অটবী সুখ
৩২.
জানালার শুভ্র পর্দা নড়ছে। সূক্ষ্ণ রোদ্দুরের আলোটুকু কাঠের মেঝে রাঙিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। ফ্যান চালু নেই। বিদ্যুৎ নেই হয়তো। তবুও গরম লাগছে না। ভোর রাতের দুষ্টুমিষ্টি, স্নিগ্ধ বৃষ্টির দরুণ আবহাওয়া সেই তখন থেকেই ঠান্ডা ঠান্ডা। গায়ে মোটা কম্বল জড়ানো। অটবীর লতাপাতার মতো বাঁকানো ছোট্ট শরীরটা পুরো ঢেকে আছে ওতে। অল্পসল্প মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে। ত্রিস্তান একটু নড়তে চাইলো। খেয়াল হলো, তার বাম হাতটা অটবীর দখলে। হাতটাকে বালিশ বানিয়ে বুকের সঙ্গে সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে লেপ্টে আছে মেয়েটা। তার নড়াতে বরং অটবীর অসুবিধে হচ্ছে। ফোলা ঠোঁটটাকে আরেকটু ফুলিয়ে ফেলেছে সে। বাচ্চাদের মতো! ত্রিস্তান ক্ষীণ হাসলো। চোখের ঘুম নিমিষে উবে গেল। আলতো হাতে প্রেয়সীর এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে অল্প ঝুঁকলো সে। কপালের মধ্যিখানে অধর ছোয়ালো। গভীর ভাবে, দৃঢ়তার সঙ্গে। পরপরই লহু কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “প্রিয় অরণ্য, তুমি আরও আগে এলে না কেন?”
প্রশ্নটা অবান্তর। ত্রিস্তান নিজেই অটবীকে তার জীবনে আরও আগে আসতে দেয়নি। এখন যখন আসতে দিলো! কোনো মতেই আর ছাড়তে চাইছে না। আষ্টেপৃষ্টে যদি মেয়েটা বুকপাজরে বেঁধে রাখা যেত! ত্রিস্তান জানে, সে অসুস্থ। খুব গুরুতর কিছু হয়েছে তার। কিন্তু সেই রোগটা কি… তার মনে নেই। মনে করার চেষ্টাটুকু করতেও এত এত আলসেমী কাজ করে! মাঝে মাঝে অবশ্য আকাশচুম্বী কিছু ভয় হুরহুর করে হানা দেয়, ডাকে। বলে, “শোন গো সুখনীল ত্রিস্তান, তোর যে কিচ্ছু হবে না৷ তুই যে একা মরবি!”
ভয়ে ত্রিস্তানে গলা শুকিয়ে যায়। হাঁসফাঁস করে। প্রতিবার অটবীর দিকে তাকালেই মনে হয়, মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তার অজান্তে করা ভুলে তাকে ঘৃণা করবে। ত্রিস্তান মনের এই ভাবনাগুলোকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ভয়ানক সব ইচ্ছে জাগে তার। কখনো কখনো ভাবে, রান্নাঘরের নিচের তাকে থাকা মোটা লম্বা দড়ি দিয়ে অটবীকে বেঁধে রাখবে, ঘরে আটকে রাখবে। কোথাও যেতে দেবে না। তবে যদি তার ভয়টা একটু কমে! পরক্ষণেই মনে হয়, এমন করলে যদি তার অটবী কষ্ট পায়? তাকে যদি আরও ঘৃণা করে? বিরূপ চিন্তায় পাগল হয়ে যায় ত্রিস্তান। দিশেহারা বোধ করে। এখনো! এখনো তার অটবীকে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করছে। সবসময় করে। অটবী তার এত কাছে! বুকের মধ্যখানে ওর মাথা। ওর এক হাত ত্রিস্তানকে জড়িয়ে আছে। তবুও উড়ন্ত দ্বিধার এতখানি বিষাক্ত ছোঁয়া! বুকে চাপা ব্যথা! ত্রিস্তান বুঝে পায় না। মারাত্বক উন্মাদনায় অটবীকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। বিড়বিড় করে আওড়ায়, “আমি প্রচন্ড ভীতু, অটবী। তুমি আমার ভয় কাটিয়ে দাও। কালো অন্ধকারগুলো দূরে সরিয়ে দাও। আমার হাত-টা শক্ত করে ধরো, অটবী।”
–
পুনঃপুন করে জ্বলতে থাকা চুলার কড়াইয়ে আলু ভাঁজি হচ্ছে। আধসিদ্ধ এখনো। হতে আরও দশ-বারো মিনিটের মতো লাগবে। রুটি বেলতে বেলতে ঘড়ির দিকে একবার তাকালো অটবী। সকাল দশটা বেজে দু’মিনিট। ত্রিস্তান এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। কালরাত্রি বেলা ভীষণ জ্বরে কাতরাচ্ছিল লোকটা। ‘মা’ ‘মা’ বলে করুণ সুরে বুলি আওড়াচ্ছিল। অটবী সস্নেহে চুলে হাত বোলানো মাত্রই সে শান্ত, নিশ্চুপ! বন্ধ চোখের কোণে অঘোষিত দু’ফোঁটা জলের বিষাদময় অস্তিত্ব!
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। ঢাকনা তুলে আলু ভাঁজিটা একটু নেড়েচেড়ে দিলো। পেছন হতে সরোজের গলা শোনা গেল, “কি ভাবি? কি রাঁনধেন?”
নাহ্! সম্মোধনটা অটবীর ভালো লাগলো না। কপাল কুঁচকে ঘাড় ঘুরিতে তাকালো সে। সরোজ তখন ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করছে। জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমাকে ভাবি কবে থেকে ডাকতে শুরু করলে, সরোজ? নতুন কি ফন্দি আঁটছো?”
সরোজ সময় নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারলো না। পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে পরপরই চোখ মুখ দারুণ ভাবে কুঁচকে বললো, “ছি! ছি! ছিহ্… তুমি আমারে এমন ভাবো, ভাবি? আমি তোমারে নিয়া ফন্দি আটুম? বড় ভাইয়ের বউরে লইয়া? নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ! এমন বিচ্ছিরি সন্দেহ কইরো না গো। তুমি ত্রিস্তান ভাইয়ের বউ দেইখাই তোমারে ভাবি ডাকনের প্রেকটিস শুরু করছি৷ আর তুমি আমারে এমন ভাবে সন্দেহ করতাছো? এইডা ঠিক না ভাবি, এইডা ঠিক না।”
সরোজের কণ্ঠে অতিরিক্ত রংঢং, মন খারাপের কৃত্রিম রেশ। অটবী শুনলো মাত্র। জবাব দিলো না। নিজের কাজে মন লাগালো। এখনো অনেক কাজ বাকি পরে আছে। চা বানাতে হবে। ত্রিস্তানকে ডাকতে হবে। লোকটার জ্বর সেরেছে কি-না তাও তো একবার দেখা হয়নি।
চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসগুলো আরেকদফা ধূলিসাৎ হলো, ভাঙলো, জোড়া লাগলো, এরপর আবার ভাঙলো! এক এক করে ভেঁজে রাখা রুটিগুলো প্লেটে সাজিয়ে রাখলো অটবী। দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “নলীর সাথে কি কালকে তোমার দেখা হয়েছিল, সরোজ?”
সরোজ হকচকালো খুব। ভীষণ তোতলিয়ে বললো, “ন-নলী মানে? ও-ওর সাথে আমার দেখা হইবো ক্যান?”
—“নাটক করা এবার থামাও, সরোজ। তোমরা যে আমি মানা করার পরও দেখা করো, সেটা আমি জানি। ওর সামনে পরীক্ষা। দয়া করে ওকে যে ফোনটা দিয়েছো, ওটা নিয়ে নেবে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে ও শুধু ফোন নিয়ে বাথরুমে, উঠোনের ঝোপঝাড়ে পরে থাকে। নিজে তো পড়ালেখা করো না, এবার কি ওকেও পড়ালেখা করতে দেবে না?”
হতবিহ্বল সরোজ জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়ালো। একবার, দু’বার, লাগাতার! অর্থাৎ, সে দেবে। অবশ্যই নলীকে পড়তে দেবে। পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পাল্টাতে সরোজ নড়বড়ে কণ্ঠে বললো, “আইজকা তো ত্রিস্তান ভাই মনে হয় বিকালের দিকে বাইর হইবো। রহিম ভাইগো লগে কি যেন বোঝাপড়া করতে হইবো। আমি যামু লগে। এই-ই সুযোগ ভাবি। আপনে ত্রিস্তান ভাইয়ের ঘরে একবার চেক মাইরেন।”
তরকারি নাড়াতে থাকা হাতটা আচমকাই থমকে গেল। চোখের পলক আস্তে ধীরে ফেলে অটবী বললো, “ত্রিস্তানের অনেক জ্বর, সরোজ। উনি কিভাবে বের হবেন?”
—“হেইডা বিকাল হইলেই দেখবেন। ভাই কাজের সময় হেলাফেলা করে না। হে কইছে বিকালে বাইর হইবো, মানে বি-কা-লেই বাইর হইবো! কেউ তারে আটকাইতে পারতো না। জ্বর-টর মনে কইরবেন তহন নাই! গায়েব!”
অথচ অটবী মানতে চাইলো না। ভেতরকার অশান্তি এক ফোঁটাও কমলো না। বরং তা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। প্রত্যেকবারই তীব্র দ্বিধাদ্বন্দে আটকে দিচ্ছে, “তুমি কি সত্যিই ত্রিস্তানের ঘরে মেয়েলি চিৎকার শুনেছো, সরোজ?”
সরোজ মাথা নাড়ালো। হ্যাঁ, সে শুনেছে।
অটবী আবার বললো, “কিন্তু আমি তো এই ছয়দিনে কোনো চিৎকার শুনিনি।”
—“আমি এত কিছু ডিটেইলে জানি না, ভাবি। মাগার, ত্রিস্তান ভাই আপনি আহনের পর এহন আর ফ্রিজে রক্তও রাহে না। আপনারে বুইঝা শুইনা সবকিছু করতে হইবো।”
অটবী আর কোনো প্রশ্ন করলো না। কৌতূহলী ভাবচিত্র প্রকাশে আনলো না। নিশ্চুপভাবে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো, “আরেকটু পর নাস্তা হয়ে যাবে, সরোজ। তুমি গিয়ে তনয়াকে ডাকো। আমি ত্রিস্তানকে ডাকছি।”
–
বাস্তবিকই বিকাল হতে হতে শরীরের উত্তাপ প্রায় কমে এলো ত্রিস্তানের। জ্বরের অস্তিত্ব ক্ষীণ বিলিন হয়ে চোখের লালচে ভাবটাও মিলিয়ে গেল যেন। লোকটা আপাতত ফিটফাট হয়ে তৈরি হয়ে আছে বাহিরে যাবার জন্য। চোখমুখ মলিন, তবুও উজ্জ্বল রঙের শার্ট-টাতে তাকে এত মানিয়েছে! এত সুদর্শন লাগছে! অটবী চোখ ফেরাতে পারলো না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবুক নয়নে চেয়ে রইলো দুঃখ মানবের পানে।
সরব, আগোছালো চুলে অটবীর দিকে এগিয়ে এলো ত্রিস্তান। হাঁটু গেঁড়ে বসলো। সামান্য ঝুঁকে, মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “চুল আঁচড়ে দাও, অটবী।”
বিয়ের পর থেকেই ত্রিস্তান বড্ড আলসে হয়ে গেছে। নিজের কোনো কাজই তার করতে ভালো লাগে না, ইচ্ছে হয় না। সময়ে সময়ে অটবীকে আবদার করে বলে, “কোন শার্টটা পড়বো, অটবী? কোনোটাই তো ভালো লাগছে না। এদিকে আসো। একটা শার্ট খুঁজে দিয়ে যাও।” কিংবা “অটবী, আজকাল নিজ হাতে খাবার খেতে একদমই ভালো লাগে না। তুমি খাইয়ে দাও তো!”
অটবীর অবশ্য এসব ছোটখাটো আবদার খুব একটা খারাপ লাগে না। বরং ত্রিস্তানের একেকটা আবদার সাচ্ছন্দ্যে পূরণ করবার চেষ্টা করে সে, করছে।
—“দেখি, আমার দিকে তাকান। এভাবে ঝুঁকে থাকলে চুল আঁচড়াবো কিভাবে?”
ত্রিস্তান তাকালো। চোখে চোখ রেখে। কেমন কেমন করে যেন পরখ করতে লাগলো অটবীকে। চোখের দৃষ্টি গভীর, সূক্ষ্ণ, তেজিয়ান! অটবীর অস্বস্তি হলো। কোনোমতে ঝটপট চুল আঁচড়ে দিয়ে বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
ত্রিস্তানের এক বাক্যে উত্তর, “তুমি তাকাতে বলেছো।”
—“কিন্তু আমি তো এমন এমন ভাবে তাকাতে বলিনি।”
—“তাহলে কেমন কেমন ভাবে তাকাতে বলেছ?”
অটবী জবাব দিতে সময় লাগালো। উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হলো। এরমাঝে ত্রিস্তান আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কথা বলছো না কেন, অটবী? তোমার দিকে আমার কিভাবে তাকানো উচিত, শেখাবে না?”
চোখে মুখে দারুণ দুষ্টুমি নিয়ে তাকিয়ে আছে ত্রিস্তান। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেশ। সেই হাসিটুকু একবার দেখে অটবী ঝটপট উত্তর দিলো, “ভদ্র ভাবে তাকাবেন।”
—“আমি ভদ্র ভাবে তাকালে অভদ্র ভাবে কে তাকাবে, অটবী? তোমার লজ্জারা যদি একটু অবসর নিতো, তবে আমি ভেবে দেখতাম।”
কপালের মধ্যিখানে ওষ্ঠধরের গাঢ় স্পর্শ এঁকে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ভাঁজ করা শার্টের হাতায় আরেকটা ভাঁজ ফেলে সুধালো, “তোমার জন্য আসার সময় কি আনবো? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?”
অটবী মাথা নাড়ালো। তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
—“তবে আইসক্রিম নিয়ে আসি? চকবার? ওটা তো খাবে?”
ত্রিস্তান আর সরোজ চলে যেতেই সদর দরজাটা নিঃশব্দে আটকালো অটবী। ত্রিস্তানের ঘরে যাওয়ার পূর্বে একবার তনয়ার ঘরে উঁকি দিলো। নাহ্! তনয়া ঘুমাচ্ছে। দুপুরে যে ঘুমিয়েছিল, এখনো ওঠেনি। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে কদমে কদমে বা’দিকের ঘরটায় ঢুকলো সে। দরজা ভেড়াল। পরিচিত ঘর! আনাচে-কানাচে চেনা। অথচ কোথা থেকে কি খোঁজা শুরু করবে, তা ঠাওরে এলো না তার। ত্রিস্তান তার বুকসেল্ফটা কাউকে অত একটা ধরতে দেয় না। তাকে, সরোজকে, তনয়াকে— কাউকে না। প্রথমে এখান থেকেই খোঁজা শুরু করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ! এগিয়ে গিয়ে বুকসেল্ফটার সামনে দাঁড়ালো অটবী। পাঁচটা তাকের প্রত্যেকটা বই এক এক করে খুঁজতে লাগলো। প্রথম তাক! দ্বিতীয় তাক! তৃতীয় তাক! চতুর্থ তাকের সাত নম্বর বইটা টান দিতেই হঠাৎ বিকট শব্দে নড়েচড়ে উঠলো বুকফেল্ফ। বা’দিকের খালি জায়গাটায় সরে গেল। দৃশ্যমান হলো, কালো কাঠের অতি পুরোনো দরজা। তালা কিংবা অন্য কোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্ধ নয়। সামান্য ছিটকিনির মাধ্যমেই দরজাটা খুলে গেছে। কিন্তু দরজার ওপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের আলো থেকে যতটুকু বোঝা যায়, ওপাশে সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি বেড়ে নিচে নামতে হবে। স্তব্ধ অটবী এদিক-ওদিক তাকালো। টেবিলের ওপর থেকে টর্চ লাইটটা নিয়ে সুইচ চাপলো। তবুও যেন নিকষকৃষ্ণ আঁধারে অতটুকু আলো যথেষ্ট নয়। আলো চারিদিকে ছড়াচ্ছে না। কি অদ্ভুত! রয়েসয়ে ঢোক গিললো অটবী। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। ঠিক যেন কোনো আলাদিনের চেরাগ খুঁজতে অন্ধকার গুহায় হেঁটে চলেছে সে। সোনা রুপার কথা জানা নেই, কিন্তু যতই সে এগোচ্ছে একটা বিদঘুটে গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে তার। এত বিশ্রী! এত দমবন্ধকর! অটবীর নাসিকারন্ধ্র রোধ হয়ে এলো যেন। নাকে ওড়না চেপে টর্চ লাইট-টা এদিক ওদিক ঘোরালো। সামনে আর সিঁড়ি নেই। দেওয়ালের একপাশে সুইচ জাতীয় কি যেন দেখা যাচ্ছে। সেটা চাপতেই হঠাৎ আলোকিত হয়ে গেল চারিপাশ। প্রথম প্রথম অটবী চোখ মেলতে পারলো না। তীব্র আলোয় অস্পষ্ট দেখলো সব। তারপর যখন আস্তে আস্তে আলো চোখে সয়ে এলো? আশপাশ, পুরো ঘর স্পষ্ট হলো? চমকের দরুণ শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারালো অটবী। বিস্ময়ে স্থবির হলো, হকচকালো, ভড়কালো, নিশ্বাসগুলো আটকে আটকে এলো খুব।
পাতালঘরের মতো ছোট্ট একটা ঘর। মাথার ওপর জ্বলতে থাকা বাতি ছাড়া আর কোনো আসবাবের দেখা নেই। প্রত্যেকটা দেওয়ালে লাল বর্ণের কি যেন অস্বাভাবিক ভাবে লেপ্টে আছে। অটবীর ধারণা, এগুলো রক্ত। মেঝের একপাশে একটা স্টিলের বাটি আর দুটো শেকলের মাঝেও রক্তের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। শুকিয়ে-টুকিয়ে বিদঘুটে অবস্থা! অটবী তার আঁখিজোড়া আবারও সচল করলো। প্রত্যেকটা আনাচে কানাচে ভালো করে পরখ করতে লাগলো। নাহ্! কেউ নেই। এই পুরো ঘরে সে ছাড়া একটা মশা পর্যন্ত নেই। তবে… তবে ত্রিস্তান কি লুকাতে চেয়েছিল এখানে? কি লুকিয়েছিল? মস্তিষ্কে হিসাব কষতে কষতে সব দলাপাকালো। দুর্বিষহ ঠেকলো। এমনিতেও বাজে গন্ধে এই ঘরটাতে টেকা যাচ্ছে না৷ তারওপর এখন মাথা ব্যথাটাও চড়া দিয়ে ওঠেছে। সুদূর থেকে শুনতে পাচ্ছে, সরোজের উচ্চ কণ্ঠস্বর! ত্রিস্তান কি তবে চলে এসেছে? এত তাড়াতাড়ি? হাঁসফাঁস ভাবটা কমে এলো। আগের সেই আতঙ্ক অনুভব করলো না অটবী। আস্তে ধীরে পাতালঘরের বাতি নিভিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
–
বাহির থেকে আকাশের গর্জন শোনা যাচ্ছে। গুরুম, গুরুম! তীব্র বাতাসে খোলা জানালা গলিয়ে লতাপাতা ঢুকছে। ক্ষীণ বৃষ্টির ছিঁটায় মেঝে পিচ্ছিল। দরজা আটকানো। ওপাশ থেকে একটু আগেও সরোজের হাঁক শোনা গেলেও এখন তা পুরোদমে নিস্তব্ধ।
বিছানার একপাশে ত্রিস্তানকে বসে থাকতে দেখা গেল। বিকালের সেই ফিটফাট রুপটা নেই। বড্ড অগোছালো, উদ্ভ্রান্ত। একাধারে নিচের দিকে চেয়ে মাথার চুলগুলো দুহাতে খামছে আছে লোকটা। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। বুকের উঠানামা অস্থির, অশান্ত। অটবী ধীর পায়ে পাশে গিয়ে বসতেই ক্ষীণ ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সব জেনে গেছ, তাই না?”
অটবী জবাব দিলো না। ত্রিস্তান উত্তরের অপেক্ষাতেও নেই, “তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, অটবী? যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? তুমি না থাকলে আমার সময় কাটবে কিভাবে?”
ভীষণ মিনতিপূর্ণ অনুরোধ। কণ্ঠে হাজারটা হাহাকার। কথাটা বলার সময় অটবীর দিকে তাকালো ত্রিস্তান। সমুদ্রের ন্যায় গভীর চোখ দুটোয় কি অসীম ভালোবাসার দুর্গম ভয় দেখা দিলো? তাকে হারানোর ভয়? দিলো বোধহয়।
মুচকি হেসে অটবী বললো, “আপনি বলেছিলেন, আমাকে হারানোর ভয় আপনার নেই। আপনি জানেন আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো না। তবে এখন ভয় পাচ্ছেন কেন?”
ত্রিস্তান অটবীর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বললো, “মিথ্যে বলেছিলাম।”
—“আপনি এত মিথ্যে বলতে পারেন ত্রিস্তান! আমাকে আজ পর্যন্ত কতগুলো মিথ্যে বলে বোকা বানিয়েছেন, বলুন তো!”
উন্মাদনা আরেকধাপ বাড়লো। ত্রিস্তান দ্রুত উত্তর দিলো, “আর বলবো না, অটবী। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?”
—“যাবো না। তবে আপনাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”
—“কি প্রশ্ন?”
অটবী একটু সময় নিলো। নমনীয় গলায় জিজ্ঞেস করলো, “নিচের ওই ঘরে কে থাকে, ত্রিস্তান?”
—“মা।”
—“নিজ মাকে ওখানে কেন রেখেছেন? ওভাবে?”
—“তনয়া মাকে দেখে ভয় পাবে। তুমি, সরোজ সবাই ভয় পাবে। তাই… আমি আসলে মাকে লুকিয়ে রাখতে চাইনি।”
অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুদীর্ঘ লম্বা নিশ্বাস! ত্রিস্তান যে অসুস্থ, বিরল রোগে আক্রান্ত, সে তা বহু আগেই জেনেছে। কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে ত্রিস্তানের কথাগুলো, কথা বলার ভঙ্গিমা— সবকিছু ভীষণ দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে ভেতরটা। অসহনীয় করে তুলছে বারংবার।
—“আমি আপনাকে ছেড়ে সত্যিই কোথাও যাবো না, ত্রিস্তান। সুখনীল ছাড়া অরণ্য যাবেই-বা কোথায়?”
সময় গড়িয়েছে। সন্ধ্যা শেষে রাতের আগমন ঘটছে আস্তে আস্তে। অটবী তখনো সেই বিছানাতেই বসে। তার কোলের ওপর ত্রিস্তানের মাথা। শরীরটাকে গুটিয়ে ভীষণ তন্দ্রায় তলিয়ে আছে লোকটা। তার ঝাকড়া চুলগুলোর ভেতর অটবীর হাত ঘুরঘুর করছে। দু’মিনিট যেতেই হাতটা সরিয়ে নিলো অটবী। অল্পসল্প পাশে ঝুঁকে বিছানার তোষক উল্টালো। কিছু কাগজপত্র আর একটা ডায়েরী পরে আছে। ডায়েরীটা ত্রিস্তানের। মোলাটে সুন্দর করে ছয় বছর আগের সালটা খোদাই করা। কাগজপত্রগুলো অবশ্য তেমন পুরোনো নয়৷ তিন বছর আগের। কাগজ আর ডায়েরীটা অটবী সেই প্রথম দিনই খুঁজে পেয়েছিল। ওইযে? সরোজ তাকে কিছু বই এনে দিয়েছিল না পড়তে? সেখানে ডায়েরী আর কাগজগুলোও ছিল। ত্রিস্তান হয়তো তা জানতো না। নয়তো এত সহজে কি অটবীকে নিজের অতীত নিজেই জানতে দিতো?
ডায়েরীটা রেখে প্রথম কাগজটা হাতে নিলো অটবী। খুললো। কোনো এক হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্ট। রোগীর নামের জায়গায় ‘Sukhneel Tristan’ নামটা সুন্দর করে লিখা। এর বেশ নিচে গাঢ় কালির দাগে রোগটার সন্ধানও পাওয়া গেল, ” Parsonality disorder”.
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা