অটবী সুখ পর্ব-২৪+২৫

0
538

অটবী সুখ

২৪.
রাত ঠিক কত হবে? অটবীর জানা নেই। ঘড়ি দেখা হয়নি। বাসায় এতক্ষণে নিশিরাতের গভীর ঘুমে সবাই। তার বড়োলোকি আত্নীয়দের কেউই তাদের এই ভাঙ্গা বাসায় থাকতে আগ্রহী নয়। বিয়ে ভাঙ্গা পরপরই একরাশ উত্তাপে ভরা সমালোচনার পর যার যার বাসায় চলে গেছে। পরিবেশটা তখন থেকেই গুমোট, নিস্তব্ধ। অটবী পায়ে পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মুখস্ত শিক্ষার্থীর মতো চলে গেল নিজ রুমে। নলী আর পৃথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘোর তন্দ্রায় বিভোর হয়ে আছে। ঘুমানোর ধরনটা এলোমেলো। নিশ্চিৎ এতক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করছিল! ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে গেল অটবী। সুন্দর করে শুইয়ে দিয়ে কাথা টেনে দিলো। এ মেয়ে দুটোর ঘুম আবার ভীষণ ভালো। একবার ঘুমালে প্রচন্ড শব্দেও সহজে ঘুম ছেড়ে উঠে না।

ফোনে তখন অত চার্জ নেই। কোনোমতে লম্বালম্বি বক্সে একদাগ অবশিষ্ট আছে। নষ্ট ফোনে এইটুকু চার্জ পাঁচ মিনিটও ঠিকবে না। কিন্তু ত্রিস্তান বলেছিল, বাসায় ফিরে একটা মেসেজ দিতে। দিবে কি? লোকটা যদি অপেক্ষায় থাকে?
নলীদের পাশের অল্প জায়গায় রয়েসয়ে গা এলালো অটবী। ফোনের কন্টাক্ট লিস্টের টি(T) অক্ষরের ত্রিস্তান নামটি খুঁজে বের করলো চটজলদি। বার্তা পাঠালো, “বাসায় পৌঁছেছেন?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো না। সময় নিলো। অটবীর অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোনে জ্বলজ্বল করলো তিনটি অক্ষরের শব্দ, “এসেছি।”
তারপর আবার টুং করে শব্দ হলো, “এখন কি করছো? বাসার কেউ কিছু বলেছে?”

অটবী দ্রুত টাইপ করলো, “না। সবাই ঘুম।”
—“আচ্ছা।”

এরপর আর কোনো বার্তা এলো না। অটবী অক্লান্ত চোখে পিটপিট করে চেয়ে দেখলো আলো আঁধারিয়া আকাশটাকে। চোখে ঘুম নেই। ফোনটাও ততক্ষণে চার্জের অভাবে প্রাণহীন হয়ে পরে আছে, বদ্ধ হাতের মুঠোয়। অথচ মস্তিষ্কে এক নিদারুণ অলসতা অনুভব করছে সে। কিছু ভাববার অলসতা। ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার অলসতা। সে কি সত্যি ত্রিস্তানের হয়ে গেছে? ত্রিস্তান কি এখন তার? সব এত জলদি জলদি হয়ে গেছে যে অটবীর মনে হচ্ছে, সে বুঝি কোনো কাল্পনিক গল্পের সুখী চরিত্র! চরিত্রটা যদিও খারাপ নয়। অটবী বোধহয় ছোট থেকে এমনই এক সুখ সুখ চরিত্রের সন্ধানে ছিল। সন্ধ্যান পেয়ে যেতেই নিজেকে এখন কেমন নির্ভার, চিন্তামুক্ত লাগছে!

সকাল থেকে রেবা বেগম খুব কম কথা বলছেন। প্রয়োজন ছাড়া তার কণ্ঠনালি গলিয়ে একটা টু শব্দও বেরুচ্ছে না। অটবীর তাই অল্পসল্প মন খারাপ। সকালে সে মুশফিক ছেলেটাকে কল করার চেষ্টা করেছিল। প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ বলছে। মুশফিকের কাছে অটবী যেমন কৃতজ্ঞ, তেমনি ছেলেটার জন্য একটা সুক্ষ্ণ অপরাধবোধও ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। পাশাপাশি এ-ও জানতে ইচ্ছে করছে, শেষ মুহুর্তে ছেলেটা এমন বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেল কেন? ঠিক কি কারণে? অটবীর ওপর প্রবল ঘৃণায়? হতে পারে। অটবী কাজটাই করেছে এমন।

নলী আর পৃথাকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসার পথে ত্রিস্তানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অটবীর। লোকটা মাত্রই জঙ্গলের পথ শেষ করে মেইনরাস্তায় পা দিয়েছে। ভ্রু দুটো কুঁচকানো। খুব বিরক্ত হয়ে ফোনে কি যেন টাইপ করছে। তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কেঁদেছো?”

হকচকিয়ে অটবী উত্তর দিলো, “কই, নাতো!”
—“চোখ ফোলা তোমার।”
—“রাতে ঘুমাইনি। এজন্যই বোধহয়।” বলতে বলতে দু’চোখে একবার হাত ছোঁয়ালো অটবী। আসলেই চোখদুটো ফুলে আছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে মনে হচ্ছে, সে কোনো পানির বল ধরছে। এত ফুললো কখন?

ফোনটা প্যান্টের পকেটে পুরে ত্রিস্তান আবার বললো, “আর কোনো কাজ আছে তোমার? টিউশন বা অন্য কিছু?”
—“মায়ের কথায় টিউশন ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওদের সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি।”
—“অন্য কোনো কাজ নেই বলছো?”
—“নেই।”

ত্রিস্তান এবার কাছাকাছি হলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে অটবীর হাত ধরে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “তোমার কিছু গলার, হাতের কিসব রেখে গেছো বাসায়। নূপুরও দেখলাম। কালকে কি আমাকে বিয়ে করতে এসেছিলে নাকি যুদ্ধ করতে? ওগুলো খুলে রাখলে কখন? খুললে যখন আবার নিয়ে গেলে না কেন?”

অটবী সরু চোখে তাকালো। লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? গতকাল কান্নাকাটির এক পর্যায়ে সে ত্রিস্তানের গায়ে তার চুড়ি খুলে ছুড়ে মেরেছিল। গলার গহনা আর নুপুর তো লোকটার সামনেই খুলেছিল কাজী অফিস যাওয়ার পূর্বে। তাহলে? ‘কখন খুললো’– এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?
অটবী সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো, “আপনার সামনেই তো খুলেছিলাম ওগুলো। চোখ কি তখন আকাশে রেখে এসেছিলেন?”

ত্রিস্তান ততক্ষণে অটবীর হাতে হাত রেখে জঙ্গলের পথে পারি জমিয়েছে। এবারও তার নির্লিপ্ত জবাব, “নাওনি কেন আর?”
—“নেওয়ার সুযোগ ছিল? বিয়ের পর তো বাসাতেই চলে গিয়েছিলাম।”

ত্রিস্তান অটবীর দিকে না তাকিয়েই ভারী নিশ্বাস ফেললো, “ওহ! তাইতো!”

অটবী আশ্চর্য হলো। চূড়ান্ত পর্যায়ের আশ্চর্য, হতবাক, বিমূঢ়! লোকটার আসলে সমস্যা কি? কি চায়? অটবীকে বিরক্ত করতে এত মজা লাগে কেন তার? অটবীর তো মোটেও মজা লাগে না। বরং ত্রিস্তানের জায়গা অন্য কেউ এমন না বুঝে ঝগড়া করলে সে নিশ্চিৎ ওই ব্যক্তিকে দু’গালে দুটো চড় লাগিয়ে দিতো। একেবারে শক্ত হাতের কড়া চড়! ত্রিস্তান বলে বেঁচে গেছে।

সরোজ কিংবা তনয়া কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। ত্রিস্তান অটবীকে সোফায় বসতে বলে রান্নাঘরে এগোতে এগোতে সুধালো, “কি খাবে?”

অটবী বসলো না। ত্রিস্তানের পিছু পিছু রান্নাঘরে ঢুকলো। পরিপাটি রান্নাঘর। এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে উত্তর দিলো, “কিছু খাবো না। খেয়ে বের হয়েছি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “আপনি সরোজকে আর কতদিন এখানে এভাবে রাখবেন? ওকে ওর বাসায় পাঠাচ্ছেন না কেন?”

ত্রিস্তান চপারবোর্ড আর ছুড়ি নিয়ে কি যেন খুটখাট করে কাটছে। উত্তরে আস্তে করে বললো, “ও যেতে না চাইলে আমি কি করতে পারি?”
—“ওর যে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছেন? এমনিতেই পড়তে চায় না।”
—“আমি পড়াচ্ছি ওকে।”

অটবী অবাক হলো খুব।
—“বই-খাতা, এসব কোথায় পেয়েছেন?”
—“চাচা দিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে।”
এপর্যায়ে ধীর অথচ বিশাল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। চাচাকেও এরা হাত করে নিয়েছে। এখন তো তার আর কিছু বলার নেই। সরোজ যদি এখানে থেকে হলেও একটু পড়ালেখা করে, তাও-বা কম কিসের?

ত্রিস্তান এক এক করে পেয়াজ, ধনেপাতা, আলু, চপারবোর্ডে চপচপ করে কাটছে। খুবই দক্ষ হাতে। তার পুরুষালী হাতগুলো এত দ্রুত নড়ছে যে অটবী মনোযোগ সহকারে তাকিয়েও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ প্রত্যেকটার সাইজ এত পার্ফেক্ট! এত নিঁখুত!

ভাবনার অকূল পাথারেই ত্রিস্তান বললো, “অটবী? আমাকে একটু ওখান থেকে দুটো ডিম দাও তো।”

অটবী সাথে সাথে বাম পাশে তাকালো। মাঝারি আকারের একটা ফ্রিজ রাখা। আলতো পায়ে এগিয়ে সে ফ্রিজটা খুলতেই নিচ্ছিল, হঠাৎ তড়িৎ গতিতে আধখোলা ফ্রিজটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান।
অটবী ভয় পেল। চমকিত হয়ে দূরে সরে গেল কয়েক কদম। বিস্মিত নয়নে ত্রিস্তানের দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভীষণ ঠান্ডা চাহনিতে চেয়ে আছে ওরদিকে। শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “ফ্রিজ খুলছিলে কেন?”

অটবী দু’বার চোখের পলক ফেললো, “আপনি… ডিম দিতে বলেছিলেন।”
—“ফ্রিজে ডিম নেই।”
বলতে বলতে ফ্রিজের পাশের ঝুড়ি থেকে দুটো ডিম নিজেই নিলো ত্রিস্তান। অটবী কেমন দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বললো, “ফ্রিজে এমন কি আছে? এমন কেন করলেন আপনি?”

ত্রিস্তান সরে এলো ওখান থেকে। একহাতে পরপর দুটো ডিম ভাঙ্গলো চুলার গরম পাত্রে।
—“কিছু নেই।”
—“আপনি ঘামছেন কেন?”
—“কই ঘামছি?”

অজান্তেই নিজের কপালে হাত ছোয়ালো ত্রিস্তান। নাহ্। লবণাক্ততার ছিঁটেফোঁটাও নেই। অটবী তখন দূর থেকে ত্রিস্তানকে পরখ করছিল। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন, ত্রিস্তান সবসময় তার মুখটাকে এত নির্লিপ্ত করে রাখে! এবারও করে রেখেছিল। কিন্তু ইদানিং কেন যেন ওই অতি স্বাভাবিক মুখটার ভীষণ গভীরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কগুলো অটবী ধরতে পারে। ওই রহস্যময় প্রাচীন গন্ধটা নাকে বার বার বারি খায়। মস্তিষ্কে জট পাকায়। অথচ…. ত্রিস্তান বলেছিল অরণ্যর ভেতর নাকি বেশি রহস্য থাকে? কই? সে তো কষ্টকে দেখছে, হাজারটা রহস্যে মোড়ানো, আষ্টেপৃষ্টে বন্ধী।

—“আমি একটু পর নাস্তা নিয়ে আসছি, অটবী। তুমি ড্রইংরুমে গিয়ে বসো। এখানে গরম।”
—“আমি কিছু খাবো না বলেছি।”
—“তোমার কথা শুনছে কে?”

আবারও! অটবীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও সেই শান্ত দৃষ্টিটা ছুঁড়ে দিচ্ছে ত্রিস্তান। দৃষ্টিটা অটবীর পছন্দ নয়। এই দৃষ্টির কারণেই ত্রিস্তানকে অচেনা লাগে। সমুদ্র সমতুল্য রহস্যময় মনে হয়।

কাল রাত্রির নির্ঘুম, ক্লান্ত, অবসর প্রিয় চোখদুটো ত্রিস্তানের অপেক্ষায় অপেক্ষায় কখন যে সোফাতেই নিস্তেজ হয়ে গেল! অটবীর খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙ্গলো এর ঘন্টাখানেক পরই। চোখে মেলে নিজেকে আর সোফাতে পেল না সে। নরম বিছানায় কারো বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করলো। তার গলায় লোকটা মাথা গুঁজে আছে। অটবীর নিজের হাত দুটোও লোকটার গলা জড়িয়ে, চুলের গভীরে। চুলগুলো এত ঘনকালো! পরনের কুঁচকানো শার্ট, পুরুষালী গঠন দেখে যদিও বোঝা যায়, এটা ত্রিস্তান। কিন্তু অটবী জানে, ত্রিস্তান ছাড়া তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে কে?

অটবী আস্তে করে ডাকলো, “ত্রিস্তান? আপনি কি ঘুমাচ্ছেন? ছাড়ুন আমাকে!”

ওপাশ থেকে জবাব নেই। অটবী মাথা উঁচিয়ে একবার ত্রিস্তানকে দেখে নিলো। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! সে আবার ডাকলো, “ত্রিস্তান! উঠুন!”

ত্রিস্তান নড়লো ক্ষীণ। অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ালো, “জ্বালাচ্ছো কেন?”
—“আমি জ্বালাচ্ছি?”
—“জ্বালাচ্ছোওই তো, অরণ্য। জ্বালিয়ে আমার বুক ব্যথা করে দিচ্ছো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৫.
ত্রিস্তানের ঢিলে হাতদুটো নড়েচড়ে এবার শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে অটবীকে। সে ঘুমের মাঝে কথা বলছিল। প্রয়োজন মাফিক কথাটুকু বলেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। অটবী দু’তিনবার ডাকলেও আর সারাশব্দ পাওয়া যায়নি। বরং ত্রিস্তানের ওই পুরুষালি কঠিন মুখটার নমনীয় হয়ে পরে থাকাটা বেশ লাগছে তার। এত স্নিগ্ধ! এত আদুরে! চোখের পাপড়িগুলোও কি লম্বা! একবার ছুঁয়ে দেখবে কি? অটবী প্রথমে নিজের চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখলো। এরপর কাঁপা হাতে ত্রিস্তানের। পরিমাপ করে দেখলো, নাহ্! ত্রিস্তানের পাপড়িগুলো তার চেয়েও একটু বেশি লম্বা। ঘনও বটে।
কাঁপা আঙুলদুটো আস্তে আস্তে গাল ছুলো। এরপর নাক, চিবুক! ঠোঁটের আশপাশে যাওয়ার সাহস হলো না। দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিলো অটবী। একটু চেষ্টা করতেই ত্রিস্তানের বাঁধন থেকেও ছাড়া পেয়ে গেল। এবার সে কি করবে? চলে যাবে? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো, মাত্র দুপুর তিনটে বেজে এক মিনিট। সে ঘুমিয়েছিল একটার আশপাশে। বেশি ঘুমোয়নি তবে। নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হতেও আরো একঘণ্টার মতো বাকি। তাহলে তো একটু থাকাই যায়।

সরোজ তনয়াকে জোড় করে নলীদের স্কুলের ওখানে নিয়ে গেছে। তনয়া যেতে চাইছিলো না। বার বার জিজ্ঞেস করছিল, “তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো, সরোজ ভাইয়া?”

সরোজ ক্ষীণ বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি তোমার ভাইয়া হই না, আপু। কতবার কমু?”
—“যারা বড়, তাদেরকে তো ভাইয়াই ডাকতে হবে। ত্রিস্তান ভাইয়া বলেছে। তাছাড়া তুমি আমার থেকে কত লম্বা দেখেছো?”

টিফিন ছুটি দিয়েছে মাত্র। শিক্ষার্থীরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। নলী তো বলেছিল, টিভিন ছুটি হলেই দৌঁড়ে আসবে। তাহলে? এখনো আসছে না কেন? তাকে কি খুঁজে পাচ্ছে না? সে কি একটু গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে দাঁড়াবে?
যথারীতি গাছের আড়াল থেকে একটি দূরে সরে দাঁড়ালো সরোজ। তনয়ার অধৈর্য চাহনি একবার লক্ষ করে উত্তর দিলো, “হেইডা তো বয়সে বড় হইলে কইতে কইছে। আমি তোমার থেইকা লম্বা হইলেও বয়সে তুমি বড়। ধরো, তুমি আইফেল টাওয়ার হইলে আমি হইলাম গিয়া পুদিনা পাতা।”

তনয়া চোখ পিটপিট করে বারকয়েক পলক ফেললো। অবুজ কণ্ঠে সুধালো, “আইফেল পাওয়া, সেটা কি ভাইয়া?”

সরোজ যেন বুঝতে পারলো না। কান খাঁড়া করে, ভ্রু দুটো কুঁচকে বললো, “কি, কি? কি বললা?”
—“আইফেল পাওয়ার, এইটা কি?”

ঠোঁট দুটোর মধ্যিখানে বিস্তর ফাঁক দেখা দিলো। কিচ্ছুক্ষণ নিরবে তনয়ার দিকে চেয়ে থেকে বিশাল লম্বা শ্বাস ফেললো সরোজ। বেদনা ভরা কণ্ঠে বললো, “কিচ্ছু না আপু। ওইটা কিচ্ছু না।”

দেখা গেল, একটু পরই নলীর দেখা মিলেছে। ওইতো! স্কুল ড্রেস পরা, পিচ্চি পিচ্চি ভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। এসেই চঞ্চল, তাড়া লাগানো গলায় বলে উঠলো, “বেশি কিন্তু সময় নেই। কি জরুরি কথা বলবেন বলেছিলেন? বলে ফেলুন।”

সরোজ মন খারাপ হলো। খুব! খুব! খুব!
—“আমি কি খালি জরুরি কথা কইবার আহি? প্রেম প্রেম কথা কইবার আইতে পারি না? এমন আছরণ ক্যান করতাছিস নীলিমা? তুই মেলা পাল্টাই যাইতেছিস।”

সরোজের কথায় তেমন একটা পাত্তা দিতে দেখা দিলো না নলীকে। বরং তনয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো সে। জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো আপু? কি হালচাল?”

তনয়া হেসে মাথা দুলালো মাত্র। যার অর্থ, সে ভালো আছে।
পাশ হতে সরোজ আবারও বললো, “তোরে কিছু কইছি নীলিমা। উত্তর দেস না ক্যালা?”
—“কি উত্তর দিবো? এখন থেকে এসবের অভ্যাস করুন। নরম মন পেয়ে অনেক জ্বালিয়েছেন।”

সরোজ অধৈর্য হলো, “আমি জ্বালাইছি? কখন? কোন সময়? তুই এ-না জ্বালাইতেছিস আমারে। আমার পরাণডা দেখছিস? তোর দহনে পুইড়া যাইতেছে রে…!”

নলী সরাসরি তাকালো এবার। চোখে চোখ রাখলো। ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান?”

সরোজের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “হ, চাই।”
—“তাহলে এসব বাজে ঘোরাঘোরি বন্ধ করে পড়ালেখায় মন দিন। নয়তো আমি একদম ভেগে যাবো। আপনাকে মোটেও বিয়ে করবো না।”

সরোজের দু’চোখ বড় বড়। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো, “তওবা তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ্! এইরম কথা কইবার পারলি নলী? তুই ছাড়া আমার জীবন কেমনে ধ্বংস হইবো হেইডা জানোস তুই? হেইডা জাইনাও এইরম কথা কইবার পারলি? বুক কাঁপলো না তোর? জিহ্বায় আটকাইলো না?”

নলী এইবারও পাত্তাহীন। তবে ক্ষীণ বিরক্ত হতে দেখা গেল। ডান হাতের ঘড়িটির দিকে একবার তাকিয়ে যেনতেন ভাবে বললো, “সময় নেই আমার। আর কথা বলতে পারবো।”
সরোজ আবারও চমকালো, “তুই তো আইলিই মাত্র।”

নলীর দায়সারা চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বললো, “এমন করতাছিস কেন, নলী? তুই এহন আমারে একদমই সময় দিবার চাস না।”
—“দিবো। আগে ঠিকঠাক পড়ালেখা করুন।”

নলী চলে গেল। পেছনে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো পরে থাকা সরোজ উত্তপ্ত দাবানলের মতো ফুসে উঠলো যেন। সে যদি পারতো, এই পড়ালেখা আবিষ্কার করা লোকটিকে কবর থেকে উঠিয়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা গুলি মেরে দিতো! ফাজিল লোক! দুনিয়াতে আজব জিনিসের অভাব ছিল? এর এই পড়ালেখাই আবিষ্কার করতে হবে? আশ্চর্য!

কচ্ছপের গতিতে চলতে থাকা সময়টাতে বড্ড আলসেমি লাগছে অটবীর। ত্রিস্তানের ঘরে নতুন করে কিছু ঘুরে দেখার নেই। তবে বুকসেল্ফের বইগুলো থেকে একটা বই নিয়ে সময় কাটানো যায় অবশ্য। কিন্তু ত্রিস্তান আগেরবার যা কান্ড ঘটিয়েছিল, তা থেকে ওই ইচ্ছেটাও শক্ত করে জন্মাচ্ছে না।
ঘুমন্ত ত্রিস্তানকে আরও একবার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো অটবী। পুরাতন হলেও বাড়িটাতে একটা রাজকীয় ভাবসাব আছে। একেকটা জিনিস এত মানানসই! যেন এই বাড়িটাকে উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছে সব। অটবী ধীর পায়ে টেবিলের ওপাশে টাঙানো ত্রিস্তানের পারিবারিক ফ্রেমটার দিকে এগোলো। প্রথমেই দৃষ্টি ছুটলো, ত্রিস্তানের মায়ের পানে। তাকে কাছ থেকে আরও বেশি সুন্দর দেখায়। গায়ের ফর্সা রঙটা সাদা বাতির মতো জ্বলজ্বলে। নীল চোখের মণিটা যেন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে দেখছে অটবীকে। এত নিখুঁত, স্পষ্ট! ত্রিস্তানের বাবাও যদিও কম নন। অটবী হলফ করে বলতে পারে, ওইসময়কার শত রমণীর রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া স্বপ্নপুরুষ তিনি। মা-বাবা এত সুন্দর বিধায় তনয়া আর ত্রিস্তানও তাই বোধহয় এমন সৌন্দর্যের পুজারি হয়েছে। দুজন যেন চাঁদের দুটো টুকরো।

কোমল গোলাপের মতো ফুটে থাকা ত্রিস্তানের মুখখানা একটু করে ছুয়ে দেখলো অটবী। আলতো করেই। কিন্তু আকস্মাৎ কি যে হলো! ছবির ফ্রেমটা কেমন কেঁপে উঠলো। একেবারে আলাদিনের চেরাগের মতো ডানপাশে সরে ছোট্ট লকারের মতো কি যেন বেরিয়ে এলো। পুরানো দিনের লকার। তালা নেই। অনেকটা কৌতূহল নিয়েই লকারটা খুললো অটবী। সোনালী রঙের রিংবক্স মধ্যিখানে পরে আছে। বক্সের ঢাকনা নেই। ময়লা ট্যিসুর ওপর একটা ঝকঝকে চাবি শোয়ানো। অটবী চাবিটা ধরতে নিবে, পূর্বেই সদর দরজা খোলার আওয়াজ হলো হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো অটবী। দিকবেদিক শূণ্য হয়ে ধাম শব্দে লকার লাগালো। ছবির ফ্রেমটা টেনে ওপাশে নিতে নিতেই সরোজের কণ্ঠ শোনা গেল, “আরে… অটবী আপু যে? কখন আসলা? ওখানে ফ্রেম ধইরা কি করতাছো?”

ততক্ষণে ফ্রেম ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছে অটবী। ইতোমধ্যে কপালে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। শুষ্ক ঢোক গিলে সে উত্তর দিলো, “দে–দেখছিলাম, ছবিটা।”

সরোজ দাঁত বের করে হাসলো। হি হি শব্দ হলো ওতে। বললো, “তুমি এইহানে আইলেই ছবিটার দিকে তাকায় থাকো। এতো ভাল্লাগে তোমার ছবিটা? ত্রিস্তান ভাইরে কও, তোমারে ছবিটা যেন দিয়া দেয়।”
একটু থেমে রান্নাঘরে একপলক উঁকি দিলো সরোজ। এরপর আবার সুধালো, “ভাই কই?”

অটবীর দৃষ্টি এলোমেলো, “ঘু–ঘুমাচ্ছে।”

তনয়া দৌঁড়ে আসলো তক্ষুণি। অটবীকে এতদিন পর দেখে তার খুশির অন্ত নেই। অটবীর হাত দুটো মুঠোয় পুরে, দুলিয়ে দুলিয়ে আবদার করলো, “অটবী আপু, আমার সাথে খেলবে?”

তনয়ার মিষ্টি মুখপানে চেয়ে অটবী হাসলো ঠিক, কিন্তু তার ভেতরকার পরিস্থিতি এখনো সেই ছবির ফ্রেমের ভেতরেই আটকে আছে। অজানা চাবিটা নিয়েও খুব চাপাচাপি করছে মস্তিষ্ক। আর কত… আর কত রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাড়িটায়? কেমন রহস্য লুকিয়ে আছে? বাজে? নাকি খুব বাজে?

ত্রিস্তানের ঘুম ভাঙলো একটু পরই। ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে সে এসে হাজির হলো তনয়ার ঘরে। অটবী তখন তনয়ার সাথেই খেলছিল। তনয়ার ছবি আঁকার হাত মারাত্বক! এত সুন্দর আঁকে মেয়েটা! সে বসে বসে একেকটা ছবি মুগ্ধ নয়নে দেখছিল। ত্রিস্তান এসে পাশে দাঁড়াতেই মুখ উঁচিয়ে তাকালো।

মাত্র ঘুম থেকে ওঠা মুখ! ক্ষীণ তৈলাক্ত ভাবটুকু বাতির আলোয় চিকচিক করছে। চোখ আর ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফোলা। ঝাকড়া চুলগুলো এলোমেলো। কপাল ঢেকে রেখেছে। পরনের শার্টটাও বাজেভাবে কুঁচকানো।
অটবী ত্রিস্তানের সরু চোখের দিকে চেয়েই জিজ্ঞেস করলো, “মাত্র উঠেছেন?”

ত্রিস্তানের একবাক্যে উত্তর, “হ্যাঁ।”

অটবী উঠে দাঁড়ালো এবার। তনয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, “আমি আজকে আসি তাহলে? পরে তোমার সাথে খেলবো?”

—“আমি সাথে যাচ্ছি। চলো।” পাশ থেকে বলে উঠলো ত্রিস্তান। কিন্তু অটবী রাজী হলো না, “যেতে পারব আমি। শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।”

—“আমি বলেছি কষ্ট হবে?” ত্রিস্তানের দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
—“আমি যখন যেতে পারবো তখন আপনার শুধু শুধু যাওয়ার দরকার কি?”
—“আমি তোমাকে একা ছাড়বো কেন?”

অটবী থমকালো। চোখ ঝাপটালো বার কয়েক। কথাটা হজম করতে মিনিটখানেক সময় নিয়ে বললো, “আমি বাসায় যাবো না এখন। স্কুলে যাবো। একটু পর নলীদের স্কুল ছুটি হবে।”
—“তো?”
—“তো মানে? স্কুলে আপনার কাজ কি?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। লোকটা ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। চোখে-মুখে নিখাঁদ বিরক্তি! অটবী বুঝে পাচ্ছে না, লোকটার আজ হলো কি? কথায় কথায় এত তর্ক করছে কেন?

ত্রিস্তান সেই নিঁখাদ বিরক্তি নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি আমার সাথে যাবে না?”
—“না।”
—“সত্যি যাবে না?”
—“না বলেছি তো।”

ত্রিস্তান তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। মেঝের দিকে একবার চেয়ে অটবীর দিকে তাকালো আবার। কেমন কেমন করে যেন বললো, “তুমি কিন্তু তোমার বরের অবাধ্য হচ্ছো, অটবী!”
হকচকালো অটবী, “কিহ্?”
—“তোমাকে কিন্তু আমি সবসময় শাড়ি পরিয়ে রাখবো।”
—“কি আবলতাবল বকছেন?”
—“তোমাকে কিন্তু আমি বেঁধে রাখবো, অটবী।”
—“আশ্চর্য ত্রিস্তান! তনয়াকে দেখছেন না আপনি?”

তনয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো অটবী। সে হা করে তার ভাইকে একবার, তারপর অটবীকে একবার দেখছে। অথচ ত্রিস্তানের সেদিকে খেয়াল, ধ্যান কিচ্ছু নেই। সে নির্বিকার কণ্ঠে আবারও সুধালো, “তুমি আমার সাথে যাবে না?”
—“না।”
—“আমি কিন্তু তোমাকে এখন কোলে নিবো, অটবী।”
—“ত্রিস্তান!”
—“তোমাকে কিন্তু…”

অটবী আর বলতে দিলো না। হাত টেনে ঘরের বাহিরে যাওয়ার সময় খেয়াল হলো, দরজায় হেলান দিয়ে সরোজ নিঃশব্দে পেট জড়িয়ে হাসছে। ব্যাপারটায় খুব লজ্জা পেল অটবী। নিচু গলায় ত্রিস্তানকে বকলোও, “এমন করলেন কেন আপনি? লজ্জা নেই?”

ত্রিস্তান কি একটু হাসলো? অটবী দেখতে পেলো না।

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে