অটবী সুখ
২২.
বিষণ্ণ ক্ষণ। বিষণ্ণ আকাশ। বিষণ্ণ সন্ধ্যে। বিষণ্ণ অটবীর চাপা মনটাও। বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হওয়ার পর থেকে তার সুশ্রী মুখটা মলিন রঙে ঢেকে গেছে। ভেতরটা নিদারুণ উদাসীনতায় জড়োসড়ো, আতঙ্কিত। অটবী বসে আছে ঠিক জানালার মাঝখানটায়। নির্জীব দৃষ্টি দূর গহীনে। হাতে ফোন। ফোনের স্ক্রীনে মুশফিকের নামটা গোটা গোটা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। বিয়ের কথাবার্তা আগানো মাত্রই মুশফিক ছেলেটা কেমন যেন অদৃশ্য অধিকার দেখাচ্ছে অটবীর ওপর। এটা করো না, ওটা করো না, ফোন দিলে সাথে সাথে ধরবে– ইত্যাদি! ইত্যাদি! অটবীর ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। বিরক্ত অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু তাতেই-বা কার কি? কে তার মনের অবস্থাটুকু শুনবে? মায়ের তো ওই এক কথা! এখানেই বিয়ে করতে হবে। নয়তো আবার সেই জেদি অভিমান!
নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অটবী কলটা ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, “ফোন কই থাকে তোমার? এতক্ষণ লাগে কল ধরতে?”
সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে বদলেছে। অটবীর ক্ষেত্রে না, মুশফিকের দিক থেকে। আর এই বিষয়টাই অটবীকে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে দিচ্ছে। বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে।
সে ধীর গলায় জবাব দিলো, “ওয়াশরুমে ছিলাম।”
ওপাশ থেকে একটা ছোট্ট নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। পরপরই অনেকটা প্রেমে মাখোমাখো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি করছো? নাস্তা করেছো?”
অটবীর ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“আমি খেয়েছি কি-না জিজ্ঞেস করবে না?”
—“আপনি খেয়েছেন?”
প্রশ্নের ধরণটা অনেকটা দায়সারা, নির্জীব। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটা সম্ভবত বুঝতে পারলো। একটু চুপ থেকে কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি কি এ বিয়েতে রাজি না, অটবী? তোমার আচরণ, কথার ধরণ, বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তোমার! বিয়ের সপিংটা পর্যন্ত আমার সাথে করতে গেলে না। এমন কেন করছো?”
অটবী এমন কেন করছে? প্রশ্নের উত্তরটা তারও জানা নেই। দুই-তিন দিন ধরে সে এই একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে চলেছে। কিন্তু প্রশ্নটা বড্ড কঠিন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু এটুকু জানে, এই বিয়ে সে করতে চায় না। এই এলাকা ছেড়ে সে চলে যেতে চায় না। মুশফিককে চায় না। মাকে, নলীকে, পৃথাকে! কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। আর ত্রিস্তান? তাকে নিয়ে অটবীর চিন্তা ঝাপসা, অস্পষ্ট। শুধু একটুখানি অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করে সে তার নাম দিয়েছে, “হৃদয় কামড়ানো নীল ব্যথা!”
রান্নাঘর থেকে রেবা বেগম হাঁক ছাড়ছেন। চা, পরোটা বানানো হয়ে গেছে। সবাইকে খেতে ডাকছেন। ফোনের ওপাশ থেকে মুশফিক ডাকটা শুনলো। অটবীকে কিছু বলতে না দেখে নিজেই কথা আগালো, “উত্তর দিবে না? আবারও বাহানা করে কথা কাটিয়ে দিবে?”
অটবী ম্লান হাসলো। দু’এক সেকেন্ডের জন্য। এরপর আস্তে করে বললো, “রাখছি।”
কল কেটে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রাখলো অটবী। চেয়ার থেকে ওড়না নিলো। গায়ে জড়ালো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো, তার দুই বোন, দুই পন্ডিত আগে থেকেই খাবার টেবিলে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। মন তাদেরও খারাপ। বোনের বিয়ে এখনই হোক, সেটা তারাও চায়নি।
অটবী নিঃশব্দে ওদের পাশের চেয়ারটাতে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “খাচ্ছিস না কেন? খাওয়া শুরু কর।”
নলী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে করুণ গলায় বললো, “আর মাত্র দুইদিন আপা।”
—“কিসের দুইদিন?”
প্লাস্টিকের একটা বৈয়ম থেকে বিস্কুত নিয়ে কামড় বসালো অটবী। নলী আবারও বললো, “তারপর আর তোমাকে যখন তখন জড়িয়ে ধরতে পারবো না।”
বিস্কুটের অবশিষ্ট অংশটুকু গলায় আটকে আটকে নামলো যেন। খুব রয়েসয়ে। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো। নিশ্বাস থমকালো। অটবীর কি বুক চিঁড়ে কান্না আসছে? কারো কি বুক চিঁড়ে কান্না আসে কখনো? তাহলে তার এমন লাগছে কেন? জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিললো অটবী। কৃত্রিম ধমকের সুরে বললো, “এসব কি কথা? এমন কথা তোদের মাথায় ঢুকিয়েছে কে?”
নলী, পৃথা কিছু বললো না। কাঁদলো মাত্র। তাদের মিষ্টি চেহারায় এই বিষাদ কান্না বেমানান। বিশ্রী রকমের নিষ্ঠুর। কিন্তু অটবী তাদের কাঁদতে মানা করলো না। জোরপূর্বক চুপচাপ বিস্কুট চিবুতে লাগলো। ততক্ষণে রেবা বেগম রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের এমন কান্না দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন, “কিরে? তোরা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিস কেন? অটবীর সুখ কি তোদের সহ্য হয় না? মেয়েটা কি সারাজীবন তোদের জন্য ঘরে বসে থাকবে?”
তিক করে মেজাজটা চড়ে উঠলো। চাপা রাগটা সীমা অতিক্রম করতেই না চাইতেও অনেকটা উঁচু গলায় বলে ফেললো অটবী, “আশ্চর্য! ওদের বকছো কেন?”
রেবা বেগম শক্ত চোখে তাকালেন। শাসনের সুরে বললেন, “তো বকবো না? বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে তুই একদম চুপচাপ হয়ে গেছিস। এখন আবার এদের কান্না! এই বিয়েতে তোদের এত সমস্যা কেন, বলতো? মুশফিক ছেলেটা কোন দিক দিয়ে খারাপ?”
—“কোনো দিক দিয়েও না। সে ভালো। কিন্তু আমি তার জন্য পার্ফেক্ট না। আমার এখন বিয়ে করারও ইচ্ছে নেই। তুমি জোর করছো, না খেয়ে থাকছো, কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছো! এগুলা কি মানসিক অশান্তি না?”
—“আমি এসব তোর ভালোর জন্য করছি, অটবী।”
হাহ! ভালোর জন্য! মুখে একটা তাচ্ছিল্যের রেশ ফুঁটে উঠলো অটবীর। খাওয়ার ইচ্ছে পুরোপুরি মরে গেল। চেয়ার ছেড়ে ঘরে যেতে নিলেই রেবা বেগম আবার ডেকে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছিস অটবী? খেয়ে যা!”
অটবী শোনে নি। দাঁড়ায়নি। চোখের পলকে ঘরে চলে গেছে। রেবা বেগম তার ছোট মেয়ে দুটোর দিকে তাকালেন এবার। ওদের মুখশ্রীতেও স্পষ্ট অসন্তুষ্টি। অথচ মেয়েগুলো বুঝতে পারছে না কেন? মা কি কখনো সন্তানের খারাপ চায়? মেয়ের বয়স হয়েছে। আর কত নিজের প্রয়োজনে, নিজের স্বার্থে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন? পাড়া প্রতিবেশীরাও কম কথা শোনাচ্ছে না। মুশফিক ছেলেটা ভালো। টাকাপয়সা মোটামোটি আছে। অটবী সুখে থাকবে। তাহলে কেন তিনি এই বিয়ে চাইবেন না?
–
রাত তখন বারোটা। নলী, পৃথা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে বহু আগে। অটবীর চোখে ঘুম নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একাধারে দেখছে নিশ্চল, নিস্তব্ধ রাতটাকে। রাত যত বাড়ছে মনের শঙ্কা, ভয় ততই বেড়ে চলেছে তার। কাল বাদে পরশু বিয়ে। ছোটখাটো, ঘরোয়া অনুষ্ঠান। শুধুমাত্র পাত্রপক্ষদের কয়েকজন আত্মীয় আর রেবা বেগমের পরিচিত কিছু প্রতিবেশী থাকবেন। বিয়ে পরানোর পরপরই অটবীকে নিয়ে যাওয়া হবে অচেনা, অজানা জায়গায়।
মুশফিক দু’দিন আগে বিয়ের যাবতীয় গহনা, শাড়ি নিয়ে এসেছিল। আলমারিতে সেগুলো সে থেকেই পরে আছে। অটবী ছুঁয়ে দেখেনি। তার আগ্রহই জাগে নি কখনো। আজকাল সব আগ্রহ মিছে হয়ে যাচ্ছে। ধূলিসাৎ হয়ে কোথায় যে উড়ে যাচ্ছে! সরব, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে গেল। রেবা বেগম এসেছেন। অটবী সেদিকে একবার তাকালো মাত্র। এর পরপরই নজর ফিরিয়ে নিলো।
রেবা বেগম কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “রাত ক’টা বাজে, অটবী? এখনো ঘুমাস নি কেন?”
অটবী উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি এবার গলার জোর আরেকটু বাড়ালেন, “কি বলেছি তোকে? ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”
বোধহয় কাজ হলো। অটবী চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। নলীর পাশে। টু শব্দটিও করলো না। রেবা বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসলেন। আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন দু’চার মিনিট। সস্নেহে, অতি আদরে। তারপর শান্ত গলায় সুধালেন, “ঘুমিয়ে গেছিস, অটবী?”
অটবী এবারও জবাব দিলো না। রেবা বেগম একটা সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “অটবী… তুই আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছিস। অনেক! তোর বাবা দেখলে হয়তো বলতো, ‘আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে!’ অবশ্য সে জীবিত থাকলে তোকে এতো কষ্টও করতে হতো না। শুন মা, আমি তোর ভালো চাই। তোকে প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতে দেখলে কষ্ট পাই। তুই যখন রাতে দেড়ি করে ফিরিস, ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায়। আমি চাই না আমাদের জন্য তোর জীবনটা এমন পরিশ্রমে পরিশ্রমে শেষ হয়ে যাক। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বাবা থাকলে হয়তো এতদিনে বিয়েটাও হয়ে যেত।”
একটু থেমে আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “মুশফিক ছেলেটা ভালো। ব্যবহার সুন্দর। আশেপাশের মানুষ থেকেও খারাপ কিছু শুনিনি। সবচে’ বড় কথা, ছেলেটা তোকে নিয়ে অনেক ভাবে। নিজ থেকেই নলী আর পৃথার দায়িত্বও নিবে বলেছে। তুই তো এমন কিছুই চেয়েছিলি। তাহলে এই বিয়ে নিয়ে এত রাগ, নিষেধাজ্ঞা কেন? বিয়েটা খুশি মনে করে নে মা। তুই, আমি, আমরা সবাই ভালো থাকবো।”
অটবীর অনুভূত হলো, রেবা বেগম কাঁদছেন। লহমায় এ-ও বুঝতে পারলো, তার বন্ধ চোখ দিয়ে একটু একটু করে অশ্রু কণা বালিশ ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। শুধু কি বালিশ? স্রোতের মতো তার জীবনটাকেও উলটপালট করে দিয়েছে।
–
গুমোট পরিবেশে একরাশ আচ্ছন্নতা হয়ে বারি খাচ্ছে তরঙ্গের মতো ভেসে বেড়ানো গানগুলি। হিন্দি গান, বাংলা গান, কত যে গান! কিছু কিছু গান অটবী কস্মিনকালেও শোনেনি। তার শোনার, জানার ইচ্ছেও নেই। সে আপাতত একদৃষ্টে আয়নার প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে আছে। হলুদ বর্ণ গায়ে লাল শাড়িটা মানিয়েছে খুব। মুশফিক কোত্থেকে যেন পার্লারের মেয়ে পাঠিয়েছে। সে অতশত সাজেনি। কিন্তু তাতেও দেখতে খারাপ লাগছে না। কৃত্রিম স্বর্ণের মতো চিকচিক গহনায় বরং অপ্সরীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে। মাথায় বড়সড় আঁচলের ঘোমটা। তাকে কি আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে? অথচ সে চেয়েছিল তাকে যেন আজকে খুব বাজে লাগে। খুব!
তখন বাজে দুপুর দুটো। বিকেল তিনটে বা চারটের দিকে বিয়ে পরানো শুরু হবে। অটবী এখন থেকেই আশেপাশের মানুষের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পাচ্ছে। আহা! কি আনন্দ তাদের! কি উল্লাস! অটবী এত আনন্দিত হতে পারছে না কেন? তার ভেতরে তো কোনো আনন্দই কাজ করছে না।
—“আপু? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
খানিকটা ভয় ভয় কণ্ঠ। অটবী পাশ ফিরে নলীর দিকে তাকালো। মেয়েটার কপাল অস্বাভাবিক ভাবে ঘেমে আছে। ক্ষীণ তোতলাচ্ছে, দ্বিধায় ভুগছে। অটবী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে?”
—“তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো, তাই না? ভাইয়াকে ভালোবাসলে এই বিয়ে করছো কেন?”
আচমকা এহেন কথায় হতবাক হলো অটবী। তৎক্ষণাৎ পুরো রুমে একবার করে চোখ বুলালো। নাহ্! আশেপাশে কেউ নেই।
—“তুই ইদানিং এমন অদ্ভুত কথা কোত্থেকে খুঁজে আনছিস, নলী? আমি তোর ত্রিস্তান ভাইকে কেন ভালোবাসতে যাবো?”
—“মিথ্যে বলছো কেন? আমি জানি তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো। সেও তোমাকে ভালোবাসে।”
—“সে আমাকে ভালোবাসে না, নলী। আমিও বাসি না।”
নলীকে অধৈর্য দেখালো। মুখের রঙ পালটে, প্রচন্ড উৎকন্ঠা হয়ে বললো, “তুমি মায়ের মতো জেদ করছো আপা! এইসময় জেদ খাটে না। তোমার কাছে মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা আছে। এখন যদি তুমি এমন বাচ্চাদের মতো করো, তাহলে কিভাবে কি হবে? বিষয়টা বুঝতে পারছো না কেন?”
অটবীর অনুভূতি শূণ্য চোখজোড়া শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ, “তুই বড়দের মতো কথা বলছিস।”
—“কারণ তুমি বাচ্চাদের মতো করছো। ভালোবাসা ছাড়া কি জীবন চলে আপা? মুশফিক লোকটার সাথে কি ভালোবাসা ছাড়া সারাজীবন থাকতে পারবা? তোমার মনে তো শুধু ত্রিস্তান ভাইয়া।”
—“তুই এত কিছু জানিস কিভাবে?”
—“জানি এক ভাবে। তুমি দ্রুত সিধান্ত নাও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”
দু’হাতে দশটা, দশটা করে বিশটা কাঁচের চুড়ি অটবীর। লাল রঙের। একটু ধারালো। হাতে খোঁচা লাগছে। চুড়িগুলো কোনোমতে সামলে অটবী ধীর গলায় উত্তর দিলো, “এখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছে, নলী। আমি চাইলেও কিছু হবে না।”
—“কে বলেছে হবে না? সরোজ ভাই পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মা, পৃথা, বাকি সবাই সামনের উঠোনে। কেউ কিচ্ছু জানবে না আপা। তুমি পালিয়ে যাও।”
অটবী তৎক্ষণাৎ তাকালো। চোখে বিস্ময় নিয়ে শুধালো, “সরোজ এলো কোত্থেকে? নলী! তুই বারণ করার পরও সরোজের সাথে কথা বলেছিস?”
এপর্যায়ে নিজের বোনের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো নলী। কিসব খেজুরে আলাপ লাগিয়ে দিয়েছে! ওইদিকে মায়ের আসতে দেড়ি নেই। এক্ষুণি এসে পরবেন।
চট করে অটবীর বাম হাত টেনে দাঁড় করালো নলী। টেনে নিয়ে পেছনের দরজার দিকে আগাতে নিলেই অটবী বাঁধা দিতে চাইলো, “আমি কোথাও যাবো না নলী। এটা হয় না। মা অনেক কষ্ট পাবে। তাছাড়া… ত্রিস্তান… সে আমাকে চায় না।”
বিরক্ত সূচক শব্দ করলো নলী,
—“কে বলছে চায় না? তোমারে এমন ওকালতি করতে কে বলছে? ত্রিস্তান ভাইয়া যে তোমার বিয়ের কথা শুনে ঘরবন্দি হয়ে আছে, সেকথা জানো?”
অটবী জানে না। জানতেও চায় না। এত কষ্ট করে নিজের মনকে বুঝিয়েছিল, নলী এসে এমন ঝড় তুলছে কেন? সে পরে নিজেকে সানলাবে কিভাবে?
—“নলী, হাত ছাড়! আমি কোথাও যাবো না। আর দু’ঘণ্টা পর বিয়ে। এখন… তুই হাত ছাড়!”
নলী ছাড়তে চাইলো না। কিন্তু অটবীর ধমকের পিঠে বেশি জোড় খাটাতেও পারলো না। মনে মনে ভীষণ কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। তার বোন এমন কেন? সবার সুখের হিসেব রাখতে গিয়ে নিজের সুখের হিসেবটা এমন গোলমেলে করে ফেলছে কেন?
নলী থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী সোজা নিজের রুমে চলে গেল। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো, তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। আগেও বিষণ্ণ লাগছিল। কিন্তু এখন কেমন যেন না পাওয়া কষ্টে, আফসোসে মৃত মানুষের মতো লাগছে। মৃত মানুষ! অটবীর ভেতরটা হঠাৎ করেই চমকে উঠলো। আধভাঙ্গা ড্রেসিংটেবিলের ওপর তার ফোনটা রাখা। মেসেজ আসায় স্ক্রীন জ্বলজ্বল করছে। ওতে লেখা, “অটবী, তোমার বউ সাজের একটা ছবি দেবে? আমি আসলে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছি না। রাস্তায় এত জ্যাম!”
মেসেজটা মুশফিকের।
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
২৩.
যেন এক অসহায়, জীবনশূণ্য মানুষের মতো সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলো অটবী। বাঁচার কোনো আশা নেই, চেষ্টা নেই, মায়া নেই! তারপর হঠাৎ করেই এক বিন্দু আলো সুদুর থেকে উঁকি দিতেই মনটা ঝটপটে হয়ে উঠলো। নির্জীব হাত-পা জোড়া হলো চঞ্চল। এদিক ওদিক শূণ্যে নাড়িয়ে, সাঁতরে উপরে উঠতে চাইলো যেন! তবুও মনে বিস্তর সংশয়, আঁতঙ্ক! সমুদ্রের তীরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটা তার জন্য অপেক্ষা করবে তো? নাকি প্রতিবারের মতো ঠুনকো করে দূরে সরিয়ে দিবে?
প্রচন্ড ঝংকার তুলে ফোনটা বিশ্রী সুরে বেজে উঠলো। অটবী তখন দ্বিধাদ্বন্দে মিইয়ে বিছানার এককোণে বসে আছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মুশফিক কল করেছে। অতিশয় দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো সে। ভেঙ্গেচুরে নিসাড় হওয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন তুললো, “হ্যালো?”
ওপাশ থেকে হিন্দি গানের তীব্র শব্দ, হৈচৈ। কথা খানিকটা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। মুশফিক বলছে, “অটবী, কি করছো?”
অটবী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না। রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “বসে আছি।”
—“তোমার সাথে কে আছে?”
—“কেউ নেই।”
—“তুমি একা একা বসে আছো? আচ্ছা, ভালো! খেয়েছ কিছু?”
—“হু।”
অটবীর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। প্রচন্ড হিংস্র কান্না বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে গুমরে আছে। কি ভীষণ যন্ত্রণা! কথা বলতে গিয়েও কণ্ঠ কেমন কেঁপে কেঁপে অস্থির। মুশফিক হয়তো সেই কাঁপনটুকু অনুভব করতে পারলো। মুহুর্তেই কণ্ঠস্বর নরম করে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি কাঁদছো অটবী? কি হয়েছে? আরে বাবা সব মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়, পরিবার ছাড়তে হয়। তাই বলে এভাবে কাঁদবে? আমি কি তোমাকে খারাপ রাখবো নাকি?”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো অটবী। তবুও হলো না। বাজে একটা করুণ সুর গলায় রয়েই গেল।
—“আপনাদের আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
—“বেশি না। বিশ-পঁচিশ মিনিট। আরও আগে পৌঁছাতাম। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তারওপর বাবা মিষ্টির দোকান থেকে কি কি যেন কিনছেন। এখনো দোকানের সামনেই বসে আছি।”
অটবী পুরো কথা শুনলো। খুব মনোযোগ দিয়ে। আস্তে করে বললো, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। বলি?”
ওপাশ থেকে মুশফিকের আহ্লাদী কণ্ঠ, “জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কেন? বলে ফেলো।”
জানালার বাহিরে ঝলমলে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটুখানি রোদ্দুরে মাখো মাখো সাদা মেঘমালা। অটবী একপলক সেই আকাশটা দেখে নিলো। নাসিকাগ্রন্থে সতেজ নিশ্বাসটুকু টেনে নিয়ে চোখ বুজলো শক্ত করে। একদমে বললো, “ধরুন, আপনি কাউকে অনেক ভালোবাসেন। সেও আপনাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছু কারণে আপনাকে মেনে নিতে পারছে না। সেসময় আবার আপনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। আপনি অনেকটা জেদের বশে কিংবা নিজ মায়ের জোড়াজোড়িতেই বিয়েতে রাজী হন। বিয়ের একদম শেষ মুহুর্তে, আর দু’এক ঘণ্টা বাকি; আপনি জানতে পারেন আপনার ভালোবাসার মানুষটা আপনার বিয়ের সংবাদ পেয়ে ঘর বন্দি হয়ে আছে। আপনার এখন একদমই এই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না। সব জেদ, অভিমান ধুলোয় মিশিয়ে সেই মানুষটার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখন আপনি কি করবেন? বিয়েটা করে নিবেন?”
অটবী থামলো। উত্তরের অপেক্ষা করলো। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, এক মিনিট! কিন্তু মুশফিক কিছু বলছে না। ঘন ঘন নিশ্বাসের তেজি শব্দে কানে ঝং ধরিয়ে দিচ্ছে। অটবী এবার ডাকলো, “মুশফিক? শুনছেন আমার কথা?”
একটা তীব্র হাহাকারে ভরা নিশ্বাস! হতাশা! ফোনের ভেতর থেকেও মুশফিক ছেলেটার বিকৃত মুখটা চোখে ভেসে উঠলো অটবীর। শান্ত অথচ গনগনে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “মানুষটা তুমি, তাই না? তুমি এখন বিয়ে ছেড়ে পালাতে চাইছো?”
অটবীর কণ্ঠ ধরে এলো, “ন-নাহ্! আমি শুধু বলছি, আপনি কি করতেন?”
—“বিয়েটা করে নিতাম।”
চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরলো। শুনতে পেল, গাড়ির দরজা খোলার ক্ষীণ শব্দ। লহমায় আবার প্রচন্ড রূঢ় শব্দে দরজাটা আটকে পায়ের ধুপধাপ হাঁটার আওয়াজ। অটবীর ভয় বাড়লো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে চাইলো, “আপনি একপাক্ষিক ভাবছেন।”
মুশফিক আক্রোশে ফেঁটে উঠলো, “তাহলে এখন কি চাইছো? এইমুহুর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেই? আদৌ সম্ভব? তোমাকে আমি আগে জিজ্ঞেস করিনি? রাজী আছো কি নও কতবার জিজ্ঞেস করেছি? তখন তো চুপ ছিলে। এখন আবার কি প্রেম, ভালোবাসা; আশ্চর্য!”
নিচের ঠোঁটের পাতা কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে অটবী। সে জানে সে ভুল। এমনটা.. এসময়ে.. এখন.. মোটেও বলা উচিত হয়নি। কেন যে বললো! মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করবে, তার পূর্বেই মুশফিক রাগে মিইয়ে কেমন শীতল অনুরোধ জারি করলো, “তুমি বরং পালিয়ে যাও, অটবী। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
কিন্তু অটবী পালালো না। হু হু বুকের বিষক্ষয় নিয়ে চুপটি করে নিয়তির অপেক্ষায় রইলো। কাঁদলোও আবার। একটু একটু করে চোখের জলে সাজ-সজ্জা সব মলিন করে তুললো।
প্রাণ যখন একদম ফুরিয়ে আসছিল, বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় চোখের সামনে ভাসছিল না, এমন সময় উঠোন থেকে হুলুস্থুল চিৎকার, চেঁচামেচি চারিদিকে তরঙ্গ ছড়ালো, “জামাই নাই! জামাই নাই! কই গেলা সবাই? জামাই তো পালাইছে।”
–
গুণে গুণে তিনটে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ভোরবেলায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল ত্রিস্তান। ঘড়িতে এখন রাত দশটা। কে যেন প্রচন্ড শক্তি নিয়ে সদর দরজায় কারাঘাত করছে। আশ্চর্য! দরজা ভেঙ্গে ফেলবে নাকি? ঘুমের মাঝেই চোখ, কপাল দারুণ চিত্তে কুঁচকে ফেললো ত্রিস্তান। ঘুম ভাঙ্গতেই লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো। চোখে এখনো তন্দ্রা লেগে আছে। ঔষধের প্রভাব কাটেনি বোধহয়। এখন চোখটা বন্ধ করলেই অনায়াসে আরও দু’তিন ঘণ্টা আরামে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু এসময় তাকে বিরক্ত করতে দরজায় বারি দিচ্ছে কে? সরোজটাও-বা কোথায়? দরজা থাক্কানোর শব্দ কি সে শুনতে পাচ্ছে না?
দু’আঙুলে কপাল ঘঁষে মাথার টনটনে বিশ্রী ব্যথাটা আয়ত্বে আনার চেষ্টা চালালো ত্রিস্তান। আরও তিন-চার সেকেন্ড শুয়ে থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি তখনো কারাঘাত থামায়নি। বরং থেমে থেমে, একটু পরপর তীব্র টোকার শব্দে নিস্তব্ধ পরিবেশটা গরম করে দিচ্ছে। ত্রিস্তানও অত একটা তাড়া দেখালো না। রয়েসয়ে একবার তনয়ার ঘরের ভেতরটা দেখে নিলো। তনয়া, সরোজ দুজনেই ঘুমাচ্ছন্ন। সরোজ মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে আর তনয়া বিছানায় রঙ পেন্সিল নিয়ে। আরেকদফা বহমান বাতাসের একটুখানি নিজের ভেতর টেনে আবার ছাড়লো ত্রিস্তান। পা বাড়ালো সদর দরজার উদ্দেশ্যে।
বাহিরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। দরজা খুলতেই ভেতরের কৃত্রিম বৈদ্যুতিক আলো উঠোনে ছড়িয়ে পরলো তরতরিয়ে। দেখতে পেল, তার সামনে চিরচেনা, অপ্রত্যাশিত সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান কিঞ্চিৎ চিন্তায় মগ্ন হলো। ঘুমের ঔষধের প্রভাবটা কি এখনো যায়নি? স্বপ্নেতেও ত্রিস্তান অটবীকে এমন বউ সাজেই দেখেছিল। এখন আবার সামনে থেকে, একদম কাছ থেকে দেখছে! বুঝতে পারছে না, এটা তার কল্পনা নাকি বাস্তব? কল্পনাই হবে। নয়তো অটবী এখানে আসবে কোত্থেকে?
ভাবনা অকূল পাথারেই অটবী থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এখন কি ভেতরেও ঢুকতে দেবেন না? এভাবে সামনে সং সেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
নাহ্! স্বপ্নের অটবী মিষ্টি করে কথা বলছিল। এ মেয়ে স্বপ্ন হতেই পারে না! তবে কি বাস্তব? ত্রিস্তান আস্তে করে পলক ফেললো।
—“তুমি সত্যি?”
জবাব পাওয়া গেল না। অটবী কেমন কঠিন করে চেয়ে আছে, “এখনো সরছেন না কেন? ঢুকতে দেবেন না তাহলে?”
লহমায় ত্রিস্তান সরে দাঁড়ালো। তার মনে হচ্ছে, তার মাথায় গুটিকয়েক গাজুরিয়া মাইর পরেছে। কি তীব্র ব্যথা! সব কি ভীষণ উলোটপালোট!
অটবী গিয়ে সোফায় দ্বিধাহীন ভাবে বসলো। পরনের শাড়ি একটু ভিঁজেছে। নিচের পাড়টায় অল্প বালি ভাব জমিয়েছে। সেই জমানো বালিটা হাত দিয়ে একটু ঝেরে নিলো সে। ততক্ষণে ত্রিস্তান গ্লাস ভর্তি পানি এনে এগিয়ে দিয়েছে অটবীর পানে। অটবী নিলো গ্লাসটা। তার কাঠকাঠ হয়ে থাকা গলা ভেঁজাতে এই পানির খুব প্রয়োজন ছিল।
—“তুমি এখানে কেন এসেছো, অটবী?”
পানিটুকু পান করে সশব্দে গ্লাসটা টেবিলে রাখলো অটবী। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।”
ত্রিস্তান সামনাসামনি সোফায় বসেছে। দুজনের চোখ দুজনের মধ্যিখানে। অটবী স্পষ্ট দেখলো, ত্রিস্তান বাম চোখটা খুব সামান্য লাফিয়েছে। অথচ চেহারা ভাবাবেগ শূন্য! লোকটা কি বিশ্বাস করেনি?
—“আপনি কিছু বলবেন না?”
—“কি বলবো?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠ। অটবীর সহ্য হলো না, “আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে ত্রিস্তান! আপনার কিছুই বলার নেই?”
ত্রিস্তানের দৃষ্টি অটবী থেকে সরে এখন পানির গ্লাসে। ঠিক যেখানটা অটবী ঠোঁট ছুঁয়েছিল? সেখানে লিপস্টিকে স্পষ্ট দাগ! ঠোঁটের নিঁখুত ভাঁজ! নাহ্, গ্লাসটা ধোঁয়া যাবে না। কোথাও গোপন করে লুকিয়ে রাখতে হবে।
গ্লাসের দিকে নজর রেখেই ত্রিস্তান বললো, “তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি, অটবী। চলো, বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। আর এমন পাগলামি করবে না।”
যেন একটুখানি হাওয়া বইছিল। হঠাৎ করেই ঝড় শুরু হলো। সেই ঝড়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো অটবী। ঠোঁট কাঁপলো! চোখের পাতা পলক ফেললো! নিমিষেই উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সে, “আমি পাগলামি করছি? তাহলে আপনি কি করছেন? ঘুমের ঔষধ খেয়েছেন না, ত্রিস্তান? কেন খেয়েছেন? বিন্দাস একটা লাইভ লিড করছেন! যাকে তাকে ভালোবাসার বুলি বলে কয়ে হারিয়ে যাচ্ছে! আপনার তো কষ্ট থাকার কথা না। তাহলে কার কষ্টে ঘরবন্দি ছিলেন? আমার? কই! আপনি তো আমাকে খেলনা ভাবেন। যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছেন। তাহলে? খেলনার জন্য কষ্ট লাগছে?”
এক ধরণের অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে অটবীকে কিছুক্ষণ একাধারে দেখলো ত্রিস্তান। নয়নে গভীরতা লুকোচুরি করে অশান্ত গলায় বললো, “বুঝিনি অটবী, তোমাকে ভুলে ভালোবেসে ফেলবো।”
অটবীর উগ্র ভাবটা কোথায় যেন হারালো। আর ফিরে এলো না। এতে বেশ বিরক্তই হলো সে। লোকটা তাকে এত জ্বালিয়েছে, অথচ সে একটু উঁচু গলায় কথা বলতে পারছে না? কেন?
ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁক করে ক্লান্ত নিশ্বাস ছাঁড়লো অটবী। দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “চলুন, বিয়ে করবো।”
ত্রিস্তান ভ্রু কুঁচকালো। চমকটা একটু জোরেসরেই লেগেছে। অবাক কণ্ঠে সুধালো, “কি বললে?”
—“বিয়ে করবো। এক্ষুণি।”
—“সম্ভব না, অটবী।”
—“কেন সম্ভব না? এত… এত পাষাণ কেন আপনি?”
কান্নাটা আটকানো গেল না। বহু কষ্টে চেপে রাখা অশ্রুকণা বেরিয়ে এলো নিঃশব্দে। আর কত নিচে নামবে অটবী? আর কত বেহায়া হবে? কিসের এত বাঁধা? ত্রিস্তান কেন তাকে একটু কাছে টানছে না? অথচ উত্তরটা বরাবরের মতোই সাদা কালিতে অদৃশ্য।
ত্রিস্তানের মনে হলো, সে ক্রমশই দূর্বল হয়ে উঠছে। ভেতরে কি একটা যেন বাজেভাবে ছিঁড়ে যাচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। এই মেয়েটা… এই মেয়েটা তার প্রাণ। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে পিষে ফেলতে। অথচ অদৃশ্য বাঁধায় শিকল বন্ধী। ত্রিস্তান শিকলটা শক্ত করে ধরলো। শেষ চেষ্টা করে বললো, “তুমি আমার সঙ্গে কখনো ভালো থাকবে না, অটবী। আমি অনেক খারাপ।”
—“আমার সমস্যা নেই।”
—“তুমি আবেগে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো।”
অটবী রাগলো এবার। লোকটা এখনো তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তার আবেগের বয়স আছে এখনো?
ক্ষিপ্ত গলায় বললো, “আপনাকে কে বলেছে এটা আবেগ? আমার অনুভূতি আপনি আমার থেকে বেশি জানেন?”
শক্ত টানে শিকলটা ছিঁড়ে গেল। তৃষ্ণা, ধৈর্য সব ফুরালো। ত্রিস্তান মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো ক্ষীণ। মুচকি হাসি। এগিয়ে এসে অটবীর হাত ধরে, অটবীকে অবাক করে দিয়ে বললো, “চলো, বিয়ে করবো।”
বিয়েটা হয়ে গেল তক্ষুণি। এই মাখো মাখো প্রেম সুর নিয়ে আসা শ্রাবণ ক্ষণেই। তখন বোধহয় এগারোটা পেরিয়েছে। দোকানপাট সব বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আধঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে শহরের মাথায় একটা কাজী অফিস খোলা পাওয়া গেল। কাজীর তখন ঘুমের সময়। তবুও টাকার চাকচিক্য ঝলকে সে রাজী না হয়ে পারে নি। স্বাক্ষী হিসেবে ত্রিস্তানের দুজন বন্ধুও এলো। বেশভূষায় আধুনিক, রুচিশীল। ত্রিস্তানের এমন বন্ধুও আছে? কই, আগে তো কখনো দেখেনি।
বৃষ্টি তখন নেই। অটবী রাস্তার পাশের ভেঁজা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি, দূরের ত্রিস্তানের পানে। লোকটা তার বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে এদিকেই আসছে। ক্রমশই এত কাছে চলে আসছে! মনে হচ্ছে তাদের মাঝের যোজন যোজন দূরত্বটা কমে ছোট হয়ে গেছে। একদম ছোট!
ত্রিস্তান ধপ করে অটবীর পাশে এসে বসলো। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে, দারুণ নিশ্বাস ফেলে বললো, “তুমি কিন্তু আর আফসোস করতে পারবে না, অটবী।”
অটবীর ধীর উত্তর, “আচ্ছা।”
—“তুমি এখন সোজা বাসায় যাবে। আমি পৌঁছে দেব।”
—“ঠিকাছে।”
—“বাসায় কেউ জানে তুমি আমার কাছে এসেছো?”
—“নলী আর পৃথা জানে। ওরা ওদিকটা সামলাবে।”
ত্রিস্তান একটু থামলো। একটু একটু করে ঝুঁকে পরলো অটবীর দিকে। ছোট্ট, নরম কাঁধে মাথা রাখলো। ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি শুধু ভুল করেই যাচ্ছি, অটবী।”
পরপরই অটবী অনুভব করলো, তার গলার মধ্যিখানে এক অধৈর্য ঠোঁটের শক্ত চুমু।
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা