে?
২৫শে এপ্রিল

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মা মরে নি। আমার সাথেই আছেন। হাসছেন, কথা বলছেন! আমার তখন এত ভালো লাগে! মাকে ইচ্ছে করে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তারপর হঠাৎ করেই মা উধাও! বুকটা খালি হয়ে যায়। আফসোস হয়, যদি আগের সময়গুলোতে ফেরা যেত! এইতো! এইতো সেদিনই তো মায়ের হাতে ভাত খেয়েছিলাম। বোনের বেণুনী টেনে মজা নিচ্ছিলাম। এখন হাত বাড়ালেই সব শূণ্য কেন? চোখ মেললেই সব ঘুটঘুটে অন্ধকার কেন?
৩০ এপ্রিল

আমি বিরল রোগে আক্রান্ত। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। রোগটার নাম শুনলে আগে হাসি পেত। এমনও রোগ হয় নাকি? একই মানুষ কিন্তু দুইটা চরিত্র! কি হাবিজাবি কথা! অথচ সেই রোগটাই আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমি সেই হাতটা ধরেছিও! ফ্রিজে হঠাৎ রক্তের ব্যাগ আসার কারণটাও আমার কাছে এখন স্পষ্ট। এই রক্তের ব্যাগ কোথা থেকে এসেছে আমার জানা নেই। তবে ডাক্তারদের ধারণা, আমি আমার মায়ের চরিত্রটাকে নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলেছি। যা নেই, আমি তাও বাস্তব ভেবে জীবনযাপন করতে শুরু করেছি। রোগটা নাম… ঠিক মনে পরছে না। তবে ভালোই হয়েছে। আমি সব ভুলে গেলেই ভালো। এসব মানসিক চিন্তা থেকে তো অনতত মুক্তি পাবো!
৩ জুন

তনয়ার মতো এখন আমারও মনে হয়, ওর বিয়ে হয়েছিল। আমি জানি এটা সত্য নয়। তবুও কেন যেন আমার ভেতর সত্ত্বা কথাটা মানতে চায় না। লোকেদের আমি এটাই বলে বেড়াই। যারা আমাকে চেনে, তারা হাসে, বাজে বাজে মন্তব্য করে। আমি অবুজ হয়ে তাকিয়ে রই। কিছুই করতে পারি না। আমি এত ব্যর্থ সন্তান! ব্যর্থ ভাই!
সেদিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তনয়ার ব্যাপারে কথা বলতে। ও ঠিক হবে কি-না জানতে। ডাক্তার বলেছেন, ঠিক হওয়ার চান্স ফিফটি-ফিফটি। আমি শুনেছি, সায় দিয়েছি, এরপর চলে এসেছি রিপোর্ট সমেত। সেই হাসপাতালে আর যাইনি। অন্য কোনো হাসপাতালেও না। এই ফ্ল্যাট বেচে হলেও আমি তনয়ার চিকিৎসা করাতে পারবো, এ ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু তনয়া যদি ঠিক হয়ে যায়? আমার কর্মের জন্য আমায় যদি ঘৃণা করে? আমি তা মেনে নিতে পারবো না। আপন মানুষ বলতে ওই-তো আছে আমার জীবনে। ও চলে গেলে আমি একা হয়ে যাবো না?
আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে স্বার্থপরও!
২৫ জুন

আমি আমার আর তনয়ার চিকিৎসা আর করাই নি। শহর থেকে বহুদূরে, মফস্বল এলাকার বাড়িটাতে চলে এসেছি। ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম এখানে। অনেক রহস্য লুকিয়েচুকিয়ে বানানো জঙ্গলের এই বাড়িটা। বাবার অনেক সখের। নিচে একটা পাতাল ঘরও আছে। আমার কেন যেন মনে হয়, ওখানে মা আছেন। আমাকে ডাকছেন। আমি সেখানে লুকিয়ে রেখেছি তাকে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেন আবারও সেই কালো অতীতটা ফিরে না আসে। লোকে যেন মায়ের ব্যাপারে জেনে না যায়…..
আশেপাশের মানুষদের কত কি যে বানিয়ে বানিয়ে বলি! ওরা বোকার মতো বিশ্বাস করে। আমাদের চেনে না বলেই হয়তো। কিন্তু এই মিথ্যেগুলো আজকাল সত্য মনে হয়। সত্য মিথ্যার পার্থক্যটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। কোনটা সত্য? আমার মা বেঁচে নেই? নাকি আমার মা আছেন? ওই পাতাল ঘরটায়?
১৬ জুলাই

ডায়েরীর বাকি পাতাগুলো খালি। শেষের এক পৃষ্ঠার মধ্যখানে অবশ্য ছোট্ট করে লিখা, এ ডায়েরীটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ত্রিস্তান হয়তো এটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এজন্য হয়তো পুড়ে ফেলাও হয়ে ওঠেনি।

অটবীর জট পাকানো প্রশ্নগুলোর ঘুরপাক থেমে গেল। সব এবার স্পষ্ট হতে লাগলো একটু একটু করে। পাতালঘরে আসলে কখনোই কেউ ছিল না। ওসব ত্রিস্তানের কাল্পনিকতা। ত্রিস্তান যখন নিজের সত্ত্বায় থাকে, তখন তার মস্তিষ্ক তাকে এ বলে দাবিয়ে রাখে, ওখানে তার মা আছেন। সে তাকে সেখানে আটকে রেখেছে। সেই ভাবনা থেকেই ত্রিস্তান যখন যখন তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পাতালঘরে যায়, তার চরিত্র পালটে যায়। ওখানে সে কি করে, না করে কিছুই তার মনে থাকে না। সে নিজেই নিজের মায়ের সত্ত্বা ধারণ করে, কাঁদে, হাসে, কথা বলে। ঠিক যেমনটা তার মা করতো? গায়ে শতশত আঁচর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে নিজ শরীর। তার পরপরই যখন কাল্পনিক রাজ্যের ঘোর ভাঙ্গে, ত্রিস্তানের মস্তিষ্ক তাকে শিখিয়ে দেয়, ওটা আসলে ওর মায়ের দেওয়া আঘাত। ওর কর্মের ফল। নিজ মনেই মায়ের সঙ্গে এক কাল্পনিক সাক্ষাৎ সাজিয়ে নেয় ত্রিস্তান। একা একা কষ্ট পায়, দুশ্চিন্তায় ভোগে, বিষণ্ণ হয়! এমনি এতকাল সে মানুষদের তার সম্পর্কে যা যা বলেছে, যা যা করেছে সবটাই কাল্পনিক রাজ্যে বসবাস করা মস্তিষ্কের জোড় থেকেই। ওটা আসল ত্রিস্তান না। আসল ত্রিস্তানটা বোধহয় সমাজের কুৎসিত আচরণের কবলে মরে গেছে। আর ফিরেনি….

রয়েসয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। হাতে তখনো ত্রিস্তানের ডায়েরী, তনয়া আর তার মেডিকেল রিপোর্টস্! সযত্নে সেগুলো আবারও তোশকের নিচে রেখে ত্রিস্তানের পানে তাকালো সে। লোকটা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমাবে। এখন উঠবে না। ঘড়িতে ন’টা বাজছে প্রায়। রাতের রান্না করতে হবে। ভেবে ভেবে ত্রিস্তানের মুখপানে আরেকদফা তাকালো অটবী। হাত বাড়িয়ে চুলের গভীরে, কপালে, চোখে, ঠোঁটে একে একে আঙুলের আলতো স্পর্শ একে দিতে লাগলো। অল্প ঝুঁকে কপালের একেবারে মধ্যিখানে অধর ছুঁইয়ে দিতেই ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো ত্রিস্তান। অটবী আর অপেক্ষা করলো না। সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। লোকটার শরীরে কম্বল জড়িয়ে দিলো।

ত্রিস্তান তার জন্য ঠিকই আইসক্রিম এনেছিল। সবুজ পলিথিনে মোড়ানো দু’তিনটে চকবার সেই বহু আগে থেকেই মেঝেতে পরে আছে। এতক্ষণে হয়তো গলেও গেছে। মেঝে থেকে পলিথিনটা উঠিয়ে নেওয়ার মাঝেই শুনতে পেল, দরজার ওপাশ থেকে সরোজের তুমুল কণ্ঠস্বর। মৃদু চাপা কণ্ঠে একাধারে ভাবি ভাবি ডেকে চলেছে সে। দরজা খুলতেই একবার ঘরের ভেতর উঁকি মেরে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে ভাবি? ভাই কি কিছু কইছে? বুইঝা ফেলছে নাকি সব? তুমি কি কিছু খুঁইজা পাইছো?”

অটবী ক্লান্ত নয়নে তাকালো, “একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে কিভাবে উত্তর দেব, সরোজ?”
—“এক এক কইরাই দাও। আমি আর অপেক্ষা করতে পারতেসি না, ভাবি।”

বলতে বলতে আবারো ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারলো সরোজ। ত্রিস্তানকে ওভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বললো, “ত্রিস্তান ভাই ওইভাবে ঘুমায় ক্যান? তোমাগো মাঝে ঝগড়া টগড়া কিছু অয় নাই?”
—“তুমি কি আমাদের ঝগড়া জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

এপর্যায়ে ভীষণ বিরক্ত হলো সরোজ, “মজা নিও না তো, ভাবি! আমি এহন এমনেতেও সিরিয়াস। যা কাম হওনের কতা আছিল, তা ওই রহিম বাটপার আইজকা করবো না। ভাই এদিকে আইসক্রিম কিন্নাই বাসায় চইলা আইবো। অনেক কষ্টে তারে দোকানে পাঁচ দশ মিনিট আটকাই রাখছিলাম। সে আর থাকবোই না! ঘরে আইসে, তোমারে ডাইকাও পায় নাই। হে তো বুইঝা গেসে কিছু একটা গন্ডগোল। ধইরা বাইনধাও আটকাইবার পারি নাই। সোজা রুমে ঢুইকা দরজা আটকাই দিসে।”
একটু থেমে বললো, “তুমি কি কোনো ইম্পোর্টেন্ট কিছু পাইছিলা? ওই মহিলারে খুঁইজা পাইছো?”

অটবীর চাপা নিশ্বাস। প্রথমেই কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। গলে যাওয়া আইসক্রিমগুলো ফ্রিজে রেখে দেবার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। বিড়াল ছানার ন্যায় তার পিছু নিলো সরোজও।
—“আমি আর তনয়া ছাড়া এখানে কোনো মেয়ে থাকে না, সরোজ।”
—“তাইলে আমি কার চিৎকার শুনছি?”

সরোজের চোখে মুখে কৌতূহল। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত। যেন আজ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই ছাড়বে সে। তার এহেন নাছোরবান্দা স্বভাব দেখে অল্পসল্প হতাশ হলো অটবী। বললো, “ঠিক কেমন আওয়াজ শুনেছো, সেটা তো বলতে পারছি না। তবে ত্রিস্তানের মোবাইলে তার মায়ের একটা ভিডিও আছে। সেখানে তিনি কাঁদছিলেন। চিৎকার করে।”

আগামাথা হীন কথা! সরোজ সহজেই বুঝতে পারলো না। কিংবা বুঝলোই না। সেকেন্ড কয়েক বোঝার চেষ্টা করেও যখন কথাগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, অবুঝ কণ্ঠে সে সুধালো, “আমি কিছু বুঝবার পারতেছি না, ভাবি। সহজ কইরা কও।”

কেবিনেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একে একে নামিয়ে রাখতে লাগলো অটবী। চুলার পাশ থেকে চপিং বোর্ড নিয়ে পিয়াজ কাঁটতে লাগলো। রয়েসয়ে বললো, “ত্রিস্তান অসুস্থ, সরোজ। তিনি যা করেছেন, করছেন সবটাই কাল্পনিক। রক্ত দিয়েও তিনি কি করেন, আমি জানি না। হয়তো ফেলে দেন, নয়তো…”
বলতে বলতে থমকালো অটবী। অনুভূত হলো, কথাটা সরোজকে বলা ঠিক হবে না। কাউকেই বলা ঠিক হবে না। ত্রিস্তানের মায়ের সঙ্গে যা হয়েছিল, তা যদি ত্রিস্তানের সঙ্গে হয়? সরোজকে সে চেনে। মরে গেলেও ভাই সমতুল্য ত্রিস্তানের নামে একটা বদনামও সে রটাবে না। তবুও কোথা থেকে এক তীক্ষ্ণ সুর বাকি কথাগুলো বলতে বিচ্ছিরি বাঁধা দিচ্ছে অটবীকে।

পাশ হতে সরোজের লাগাতার প্রশ্ন, “এত ট্যেকা দিয়া রক্ত কিন্না ভাই রক্ত ফালাই দেয়? এইডা কেমন কতা, ভাবি? তুমি কি ভালো কইরা খোঁজ নিছিলা?”
—“একবার বলেছি তো, সরোজ! ত্রিস্তান অসুস্থ! একজন অসুস্থ মানুষ থেকে কিই-বা আশা করছো তুমি? কি শুনতে চাচ্ছো?”

সরোজের নমনীয় কণ্ঠস্বর, একরাশ বিশাল অনুরাগ, “আমি বুঝবার পারছি, ত্রিস্তান ভাইয়ের কোনো অসুখ হইছে। এইডাও বুঝবার পারতেছি, তুমি আমার কাছ থেইকা কিছু লুকাইতেছো। কিন্তু এইডা ঠিক না, ভাবি। আমি ভাইরে আমার আপন মানুষ থেইকা কম কিছু মনে করি না। হে আমার বড় ভাই। হের কিছু হইলে হেইডা আমার জানবার অধিকার আছে। তার কষ্ট একেবারে মাইরা ফেলতে না পারি, ভাগাভাগি তো কইরা নিতে পারুম?”
গাঢ়, দৃঢ় কথাগুলোর মাঝে কি যেন ছিল। কাজ করতে থাকা অটবীর হাত দুটো আচমকাই থেমে গেল। সরোজের শান্ত কণ্ঠে বলা একেকটা কথা শুনে মনে হলো, সে আর ছোট নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে।

বলবে না বলবে না করেও সবটা বলে ফেললো অটবী। একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু! ভেবেছিল, সত্য শুনে সরোজ চমকাবে, বিরূপ ভঙ্গিমায় মুখ বাঁকাবে। কিন্তু নাহ্! সরোজ অতশত চমকালো না। শুধু প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এহন কি করবা, ভাবি? ভাইরে ডাক্তার দেইখাইবা না?”

ভাবুক অটবী চুলার ফুটন্ত তরকারির দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রয়েসয়ে, সময় লাগিয়ে বহুক্ষণ পর সে ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলো, “আমি আসলে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি, সরোজ। লোকটার তার অতীতের প্রায় অনেক কিছুই মনে নেই। বিশেষ করে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশটা, অধপতনটা। ত্রিস্তান তনয়ার চিকিৎসাও করায়নি এই ভেবে, তার বোন হয়তো তাকে ঘৃণা করবে। ছেড়ে চলে যাবে। এমনকি নিজের অসুস্থতার কথা জেনেও সে চুপ ছিল। নিরবে কষ্ট পেয়েছে, কষ্টে কাতরেছে। সব কিছু ভুলে যাওয়াটা তার কাছে আনন্দের। সেখানে আমি কিভাবে তাকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেই? কোন অধিকারে?”

সরোজের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ কাঁপলো যেন। সামান্য প্রতিবাদ করতে চাইলো, “এইভাবে তো ভাই আরও অসুস্থ হইয়া পরবো, ভাবি। তারওপর ভাইয়ের নাক দিয়া হঠাৎ হঠাৎ রক্ত পরে।”

এ কথার জবাব পাওয়া গেল না৷ জবাব দিতে অটবীর ইচ্ছে করলো না। তরকারিতে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিয়ে বললো, “তনয়া কি এখনো ঘুমাচ্ছে, সরোজ? ওকে একটু ডেকে আসো। দুপুর থেকে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।”

সরোজ তনয়াকে ডাকতে গেল ঠিকই, কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ভীষণ অর্থপূর্ণ কণ্ঠে বলে গেল, “তুমি যা-ই করো না ক্যান ভাবি; তা যদি ভাইয়ের ভালার লাইগা হয়, আমারে সবসময় তোমার পাশে পাইবা।”
নাহ্! ছেলেটা সত্যিই হুট করে বড় হয়ে গেছে।

বিশাল আকাশ কোণে তপ্ত সূর্যের উত্তপ্ততা আজ একটু কম। মৃদুমন্দ বাতাসে গাছপালা অল্পসল্প দুলছে, খেলছে। সুদুর কোথা থেকে কাকের কা কা ডাক শোনা যাচ্ছে। জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখা মিললো, দূর গাছের ডালে বসে থাকা কাকটির। আপাতত কয়েকধাপ ডাকাডাকি শেষে সে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে!
অটবী তখন বিকালের নাস্তা বানানো শেষে মাত্রই সোফায় এসে বসেছে। পাশে খাতায় কি যেন আঁকিবুঁকি করে ভরিয়ে ফেলছে তনয়া। ঠোঁটে তৃপ্ত হাসি তার। চারপাশে রঙপেন্সিল ছড়িয়ে-ছিটানো। দৈবাৎ, কলিংবেলের শব্দ হলো। একবার, দুইবার, তিনবার! অটবী উঠতেই নিচ্ছিলো, এরমাঝে কোত্থেকে হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে এলো সরোজ। অটবীকে দেখে সামান্য ভড়কালো। সদর দরজা খুলতে খুলতে বোকা হেসে বললো, “ন-নলী মনে হয় আইসা পরছে, ভাবি। হেহ্ হেহ্।”

অথচ অটবীর মুখমন্ডল দৃঢ়, হাসিহীন। চোখ ছোট ছোট করে সরোজকে আগাগোড়া পরখ করছে সে। যেন রক্তগরম দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার বোন থেকে দূরে থাকো!

সরোজ আর সেখানে দাঁড়ালো না। একপলক প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমাকে পরাণ ভরে দেখে পকেট থেকে ফোন বের করলো। মিছেমিছি অভিনয় করতে লাগলো, “ওহ্হো! আমারে তো ত্রিস্তান ভাই ফোন দিছিলো! কি করুম কন তো, ভাবি? ভাইয়ের আমারে ছাড়া চলেই না! এসএমএস কইরাও কইতেছে, তার নাকি আমারে দরকার। আমি আরও নলী…. না মানে আপনাগো লগে থাকতে চাইছিলাম। কিন্তু কি আর করার! ভাইয়ের আমারে দরকার।”
পরপরই এক প্রকার চোরের মতো করেই পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

—“সরোজ ভাই এভাবে পালিয়ে গেলো কেন, আপা? তুমি কি আবারও তারে ভয় দেখাইছো?”
প্রশ্নটা নলীর। সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো সে।
অটবী সে কথার উত্তর দিলো না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “আম্মা নাকি আচার পাঠিয়েছে? কই? আনিস নি সাথে?”
—“এনেছি। ব্যাগে আছে।”

বলতে বলতে কাঁধ ব্যাগ থেকে দুটো আচারের বোয়ম বের করলো নলী। একটা বড় বক্সও আছে সাথে। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “ত্রিস্তান ভাইয়া কই? আম্মা ভাইয়ার জন্য পিঠাও পাঠিয়েছে।”
—“বাহিরে গেছে একটু আগে। এখনই চলে আসবে। তুই বল, আম্মা আর পৃথা কেমন আছে? পৃথাকে আনিস নি কেন সাথে?”

পৃথার কথা জিজ্ঞেস করায় একটু বরং বিরক্তই হলো নলী৷ সেই বিরক্তিটুকুর পরিমাপটা তার কণ্ঠেই বোঝা গেল, “ওর কথা জিজ্ঞেস কইরো না তো, আপা! ওই ছেমড়ি ভালোই আছে। এখনো তোমার ফোন দিয়ে কাদিনের সাথে প্রেম করে। ওই ছেলে যখন ওরে ছ্যাঁকা দিবে, তখন বুঝবে মজা!”
অটবী শুনলো, বুঝলো। নরম কণ্ঠে বললো, “তুইও সাবধানে থাকিস, নলী। ভুল কিছু করিস না।”
—“আমি আবার কি ভুল করবো? সরোজকে তো তুমি চিনোই, আপা।”

হাত বাড়িয়ে আমের আচারটা খুললো অটবী। তনয়া মুখিয়ে আছে একটুখানি আচার চেখে দেখবার জন্য। লোভনীয় দৃষ্টি সেই বহু আগে থেকেই আচারগুলোর পানে সীমাবদ্ধ। অটবী তাকে একটুখানি আচার খাইয়ে দিতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো তনয়া। খিলখিল করে হাসলো। হাসলো অটবীও। লহু হাসি, দুই তিন সেকেন্ডের জন্য। পরপরই নলীর চোখে চোখ রেখে কেমন কাঠিন্যতা নিয়ে বললো, “আমি তোদের ক্ষেত্রে ত্রিস্তানকেও বিশ্বাস করবো না, নলী।”

সময় গড়িয়েছে। বিশাল বারান্দার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের ডুবি ডুবি সূর্যটাকে দেখছে অটবী। অপেক্ষা করছে প্রাণ পুরুষের, তার দুঃখ মানবের। এমনটা সে প্রায়ই করে। একটু অবসরে, একটু অলসতা নিয়ে নিজেকে এই একান্ত সময় দেওয়াটা ভীষণ প্রিয় অটবীর। সারাদিনে সে কি করলো, পরবর্তীতে তার কি করা উচিত, কি করা উচিত না— এসব ভাবনাতে সূর্যের মতোই অল্প অল্প করে ডুবে যায় অটবী। কিন্তু ভাবনাগুলো তার শেষ হয় না। মাঠ, ঘাট, দিগন্ত, প্রান্ত ছাপিয়ে শূন্যে ভাসে। চাপা দীর্ঘশ্বাসগুলো আবারও জড়ো হয়ে আন্দোলন চালায়। এত করুণ আন্দোলন!

হঠাৎ, পেছন থেকে দুটো হাত অটবীর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। অটবী চমকাল ক্ষীণ। ভাবনা গুড়িয়ে ভঙ্গুর হলো। জিজ্ঞেস করলো, “কখন এসেছেন?”

ত্রিস্তান তখন অটবীর মাঝে মগ্ন। অটবীর নিজস্ব ঘ্রাণে সিক্ত। ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “এখনই।”
—“নলী এসেছিল। আপনার সাথে দেখা করবে বলে অনেক্ষণ অপেক্ষাও করেছিল মেয়েটা। আপনি আসতে এত দেড়ি করলেন যে? এতক্ষণ বাহিরে কি করছিলেন?”
ত্রিস্তান আগের মতোই উত্তর দিলো, “একটু কাজ ছিল। বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”

সঙ্গে সঙ্গে ত্রিস্তানের দিকে ফিরলো অটবী। মুখোমুখি হলো। কপালে হাজারটা ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি আবারও রহিমদের ওখানে গেছেন, তাই না? আপনাকে কতবার বলেছি ওদের সাথে না মিশতে? কথা কেন শুনছেন না, ত্রিস্তান? দুটো টিউশন তো করছেনই! এখনো ওদের সঙ্গে মেশার কি দরকার….”

অটবীর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ডান গালে চট করে একটা চুমু এঁকে দিলো ত্রিস্তান। অটবী গরম চোখে তাকালো। আবারও কিছু বলতে নিলেই তার বাম গালে আরও একবার চুমু খেলো ত্রিস্তান। মুচকি হেসে সুধালো, “তুমি রাগলে আমার এত ভালো লাগে কেন, অরণ্য?”

অটবী জবাব দিলো না। মুখ ফুলিয়ে রাখলো। তা দেখে আরেকদফা হাসলো ত্রিস্তান। দীর্ঘ, লম্বা হাসি! অটবীকে শক্ত করে বাহুডোরে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, অটবী। রহিমদের সাথে না।”
—“হু? আপনার আবার কোন বন্ধু….” বলতে বলতে থমকালো অটবী। কিছু একটা মনে পরতেই আবার জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আমাদের বিয়েতে আপনার কিছু বন্ধু এসেছিল না? সাক্ষী দিতে? ওদের সাথেই কি দেখা করতে গিয়েছিলেন?”
—“ওদের কথা তোমার এখনো মনে আছে?”
—“আছে।”

অটবী দু মিনিট চুপ থাকলো৷ কি যেন ভাবলো। এরপর সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, “ওরা কে, ত্রিস্তান? ওদের সাথে আপনার কিভাবে দেখা হয়েছে? না মানে… আমি তো শুনেছিলাম আপনার তেমন একটা বন্ধুবান্ধব নেই।”
—“পাঁচ মাস আগে শহর থেকে কিছু স্টুডেন্ট এসেছিল, ঘুরতে। ওরা বিপদে পরায় আমি সাহায্য করেছিলাম।”
—“তারপর থেকে ওরা আপনার বন্ধু?”
—“হ্যাঁ।”

স্পর্শের গভীরতা বেড়েছে। বেড়েছে তীব্র বাতাসের আনাগোনা, অন্ধকার নিকষকৃষ্ণের ঘনত্ব। বুকের বা’পাশের যন্ত্রটার ধুকবুক নিয়ন্ত্রণ হারা হতেই অটবী আটকালো, “আপনি মাত্র বাহির থেকে ফিরেছেন, ত্রিস্তান! ফ্রেশ হবেন না?”
ত্রিস্তানের ব্যস্ত উত্তর, “পরে।”
বলতে বলতে অটবীর অধরে অধর ছুঁইয়ে দিতে চাইলো সে। অটবী দিলো না। আবারও আটকালো। চোখে চোখ রেখে আস্তে করে বললো, “কালকে কিন্তু আমাদের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”

চোখের পলক পরলো। বেশ কয়েকবার। প্রশ্ন করলো, “ডাক্তারের কাছে কেন? মাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে?”

অটবী হাসলো মাত্র। অদ্ভুত লুকোচুরি মাখা হাসি! পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো ত্রিস্তানের গলা। ত্রিস্তান চমকালো। টাল সামলাতে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকলো সে নিজেও। বলতে চাইলো, “কি হয়েছে, অরণ্য?”

অথচ অটবী তার ওষ্ঠধর ছুঁয়ে দিতেই সব কথা থেমে গেল! উড়ে গেল! বলা হলো না, অটবীর জন্য সে একটা উপহার এনেছে। সদর দরজায় লাগাবার জন্য ছোট্ট একটা নেমপ্লেট। যেখানে খুব সুন্দর কারুকাজে লিখা আছে, ‘অটবী সুখ’

_________________

সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে