অটবী সুখ
১৮.
চারিদিকে বৃষ্টির মাতাল ঘ্রাণ। শূণ্য, ফাঁকা রাস্তা। বর্ষণের ঝরঝর গানের মাঝে গরম নিশ্বাসের তীব্র শব্দ কানে ঠিকই পৌঁছাচ্ছে। মনহরিণ দুঃখ বালকটা অটবীর একদম গা ঘেঁষে এঁটে আছে। জ্বরে শরীর উত্তপ্ত, কাঁপছে ক্ষীণ। অটবী পূর্ণদৃষ্টিতে ত্রিস্তানের দিকে চেয়ে রইলো। লোকটার শারীরিক দূর্বলতা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফর্সা ত্বকের জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ লাল আবরণ। ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে বারবার। অটবী বুঝতে পারছে না। তিক্ত একটা স্বাদ গলায় ঠেকে আছে। চিন্তা হচ্ছে, রাগ লাগছে। এই বৃষ্টির দিনে লোকটার বের হওয়ার দরকার কি ছিল?
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তানকে ডাকার চেষ্টা করলো অটবী, “ত্রিস্তান? শুনছেন? উঠুন! আপনার ফোন কোথায়? পকেটে?”
ত্রিস্তান জবাব তো দিলোই না, উলটো অটবীর শরীরের সঙ্গে আরও লেগে বসলো যেন। হাতের বাহুতে নাক ঘঁষে আবারও কি যেন বিড়বিড়ালো।
অটবী হাল ছেড়ে দিলো। নিজেই ত্রিস্তানের ফোন খুঁজতে লাগলো। প্রথমে শার্টের পকেট, এরপর প্যান্টের পকেট! বাম পাশের পকেটটায় পাওয়া গেল ফোনটা! ত্রিস্তানের ফোন দিয়ে আগেও একবার সরোজকে কল করেছিল অটবী। ওইযে? যেদিন লোকটা অসুস্থ হয়ে পরেছিল রাস্তায়? তাই একটু চিন্তা মুক্তই হলো সে। অনতত বিপদের সময় ফোনের লক-টক খোলার তো কোনো ঝামেলা নেই। নয়তো লোকটার যা অবস্থা! মনে তো হয় না ভূমিকম্পে চাপা পরলেও ঘুম ছেড়ে উঠবে।
ত্রিস্তানকে একপলক দেখে ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ লাগালো অটবী। সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা প্রবল ঝটকা তিরতির করে শিরাউপশিরায় উপচে উঠলো। নিশ্বাস থমকালো, চোখের পাতা মিলেমিশে একাকার হতে ভুলে গেল, মন হতবিহ্বল হয়ে নিজেকে শুধালো, “এসব কি?”
ফোনের ওয়ালপেপারে অটবীর নিজের ছবি। বাজারে সবজি কিনছে সে। কোনো কারণে দোকানির সাথে বিশাল বাকবিতর্ক হওয়ায় ভীষণ বিরক্ত নিয়ে চেয়ে আছে। হাতে আরও কিছু সবজি-মাছ-মাংসের পলিথিন। অটবীর নিশ্বাস থেমে থেমে আবার আটকালো। তার মনে পরলো, ছবিটা বেশিদিন আগের না। কালকে এই ছাই রঙা জামাটা পরেই বাজারে গিয়েছিল সে। পণ্যের দাম বেশি চাওয়ায় বিক্রেতার সঙ্গে চরম ঝগড়াও করেছিল। কই? ত্রিস্তানকে তো তখন আশেপাশে দেখেনি!
মনের সন্দেহের দানাটা বিপুল হতেই কি মনে করে গ্যালারিতে ঢুকলো অটবী। সেখানে আলাদা কোনো ছবির ফোল্ডার নেই, ছবি নেই, ভিডিও নেই— শুধু মাত্র পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ছবি ছাড়া। পাঁচটি ছবিই তার। একটাতে সে হাসছে, একটাতে নলীকে বকছে, একটাতে শাড়ি পরে আনমনা হয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছে! প্রত্যেকটা ছবিই ভীষণ সাবধানে তোলা। অটবী কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ত্রিস্তানের এমন রুপও থাকতে পারে!
মস্তিষ্কের নিউরনগুলো হঠাৎই চঞ্চল হয়ে এক এক করে দেখিয়ে দিলো, ত্রিস্তানের করা প্রত্যেকটা কাজ, কথা বলার ধরণ, যত্ন! চুপিচুপি বললো, ছেলেটা তোকে পছন্দ করে বোকা মেয়ে। নয়তো এসবের মানে কি?
দমবন্ধকর অনুভূতি নিয়ে ফোন থেকে দৃষ্টি সরালো অটবী। নিশ্চল চোখে ত্রিস্তানের ফ্যাকাশে মুখপানে তাকিয়ে রইলো বহুক্ষণ। আটকে আসা কণ্ঠে বলতে চাইলো, “ত্রিস্তান, আপনি কখন…এতটা…”
গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। ত্রিস্তান নড়ছে। চোখ পিটপিট করে আবারও ঘুমের অতলে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। দিশেহারা অটবী ত্রিস্তানকে কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে শিউরে উঠলো।
–
চারদিন একাধারে বৃষ্টির পর আজকের দিনটা রোদ্দুরে ঝলমল। বৃষ্টির কারণে অনেকটাই রাজনৈতিক ঝগড়া মিটে গেছে। অল্পতে ঝামেলা শেষ করতে রাজি হয়েছে দু’পক্ষ। নয়তো আজ বাদে কালও গোলাগুলির ভয়ংকর শব্দে গোটা এলাকা আঁতঙ্কে থতমত হয়েছিল।
অটবীর মন বলছে, সেদিন ত্রিস্তান তার জন্যই বৃষ্টি মাথায় করে এসেছিল। তাকে আটকাতে। সফলও হয়েছিল বটে! সরোজকে কল করার পর সে একবাক্যে মানা করে দেয়, এখন এলাকায় ঢোকা যাবে না। পরিস্থিতি শিথিল হলে সে নিজেই তাদের নিতে আসবে। গুণে গুণে তিন ঘণ্টা ত্রিস্তানকে নিয়ে সেই নির্জন আঁধারিয়া জায়গায় জড় বস্তুর মতো বসে থাকতে হয়েছিল অটবীকে। ত্রিস্তান তখনো জ্বরে কাতর। আধবেহুশ। কিছুক্ষণ পর পর কিসব হাবিজাবি কথা বলে পাগল করে দিচ্ছিল। আচ্ছা, লোকটা এখন কেমন আছে? এতদিনে তো সুস্থ হয়ে যাওয়া কথা। সুস্থ হয়েছে কি? কিজানি! ওইদিনের পর তো আর দেখাই হলো না!
ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে সাত। টিউশনে বেরিয়েছে অটবী। সাধারণত এত সকাল সকাল সে কোথাও বের হয়না। টিউশনগুলোও বিকালে অথবা রাতের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করে। কিন্তু রেবা বেগমের স্পষ্ট মানা, সন্ধ্যার পর বাসার বাহিরে থাকা যাবে না। কারণটা অবশ্য সেদিনের ঘটনাই। মেয়েকে রাতে বাসায় ফিরতে না দেখে প্রেসার বাড়িয়ে, কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর যখন অটবী বাসায় ফিরলো, তখন শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে নিজের বুকের ভেতর গুঁজে রেখেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আসলে মায়ের মন তো! মায়েরা আবার মেয়েদের প্রতি একটু বেশিই ব্যাকুল থাকেন।
সরব, কে যেন ডেকে উঠলো অটবীকে। ডাকটা সামনে থেকে আসছে। সামনের মুদির দোকান থেকে।
—“অটবী আপু? কেমন আছো?”
অটবী রয়েসয়ে নজর তুললো। তনয়া দৌঁড়ে আসছে। হাতে চিপস, কোক। দ্রুত কাছে এসে আবারও ছটপটে কণ্ঠে বললো, “কত্তদিন পর দেখা আপু! জানো, আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি। ভাইয়াকেও বলেছিলাম তোমার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু ও পঁচা। তোমার কাছে নিয়ে যায় না।”
অটবী একটু অপ্রস্তুত হলো। সস্নেহে হাত রাখলো তনয়ার চুলের ভাঁজে। আলতো হেসে বললো, “কেমন আছো?”
—“ফাঁটাফাঁটি।”
—“তোমার ভাইয়া কেমন আছেন? উনার জ্বর ঠিক হয়েছে?”
অটবী কি কোনো কৌতূক বললো? হয়তো। তার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তনয়া। প্রচন্ড গর্ব নিয়ে বললো, “বুঝলা? আমার ভাইয়াকে জ্বরও ভয় পায়। একদিনও টিকতে পারে নি। ভাইয়া একটা ধমক দিয়েছে, আর ও গায়েব!”
অটবী আবারও হাসার চেষ্টা করলো। মুদির দোকানে একটু করে তাকিয়ে দেখলো, সরোজকে দেখা যাচ্ছে। চিপস্, কোকের দাম মেটাচ্ছে সে। সাথে নিজেও কি যেন কিনছে। অটবী সেদিকে চেয়ে থেকেই কোনোরূপ ভণিতা ছাড়া বললো, “তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে তনয়া?”
—“কি কাজ?”
অটবী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো,”বেশি কিছু না। তোমাদের বাসাটা অনেক সুন্দর। আমার ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে? আমি তোমার সাথে সময়ও কাটাতে পারবো। একসাথে খেলতেও পারবো।”
তনয়া অবুঝ চোখে চেয়ে অটবীর কথা বোঝার চেষ্টা করলো। পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলে বললো, “আমি কিভাবে নিয়ে যাবো? আমি তো বাসার রাস্তা চিনি না।”
—“তোমাকে নিতে হবে না। সরোজ নিয়ে যাবে। তুমি শুধু সরোজকে বলবে, তুমি চাও আমি যেন তোমাদের সাথে তোমার বাড়ি যাই। বলতে পারবে না?”
তনয়া দাঁত বের করে হাসলো। মাথা দুলালো, “পারব।”
—“কাউকে বলবে না আমি তোমাকে এটা শিখিয়ে দিয়েছি, ঠিকাছে? তোমার ভাইয়াকেও না।”
—“আচ্ছা।”
অটবী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল! সে এমনটা কেন করছে, তা তার নিজেরও জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছে, অনেক কিছু আছে যা সে জানে না। কিন্তু তাকে জানতে হবে। জানতেই হবে!
–
অটবীকে ত্রিস্তানের বাড়িতে আনতে পেরে সরোজও অনেক খুশি। তার কেন যেন মনে হয়, ত্রিস্তান আর অটবীর মাঝে কিছু একটা চলছে। সবার অগোচরে তারা মারাত্বক প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এও মনে হয়, শীগ্রই সে একটা বিয়ে খাবে। অটবী আর ত্রিস্তানের। এরপর তার আর নলীর মাঝে বাঁধাধরা থাকবে না। ত্রিস্তান ভাই তো তাকে চেনে। তার নিশ্চই তাদের সম্পর্কে আপত্তি নেই। ত্রিস্তান অটবীকে শতভাগ রাজি করাতে পারবে। দরকার হলে সরোজ তার পায়ে পরবে, কান্নাকাটি করবে। আর অটবী তো ত্রিস্তানের কথা ফেলতেই পারবে না!
আগাম পরিকল্পনার কথা ভেবেই আনন্দে, উল্লাসে বাক-বাকুম পায়রা হয়ে গেল সরোজ। অটবীকে ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে শ্রদ্ধার সহিত জিজ্ঞেস করলো, “কি খাইবা আপু? তোমার লাইগা কি বানামু কও? তুমি খালি মুখ থেইকা বাইর করবা, আমি এক্ষুণি হাজির করতাছি।”
অটবী তখন ডাইনিং টেবিলের সামনে ত্রিস্তানের ফ্যামিলি ফটোটা দেখছিল। সরোজের প্রশ্নে ওর দিকে তাকালো, “আমি এখানে খেতে আসিনি… ত্রিস্তান আছে বাসায়?”
সরোজ চোখ বড় বড় করলো। ঠোঁটে বিরাট দুষ্টু হাসি এঁটে বললো, “ভাই তো নাই। আইয়া যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না। বেশি অপেক্ষা করতে হইবো না।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “নুডুলস্ বানাই তোমার লাইগা? কিছু না খাইয়া তো এন থেইকা যাইতে পারবা না।”
অটবীর হতাশ চোখের দৃষ্টি, “নিজের বাসায় যাচ্ছো না কেন, সরোজ? চাচা তোমার জন্য কত চিন্তায় আছেন, জানো কিছু?”
সরোজ যেন গায়ে মাখলো না। আনন্দে আটখানা হয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো, “থাকতে দাও। একটু চিন্তা করলে বুইড়ার কিচ্ছু হইতো না।”
সময় গড়ালো। ঘড়িতে দশটা বাজছে। সরোজ রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। তনয়া অটবীর পাশে বসে রঙ নিয়ে কি কি যেন আঁকাবুকি করছে। তাদের ডান পাশে দুটো রুম। প্রথমটার দরজা বন্ধ। ওটা ত্রিস্তানের। পাশেরটা তনয়ার। দরজার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন পুতুল, ড্রেসিংটেবিলে সাজগোজের জিনিস দেখা যাচ্ছে।
অটবী আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “সরোজ, ওয়াসরুমটা কোথায়?”
—“ত্রিস্তান ভাইয়ের রুমে একটা। তনয়া আপুর রুমে একটা। তোমার যেডায় মন চায় চাও। ত্রিস্তান ভাইয়ের রুম কিন্তু পয়লাডা!”
কথাগুলো সরোজ উলটাপালটা মতলবে বললেও অটবী ভেতরে ভেতরে ভীষণ দূর্বল, অনিশ্চিৎ, ভীতু। ক্রমশই হাত পায়ের শীতলতা টের পাচ্ছে সে। সে যা করছে তা কি ঠিক? হয়তো না। একদমই ঠিক না। কিন্তু এছাড়া যে আর কোনো পথ নেই। সামনের বিরাট সাইনবোর্ডে লিখা, “ফিরে যাওয়া নিষেধ।” তবে? অটবী ফিরবে কেমন করে? সব যে বন্ধ! তালা দেওয়া!
তেঁতো নিশ্বাস ফেলে তনয়ার দিকে একবার তাকালো সে। নাহ্! এদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। সে নিজের কাজেই ব্যস্ত। পাথর সম পাদুটো নিয়ে অটবী এবার সামনে এগোলো। নিঃশব্দে ঢুকলো ত্রিস্তানের ঘরে। সাদামাটা একটা ঘর! তবে দৈর্ঘ-প্রস্থ অনেকটাই বড়। আগাগোড়া পরিচ্ছন্ন, গোছানো! আসবাবপত্র তেমন একটা নেই। শুধু বুকসেলফ, চেয়ার-টেবিল, খাট, আলমারি। এজন্যই হয়তো আকারে বড় লাগছে ঘরটা। অটবী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। পা বাড়িয়ে বুকসেলফের কাছাকাছি হলো। উপরের তিনটে তাকেই বই। বাকি তাকগুলো কাঁচের ভেতর তালামারা। খোলার উপায় নেই। তৃতীয় তাকে বইয়ের পাশাপাশি কিছু ফাইলও আছে। অটবী সেগুলোতেই হাত বাড়ালো। ভেবেছিল, কিছু একটা পাবে। কিন্তু না। ফাইলগুলোতে কিসব হিসাব প্রিন্ট করা। কাজের কিছু নেই। আশাহত হয়ে অটবী বইগুলো দেখতে লাগলো এবার। এক এক করে সবকটা। তার মন টানছে না। সে কিছু একটা চায়। কোনো একটা রহস্যের সমাধান! যেকোনো একটা!
উপরের তাকের বইগুলোতে হাত বাড়াতেই নিচ্ছিল, এসময় হঠাৎ বাহুতে টান পরে। চোখ তুলে দেখে, ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাজারের ব্যাগ। মুখ ঘর্মাক্ত। চোয়ালে কাঠিন্যতা স্পষ্ট। বাহির থেকে এসেই হয়তো এ ঘরে ঢুকেছে।
—“এখানে কি করছিলে, অটবী?”
অটবীর গলা দিয়ে যেন কথা বেরোলো না। বাজেরকমের আন্দোলনে আহত হলো। থেকে থেকে বলতে চাইলো, “আমি… ওয়াসরুম…”
ত্রিস্তান থামিয়ে দিলো, “ওয়াসরুম ওদিকে। এখানে কি করছো?”
—“বই দে-দেখছিলাম।”
সশব্দে একটা নিশ্বাস ফেললো ত্রিস্তান। ধপ করে বাজারের ব্যাগটা ফেলে দিলো মেঝেতে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, “এরপর থেকে তনয়ার রুমে যা দরকার করবে। এ রুমে আসবে না।”
অটবীর বলতে ইচ্ছে হলো, “এঘরেই তো তার যত সব দরকার। তাহলে কেন আসবে না?”
কিন্তু বলা হলো না। ততক্ষণে ত্রিস্তান চোখের ইশারায় তাকে বিছানায় বসার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সেও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ একপাশে বসলো। ত্রিস্তানের মুখোমুখি। আস্তে করে বললো, “আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”
ত্রিস্তানের গলার সুর শীতল, অস্বাভাবিক শান্ত। সে প্রায় তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, “সেদিনের কথা ভুলে যাও, অটবী। আমি যা বলেছি সব ভুল। কিচ্ছু সত্য না।”
অটবী দমলো না। গলার জোর বাড়ালো, “আপনার বাবা-মার এক্সিডেন্টের পর কি হয়েছিল, ত্রিস্তান? আমি জানতে চাই।”
—“তোমাকে সব ভুলে যেতে বলেছি।”
—“ভুলে যাওয়ার মতো কিচ্ছু বলেননি। যা বলেছেন তা আমার কৌতূহল বাড়িয়েছে মাত্র! কোনো রহস্য উদঘাটন হয়নি।”
অটবী থামলো। তারপর কেমন করে হাসলো যেন, “আপনি অনেক চতুর, ত্রিস্তান। জ্বরের ঘোরেও সত্য বলেননি। পুরোটা চেপে গেছেন। আপনি আমাকে পছন্দ করেন, সেটাও কখনো বুঝতে দেননি। কেন?”
কণ্ঠ কাঁপছে তার। চোখ জলে টলমল। পাষাণ ত্রিস্তান কঠিন হৃদয়ে পুরোটা দেখলো শুধু। কিচ্ছুটি বললো না। দেখে মনে হচ্ছে, সব স্বাভাবিক। আগের মতো।
তার এমন নির্বিকার আচরণ অটবীর পছন্দ হলো না। ভেতরটা বিষিয়ে দিলো। চোখের পানিগুলো অনাদরে ফেলে দুর্বিষহ কণ্ঠে হাহাকার তুললো, “আপনি আমাকে নিজের প্রতি দূর্বল করে এভাবে মাঝপথে ছেড়ে যেতে পারেন না, ত্রিস্তান! নিজের বাবা থেকে আপনি কম কিসের?”
ত্রিস্তান কি একটু চমকালো? মনে হলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে লোকটা ভীষণ নির্লিপ্তভাবে এগিয়ে এলো কাছে। অটবীর কান্না ভেঁজা গালদুটো মুছে দিলো মোলায়েম স্পর্শে। মেয়েটাকে কাঁদলে এত মানায়!
ধীর কণ্ঠে বললো, “আস্তে কথা বলো। সরোজ, তনয়া শুনতে পাবে।”
কথাটা কি তাকে তাচ্ছিল্য করে বললো লোকটা? মুহুর্তেই রুঢ় ভাবে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানের গভীর চোখদুটো নিজের দাবানলে আসক্ত চাহনির পিঠে ঝাঝরা করে দিলো। কাঠকাঠ গলায় বললো, “এ ঘরে কাকে লুকিয়ে রেখেছেন, ত্রিস্তান?”
চোখের পাতা যেন একটু কাঁপলো। অটবীর রক্তিম গালদুটো আলতো করে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো সে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “একটা মিথ্যে বলি অটবী? শুনবে?”
অটবীর উত্তর নেই। ত্রিস্তান উত্তরের অপেক্ষাতেও নেই। সে নিজের মতোই সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যেটা বলে উঠলো, “আমি তোমাকে ভালোবাসি না বলেই তোমার সব কিছু জানা অধিকার আছে, অটবী।”
তবে? এই মিথ্যের সত্য কি? আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সবকিছু জানার অধিকার নেই? কেন নেই?
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
১৯.
নিস্তব্ধ ঘরটাতে হৃদযন্ত্রের ধুকধুক ধ্বনি স্পষ্ট। আলাদা কোনো শব্দ নেই, কথা নেই। ত্রিস্তান তখনো চোখ বুজে রেখেছে। অটবীর গাল ধরে রাখা তার হাত দু’টো স্থির নেই। অসম্ভব কাঁপছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে অটবী দেখলো, ত্রিস্তান তার অতি নিকটে। রুঢ়ভাবে কপাল কুঁচকে আকাশের মতো বিষাদ নিয়ে লেপ্টে আছে। না পাওয়ার এক সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা চারিদিকে মৌ মৌ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন। এত বিষাদে ভরা কেন লোকটা? একটু মন খুলে কি হাসতে পারেনা? এত কষ্ট কিসের?
কর্মহীন পরে থাকা হাতটা ত্রিস্তানের হাতের পিঠে আলতো করে রাখলো অটবী। আটকে আসা কণ্ঠে ডাকলো, “ত্রিস্তান?”
ত্রিস্তান শুনলো। শেষ বারের মতো প্রিয়তমাকে অতি নিকট থেকে ছুঁয়ে, দেখে সরে দাঁড়ালো আস্তে আস্তে। বেদনায় নিমজ্জিত মুখটা মুহুর্তেই কঠিন করে অটবীর দিকে দৃষ্টি ফেলতেই খেয়াল করলো, মেয়েটা আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। চোখে ভয়। মনে আতঙ্ক। ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলার জন্য। ত্রিস্তানের ভ্রু কুঁচকে গেল হঠাৎ করেই। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে?”
ভারী আওয়াজে একটু চমকালো অটবী। দমবন্ধকর গলায় শুধালো, “আপনার কি হয়েছে ত্রিস্তান? আপনি কি সত্যিই অসুস্থ?”
ভ্রুটা যেন আরেকটু বেঁকে গেল। অটবীকে গভীর চোখে দেখতে গিয়ে জিভে এক বিশ্রী নোনতা স্বাদ উপলব্ধি করলো ত্রিস্তান। চট করে নাকের কাছে হাত ছোঁয়ালো। রক্ত! নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে! হাহ্! বিরক্তিকর এক নিশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে রুমাল নিলো ত্রিস্তান। যেমন তেমন করে রক্ত মুছতে মুছতে আদেশের সুরে বললো, “এখান থেকে যাও অটবী। আর কখনো এঘরে আসবে না।”
অটবী চরম অবাধ্য হলো। নিজ জায়গা থেকে এক পাও নড়লো না। জোর গলায় বললো, “উত্তর দিন আগে। আপনি কি অসুস্থ?”
—“হলে? চিকিৎসা খরচ দিয়ে উদ্ধার করবে আমায়?”
নিশ্বাসের গতি কমে নেই হয়ে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বিশ্রীরকমের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে অটবী। কিন্তু হচ্ছে না। উদাস এক ব্যর্থতা দুমড়েমুচড়ে নস্যি করে দিচ্ছে প্রতিবার। অটবী কখনো কারো সামনে কাঁদে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বুঝতে শিখেছে, নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে নেই। এই কঠিন নীতি মেনে চলা মেয়েটা সর্বদাই জয়ী, সফল। তবে আজ কি হলো? কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না কেন? চোখের কোণ ঘেঁষে একের পর এক অশ্রুকণা গালের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ নিজের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিয়ে ত্রিস্তান একবারও তাকে চেয়ে দেখছে না। কেন দেখছে না?
ত্রিস্তানের কাছে এক পা এগিয়ে লোকটার সামনাসামনি দাঁড়ালো অটবী। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললো, “আমি আপনার থেকে দূরে দূরেই ছিলাম ত্রিস্তান। আপনি কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করেছেন। এখন এর দায়ভার নিতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আগে মনে ছিল না? কষ্ট কি শুধুই আপনার হয়? আমার নেই?”
ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। গভীর চোখে চেয়েই রইলো। ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলো, “আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যেস আছে, অটবী। তোমার নেই।”
—“আমি অভ্যেস করে নেব। আপনি শুধু আমাকে সত্যটা বলুন।”
—“তুমি আমাকে ঘৃণা করবে, অটবী। এর চেয়ে আমি তোমাকে নাই-ই পেলাম।”
অটবীর গাল গড়ানো জলগুলো মুছে দেওয়ার বড্ড স্বাদ জাগলো তার। হাত বাড়াতে গিয়েও কি মনে করে আবার গুটিয়ে নিলো। টেবিলের পাশে ডাস্টবিন আছে। সেখানে রক্তে রঞ্জিত টিস্যুটা ফেলে আস্তে করে বললো, “আমার ঘুম পাচ্ছে অটবী। ঘুমাবো। তুমি এখন যাও।”
অটবী গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হলো, ত্রিস্তানের হাঁটু কাঁপছে। সে ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। মুহুর্তেই পাশ ড্রয়ার থেকে কি যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। দেখা গেল, ছোট্ট একটা কৌটা থেকে কিসের যেন তিনটে ঔষধ নিচ্ছে সে। পানির গ্লাসটা ওঠাতে গেলেই মেঝেতে পরে গেল সেটা। ত্রিস্তান অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। অথচ মুখটা তখনো কঠিন, রুক্ষ।
অটবী দেড়ি করলো না। ছুটে গিয়ে ত্রিস্তানের পাশে বসলো। কাঁধে হাত রেখে উদগ্রীব কণ্ঠে একাধারে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এমন করছেন কেন ত্রিস্তান? বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকি? শুনুন না! ত্রিস্তান?”
ত্রিস্তান জবাব দিচ্ছে না। একটা হাত কপালে চেপে ঝুঁকে আছে। অটবীর ভয় বাড়ল। দিকবেদিক শূণ্য হয়ে সরোজকে ডাকতে নিলেই থামিয়ে দিলো ত্রিস্তান।
—“পানি খাবো।”
মেঝেতে পরা গ্লাসটা কাঁচের হলেও ভাঙ্গেনি। অটবী সেটা উঠিয়ে আবার পূণরায় পানি ঢাললো। ঔষধ সহ ত্রিস্তান সেটা গিললো মাত্র। কিন্তু তবুও শান্তি মিলছে না। বুক জ্বলছে, চোখ জ্বলছে। বুকের ব্যথাটাই বরং বেশি।
ত্রিস্তানকে কোনোমতে শুইয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অটবী। লোকটা কিছুতেই শুতে চাইছিল না। ত্যাড়া আচরণ করছিল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছেন এখন?”
ত্রিস্তান সে উত্তর দিলো না। অতি গোপনে অটবীর একটা হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিলো। ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কেমন করে যেন বললো, “এই অটবী! আমার কিন্তু তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
লোকটা ঘুমিয়ে গেছে। তখনো গভীর করে ধরে রেখেছে তার হাত। অটবীও ছাড়লো না। ধরে রইলো। এরমাঝে অবশ্য সরোজ আর তনয়াও একবার এসেছিল, আওয়াজ শুনে। কিন্তু তাদের এভাবে দেখে তনয়াকে জোড় করে টেনে নিয়ে গেছে সরোজ। আর আসতে দেয়নি।
–
ঘড়িতে একটা বেজে সাত। এ বাড়ির আশেপাশে মসজিদ না থাকলেও সুদূর থেকে আযানের ক্ষীণ সুর কানে ভেসে আসছে। খোলা জানালার বামদিকে দুটো চড়ুই বসে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথা এদিক-ওদিক করে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে যেন। অটবী সেখান থেকে দৃষ্টি সরালো। দুঃখ মানব গভীর তন্দ্রায় বিভোর। নিশ্বাসের আনাগোনা প্রচন্ড ধীর, ক্ষীণ। হাতের বাঁধনও আলগা হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত কি? হওয়ারই কথা।
ত্রিস্তানের প্রতি অটবী ঠিক কখন দূর্বল হয়ে পরেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর আদৌ তার জানা নেই। হয়তো দূরে দূরে থাকতে গিয়েই ক্রমশ অধঃপতনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। পা বাড়াতে বাড়াতে এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। ফিরে যাওয়াটা এখন ভীষণ কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রিস্তানের গাল আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো অটবী। ঠান্ডা হয়ে আছে। আঙুলের ছোঁয়াটা গালের সবটুকু জায়গায় ঘোরালো। লোকটার অতীত সম্পর্কে সে অত শত জানে না। যেটুকু জানে, সেটুকু তার বিশ্বাস করতে খুব অবাক লাগে। এ জানার মাঝেও অনেক কিছু লুকানো আছে, আড়ালে আছে। ত্রিস্তান জ্বরের ঘোরেও সেসব কথা মুখে আনেনি।
অটবীর চোখে ভাসে, সেদিন বৃষ্টির রাতে ত্রিস্তানের অবুঝপনা। একদম নিষ্পাপ শিশুটি হয়ে যাওয়া। ত্রিস্তান যেন তখন অন্য মানুষ। কৃত্রিমতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। উদাস এক ব্যক্তি হয়ে একমনে চেয়ে ছিল অটবীর মুখপানে। মাদকতা নিয়ে বলেছিল, “তোমাকে আমার বুকে গুঁজে রাখতে ইচ্ছে হয়, অটবী। বুকে আসবে?”
অটবী তখন কিছু বলতে পারেনি। চুপ করে ছিল। এই চুপ করে থাকার সময়টাতেই ত্রিস্তান কতকিছু যে বলেছে! ও-কে নিয়ে, ওর মাকে নিয়ে, ওর বাবাকে নিয়ে। এইযে! এই সুন্দর ছেলেটা আগে প্রচন্ড রকমের খারাপ ছিল। পুরো দিন-রাত নেশায় বুদ হয়ে থাকা ছিল তার একমাত্র কাজ। ঠিকঠাক ভাবে খেতো না, ঘুমাতো না। পড়ালেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। ড্রাগস্-এর নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ত্রিস্তান। ত্রিস্তানের বাবা তাই ছেলের এ অবস্থা দেখতে পারছিলেন না। তার এত স্বাদের ছেলে! সুস্থ ছেলে! এমন হয়ে গেল কিভাবে? ছেলেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ত্রিস্তানের বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া হতো। দুজনেই দুজনকে দোষারোপ করছে, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে, “তুমি ভুল!”
ঝগড়ার একপর্যায়ে ভালোবাসাটা যেন কোথাও লুকিয়ে গেল। দূরত্ব বাড়লো। অভিমান বাড়লো। ত্রিস্তানের বাবা আলাদা রুমে শুতে লাগলেন। কিন্তু তখনো ত্রিস্তান তার মতো। নির্বিকার। চোখের সামনে বাবা-মায়ের ঝগড়াটাও যেন তার বিবেক নাড়াতে পারছিল না।
ত্রিস্তানের মা, ডায়না আলবার্ট। বিয়ের পর হলেন ডালিয়া হোসাইন। ভীষণ দূর্বল, প্রিয়জন প্রিয় মানুষ। সম্পর্কের এই তিক্ততা, জটিলতা মেনে নিতে পারেননি। এক মধ্যরাত্রিতে ঝগড়ার মাঝখানে হাতের রগ কেটে ফেলেছিলেন। ভালোবাসায় যেন তখনই টান অনুভব হলো। ত্রিস্তানের বাবার সম্বিৎ ফিরলো। স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। কিন্তু তারপর… তারপর পরিস্থিতি পুরো পালটে গেল। কার এক্সিডেন্টে আহত-নিহত হলেন ত্রিস্তানের বাবা-মা। ত্রিস্তান যখন এ খবর শুনেছে, তখন রাত পেরিয়ে সকাল। নেশায় বুদ হয়ে পরেছিল বিছানার একপাশে। তনয়া আট মাসের ভরা পেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ডাকছিল ভাইকে। ত্রিস্তান উঠছিল না। তার চোখে যে তখন কি ঘুম! এত ঘুম পাচ্ছিল কেন? রাতে বেশি নেশা করে ফেলেছিল বলে?
ত্রিস্তানের চোখের কালো দাগে হাত বুলালো অটবী। পরক্ষণেই কি মনে করে দ্রুত ড্রয়ারটা টান দিয়ে খুললো। ত্রিস্তান যে ঔষধগুলো খেয়েছিল তার কৌটা সাদা রঙের। সামনে-পেছনে-উপরে-নিচে কোথাও সামান্য লেখা নেই। সম্পূর্ণ ফাঁকা। ড্রয়ারে যদি কিছু থাকে! তবে আফসোস! তন্য তন্য করে খুঁজেও তেমনে কিছু পেল না অটবী। শুধু এক ডায়েরি ছাড়া। ডায়েরির আগাগোড়ায় কয়েকটা কবিতা লেখা। কবিতার একদম শেষে অচেনা নামও উল্লেখ করা। ‘সৈয়দ শাহ্জাহান!’ এটা কে হতে পারে? অটবী অতসবে গেল না। এক এক করে সব পৃষ্ঠা দেখতে লাগলো। সর্বশেষ পৃষ্ঠাটায় গুটিগুটি করে লিখা,
“প্রিয় অরণ্য, আমার কেন যেন মনে হয়, তুমি সুখী হবে। কোনো এক সুখী মানুষের সাথে ঘর বাঁধবে। সেই ঘরের নাম দেবে ‘অটবী সুখ’। সেই ঘরের কোথাও আমি থাকবো না। আমার অস্তিত্ব থাকবে না। অথচ তোমাকে চোখের আড়ালও হতে দেবো না। তুমি যখন ফুটপাত দিয়ে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটবে, আমি দূরে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখবো। তোমার হাসিটুকু দেখে নিজেও হাসবো…
এই অটবী! এই মানুষটা অন্যের জেনেও তাকে ভালোবাসা কি পাপ হবে? আমি কি আজীবন পাপী হয়ে থাকবো?”
স্তব্ধ অটবী খামচে ধরলো ডায়েরিটা। হাত, পা কাঁপছে। ভেতরটা নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় তিরতির করছে। টলমলে চোখদুটো ত্রিস্তানের পানে স্থির হতেই মস্তিষ্কে টান লাগলো, ত্রিস্তান বলছে, “আমি আমার বাবা-মায়ের মতো হতে চাইনি, অটবী। আমি তাকে রুমে আটকে রাখতে চাইনি।”
সেদিনের মতো। সেদিনের সেই বৃষ্টির রাতের মতো ত্রিস্তান আবারও একই কথা বলছে।
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা