অটবী সুখ
২০.
“My lady, If I could, I would hold you so tightly that you would never let go of me.”
ঘুম থেকে উঠে অটবীকে আশেপাশে পায়নি ত্রিস্তান। বাহিরে তখন সন্ধ্যা শেষে আঁধার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতক্ষণ অবশ্য থাকার কথাও না। শরীরের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। টি-টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিললো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে সূক্ষ্ণ জ্বালাতন। বুক ভারী। মেয়েটা কি সত্যিই চলে গেছে? ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস সুরসুর করে বেড়িয়ে এলো। সরোজ তখনো রান্নাঘরে কি যেন করছে। একটু পর পর খুটখাট শব্দে মেতে উঠছে নিস্তব্ধ পরিবেশ। অটবী তার বানানো নুডুলস্ খেয়ে যায়নি। তাই তার একটু মন খারাপ। কাঁচের প্লেটে নিজের বানানো নুডুলস্ নিজেই চামচের আঘাতে টুংটাং শব্দে খাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ করছে।
সরোজের কাছে যাওয়ার পূর্বে তনয়ার রুমে একবার তাকালো ত্রিস্তান। দরজা ভেড়ানো। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। সরোজকে বললো, “অটবী কখন গেছে?”
সরোজ চমকালো, ভড়কালো। হঠাৎ ত্রিস্তানকে দেখে ভয় পেল ক্ষীণ। বুকে লাগাতার কয়েকবার ফুঁ দিয়ে চোখ বড় বড় করে অভিযোগ জানালো, “এমন ভূতের মতো হঠাৎ কথা কও ক্যান? কথা কওনের আগে কাঁশি-টাঁশি দিতে পারো না?”
ত্রিস্তান সে কথার ধার ধারলো না। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে রান্নাঘরের বামপাশটায় এগোলো। ক্ষুধায় পেটে হরতাল লেগে যাচ্ছে। ছোট একটা বাটিতে নুডুলস্ নিতে নিতে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “অটবী কখন গেছে?”
—“বেশিক্ষণ হয় নাই। এই আযানের একটু আগে।”
কথাটা বলে একটু থামলো সরোজ। আড়চোখে ত্রিস্তানকে একবার দেখে নিলো। গম্ভীর মুর্তে নুডুলস্ গিলছে সে। চাবাচ্ছে কি-না তাতেও সন্দেহ! আমতা আমতা করে সরোজ বলতে চাইলো, “তোমগো মাঝে কি ঝগড়া হইছিল, ভাই? অটবী আপুরে দেখলাম কানতেছিল।”
তৎক্ষণাৎ খাওয়া থামলো। মুখে তখন মাত্র এক চামচ নুডুলস্ পুরেছে ত্রিস্তান। সেটা কোনোমতে গিলে অবাক কণ্ঠে সুধালো, “কাঁদছিল মানে?”
—“ওইতো, যখন এন থেইকা যাইতেছিল গা তখন চোখ মুখ লাল, পানি। কান্নার লাইগা কথাও কইতে পারতেছিল না।”
ত্রিস্তান শুনলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সশব্দে রেখে দিলো বাটি-টা। পেটে ক্ষুধা থাকলেও এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। রুচি চলে গেছে। গলা দিয়ে আর খাবার নামবে না।
—“সরোজ, তোকে যেটা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?”
—“হ। আনছি।”
বলতে বলতে শেষ নুডুলস্-টুকু ঝটপট চিবিয়ে ফ্রিজ খুললো সরোজ। গোল প্লেট সুদ্ধ একটা লাল প্যাকেট বের করলো। গাঢ় লাল রক্তের প্যাকেট। উদ্ভট গন্ধ। ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো, “আজইকাও কি এক্সপেরিমেন্ট করবা, ভাই?”
ত্রিস্তান প্লেট-টা নিলো। সরোজের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, “হু।”
—“তোমারে একখান কথা কই, ভাই?”
ত্রিস্তানের আবারও ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“তুমি আমারে যত বোকা ভাবো আমি কিন্তু ততটা বোকা না। কিছু কিছু জিনিস আমিও বুঝি।”
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড! দারুণ চমকে সরোজের মুখপানে তাকালো ত্রিস্তান। পরমুহুর্তেই আবারও শান্ত হয়ে ছেলেটার চোখে চোখ রাখলো। নিষ্পাপ চোখদুটোয় তখন হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল ভীড় জমাচ্ছে। সেই ভীড়ের মাঝে হঠাৎ করেই চমৎকার এক দ্যুতি উঁকি দিলো। যেন এতকাল খুঁজতে থাকা প্রশ্নের কিছু উত্তর সরোজ জেনে গেছে, যা জানা তার একদমই উচিত হয়নি।
ঢোক গিলে গলাটা একটু ভিঁজিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালালো ত্রিস্তান। নিস্তেজ কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব কঠোর করে বললো, “আমার রুমে ঢুকতে মানা করেছিলাম, সরোজ। আর ঢুকবি না।”
সরোজ এমন সরাসরি প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু রোজ রাতে ত্রিস্তানের ঘর থেকে আসা নারী কণ্ঠের চিৎকার, কান্নার করুণ সুর সে উপেক্ষা করতে পারছে না। না চাইতেও বিশ্রী সন্দেহ জমাট বাঁধছে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখলো, ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। বড় বড় কদম ফেলে। যেন পালাতে চাইছে এখান থেকে। সরোজ এই লোকটাকে বড় ভাই মানে। বড় ভাইয়ের থেকেও বেশি। এলাকার সবাই যখন সরোজকে খারাপ বলে তিরস্কার করতো, একমাত্র ত্রিস্তানই তাকে কাছে টেনে ভালো-মন্দ বুঝিয়েছিল। এই মানুষটা থেকে সে দূরে সরে যায় কেমন করে?
ত্রিস্তান রুমে ঢুকতেই নিচ্ছিল, সরোজ তড়িৎ কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ কেমন প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে, “ভাই, তুমি যা-ই করো, আমি তোমার সাথে আছি। হোক সেটা খারাপ। আমারে সবসময় পাশে পাইবা।”
সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে ত্রিস্তান। দরজার সঙ্গে গা ঘেঁষে বসে পরেছে মেঝেতে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। এ সত্য সে কতদিন চেপে রাখবে? কতদিন চেপে রাখা যাবে? অটবী! সরোজ! তনয়া! নলী! সবাই ভুল বুঝবে তাকে। ঘৃণা করবে! বাবা-মায়ের মতো কেউ ভালোবাসবে না। কেউ না। শরীরের শিরা-উপশিরায় ভীষণ একটা যন্ত্রণা অনুভব হলো। হাতে থাকা রক্তের থলি, প্লেট ছুঁড়ে ফেললো সুদূর মেঝেতে। রক্তের থলি ছিঁড়লো না ঠিক, কিন্তু কাঁচের প্লেট-টা ভেঙ্গে গেল। ত্রিস্তান সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলো, কাঁচের টুকরোগুলো তাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, “ওহে সুখনীল ত্রিস্তান! দুঃখ তোর পিছু ছাড়বে নারে অভাগা!”
নিশ্বাসটা ভারী হলো। কষ্ট দিলো। নিজের ওপর বড্ড করুণা হলো তার। মস্তিষ্ক শুধু এখন একটা নামই জপছে। অটবী! অরবিন্দ অটবীতে বসবাসরত তারই মতো সুখ খোঁজি একটি মেয়ে!
–
মাথার ওপর কড়া উত্তাপ। ঝলমলে রোদ্দুর। তীব্র তাপে শরীর ঘেমে একাকার। স্কুল শেষে হাতে হাত ধরে বাসায় ফিরছিল দু’বোন, নলী আর পৃথা। হাতে দশ টাকার বাদামের ঠোঙা। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নিজেদের ব্যস্ত করে রেখেছে ওরা। আশেপাশের খেয়াল নেই। আলোচনার মূল বিষয় এই, আজকে অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। রেবা বেগম তাই মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। পাত্রপক্ষ দেখতে আসায় কেন ঘর থেকে বেরোনো যাবে না- তা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকছে না। পাশাপাশি তারা এ নিয়েও চিন্তিত, তাদের ভবিষ্যৎ বোনজামাই ঠিক কেমন হবে? ভালো হবে তো? দেখতে শুনতে ভালো না হলে বাদ। চরিত্রও ভালো হতে হবে। নয়তো তাদের ফুলের মতো বোনকে তারা কিছুতেই বিয়ে দিবে না। একদমই না।
রাস্তার মোড়ে রহিম, কাদিন সঙ্গে আরও কিছু ছেলেপেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথার মাঝে কাদিনের দিকে দৃষ্টি চলে যায় পৃথার। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে থেকে আফসোসের সুরে বলে, “কাদিন ছেলেটাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম।”
নলীও একবার কাদিনের দিকে তাকালো। অতঃপর চোখ-মুখ বিকৃত করে বললো, “কি দেখে ভালো মনে হইছিল? আমার তো প্রথম থেকেই ভাল্লাগে না। বান্দরের মতো চেহারা। শরীর একটা কাঠি। ফুঁক মারলেই বাতাসে ভাসাভাসি শুরু করে…”
কথাটা শেষ হতে পারলো না। পৃথা চোখ রাঙিয়ে চেয়ে আছে। নির্ঘাত নলীকে মেরে কুচিকুচি করার পরিকল্পনা আঁটছে মনে মনে। নলী কাদিনের বদনাম আর গাইলো না। অভিযোগের সুরে বললো, “তোরা যে সরোজকে নিয়ে বলতিস? আমার খারাপ লাগতো না? এবার বুঝ! পছন্দের মানুষকে গালাগাল করলে কেমন লাগে!”
—“সরোজ ভালো ছেলে না।”
পৃথার গম্ভীর কণ্ঠ। নলী ঢং করে বললো, “কাদিন যেন অনেক ভালো?”
—“কাদিনও ভালো না।”
ততক্ষণে ওরা রহিমের কাছাকাছি চলে এসেছে। রহিমের বাজে হাসিটা তখন টাটকা, তাজা। দাঁত কেলিয়ে ওদের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি ময়না পাখিরা? স্কুল শেষ? বাসায় যাচ্ছো?”
নলী সাথে সাথে বিরক্তি প্রকাশ করলো। পৃথার হাত টেনে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড়ালো, “তো আর কোথায় যাবো রে লুচ্চা?”
–
অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার সংবাদটা ত্রিস্তান পেল রাত্রিবেলা। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। ত্রিস্তান টং দোকানে বসে চা-সিগারেট ফুঁকছিল। কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে সংবাদটা জানালো সরোজ। সরোজের সাথে যদিও ইদানিং তার কথাবার্তা হচ্ছে অল্পসল্প। দূরত্বটা ত্রিস্তানই তৈরি করেছে। কিন্তু সরোজ তার দিক থেকে সচল, চঞ্চল। ত্রিস্তান না জানতে চাইলেও অটবীর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সম্পর্কে মিনিটে মিনিটে অবগত করছে। ত্রিস্তান সব কিছু পাত্তা দেয় না। না শোনার ভান ধরে রয়। এই যে! এখনো ধরছে। ধরার চেষ্টা করে নিজেকে বলছে, সে শোনেনি। কিচ্ছু শোনেনি।
কিন্তু ভেতরকার হৃদযন্ত্র সেকথা মানতে নারাজ। তাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠেপরে লাগছে। অধৈর্য করছে। এরপর… এরপর দশমিনিটের মাথায় ত্রিস্তান অটবীদের বাসার সামনে! ঠিক রান্নাঘরটার সম্মুখে, যেখানে আপাতত অটবী চুলায় খাবার গরম করতে ব্যস্ত।
মেয়েটার মুখশ্রী মলিন। চোখ ফোলা। সে কি কেঁদেছে? তিক্ত নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তান আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিল, অটবীকে একটু দেখেই চলে যাবে। তবে তা আর হলো না। চলে যাওয়ার পূর্বেই অটবীর নজরে পরে গেল সে। এখন কি করবে? সে কি একটু হাসবে? কিছু বলা উচিত কি?
ভাবনার অকূল পাথারে অটবীই সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছেন?”
দূরত্ব বেশি নয়। তিন-চার হাত। একটু জোরে কথা বললেই সব শোনা যায়। কিন্তু অটবী আস্তে কথা বলছে। কথাটা শুনতে ক্ষীণ বেগ পেতে হলো ত্রিস্তানের। এরপর সে নিজেও ওভাবে উত্তর দিলো, “তোমার নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? তাই দেখতে এলাম।”
অটবী মনে মনে হাসলো। লোকটার কাছে দেখি তার সব খোঁজখবরই আছে! তাহলে এই মিছে অভিনয়, দূরে সরে যাওয়া কেন? অটবীর খুব বলতে ইচ্ছে হলো, “দেখেছেন ত্রিস্তান? এবারও আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করতে। অথচ আপনি নাকি আমাকে নিজের করে চান না!”
কিন্তু মুখে বললো, “বিয়ে এখন হচ্ছে না। যখন হবে, তখন আসবেন। সবার সাথে।”
ত্রিস্তান মুচকি হাসলো। আরও কিছুক্ষণ অটবীকে মন ভরে দেখে, সুপ্ত বেদনাটা লুকিয়ে রাখলো। কেমন করে যেন বললো, “বিয়ে করে নিও অটবী। ছেলে শুনলাম… ভালো?”
—“এখন কি আপনার কথা মতো চলতে হবে?”
ত্রিস্তানের হাসির আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। কৃত্রিম, দীর্ঘ হাসি। সেই হাসি অটবীকে তৃপ্ত করতে পারলো না। বিষিয়ে দিলো। চাপা বিশ্রী রাগটাকে হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দিলো সুরসুর করে। পাষাণ লোকটার চোখে চোখ রেখে মারাত্বক ঘৃণা নিয়ে বললো, “আপনার মতো জঘণ্য লোক আর কেউ হতে পারে না, ত্রিস্তান।”
পরপরই তাদের মধ্যিখানে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালো বন্ধ বিস্তর জানালা! ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। বন্ধ জানালাটার দিকে চেয়েই থাকলো। যেন সে এখনো দেখছে, অটবী দাঁড়িয়ে আছে ওই তো, অদূরে। রাগী নয়নে ভস্ম করে দিচ্ছে তাকে। মেয়েটা এত রাগতে পারে! ত্রিস্তান আরও একবার মলিন হাসলো। কে বলে সে হাসে না? এইযে, ক্ষণে ক্ষণে হাসছে!
চোখ দুটো বুজে, আকাশ পানে মুখ করে, ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “আমার প্রাণ। প্রাণের অটবী। তোমাকে পাওয়ার যদি একটা সুযোগ পাওয়া যেত।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
২১.
পাতাল ঘরটায় ডুবো ডুবো অন্ধকার। বাজে, বিশ্রী গন্ধে এক তেঁতো ঝাঁঝ গলায় এসে উপচে আসতে চাইছে। বাতাসে ভ্যাপসা গরম, দমবন্ধ অনুভূতি। বাতি জ্বালাতেই দেখা গেল, নোংরা কাপড়ে ব্যক্তিটি দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে। পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়গুলি রাখা। ছুঁয়েও দেখেনি হয়তো।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিঃশব্দে ম্যালামাইনের সাদা বাটি-টা মেঝেতে রাখলো। এরপর ক্লান্ত গলায় বললো, “বলেছিলাম কাপড় চেঞ্জ করে নিতে। করোনি কেন?”
সাদা বাটিতে টকটকে গোলাপের মতো রক্তগুলো দেখে মনে আলতো আনন্দের বাতাস দোলা দিয়ে উঠলো ব্যক্তিটির। তবে তা তক্ষুণি প্রকাশ করলো না। ভীষণ অভিযোগের সুরে বললো, “আমার এখানে ভালো লাগে না। আর কতদিন আমাকে বন্দী করে রাখবি? আমি বাহিরে যাবো।”
বাহিরে? এ অবস্থায়? মোটেও সম্ভব না। তাছাড়া বাসায় সরোজ আছে। তনয়া ড্রইংরুমে খেলছে।
—“পরে নিয়ে যাবো। এখন এটা খেয়ে নাও।”
—“সত্যি নিয়ে যাবি?”
ত্রিস্তান জবাব দিলো না। মেঝেতে পা মুড়িয়ে বসলো। তার তুখোড় দৃষ্টি ব্যক্তিটির পানে বিদ্যমান। সে একবার ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বাটি-টির দিকে এগিয়ে গেল। লোভাতুর নয়নে প্রাণভরে রক্তগুলো পরখ করে ঝাপিয়ে পরলো খেতে। ঢকঢক শব্দে রক্ত পানের সময় ঠোঁট বেয়ে এক সূক্ষ্ণ রেখা গড়িয়ে পরলো একটু একটু করে। ত্রিস্তান সবটা দেখলো। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগলো ওর। আর কত? আর কতদিন? ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে বললো, “কালকে থেকে আর প্রতিদিন রক্ত পাবে না। ভাত খেতে হবে।”
সঙ্গে সঙ্গে চট করে তাকালো ব্যক্তিটি। খাওয়া থামালো। আশ্চর্য রকমের বিরক্তি নিয়ে বললো, “ভাত কেন খাবো? আমি ভাত খেতে পারবো না।”
ব্যক্তিটি রেগে গেছে। বিকৃত মুখশ্রীতে হাজারো অসন্তোষের ভীড়। তবে সেই অসন্তোষে পূর্ণ রাগ তাকে দমাতে পারলো না। শান্ত সুরে বললো, “তোমার মতো মানুষেরা খাবার খেতে পারে। তুমিও খেয়েছো, ভবিষ্যতেও খেতে পারবে।”
—“আমার ভাত ভালো লাগে না। আমার রক্ত ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগে না।”
—“শুধু রক্ত খেতে থাকলে একদিন মরে যাবে।”
—“আমি মরতেই চাই।”
ঘাড় ব্যথা করছে। হাত-পায়ে চিনচিনে যন্ত্রণা। আজকে জঙ্গল দিয়ে আসার সময় পায়ে কিসের যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। বিরাট আঁচড়। একটু কেটেও গেছে। ঔষধ লাগানো হয়নি। রক্ত শুকিয়ে লেপ্টানো। ত্রিস্তান পায়ের ক্ষতটা একবার দেখে নিলো। তেমন বিশেষ না। এরচেয়েও বড় আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সে। তবুও এই সামান্য কাঁটাছেঁড়ায় এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সে কোথায় যেন শুনেছিল, “ক্ষুদ্র ব্যথায় বেদনা বেশি।”
আসলেই কি তাই?
তিক্ত মেজাজটা মাথার ডান পাশে তিক করে উঠলো। বুড়ো আঙুল আর শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে কপাল বার কয়েক ঘঁষে নিলো ত্রিস্তান। বললো, “তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করো। আমার কাজ আছে।”
—“কিসের কাজ? করিস তো চুরি। অবশ্য তোর দ্বারা এর চেয়ে বেশি কিছু হবেও না।”
স্পষ্ট অপমানটা ত্রিস্তান গিলে নিলো। কিছু বললো না। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি তখনো থেমে নেই।
—“তনয়াকে আমার কাছে আর আনিস না কেন? কত দিন দেখা হয় না!”
—“কেন আনবো? আগের বার মেরে ফেলতে পারো নি বলে এবার যেন মেরে ফেলতে পারো, তার জন্য?”
না চাইতেও সেদিনের ঘটনা মনে পরে গেল ত্রিস্তানের। রক্ত খেতে না দেওয়ায় এই যে, সামনে বসে থাকা তার ভীষণ আপন মানুষটা উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ত্রিস্তানেরও যে কি হয়েছিল! পাতাল ঘরের দরজাটা আটকাতে মনে নেই। সেই সুযোগে রান্নাঘর থেকে ছুঁড়ি নিয়ে ঘুমন্ত তনয়াকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ব্যক্তিটি। ত্রিস্তানের ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সে যদি সেদিন সময়মতো না আসতো! তাহলে হয়তো ভীষণ বাজে রকমের অঘটন ঘটে যেত। ভীষণ বিশ্রী অঘটন!
অথচ সামনের মানুষটির চেহারায় অপরাধ বোধের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সে খুব আরামে বাটির অবশিষ্ট তরল বিন্দুটুকু শেষ করলো। যেন এমন অমৃত সে কখনো খায়নি। রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “তুই না খাইয়ে রেখেছিলি কেন? তাছাড়া ওই পাগল মরে গেলেই ভালো।”
চোয়াল শক্ত হলো। কপালের রগ সূক্ষ্ণ ভাবে ফুঁটে উঠলো। বলতে ইচ্ছে করলো, “তুমিও তো পাগল। তনয়ার চেয়েও বড় পাগল।”
কিন্তু তা আর ভেতর গলিয়ে বাহির হলো না। গম্ভীরমুখে উঠে দাঁড়িয়ে, সে কঠিন গলায় বললো, “কালকে থেকে তোমার এসব খাওয়া বন্ধ। ভাত পাবে শুধু। খেতে পারলে খাবে, নয়তো না খেয়ে থাকবে।”
চোখে মুখে আতঙ্ক বাসা বাঁধলো। কেঁপে কেঁপে, থেমে থেমে বলতে চাইলো, “সুখনীল! তুই জানিস… রক্ত খেতে না পেলে আমার কষ্ট হয়।”
—“আমারও হয়। যখন সময়ের কাটা প্রত্যেকটা সেকেন্ড মনে করিয়ে দেয়, আমার কেউ নেই।”
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় ত্রিস্তান শুনলো, পেছন থেকে অবিরাম ব্যক্তিটি চিৎকার করছে। চিৎকার করে বলা কথাগুলো কানে বিঁধছে খুব। অশান্তি লাগছে। দূর থেকে দীর্ঘশ্বাসেরা একপলক আকাশ দেখে করুণ সুরে অভিযোগ করছে, “আর কত? এবার থামো!”
_
অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল ঠিক রবিবার বিকেলে। সোমবার বিকেল হতে না হতেই সেই বিয়ের গুঞ্জন ধামাচাপা হয়ে যায়। পাত্রের পরিবার রাজী থাকলেও অটবী মানা করে দিয়েছে। তার অসুস্থ মা আছে। ছোট দুটো বোন আছে। সে বিয়ে করে চলে গেলে তাদের দেখবে কে? এই যুক্তি দিয়ে পাত্রপক্ষকে মানা করা গেলেও রেবা বেগম বেঁকে বসলেন। এত ভালো সম্বন্ধ! অথচ মেয়েটা কি না কি নিয়ে বসে আছে। তাদের দেখাশোনা করতে হবে বলে আজীবন বিয়ে না করে থাকবে? এ কেমন যুক্তি? এমন সম্বন্ধ কি বারবার আসে? রেগেমেগে অটবীর সঙ্গে কথা বলছেন না পুরো একদিন। অটবী প্রথম প্রথম যদিও রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছিল। এখন থেমে গেছে। তার মা অভিমানীর সঙ্গে জেদিও। তার এই অভিমান বিয়েতে রাজী না হওয়া অব্দি শান্ত হবে না। আর অটবী এই বিয়ে করবে না।
তখন ঘড়িতে দুপুর তিনটে। মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্য। তেজটা আগের চেয়ে একটু বেশিই বোধহয়। সূর্যিমামা কি তবে আজ রেগে আছেন? রেগে আছেন হয়তো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে গিয়ে অটবী খেয়াল করলো, ফোনের নোটিফিকেশনে অপরিচিত নম্বর থেকে পাঁচটা মিসড্ কল দেখাচ্ছে। অটবী জানে নম্বরটা কার। ওইযে? তাকে যারা পরশুর আগেরদিন দেখতে এলো? সেই ছেলে। তার নাকি অটবীকে খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়েতে মানা করার পরও অটবীর পিছু ছাড়ছে না। কল করে বিরক্ত করছে খুব। ফোন সাইলেন্ট করেও শান্তি নেই। সে কল ধরছে না, তবুও বেহায়ার মতো করেই যাচ্ছে!
অটবী বিরক্ত প্রকাশের অবকাশ পেল না। ষষ্ঠবারের মতো আবারও ছেলেটা কল করছে। হাহ! এমন মানুষও পৃথিবীতে হয়? অটবীর মাঝে কি এমন পেল এই ছেলে?
মোবাইলটা ঠেলেঠুলে ব্যাগের ভেতর আরও গুঁজে রাখলো অটবী। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। গরমে গলা শুকিয়ে গেছে। তৃষ্ণায় মন আকুপাকু করছে। ব্যাগ হতে পানির বোতল বের করবে, ওমনি কে যেন পাশে এসে হাঁটতে লাগলো, “আপনি আমার কল ধরছেন না কেন?”
অটবী চমকালো, থমকালো। চট করে পাশ ফিরে তাকালো। সেই দেখতে আসা ছেলেটা! এই ছেলে ভূতের মতো হঠাৎ এলো কোত্থেকে? তাকে ফলো করছে নাকি? কপাল কুঁচকে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললো, “আপনি এখানে কিভাবে?”
ছেলেটা লাজুক হাসলো। নিশ্চিন্ত হয়ে বললো, “চিনেছেন তাহলে!” এরপর আবার বললো, “একটু কাজে এসেছিলাম আসলে। যাওয়ার সময় আপনাকে দেখে কথা বলতে এলাম।”
মিথ্যে কথা। এই ছেলে বিদেশে থাকে। তিন বছর ধরে সেখানেই ছোটখাটো কাজ করছে। কয়েকদিন হলো বিয়ের জন্য দেশে এসেছে। এর বাসাও অটবীদের চার এলাকা পরে। এই ছেলের কস্মিনকালেও এখানে কোনো কাজ থাকতে পারে না। থাকলেও সেটা অটবী জড়িত। অটবীর পিছু পিছু হ্যাংলার মতো দৌঁড়ানো।
অটবী যথাসম্ভব মিথ্যেটা হজম করে নিলো। পাশ থেকে ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করলো, “উত্তর দিলেন না যে? আপনি আমার কল ধরছিলেন না কেন?”
বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। অল্পসল্প দমাতে চেষ্টা করে বললো, “ফোন সাইলেন্ট ছিল। দেখিনি।”
—“আমার তো মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যে বলছেন। একটু আগেও দেখলাম আপনি ফোন হাতে নিয়েছেন।”
অটবী নিত্যান্তই ভদ্র, শান্ত মেজাজি। এমন ছেলেদের পাত্তা না দিলেও সোজা-সাপটা কিছু বলতে পারে না। তবুও একটু তাচ্ছিল্য করে হেসেই প্রশ্ন করলো, “জানেন যেহেতু জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
কিঞ্চিৎ থতমত খেলো ছেলেটা। তবে দমলো না। সময় নিলো। ধাতস্ত হতেই ট্রেনের গতিতে ছুটলো, “আমার নাম মুসফিক। জানেন নিশ্চই? আপনার নাম অটবী, তাই না? অনেক সুন্দর একটা নাম। আপনার মতো।”
অটবী এবার কথা বাড়ানোর অবশিষ্ট আগ্রহটুকুও হারিয়ে ফেললো। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। জঘন্য রকমের অসহ্য। তার জীবনে কি কষ্টের অভাব ছিল? এই বার্তি ঝামেলার উড়ে এসে জুড়ে বসবার প্রয়োজন কি ছিল?
দুপুর হলেও রহিমের দল ঠিকই মোড়ের টং দোকানে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। সাথে ত্রিস্তান, সরোজও আছে। ত্রিস্তান সবসময়কার মতোই এক হাত দিয়ে সিগারেটে একটু পরপর টান দিয়ে অন্য হাতে চা ধরে আছে। পাশের এলাকায় বিদেশ ফেরত এক লোক এসেছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। পাঁচ ভোরিস্বর্ণ, গয়না, গোটা পঞ্চাশ হাজার টাকা! তাজা খবরটা রাকিব এক্ষুণি এনেছে। নিজের চোখে সবকিছু দেখে এসেছে সে। এই নিয়েই আজকের মূল আলোচনা। টং দোকানাদার যেন তাদের আলোচনার আগাগোড়া কিচ্ছু শুনতে না পায়, তাই তারা বেশ ফিসফিসিয়েই কথা চালিয়ে যাচ্ছে। দোকানদারও কান খাঁড়া করে আছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। এত আস্তে কেউ কথা বলে? এই ব্যাটাছেলেগুলো কি একটু মজাও নিতে দিবে না?
ত্রিস্তান এসবের ভেতর কখনোই থাকে না। সবকিছু ঠিক হওয়ার পর সে শুধু প্লেন বানিয়ে দেয়। তার আপাতত এখানে কোনো কাজ নেই। ওদের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে একেকটা সুখটান বাতাসে মিলিয়ে দিচ্ছে সে। আর যেখানে ত্রিস্তান, সেখানেই সরোজ। পাশে দাঁড়িয়ে সরোজও ড্যাবড্যাব করে আশপাশ দেখছে। হঠাৎ অটবীকে চোখে পরলো ওর। তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের বাহু গুঁতিয়ে জোরেসোরে বললো, “ভাই? ওইডা অটবী আপু না? লগে ওই ব্যাডা কে?”
ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে বামদিকের রাস্তায় তাকালো। অটবী তাড়াহুড়োয় কোথায় যেন যাচ্ছে। পাশে মোটামোটি ধাঁচের একটা ছেলে। হেসে হেসে কথা বলছে। অজান্তেই ঈগল চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। দৃঢ়, গাঢ় নয়নে ওদেরকে সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলো ত্রিস্তান। বুক ভারী হওয়ার পূর্বে সরোজকে বলতে শুনলো, “এই ব্যাডা তো মনে হয় ওই বিয়ের ছেলে। অটবী আপু না বিয়ে ভাইঙ্গা দিসে? এ ব্যাডা এনে কি করে?”
হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। দূরের দূর্বাঘাসে সেটি ছুঁড়ে ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো ত্রিস্তান। অটবী সেই ছেলেটার সাথে এতই ব্যস্ত যে, পেছনে ফেলে আসা ত্রিস্তানকে সে একবারও খেয়াল করেনি। ভালো! সে তো এটাই চেয়েছিল। প্রথম থেকে। কিন্তু তবুও বুকটা এমন নীল নীল ব্যথায় কাতরে উঠছে কেন? নীলেরা এত নিষ্ঠুর হয় কেন? মুক্ত বাতাসের অভাবে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে।
–
প্রাণের অরণ্য,
আমি দুটো তুমি দেখেছি। চোখ বুজে রাখলে আমার একদম কাছের তোমাকে আর চোখ মেললেই বহুদূর হারিয়ে যাওয়া তুমিকে।
আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। মেঘের তড়িৎ গর্জনে ভেতরটা নড়ে উঠছে। সেই দু’ঘণ্টা আগ থেকে বৃষ্টি আসবে আসবে বলেও আসছে না। ভয় লাগাচ্ছে শুধু। তনয়া বায়না ধরেছে, সে বৃষ্টি দেখে ভাত খাবে। কিন্তু কই? এত অপেক্ষা করেও তো বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেষ অনেকটা জোড় করেই তনয়াকে ভাত খাইয়ে দিতে লাগলো ত্রিস্তান। তনয়া গাল, নাক ফুলিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির ওপর তার ভীষণ রাগ। পঁচা, দুষ্টু বৃষ্টি।
ভাতে আজ বিশেষ কিছু নেই। আলু ভর্তা, ডাল। তনয়ার আবার এইসব ভর্তা বেশ পছন্দ। ভাতের একেকটা লোকমা সে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে চিবুচ্ছে। খেতে খেতে কেঁশে উঠতেই পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ত্রিস্তান। নরম কণ্ঠে বললো, “আস্তে খা।”
বলতে বলতে পাশের চেয়ারে শোকের ছায়া এঁটে রাখা সরোজকে একবার আড়নয়নে দেখলো সে। এক লোকমা ভাত তনয়ার মুখে পুরে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? মুখ অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”
সরোজ বেজায় মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি খবর শুনো নাই?”
—“কেমন খবর?”
সরোজ আগের মতোই ম্লান কণ্ঠে বললো, “অটবী আপু বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ে।”
তারপর মুহুর্তেই ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “তুমি কিছু করবা না ভাই? আপুরে এমনে এমনে বিয়ে করতে দিবা?”
ততক্ষণে চঞ্চল হাতজোড়া থেমে গেছে। স্তব্ধ হয়েছে শরীর, ফাঁকা হয়েছে মস্তিষ্ক! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিশ্বাসগুলো এমন আটকে আটকে আসছে কেন? তনয়া ভাতের জন্য তাগাদা দিতেই সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। আস্তে করে উত্তর দিলো, “আমি কি করবো?”
—“কি করবা মানে? বিয়ে আটকাবা না? তুমি না আপুরে ভালোবাসো?”
‘তুমি না আপুরে ভালোবাসো?’— কথাটা যেন কেমন। মাথায় পাহাড়সম চাপ সৃষ্টি করে। মনে হয়, তার মতো অসহায় আর দুটো নেই। সে কিছু পারে না। কাউকে আগলে রাখার নূন্যতম ক্ষমতাও তার নেই।
পুরোটা সময় সরোজ ত্রিস্তানের উত্তরের অপেক্ষায় বসে ছিল। ত্রিস্তান উত্তর দেয় নি। তনয়াকে ভাত খাইয়ে চুপচাপ চলে গেছে নিজ রুমে। বিছানার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারে কয়েকটা ঘুমের ঔষধ গুছিয়ে রাখা আছে। সেখান থেকে তিনটে ঔষধ নিয়ে ত্রিস্তান পানি দিয়ে গিললো তা। বিছানায় গা এলালো। ফোনের গ্যালারির প্রথর সারির একটা ভিডিও ওপেন করবো। এটা তার মায়ের ভিডিও। তার মা গান গাইতে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় তাকে কোলে নিয়ে এভাবেই গান গেয়ে ভিডিও করে রাখতেন তিনি। ওইযে? ভিডিও-তে দেখা যাচ্ছে তার মাকে। শাড়ি পরে, বাঙালিয়ানা সাজ সেজে ছোট্ট ত্রিস্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। বাংলা গান তো আর তেমন ভালো পারেন না। ইংরেজি কি যেন একটা গান গাইছেন। ভিডিও করছেন তার বাবা। যে কেউ দেখলে বলবে, “অ্যা ফরএভার হ্যাপি ফ্যামিলি!”
ভিডিওটা ত্রিস্তান বারবার টেনে দেখলো, শুনলো। দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে তন্দ্রায় দূর্বল হয়ে পরলো সে। চোখের তীব্র জ্বালায় কপাল কুঁচকালো। হাহ! তার না পাওয়ার ঝুলিতে আরেকটা না পাওয়া যোগ হয়ে গেল। তার এত না পাওয়া!
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা