অটবী সুখ
২৮.
শেষ রাতের বৃষ্টির রেশ এখনো রয়ে গেছে। মাথার ওপর চলন্ত বৈদ্যুতিক পাখার গতি তীব্র। শীত লাগছে। কিন্তু ফ্যান কমানোর কিংবা বন্ধ করার বিন্দু মাত্র প্রয়াস নেই। ওড়নাটা শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে অটবী শুধু ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্ত প্রান্ত পায়চারি করছে। চিন্তায় মনে হচ্ছে, মাথায় হাজারটা পাথরের বোঝা। ঠোঁটের পাতাগুলো রুক্ষ হয়ে আছে। জিভ দিয়ে তা ভিঁজিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো অটবী। এগারোটা বেজে বারো মিনিট। ত্রিস্তান এসেছে দশটায়, হুট করেই। কাল সন্ধ্যায় লোকটা বলেছিল, সে অটবীকে আজকে নিতে আসবে। অটবী বিশ্বাস করেনি। একদম পাত্তাই দেয়নি। ভেবেছিল, লোকটা মিথ্যে বলছে, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সত্যি সত্যি হয়তো আসবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ত্রিস্তান এসেছে। বসার ঘরে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। এক ঘন্টা হয়ে গেল, তাদের কথা শেষই হচ্ছে না!
এমনিতেও রেবা বেগম রহিমদের কাউকে পছন্দ করেন না। সে হিসেবে ত্রিস্তানকেও তার পছন্দ হবার কথা নয়। তারওপর বিয়ের মতো বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই উনার উচিত ছিল চিৎকার-চেঁচামেচি করে পুরো এলাকা উল্টে ফেলা। পুলিশ-টলিশ ডেকে এলাহি কান্ড ঘটানো। কিন্তু তা না করে এরা দুজন এত শান্ত, স্থবির পরিবেশে এতক্ষণ কি কথা বলছে তা কিছুতেই ঠাওর করতে পারছে না অটবী। ওপাশ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি তো দূর, কথার আওয়াজও ভেসে আসছে না। তার মনের হাঁসফাঁস বাড়ছে। ভয় বাড়ছে। বিছানায় একটু শান্তিতে বসতেও পারছে না সে। এই নলীটাও যে কোথায় গেল! কাজের সময় একদম পাওয়া যায় না।
ভাবনা অকূল পাথারেই খট করে খুলে গেল দরজা। নলী এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বললো, “কাহিনী তো ঘটে গেছে আপা।”
অটবীর ভয় সীমা ছাড়ালো যেন, “ক-কি হয়েছে? আম্মা কিছু বলেছে ত্রিস্তানকে? গালিটালি দেয়নি তো?”
ঝুঁকে থাকা নলী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পানির তেষ্টা পাচ্ছে। ঢোক গিলে বললো, “সেটাই তো সমস্যা! গালিটালি কিচ্ছু দেয় নাই। বকেও নাই। চুপ ছিল।”
অটবী ভ্রু বাঁকালো। প্রশ্ন করলো, “তাহলে?”
—“ত্রিস্তান ভাইয়া জম্বেশ একটা ভাষণ দিছে। ওমনি আম্মা শান্ত! কি ভাষণ দিছে, শুনবা?”
অটবী উৎসুক জনগণের ন্যায় তাকালো। তাতে যেন আরও উৎসাহ পেল নলী। কণ্ঠকে জোড়পূর্বক পুরুষালি করে ত্রিস্তানের মতো গম্ভীরমুখো হয়ে বললো, “আমি জানি আপনি কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না। আমাদের অবশ্যই উচিত ছিল আপনার মত নিয়ে বিয়ে করা। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। আপনাদের আর্থিক অবস্থা, হঠাৎ বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া– সব মিলিয়ে অটবী আপনাকে আর দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি। এখন আপনি বলতে পারেন, আমরাই হয়তো বিয়ে ভেঙ্গেছি বা এমন কিছু। কিন্তু আমরা আমাদের অনেক আগে থেকে পছন্দ করলেও আমাদের মাঝে সম্পর্কের উৎপত্তি ঘটেছে ওর বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর। একমাস আগে।”
নলী থামলো। বোঝা গেল, ত্রিস্তানের মতো কথা বলতে তার খুব বেগ পেতে হচ্ছে। বারবার তাল হারিয়ে ফেলছে। জোড়ে জোড়ে দুটো নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “অটবী আপনাকে খুব সম্মান করে, ভালোবাসে। আপনি ওর মা। ওকে মারতেই পারেন। কিন্তু যে নিজেই ভুল পথে হাঁটছে, তার কথা বিশ্বাস করে; পুরোটা না জেনেই ওকে মারা উচিত হয়নি। একটু নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন। ওর পুরো কথা শুনুন। আগে আমি কেমন তা জানুন। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনার নিশ্চই আপনার মেয়ের ওপর বিশ্বাস আছে? ও আপনার মতামতের বিরুদ্ধে একপাও আগাবে না। আর না আমি ওর মতের বিরুদ্ধে যাবো।”
সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বিশাল বক্তব্য। তবে মিথ্যের চেয়ে সত্যই বেশি বলেছে লোকটা। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আম্মা আর কিছু বলে নি?”
—“নাহ্, বলে নাই।”
বলতে বলতে পড়ার টেবিল থেকে প্লাস্টিকের বড় বোতল উঠালো নলী। কয়েক ঢোক পানি গিলে গলা ভেঁজালো। এরপর আবার বললো, “তোমাকে ত্রিস্তান ভাইয়া বলছিল উঠানে যাইতে। কি যেন বলবে বললো।”
—“উঠানে? উনি এখনো যাননি?”
প্রশ্ন ছুড়ে, এবড়োথেবড়ো ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় জড়ালো অটবী। বসার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে সাবধানী গলায় শুধালো, “আম্মা কোথায়? বাইরে যেতে পারবো?”
—“রুমে আছে। পৃথাও মনে হয় রুমে। আল্লাহ জানে আম্মার কানে কি আকাম-কুকাম ঢালতাছে! তুমি আপা তাড়াতাড়ি যাও তো!”
অটবী আর দেড়ি করলো না। ছুটন্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। ত্রিস্তান কি এখনো অপেক্ষা করছে? নাকি চলে গেছে? অস্থির লাগছে তার। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে।
–
উঠানের দিকটায় ত্রিস্তানকে পাওয়া গেল না। আড়ষ্ট অটবীকে আরও অশান্তিতে ফেলে সে বিন্দাস গেটের বাহিরে সিগারেট ফুঁকছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। উলটো দিক ফিরে আছে। ঝাকড়া চুলের মাথার ওপর দিয়ে অবিরাম ধোঁয়ার সারি উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন ভেতরকার সব গ্লানি নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে আকাশ! ত্রিস্তানও-বা কম কিসের? চোখের লুকোচুরিতে আকাশের সঙ্গে গোপন আলাপনে মত্ত হয়েছে সে। কেমন একটা রাজকীয় ভাবসাব! কিন্তু কোথাকার রাজা সুখনীল ত্রিস্তান? অটবীর বক্ষে লুকানো ওই গোপন যন্ত্রের? নাকি এই বিশাল আকাশের? যাকে সে তার মনের সব কথা বলে।
ক্যাচক্যাচ শব্দে গেট খোলার আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ত্রিস্তান। অটবীকে দেখে অল্প হাসলো। স্নিগ্ধ হাসি! মনোমুগ্ধকর! অটবীর রাগ-টাগ চট করে উবে গেল। কি মুশকিল! সে কি আদৌ কখনো এ লোকের ওপর রাগ করতে পারবে না?
কৃত্রিম গম্ভীরতা নিয়ে অটবী মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন? আমি আপনাকে খুঁজছিলাম।”
ত্রিস্তান উত্তর দিলো না। হাতের সিগারেট-টা ফেলে পা দিয়ে পিঁষে ফেললো। আচমকা ঝুঁকে বললো, “দেখো তো, সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছো?”
লোকটা কাছে চলে এসেছে। একটু বেশিই কাছে। কানের জায়গাটুকু গরম নিশ্বাসেরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি! অটবী ভড়কে এক কদম পেছালো। কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে ত্রিস্তানকে দূরে সরিয়ে দিলো। অন্যদিকে চেয়ে বললো, “কিজন্য ডেকেছেন?”
—“ঘুরতে যাবো।”
—“হু? কি?”
অটবীর আশ্চর্য দৃষ্টি। পরনে মোটামোটি ধরণের সালোয়ার। চুলগুলো কাকের বাসা হয়ে আছে। এ অবস্থায় ঘুরতে যাওয়া? তারওপর রেবা বেগমের হাবভাবও সুবিধার নয়। কাল রাত্রির রাগ নিশ্চই এত তাড়াতাড়ি কমে যায়নি?
অটবী দিরুক্তি জানালো, “মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? এমতাবস্থায় আপনি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেন কিভাবে?”
ত্রিস্তান আগের মতোই উত্তর দিলো, “কিছু হবে না, চলো।”
অটবীর হাত ধরে ক্ষীণ টানলো সে। অথচ অটবী শক্ত হয়ে আছে। নড়ছে না।
—“আপনি বাচ্চামো করছেন, ত্রিস্তান! এমনিতেও আম্মা রেগে আছেন। তাকে আর রাগানো ঠিক হবে না।”
—“তিনি রেগে নেই।” ত্রিস্তানের নির্লিপ্ত কণ্ঠ। অটবী ভ্রু কুঁচকালো, “মানে?”
—“তোমার আম্মা মনে মনে রাজিই আছেন। শুধু প্রকাশ করছেন না।”
—“আমাকে কাল থাপ্পড় মেরে আম্মা এখন রাজি আছেন? আপনি আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছেন?”
—“কাল হয়তো ছিলেন না, এখন আছেন। তুমি উনাকে পটাতে পারোনি। এটা তোমার দোষ।”
হাহ! এখন সব দোষ তার? দিরুক্তি করে কিছু বলবে, তার পূর্বেই অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো ত্রিস্তান। কোত্থেকে হাজারটা গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, “আর কথা বলো না তো, অটবী। তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছো।”
কথাটা কি ত্রিস্তান তাকে ভয় পাওয়াতে বললো? কিন্তু অটবী তো মোটেও ভয় পায়নি। উলটো চরম বাধ্য হয়ে বললো, “সবাই দেখবে, ত্রিস্তান! আপনি এমন বাচ্চামো কেন করছেন? অনতত হাতটা তো ছাড়ুন!”
তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের একরোখা উত্তর, “তো? দেখলে দেখুক। তুমি আমার প্রেমিকা নও।”
তবে সে কে? অটবীর খুব ইচ্ছে হলো, প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সে জানে, জিজ্ঞেস করলেও ত্রিস্তান উত্তর দেবে না। চুপ থাকবে।
জঙ্গলের কাঁদায় মাখো মাখো রাস্তা পেরিয়ে ত্রিস্তানের বড়োসড়ো বাড়িটায় পৌঁছাতেই ত্রিস্তান হাত ছেড়ে দিলো। দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে বললো, “তোমাকে একেবারে নিয়ে আসবো বলেছিলাম। কথা রাখতে পারছি না বলে দুঃখীত, অটবী। তবে এখন, এই মুহুর্তে আরেকটা কথা দিচ্ছি। এখন থেকে বিকাল অব্দি এটা তোমার। এখানের সবকিছু তোমার। যা ইচ্ছা করো, যত ইচ্ছা জ্বালাও। কেউ কিছু বলবে না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
২৯.
দূর থেকে পাখির কুহুকুহু ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘরে ফ্যান চালানো নেই। বাহির থেকে মৃদুমন্দ বাতাসে ফ্যানের কথা মনেই আসছে না। জঙ্গল তো! আশপাশে প্রচুর গাছ। রোদের আলো ঠিকঠাক আসে না। গাছেরা সারাদিন দুলতে থাকে আনন্দে। গরম লাগবে কোত্থেকে? কোলে মাথা এলিয়ে শুয়ে থাকা ত্রিস্তানের চুলে অল্প হাত বুলালো অটবী। লোকটার চোখের পাতা বন্ধ। একটু আগে সেগুলো পিটপিট করলেও এখন সেটাও নিস্তেজ হয়ে গেছে। নড়ছে না। ঘনঘন নিশ্বাস একেকটা। তাকে এ রাজ্যের রাণী বানিয়ে ত্রিস্তান কি ঘুমিয়ে গেছে? এত তাড়াতাড়ি? অথচ একটু আগেও তাকে ধরে বেঁধে বিছানায় বসিয়ে বিরাট হাই তুলে বলেছিল, “হামি দিচ্ছি বলে ভেব না, ঘুমাবো। শুধু একটু কোলে মাথা রাখতে চাচ্ছি। বউয়ের কোলে নাকি মায়ের মতো আরাম আছে! আছে নাকি? তুমি কিছু জানো?”
বলতে বলতে অটবীর কোলে মাথা রাখলো ত্রিস্তান। পরপরই চোখ-মুখ কুঁচকে নিজেই আবার আশ্চর্য হয়ে বললো, “আরেহ্! তুমি জানবে কিভাবে? তোমার তো আবার বউ নেই।”
অল্প হেসে উঠলো অটবী। তার সত্যিই কোনো বউ নেই। কিন্তু একটা গম্ভীর প্রকৃতির ফাজিল বর আছে। যে আর কিছু পারুক আর না পারুক, অটবীকে জ্বালাতে খুব পারে!
—“ত্রিস্তান? উঠবেন না?”
মিহি কণ্ঠের ডাক। ত্রিস্তান নিশ্চুপ, স্থির। নিশ্বাসের গতি আস্তে আস্তে গভীর হচ্ছে। চোখে-মুখে অকৃত্রিম বিষাদ, তবু কোথাও যেন ক্ষণিকের প্রশান্তির ছায়া। একটু কি শুকিয়েছে লোকটা? হ্যাঁ, আগের চেয়ে স্বাস্থ্য কম কম লাগছে। ঠোঁট শুষ্ক, চুল রুক্ষ, চোখের নিচে বিশ্রী কালো কালির ছড়াছড়ি। বড়োবড়ো ঘন পাঁপড়ির আড়ালে থাকা কালো দাগটুকু আলতো আঙুলে স্পর্শ করলো অটবী। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো লোকটার সারা মুখ। কপাল থেকে নাক, নাক থেকে ঠোঁট, ঠোঁট থেকে আবার কপাল! ত্রিস্তান যেন একটু বিরক্তই হলো এতে। এতক্ষণ পর সামান্য নড়েচড়ে উঠলো। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আওড়ালো, “জ্বালিও না, অরণ্য। আমি একটা তুমি তুমি স্বপ্ন দেখছি।”
চোখের সামনে খুলে রাখা জানালা। গাছের পাতার দুলোদুলি ক্ষীণ কমেছে। সময় গড়াচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘড়ির টিকটক শব্দের যে কি তীব্রতা! অটবী একপলক ত্রিস্তানকে দেখলো। লোকটা তার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে আছে। সরবার কিংবা নড়বার জোটুকুও নেই। পাশের টেবিলে কিছু কেক আর বিস্কুট পরে আছে। একটু আগে যদিও ত্রিস্তানের হাতে সে ভাত খেয়েছিল। কিন্তু এখন আবার ক্ষুধারা ঝগড়ায় মেতেছে। কিছু না খেলে চলবে না। অল্প ঝুঁকে কেক নিতে গিয়ে অটবীর হঠাৎ খেয়াল হলো, টেবিলের একদম শেষ প্রান্তে তিনটে বই সোজাসোজি করে রাখা। অটবী কেক মুখে পুরলো। খেতে খেতে বইগুলো হাতে নিলো। তিনটের মধ্যে দুটো বাংলা বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের। তৃতীয় নম্বরটা কোনো বই না, ডায়েরী। কাঠের কভারে খাঁদ কেটে ইংরেজীতে লিখা ‘Shukhneel Tristan’।
মনে মনে কৌতূহলের দানা জট পাকালো। ডায়েরীর ভেতরের রহস্য জানতে বড় সাধ জাগলো অটবীর। দ্বিধাদ্বন্দে ডায়েরী খুললোও। পৃষ্ঠা উল্টালো। পৃষ্ঠাগুলোও কেমন যেন। কুঁচকানো, ভাঁজ ফেলা। কিছু কিছু লেখা ঝাপসা। যেন পানি লেগে কুঁচকে গেছে, লেখা মুছে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় আবার রক্তের ফোঁটা ফোঁটা দাগ। অটবীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, রক্তগুলো ত্রিস্তানের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে লেখাগুলোয় চোখ বুলালো,
‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কিছু ভুলে যাচ্ছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। নিজের নামটাও আজকাল মনে থাকে না। ভুলে যাই। রাতে ঘুমাতেও খুব অসুবিধে হয়। বিশ্রী বিশ্রী স্বপ্ন আসে। মাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে, তনয়াকে নিয়ে! বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এমন হচ্ছে। আমার মনে হয়, আমি খুব খারাপ কিছু করেছি। নয়তো তারা মারা যাওয়ার পরই এমন বাজে স্বপ্ন দেখছি কেন?
স্বপ্নের ওই সুখনীল ত্রিস্তান আমি নই। আমি ওরকম খারাপ হতেই পারি না। আমি তো আমার মায়ের রাজপুত্র, বাবার গর্ব, বোনের ভরসা। তাহলে স্বপ্নে ওমন দেখায় কেন? ডাক্তারও আজেবাজে কথা বলছেন। আমি নাকি নাটক করছি! আশ্চর্য! আমি কি অভিনেতা? আমি কেন নাটক করবো? আমার সত্যি কিছু মনে নেই। মাঝে মাঝে যা মনে আসে, সব ঝাপসা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু মায়ের অশ্রুসিক্ত মুখটা দেখতে পাই। মা-টা আমার এত হাহাকার করে কাঁদছিল!
মাথা ব্যথাটাও আজকাল বেড়েছে। কিচ্ছু সহ্য করতে পারিনা। তনয়া আশেপাশে সারাদিন ঘুরঘুর করে, বিরক্ত করে। আমার তখন ইচ্ছে করে ওকে…..’
অটবী থামলো। এরপরের লাইন দুটোয় অনেক কাটাছেঁড়া। চেষ্টা করেও পড়া যাচ্ছে না। হাতের তিনটে আঙুল ফাঁক রেখে গুটিগুটি অক্ষরে ত্রিস্তান আবার লেখেছে,
“আমার নাক দিয়ে সময়ে অসময়ে রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, এটা কোনো ব্যাপার না। আমার অতিরিক্ত চিন্তা আর অসুস্থতার কারণেই এমন হচ্ছে। চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাওয়া অতীতগুলো হয়তো ফিরে আসবে একে একে। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি জানি, আমি খুব খারাপ কিছু করেছি। এই জানাজানিটা এটুকুতেই থাক। আমি এতেই ভালো আছি। সারাজীবন এই রোগ বয়ে বেড়াতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু ভালো থাকতে চাই। একটুখানি শান্তি চাই। আমার কেন যেন মনে হয়, অতীত জেনে গেলে আমার আর ভালো থাকা হয়ে উঠবে না। আমি মরে যাবো। শেষ হয়ে যবো।”
সম্পূর্ণ ডায়েরীটা ফাঁকা। আর কিছু লেখা নেই। স্তব্ধ অটবী ডায়েরী রেখে দিলো। আগে যেমনটা রাখা ছিল? তেমন ভাবেই। সদর দরজায় কারাঘাত শোনা যাচ্ছে। অটবীর মনে পরলো, সে আসবে বলে সরোজ আর তনয়াকে আগেই বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছিল ত্রিস্তান। তারা বোধহয় এসে গেছে। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো সে। রোধ হওয়া কণ্ঠে জোড় লাগালো, “ত্রিস্তান? উঠুন। আমাকে এখন চলে যেতে হবে।”
–
বাসায় আসা মাত্রই রেবা বেগমের মুখোমুখি হলো অটবী। থমকালো। ভেবেছিল, তিনি আরও একবার চিৎকার চেঁচামেচি করবেন, মারবেন! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তিনি কিছুই বললেন না। চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেলেন। ক্লান্ত অটবী নিজেও বাম পাশের রুমটায় চলে গেল। পৃথা তখন ওঘরেই ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে ভিডিও দেখছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। অটবীকে দেখা মাত্রই হাসি থেমে গেল। মুখটা এমন ভাবে বিকৃত করলো যেন অটবীকে নয়, ভীষণ বিরক্তিকর কিছু দেখে ফেলেছে সে। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই অটবী ডেকে উঠলো, “পৃথা, দাঁড়া।”
পৃথা দাঁড়ালো। প্রচন্ড অনিচ্ছায়। অটবী আবার বললো, “এদিকে ফির। তোর সাথে কথা আছে।”
—“কি বলবা এভাবে বলো। আমি শুনছি।”
পৃথার হাতে দামি অ্যান্ড্রয়েড ফোন। আলমারিতে সামলে রাখা মুশফিকের সেই ফোনটা! যেটা অটবী কয়েকদিন আগেও খুঁজে পাচ্ছিল না। এটা তবে পৃথার কাছে ছিল!
—“তুই আমাকে না বলে ফোনটা নিয়েছিস কেন, পৃথা?”
পৃথার দায়সারা উত্তর, “আমার লাগবে এজন্য নিয়েছি। এখন কি তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?”
—“অবশ্যই দিতে হবে। জিনিসটা আমার, পৃথা। যেখানে আমি ফোনটা কখনো ধরে দেখেনি সেখানে তুই ধরেছিস কোন সাহসে?”
—“প্রেম করার জন্য নিয়েছি। হয়েছে তোমার?”
অটবীর ইচ্ছে হলো, খুব করে পৃথার গালে একটা চড় লাগিয়ে দিতে। ইচ্ছেটা বহুকষ্টে দমিয়ে নমনীয় হতে চাইলো, “দেখ পৃথা, বোঝার চেষ্টা কর। কাদিন ছেলেটা ভালো না।”
—“সেটা তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। নিজের চরকায় গিয়ে তেল দাও।”
পৃথা ধুপধাপ পায়ে চলে গেল। সম্ভবত মায়ের ঘরে। নলী কটমট দৃষ্টে তা দেখলো মাত্র। এ মেয়ে অনেক বাড় বেড়েছে। আগে সরোজের জন্য তাকে কত কিছু বলতো। আর এখন দেখ! নিজে হয়েছে হার বেয়াদব! অসভ্য!
পড়ার টেবিল থেকে উঠে অটবীকে জড়িয়ে ধরলো নলী। কোমল গলায় বললো, “তুমি ওর কথায় কষ্ট পেও না, আপা। ও বখে গেছে। শিক্ষা পেলেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখ না, আমি ওর সাথে কথা বলছি না? তুমিও বলো না।”
অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকে চাপা তীব্র বেদনার দীর্ঘশ্বাস! ঢিমানো কণ্ঠে বললো, “তোরা কেউই তো আমার কথা শুনিস না, নলী।”
নলী যেন বুঝলো না। অবুঝ গলায় শুধালো, “আমি আবার কোন কথা শুনিনি?”
—“সরোজ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। শুনেছিস?”
হাতের বাঁধন ঢিলে হলো। এক কদম সরে দাঁড়ালো নলী। অবাক হলো, “তুমি জানতে?”
অটবী জবাব দিলো না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। আশপাশে এত রহস্য! উদাসীনতা! মন খারাপ! কোথাও অল্প সুখের রেশ নেই।
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা