অটবী সুখ পর্ব-২৬+২৭

0
506

অটবী সুখ

২৬.
বাহিরে তখন রাত বেশ। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে বারোটার ঘর পেরিয়েছে। চারপাশে সুনসান নিরবতা। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায়, সবটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ত্রিস্তান ইচ্ছে করেই বাড়ির পেছনে কোনো বাতি লাগায়নি। কেন যেন এই অন্ধকারটুকু তার ভালো লাগে। মনে হয়, প্রতিনিয়ত এই আঁধারই তাকে তার অস্তিত্বের সাথে বেঁধে রাখছে। তার জীবনের কালো অধ্যায়গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বারান্দার একপাশে খাতা, কলম দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ত্রিস্তান। কারেন্ট থাকা সত্ত্বেও দুটো মোম জ্বালালো দু’পাশে। আধো আলোয় খাতার মাঝখান থেকে একটা পৃষ্ঠা বের করে ইংরেজি অক্ষরে দাগ কাটতে শুরু করলো, “Things are getting more difficult. I messed up everything. I can’t let go and I also can’t hold on. Why the hell this things are so complicated? My intention was to leave that girl after spending some time with her. But why can’t I leave now? Why can’t I step back from my unknown feelings? It seems like everything is out of reach.
I feel bored. I feel like I’m lying in a dark grave, badly waiting for the death. I think, It would be better if I died. Otherwise I will not be able to leave her, whom I guess I give my everything. Maybe my heart also?”

বাকিটুকু আর লিখা হলো না। দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। ত্রিস্তান দরজা না খুলেই বুঝে গেল, এটা সরোজ। নয়তো এত রাতে কেই-ইবা আসবে এখানে?
দরজা খুলে সরোজের দিকে শান্ত চোখে তাকালো ত্রিস্তান। জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

সরোজ ততক্ষণে অন্ধকার ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারছে না। এত বিশ্রী রকমের কালো ভেতরটা! বারান্দা দিয়ে যদিও হলদেটে আলো আসছে! তবুও মাথায় ‘ভূতুড়ে ঘর’ ছাড়া আর কোনো শব্দ এলো না সরোজের। কপাল কুঁচকে বললো, “কারেন্ট তো আছে! তারপরও এমন ভূতের মতোন কইরা রাখছো ক্যান ঘরডা?”

ত্রিস্তান অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো, “মাথা ব্যথা করছিল… কি জন্য এসেছিস সেটা বল।”
সরোজ কথা বাড়ালো না। হাতের বাটি-টা ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিলো চুপচাপ। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাত খাইছিলা?”
—“পরে খাবো।”
সরোজ চলে যাওয়ার পূর্বে আবারও একই ভাবে বললো, “তুমি কিন্তু রাতে ভাত খাইতেছো না ইদানিং। খাওয়া লইও ভাই। ভাতডা খালি ফ্রিজে রাখছি। গরম কইরা লইও।”

সরোজ চলে গেছে অনেক্ষণ। ত্রিস্তান দরজা আটকে নিরব বসে আছে বারান্দায়। জ্বলন্ত মোম দুটো এখন বন্ধ। বাতাস প্রচন্ড রকমের আনাগোনা শুরু করেছে। ওতেই বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ত্রিস্তানের এসবে খেয়াল নেই। রক্তের বাটি-টা ওইযে, ডানপাশের খালি জায়গায় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে সে। কিছু ভাল্লাগছে না তার। আজকাল পাতালঘরেও যেতে ইচ্ছে করে না। ব্যক্তিটির ঘৃণ্য সৃষ্টি এত পোড়ায়! এত অসহ্য লাগে! অসহ্য দমবন্ধকর অনুভূতি বারংবার করে মনে করিয়ে দেয়, সে একা। খুব, খুব, খুব একা।

আলতো দীর্ঘশ্বাসগুলো যখন মিলেমিশে ক্লান্ত, ঘুমে যখন চোখ অবাধ্য, যখন পুরো শরীরটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেকে একাকার, তখন চোখ বোজা মাত্রই একটা নাম মস্তিষ্কে হানা দিয়ে উঠলো ত্রিস্তানের। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে খুব অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো, “অটবী…”

শনিবার। দুপুর তিনটে।
গরমে ঘেমে একাকার হয়ে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরছে অটবী। পা যেন আর চলছে না। কপালের ঘামগুলো গলা ছুঁচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, সে পৃথাকে দেখেছে। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও সন্দেহ মেটাতে একটু আশেপাশে তাকাতেই সন্দেহটা আরও প্রবল হলো তার। একটু এগোতেই বুঝতে পারলো, ওটা আসলে পৃথাই। সকালে এভাবেই সাদা ফিতা দিয়ে দু’বেণী করে দিয়েছিল বোনকে। হাতে সেই একই কালো ব্রেসলেট, স্কুল ড্রেস! অটবীর বুকটা ধুপধাপ করে কাঁপলো। পৃথার সাথে ওই ছেলেটাকে? এত ঘনিষ্ট হয়ে কি করছে ওরা? একে অপরকে চুমু দিচ্ছে? অটবী দ্রুত পা চালালো। বাজারের ব্যাগটা যে তার হাত থেকে পরে গেছে, সে খেয়াল আপাতত নেই। পৃথার কাছাকাছি এসেই সর্বপ্রথমে একটা মারাত্বক চড় লাগালো অটবী। কণ্ঠ চিড়ে ধমকালো, “স্কুল বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস পৃথা? এজন্য তোকে স্কুলে পাঠাই আমি।”

বলতে বলতে ছেলেটার দিকে তাকালো অটবী। হাহ! যা ভেবেছিল তাই! এলাকার গুণধর কাদিন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে মুখে কি ভীষণ বিরক্তি!
অটবী রাগে কাঁপতে লাগলো, “আমার বোনের সাথে এসব করার সাহস পাও কোথায় তুমি? তোমার মাকে আমি এক্ষুণি গিয়ে বলব। অনেক বেড়ে গেছো তুমি!”

কাদিন যেন একটুও পাত্তা দিলো না অটবীকে। দায়সারা ভাবে বললো, “আমার মাকে বলার আগে নিজের বোনকে সামলান। আপনার বোনই আগে এসেছিল আমার কাছে, আমি না।”

অটবী বড় বড় চোখে পৃথার দিকে তাকালো এবার। পৃথা কাঁদছে কম, রাগে ফুঁসছে বেশি। আশেপাশে এত মানুষ! তার বোনের কি একটুও জ্ঞান বুদ্ধি নেই? মানুষ প্রেম করতেই পারে। তাই বলে এত চিল্লাবে?

—“কাদিন কি সত্যি বলছে, পৃথা?”
পৃথা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো যেন, “সত্যি বললে কি? মারবা আমাকে?”

অটবী থমকালো, চমকালো। ভীষণ অবাক হলো পৃথার আচরণে। পৃথা থেকে সে এমন জবাব আশা করেনি। তারচেয়েও বেশি অপমান লাগলো, যখন কাদিন তাকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো! অটবী আর দেড়ি করলো না। পৃথার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাসায়। পুরো রাস্তায় পৃথা অনেকবার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অটবী ছাড়েনি। বাসায় আসা মাত্র রেবা বেগমও পৃথাকে এভাবে টানার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। অটবী তারও উত্তর দেয়নি। পৃথাকে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে।

নলী তখন ঘুমাচ্ছিল। তার গায়ে ১০১ জ্বর। স্কুলে যায়নি আজকে। ভেবেছিল আরাম করে আজকে সারাদিন ঘুমাবে। কিন্তু বিধিবাম! জোড়ে দরজা লাগানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। রাগান্বিত অটবীকে দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালেও, পৃথাকে কাঁদতে দেখে চটজলদি উঠে বসলো সে। অবাক হয়ে সুধালো, “কি হয়েছে, বুবু?”

অটবী এবারও নিরুত্তর। পৃথার দিকে তাকালেই তার রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। স্বাভাবিক হতে চাইলো, “এমন কেন করলি পৃথা? তোকে আমি বুদ্ধীমান ভাবতাম! অথচ… এত অশ্লীলতা! তোকে এসব শিখিয়েছি আমি?”

পৃথা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো আবার। ভীষণ জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “করেছি তো কি হয়েছে? তুমি করোনা? আর অশ্লীল কাকে বলছো? চুমু খেলেই অশ্লীল হয়ে গেল? তুমি কাও নি যেন? তোমার ত্রিস্তানের সাথে কত কি করেছো আমি জিজ্ঞেস করেছি ক…”

পূর্বেই আরেকটা চড় মারলো অটবী। তবে এবার খানিকটা জোড়ে।
কণ্ঠ রোধ হয়ে আছে তার। মাথার যন্ত্রণায় সবটা আবছা লাগছে। অটবী এই পৃথাকে চেনে না। তার সহজ-সরল, একটুখানি বুদ্ধিমতি বোনটা কোথায়? কোথায় চলে গেল? মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই নলী দৌঁড়ে এসে ধরলো বোনকে। বিছানায় বসালো। পৃথা ততক্ষণে দরজা খুলে চলে গেছে। একবারও বোনের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকায়নি। ব্যাপারটায় ভীষণ ধাক্কা খেল অটবী। নলীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে সুধালো, “পৃথা কখন এমন হয়ে গেছে, নলী?”

নলী জবাব দিতে পারলো না। সে কি বলবে? তার নিজেরই পৃথাকে দেখে অবাক লাগছে।

পৃথার সঙ্গে বাকবিতর্কতার পরপরই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছিল অটবী। হঠাৎ শক্ত করে কেউ হাত টেনে উঠে বসাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখদুটো আধো আধো করে মেলার আগেই গাল ব্যাথায় টনটন করে উঠলো যেন। কানে কিচ্ছুক্ষণ কিচ্ছু শুনতে পেল না অটবী। এরপর সম্বিৎ ফিরতেই বুঝতে পেল, রেবা বেগম খুব গালাগালি করছেন তাকে। খুবই বিশ্রী গালি। ক্রোধে অন্ধ হয়ে চেঁচাচ্ছেন, “কাকে জিজ্ঞেস করে তুই একা একা বিয়ে করেছিস? এত সাহস কোথায় পেয়েছিস তুই?”

___________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৭.
আজকের সকালটা মোটেও সুন্দর ছিল না। বিকাল হতে হতে তা একেবারে বিদঘুটে হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠা ঠা শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। একটুখানি শীতলতা শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। অথচ এই বৃষ্টির কোথাও একটু ভালো লাগা নেই। নেই একটু শান্তির সন্ধান। ত্রিস্তান আস্তে করে রান্নাঘরের জালানা লাগিয়ে দিলো। ফ্রিজ খুলে সরোজের আনা রক্তের প্যাকেট দুটি রাখতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে ওই থকথকে, লাল তরলটার দিকে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো, হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ণ ব্যথা হলো। মনে পরে গেল, পুরো দিনগুলোর কথা। তার নিজের ছেলেবেলার কথা।

ত্রিস্তানের বয়স তখন কতই বা হবে? ত্যারো কি চৌদ্দ? খুব একটা বোঝার বয়স না। হাসি খুশি পরিবারের সে ছিল মধ্যমণি। সারা ঘর টইটই করে বেড়াতো। প্রায়ই দেখতো, তার বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজে রাখছেন। সাদা ঝকঝকে কাঁচের বোতলে টকটকে লাল রঙের তরল পানীয়র মতো কিছু। ত্রিস্তানের ছোট বয়স। বুক ভরা হাজারটা আগ্রহ আর কৌতূহল। তার বাবা তাকে না জানিয়ে কি এমন মজার জিনিস তার থেকে লুকিয়ে রাখছেন, সে কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারতো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যেত না। তিনি শুধু বলতেন, “ওগুলো বড়দের জিনিস। ছোটদের দেওয়া যাবে না।”

অথচ ত্রিস্তানের ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমবার নয়। এক দানব কণ্ঠ যেন তাকে বারবার বলছিল, “নাহ্! ওটা কি আমাকে জানতেই হবে!”
সেই মনোবল থেকেই একদিন রাত্রিবেলা লুকিয়েচুরিয়ে সেই লাল টকটকে তরল খেয়ে ফেলেছিল ত্রিস্তান। রক্তের স্বাদ…. মানুষের রক্তের কি-না জানা নেই, তবে স্বাদটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ত্রিস্তানের। একটু নোনতা, প্রচুর পানসে, ভীষণ বিশ্রী খেতে।

আচমকা সরোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। সরোজ উদ্বীগ্ন কণ্ঠে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে পা রাখার আগেই ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই সরোজ বলে উঠলো, “কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে ত্রিস্তান ভাই।”

রান্নাঘরের চুলার দিকটা অগোছালো। চিনির পট, লবণ-মরিচের পট এলোমেলো করে রাখা। সেগুলো গোছাতে গোছাতেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
—“তোমার শ্বাশুড়ি, মানে হইলো গিয়া অটবী আপুর মা… হে তো বিয়ার খবর সব জাইনা গেছে।”

ত্রিস্তানের হাত থমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই আগের মতোই আবার বললো, “তুই কিভাবে জানিস এতকিছু? তোকে তো আজকে সারাদিন ঘর থেকে বের হতে দেখিনি।”
—“ওইযে? নলীরে কয়েকদিন আগে একখান মোবাইল কিন্না দিলাম না? একটু আগে ফোন কইরাই সব ঘটনা কইলো।”
এরপর একটু থেমে আবার বললো, “এহন কি করবা, ভাই? আন্টি নাকি অটবী আপুরে অনেক বকছে। মারছেও নাকি!”

ত্রিস্তান এবার আর জবাব দিলো না। ভেতরকার ভারী নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইলো। শান্ত রাখতে চাইলো। কিন্তু নাহ্! সবকিছু ঘুরে ফিরে ওই অশান্তি, অস্বাভাবিকের মাঝে গিয়েই ঠেকছে। এত অসহ্য লাগছে সব! এত বিশ্রী ঠেকছে! আর বুঝি সে অটবী নামক দূর্বলতা থেকে ছুটতে পারলো না? একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেই গেল?

তখন মাত্র সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। বৃষ্টি শেষে পশ্চিম আকাশে মনোমুগ্ধকর কমলাটে রঙ। সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাঁদমামা উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন সূর্য পুরোপুরি উবে যাবে! কখন সে দৃশ্যমান হবে!
অটবী তখন জানালার ধারে বসে চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি দেখছিল। মুখ তার মলিন, চোখের শিরা-উপশিরা কান্নার দরুণ ক্ষীণ লাল। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর লম্বাটে দাগ স্পষ্ট গালে গেঁথে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাকে শান্ত দেখালেও ভেতরটা তার অস্থির। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণায় কেমন কেমন যে করছে! ফেঁটে যাচ্ছে একদম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজার দিকে আরেকবার তাকালো অটবী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। একটু একা থাকতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না। কোলাহলে, কলরবে মনে হচ্ছে, যেন সে একটা বিস্তর যানজটপূর্ণ রোডে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালা গলিয়ে একজন ড্রাইভার একজন রিকশাচালককে খুব গালাগাল করছে। ঠিক যেমনটা রেবা বেগম এখন করছেন অটবীকে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, দরজার ওপাশ থেকে অবিরাম বকাবকি করছেন তিনি। দু’চারটে হৃদয়বিদারক কথার বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অনায়াসে! অথচ এদিকে যে অটবীর প্রাণটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এর খেয়াল আছে কারো? নেই… অটবী একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আসলেই কেউ নেই।

অটবী সবে মাত্র জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সরব, কপালে উষ্ণ এক ছোঁয়া পেতেই চট করে চোখ মেললো। নজর সামনে তুলতেই দেখলো, ত্রিস্তান! তার সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে…
অটবীর ঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ দিকে। এদিকটা সচরাচর নির্জন, নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। খানিকটা জঙ্গলের মতো। ত্রিস্তানের এদিকে আসতে পারার কথা না। সে আসলো কিভাবে?
কণ্ঠে বিহ্বলতা নিয়ে অল্পসল্প ভাঙ্গা স্বরে অটবী সুধালো, “আপনি এখানে কিভাবে? কিভাবে এসেছেন?”
—“নলী হেল্প করেছে।”
—“নলীকে কোথায় পেলেন?”
—“কোথায় পাবো?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের শক্ত বাম হাতটা অটবীর নরম গালে কোমলভাবে স্পর্শ করলো।

—“কেন এসেছেন, ত্রিস্তান? কেউ দেখে ফেললে?”
—“কেউ দেখেনি।” ত্রিস্তান অদ্ভুত আচরণ করছে। তার বুড়ো আঙুল অপরিচিত ভাবে স্পর্শ করছে তাকে। গালের রক্তজমাট বাঁধা জায়গা থেকে শুরু করে চোখের পাতার নিচ অব্দি যত্নের সঙ্গে আঙুল বোলাচ্ছে ত্রিস্তান। চোখদুটোর দৃষ্টি অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম। এমন ত্রিস্তানকে অটবী আগে কখনো দেখেনি। এত গভীর নয়নে ত্রিস্তান কখনো অটবীকে পরখ করেনি।

—“অটবী… এত কেঁদেছ কেন?”
এবার ফোলা চোখের পাতায় আঙুল চালালো ত্রিস্তান। আলতো স্পর্শে কাহিল করে দিলো অটবীকে। অটবীর বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে তার একলা সময়ে কাউকে কাছে পেয়ে চোখ বেয়ে অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়ালো। সাথে সাথে সেই জল মুছে নিলো ত্রিস্তান। ঢিমে স্বরে বললো, “এত কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ?”

কথাটা গালের লাল অংশে আঙুল বুলিয়ে বললো ত্রিস্তান। এর অর্থ হয়তো এটাই, চড়টা বেশি জোড়ে লেগেছে কি-না। কিন্তু অটবীর তো শুধু গালে ব্যথা লাগেনি। তার মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মায়ের রুঢ় আচরণ, বোনের হঠাৎ পরিবর্তন— সব কিছু তার হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে তাকে।
ত্রিস্তানের প্রশ্নের উত্তরে অটবী জোড়েজোড়ে মাথা দুলালো। হ্যাঁ, তার ব্যথা লেগেছে। অনেক! অনেক! অনেক!

ত্রিস্তান আলতো তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। লবণ পানিতে প্রেয়সীর গাল আবারও ভিঁজে আসতেই কাছাকাছি হলো সে। চুমু খেল দু’গালে, দু’চোখে, নাকে আর কপালে! এরপর একটু থামলো ত্রিস্তান। যত্ন করে অটবীর কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আরেকদফা তপ্ত নিশ্বাস নস্যি করে উঁড়িয়ে দিলো বুকের মধ্যখান থেকে। অল্পক্ষণ অটবীর রক্তিম ঠোঁটটাকে দেখে হঠাৎ করেই অধরে-অধর মেলালো সে। এত আদুরে ভাবে! এত অধৈর্য হয়ে! অটবী ভয়ানক অনুভূতিতে পিসে যাচ্ছিল। তার দু’হাত কখন যে ত্রিস্তানের কলার জড়িয়ে ধরেছে, খেয়াল নেই। ত্রিস্তান সাবধানে অটবীর গালের দু’পাশ ধরে আছে। ওভাবেই কাছে টানলো ওকে। অটবী স্পষ্ট টের পেল, একটা মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রাণশক্তি রোধ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে তুলছে। কিসের সুবাসটা ওটা? তাদের একটু দূরে থাকা বেলী গাছগুলোর? হতে পারে!

তারা ওভাবে কতক্ষণ ছিল, অটবীর জানা নেই। তবে আকাশের কমলাটে রঙ এখন একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিপাশ। ঘরের বাতি জালানো নেই বিধায় অটবী ত্রিস্তানকে তেমন করে দেখতে পারছে না। শুধু অনুভব করতে পারছে, লোকটা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান থেকে জানালার উচ্চতা বেশি নয়। বরং ত্রিস্তানকেই লম্বা লাগছে। জানালাটা তার বুক অব্দি আসে।

—“কোথায় যাচ্ছো?” ত্রিস্তান বললো, শীতল কণ্ঠস্বরে।
অটবী ঘরের বাতি জ্বালাতে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “লাইট জ্বালাতে চেয়েছিলাম।”
—“প্রয়োজন নেই।”

ত্রিস্তানের অদ্ভুত আচরণের পালা তখনো শেষ হয়নি। তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে তখনো অটবীর একেকটা হাতের আঙুল।

—“তোমার চোখে আমি কতটুকু ভালো, অটবী? কতটুকু ভালো মনে করো আমায়?”
—“হু?” অটবী যেন বুঝলো না, “আপনি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছেন কেন?”

ত্রিস্তান সে কথার উত্তর দিলো না। আস্তে করে বললো, “আমি যদি কালকে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাই, সমস্যা হবে অটবী?”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো, “ক-কোথায় নিয়ে যাবেন?”

—“আমার কাছে। একেবারের জন্য।”

কথাটা শোনা মাত্রই ত্রিস্তানের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো অটবী।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৭.
আজকের সকালটা মোটেও সুন্দর ছিল না। বিকাল হতে হতে তা একেবারে বিদঘুটে হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠা ঠা শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। একটুখানি শীতলতা শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। অথচ এই বৃষ্টির কোথাও একটু ভালো লাগা নেই। নেই একটু শান্তির সন্ধান। ত্রিস্তান আস্তে করে রান্নাঘরের জালানা লাগিয়ে দিলো। ফ্রিজ খুলে সরোজের আনা রক্তের প্যাকেট দুটি রাখতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে ওই থকথকে, লাল তরলটার দিকে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো, হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ণ ব্যথা হলো। মনে পরে গেল, পুরো দিনগুলোর কথা। তার নিজের ছেলেবেলার কথা।

ত্রিস্তানের বয়স তখন কতই বা হবে? ত্যারো কি চৌদ্দ? খুব একটা বোঝার বয়স না। হাসি খুশি পরিবারের সে ছিল মধ্যমণি। সারা ঘর টইটই করে বেড়াতো। প্রায়ই দেখতো, তার বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজে রাখছেন। সাদা ঝকঝকে কাঁচের বোতলে টকটকে লাল রঙের তরল পানীয়র মতো কিছু। ত্রিস্তানের ছোট বয়স। বুক ভরা হাজারটা আগ্রহ আর কৌতূহল। তার বাবা তাকে না জানিয়ে কি এমন মজার জিনিস তার থেকে লুকিয়ে রাখছেন, সে কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারতো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যেত না। তিনি শুধু বলতেন, “ওগুলো বড়দের জিনিস। ছোটদের দেওয়া যাবে না।”

অথচ ত্রিস্তানের ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমবার নয়। এক দানব কণ্ঠ যেন তাকে বারবার বলছিল, “নাহ্! ওটা কি আমাকে জানতেই হবে!”
সেই মনোবল থেকেই একদিন রাত্রিবেলা লুকিয়েচুরিয়ে সেই লাল টকটকে তরল খেয়ে ফেলেছিল ত্রিস্তান। রক্তের স্বাদ…. মানুষের রক্তের কি-না জানা নেই, তবে স্বাদটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ত্রিস্তানের। একটু নোনতা, প্রচুর পানসে, ভীষণ বিশ্রী খেতে।

আচমকা সরোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। সরোজ উদ্বীগ্ন কণ্ঠে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে পা রাখার আগেই ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই সরোজ বলে উঠলো, “কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে ত্রিস্তান ভাই।”

রান্নাঘরের চুলার দিকটা অগোছালো। চিনির পট, লবণ-মরিচের পট এলোমেলো করে রাখা। সেগুলো গোছাতে গোছাতেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
—“তোমার শ্বাশুড়ি, মানে হইলো গিয়া অটবী আপুর মা… হে তো বিয়ার খবর সব জাইনা গেছে।”

ত্রিস্তানের হাত থমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই আগের মতোই আবার বললো, “তুই কিভাবে জানিস এতকিছু? তোকে তো আজকে সারাদিন ঘর থেকে বের হতে দেখিনি।”
—“ওইযে? নলীরে কয়েকদিন আগে একখান মোবাইল কিন্না দিলাম না? একটু আগে ফোন কইরাই সব ঘটনা কইলো।”
এরপর একটু থেমে আবার বললো, “এহন কি করবা, ভাই? আন্টি নাকি অটবী আপুরে অনেক বকছে। মারছেও নাকি!”

ত্রিস্তান এবার আর জবাব দিলো না। ভেতরকার ভারী নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইলো। শান্ত রাখতে চাইলো। কিন্তু নাহ্! সবকিছু ঘুরে ফিরে ওই অশান্তি, অস্বাভাবিকের মাঝে গিয়েই ঠেকছে। এত অসহ্য লাগছে সব! এত বিশ্রী ঠেকছে! আর বুঝি সে অটবী নামক দূর্বলতা থেকে ছুটতে পারলো না? একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেই গেল?

তখন মাত্র সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। বৃষ্টি শেষে পশ্চিম আকাশে মনোমুগ্ধকর কমলাটে রঙ। সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাঁদমামা উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন সূর্য পুরোপুরি উবে যাবে! কখন সে দৃশ্যমান হবে!
অটবী তখন জানালার ধারে বসে চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি দেখছিল। মুখ তার মলিন, চোখের শিরা-উপশিরা কান্নার দরুণ ক্ষীণ লাল। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর লম্বাটে দাগ স্পষ্ট গালে গেঁথে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাকে শান্ত দেখালেও ভেতরটা তার অস্থির। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণায় কেমন কেমন যে করছে! ফেঁটে যাচ্ছে একদম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজার দিকে আরেকবার তাকালো অটবী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। একটু একা থাকতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না। কোলাহলে, কলরবে মনে হচ্ছে, যেন সে একটা বিস্তর যানজটপূর্ণ রোডে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালা গলিয়ে একজন ড্রাইভার একজন রিকশাচালককে খুব গালাগাল করছে। ঠিক যেমনটা রেবা বেগম এখন করছেন অটবীকে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, দরজার ওপাশ থেকে অবিরাম বকাবকি করছেন তিনি। দু’চারটে হৃদয়বিদারক কথার বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অনায়াসে! অথচ এদিকে যে অটবীর প্রাণটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এর খেয়াল আছে কারো? নেই… অটবী একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আসলেই কেউ নেই।

অটবী সবে মাত্র জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সরব, কপালে উষ্ণ এক ছোঁয়া পেতেই চট করে চোখ মেললো। নজর সামনে তুলতেই দেখলো, ত্রিস্তান! তার সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে…
অটবীর ঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ দিকে। এদিকটা সচরাচর নির্জন, নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। খানিকটা জঙ্গলের মতো। ত্রিস্তানের এদিকে আসতে পারার কথা না। সে আসলো কিভাবে?
কণ্ঠে বিহ্বলতা নিয়ে অল্পসল্প ভাঙ্গা স্বরে অটবী সুধালো, “আপনি এখানে কিভাবে? কিভাবে এসেছেন?”
—“নলী হেল্প করেছে।”
—“নলীকে কোথায় পেলেন?”
—“কোথায় পাবো?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের শক্ত বাম হাতটা অটবীর নরম গালে কোমলভাবে স্পর্শ করলো।

—“কেন এসেছেন, ত্রিস্তান? কেউ দেখে ফেললে?”
—“কেউ দেখেনি।” ত্রিস্তান অদ্ভুত আচরণ করছে। তার বুড়ো আঙুল অপরিচিত ভাবে স্পর্শ করছে তাকে। গালের রক্তজমাট বাঁধা জায়গা থেকে শুরু করে চোখের পাতার নিচ অব্দি যত্নের সঙ্গে আঙুল বোলাচ্ছে ত্রিস্তান। চোখদুটোর দৃষ্টি অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম। এমন ত্রিস্তানকে অটবী আগে কখনো দেখেনি। এত গভীর নয়নে ত্রিস্তান কখনো অটবীকে পরখ করেনি।

—“অটবী… এত কেঁদেছ কেন?”
এবার ফোলা চোখের পাতায় আঙুল চালালো ত্রিস্তান। আলতো স্পর্শে কাহিল করে দিলো অটবীকে। অটবীর বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে তার একলা সময়ে কাউকে কাছে পেয়ে চোখ বেয়ে অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়ালো। সাথে সাথে সেই জল মুছে নিলো ত্রিস্তান। ঢিমে স্বরে বললো, “এত কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ?”

কথাটা গালের লাল অংশে আঙুল বুলিয়ে বললো ত্রিস্তান। এর অর্থ হয়তো এটাই, চড়টা বেশি জোড়ে লেগেছে কি-না। কিন্তু অটবীর তো শুধু গালে ব্যথা লাগেনি। তার মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মায়ের রুঢ় আচরণ, বোনের হঠাৎ পরিবর্তন— সব কিছু তার হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে তাকে।
ত্রিস্তানের প্রশ্নের উত্তরে অটবী জোড়েজোড়ে মাথা দুলালো। হ্যাঁ, তার ব্যথা লেগেছে। অনেক! অনেক! অনেক!

ত্রিস্তান আলতো তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। লবণ পানিতে প্রেয়সীর গাল আবারও ভিঁজে আসতেই কাছাকাছি হলো সে। চুমু খেল দু’গালে, দু’চোখে, নাকে আর কপালে! এরপর একটু থামলো ত্রিস্তান। যত্ন করে অটবীর কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আরেকদফা তপ্ত নিশ্বাস নস্যি করে উঁড়িয়ে দিলো বুকের মধ্যখান থেকে। অল্পক্ষণ অটবীর রক্তিম ঠোঁটটাকে দেখে হঠাৎ করেই অধরে-অধর মেলালো সে। এত আদুরে ভাবে! এত অধৈর্য হয়ে! অটবী ভয়ানক অনুভূতিতে পিসে যাচ্ছিল। তার দু’হাত কখন যে ত্রিস্তানের কলার জড়িয়ে ধরেছে, খেয়াল নেই। ত্রিস্তান সাবধানে অটবীর গালের দু’পাশ ধরে আছে। ওভাবেই কাছে টানলো ওকে। অটবী স্পষ্ট টের পেল, একটা মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রাণশক্তি রোধ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে তুলছে। কিসের সুবাসটা ওটা? তাদের একটু দূরে থাকা বেলী গাছগুলোর? হতে পারে!

তারা ওভাবে কতক্ষণ ছিল, অটবীর জানা নেই। তবে আকাশের কমলাটে রঙ এখন একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিপাশ। ঘরের বাতি জালানো নেই বিধায় অটবী ত্রিস্তানকে তেমন করে দেখতে পারছে না। শুধু অনুভব করতে পারছে, লোকটা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান থেকে জানালার উচ্চতা বেশি নয়। বরং ত্রিস্তানকেই লম্বা লাগছে। জানালাটা তার বুক অব্দি আসে।

—“কোথায় যাচ্ছো?” ত্রিস্তান বললো, শীতল কণ্ঠস্বরে।
অটবী ঘরের বাতি জ্বালাতে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “লাইট জ্বালাতে চেয়েছিলাম।”
—“প্রয়োজন নেই।”

ত্রিস্তানের অদ্ভুত আচরণের পালা তখনো শেষ হয়নি। তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে তখনো অটবীর একেকটা হাতের আঙুল।

—“তোমার চোখে আমি কতটুকু ভালো, অটবী? কতটুকু ভালো মনে করো আমায়?”
—“হু?” অটবী যেন বুঝলো না, “আপনি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছেন কেন?”

ত্রিস্তান সে কথার উত্তর দিলো না। আস্তে করে বললো, “আমি যদি কালকে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাই, সমস্যা হবে অটবী?”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো, “ক-কোথায় নিয়ে যাবেন?”

—“আমার কাছে। একেবারের জন্য।”

কথাটা শোনা মাত্রই ত্রিস্তানের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো অটবী।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে