অটবী সুখ
১৬.
আকাশে গুটিকয়েক তারা বাসা বেঁধেছে। সবচেয়ে বড় তারাটা সবার উপরে মিটিমিটি হাসছে। চাঁদের আলো মোটামোটি। জঙ্গলের আশপাশটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। তবুও অটবীর ভেতরটা স্বস্তি পাচ্ছে না। সে অন্ধকার ভয় পায়। ছোট থেকেই। দুঃখ-যন্ত্রণা সয়ে সয়ে সেই ভয়টা ক্ষীণ কমে গেলেও একেবারে নিঃশেষ হয়নি। এই যে, ইয়া লম্বা লম্বা গাছগুলো বামে-ডানে দাঁড়িয়ে লোভাতুর দৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। বুকটা কাঁপছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমশই। সে একা হলে হয়তো এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। কিন্তু পাশে ত্রিস্তান আছে। লোকটার সামনে সে তার দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। যথাসম্ভব শক্ত খোলস আঁকড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কেউ দেখলে হয়তো কখনোই বুঝবে না, অটবীর অন্ধকারে ভীষণ ভয়।
জঙ্গলের পথ প্রায় শেষ। রাস্তার শুরুতে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। সেটার আলো দশ-বারো হাত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। বাসার পথটাও অতটা নির্জন-আঁধারী না। সে নির্ভরে যেতে পারবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে অটবী বললো, “আপনাকে আর যেতে হবে না। বাকিটা আমি পারব।”
সম্পূর্ণটা পথ ত্রিস্তান নিশ্চুপ ছিল। আপন খেয়ালে মগ্ন হয়ে অটবীর পায়ের সঙ্গে পা মেলাচ্ছিল শুধু। সবসময়কার মতো আড়চোখে তাকায়নি পর্যন্ত। অটবী ভেবেছিল, এখনও বুঝি মৌন সম্মতি দিয়ে চলে যাবে সে। কিন্তু ত্রিস্তান গেল না। অনেক্ষণ বাদে নির্বিকার কণ্ঠে বললো, “তোমার বাসার ওদিকে আমার কাজ আছে।”
কথাটা অটবীকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সূক্ষ্ণ প্রস্তাব। কিন্তু আসলেই কি তার ওখানে কাজ আছে? অটবী বিশ্বাস করতে পারলো না। সরু চোখে তাকালো, “মিথ্যে বলছেন কেন?”
“আমি হতে পারি শ্রেষ্ঠ মিথ্যুক। কিন্তু এখন সত্য বলছি।”
“কি কাজ ওখানে?”
“এখানে ভালো সিগারেট পাওয়া যায় না। তাই ওখান থেকে কিনব।”
আশ্চর্য অটবী হতবিহ্বল হলো। ত্রিস্তানকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না সে ঠাট্টা করছে। চোখে-মুখে এত গম্ভীরতা! ব্যস্ততা! যেন এদিকটায় সত্যিই ভালো সিগারেট পাওয়া যায় না। ভালো সিগারেটের অভাবে ত্রিস্তান শুকিয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এইতো, আর চার-পাঁচ মিনিট। ভালো, মধুময়, অতি সুস্বাদু সিগারেট খেতে না পেয়ে ত্রিস্তানের বেদনাদায়ক মৃ’ত্যু ঘটবে।
অটবী জোরেসোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ গলায় বললো, “আপনি ক্লান্ত হন না?”
ত্রিস্তান উত্তর দেয়নি। খুব ধীরে সুস্থে সামনের দিকে একেকটা কদম ফেলছে। অটবী বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। এতদিনের সাক্ষাতের পরও ত্রিস্তানকে সে ভরসা করতে পারেনি। কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করে। লোকটা তুখোড় বুদ্ধিমান, চরম চতুর– সে জানে। অদ্ভুত আচরণ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে বোঝাতে চায়, সে খুবই ভয়ংকর একটা মানুষ। গহীনের মতো বিশাল রহস্য লুকিয়ে রাখতে রাখতে বড্ড ক্লান্ত। কিন্তু সেই রহস্যটা কি? অটবীর মাঝে মাঝে খুব কৌতূহল হয়। প্রশ্ন জাগে, বাউন্ডুলে, চোরেদের চুরি করার জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত সব বুদ্ধি দেওয়া ছন্নছাড়া ছেলেটা হঠাৎ এত রহস্যময় হয়ে গেল কিভাবে? আগের অপরিচিত ত্রিস্তানটাই বোধহয় ভালো ছিল। পরিচিত হওয়ার পর সেটা গলার কাঁটার মতো ঠেকে আছে।
“আপনার মা কি বিদেশি?”
তার প্রশ্ন শুনে ত্রিস্তান কি হাসলো? চট করে পাশ ফিরলো অটবী। নাহ্! লোকটা আগের মতোই নির্লিপ্ত হাঁটছে। দৃষ্টি, রাস্তার ইট-পাথরের দিকে। অটবী নজর ফিরিয়ে আবারও সামনে তাকালো। একটা সিএনজি বেকায়দায় এদিকেই আসছে। গতি নিয়ন্ত্রণে নেই। নেশাটেশা করে গাড়ি চালাচ্ছে নাকি? ভ্রু কুঁচকে মনে মনে কয়েকটা পাপী শব্দ উচ্চারণ করে ফেললো সে। ত্রিস্তানকে বললো, “আরেকটু কাছে আসুন। রাস্তার ওদিকে হাঁটছেন কেন?”
রাস্তার দুপাশে হাঁটার অত জায়গা নেই। ত্রিস্তান অটবীর দিকে চাপতেই না চাইতেও অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। অটবী অস্বস্তি হচ্ছে।
“আমার মা বিদেশি।”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো। জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো, “জি?”
ত্রিস্তান আবার বললো, “আমার বাবা পড়ালেখা করতে আমেরিকা গিয়েছিলেন। সেখানেই মায়ের সাথে পরিচয়, প্রেম তারপর বিয়ে।”
অটবী মন দিয়ে শুনলো। বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো কানে গুজলো। মায়াবী চোখ দুটো থেকে এখনো প্রশ্ন সরছে না। চাহনিতে প্রবল সন্দেহের দানা বুনে বললো, “আপনাকে তো বড়লোক মনে হচ্ছে। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি কোনো খারাপ কাজ করে এই এলাকায় লুকাতে এসেছেন? এমন গরিবের বেশ ধরে থাকেন কেন?”
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড! আচমকাই ত্রিস্তান হু হা করে হাসতে লাগলো। অটবী কখনো ত্রিস্তানকে এভাবে হাসতে দেখেনি। চোখ বুজে, নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অবিরাম হাসছে লোকটা। হাসতে হাসতে যেন কেঁদেই ফেলবে। অটবীর রাগ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন? আমি এমন কি বলেছি?”
নিষ্প্রাণ গাছে কে যেন পানি ঢেলেছে। মুক্ত, বাঁধাহীন হাসিতে ত্রিস্তানকে কিশোর থেকে কম লাগছে না। ছোট্ট একটা কম বয়সী ছেলে। যেন মাত্রই হাসা শিখেছে৷ আনন্দ কি জিনিস– তা উপলব্ধি করতে জেনেছে।
ত্রিস্তান হাসি থামালো। বলে চললো, “আমার মা খুব চঞ্চল ধরণের। ছোট থেকে ছোট বিষয় নিয়েই হাসিখুশি থাকতেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলো তার খুব ভালো লাগতো। বাবা তাই তাদের সেকেন্ড অ্যানিভারসেরিতে এখানে ঘুরতে আসেন। কাছের রিসোর্ট-টায়। ঘুরতে এসে খোঁজ পেলেন, জঙ্গলের মাঝখানে একটা বাড়ি আছে। বাড়ির মালিক বাড়িটা বিক্রি করতে চায়। মায়ের খুব পছন্দ হয়ে গেল বাড়িটা। বাবাও কিনে ফেললেন।”
অটবী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, “এখন তো আমি আরও নিশ্চিৎ, আপনি বড়োলোক।”
অটবীর অবুজপনায় ত্রিস্তান মুচকি হাসলো। মেয়েটার আজ হয়েছে কি? কাঠখোট্টা হওয়ার অভিনয় বুঝি আর করতে পারছে না?
রয়েসয়ে বললো, “বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারা সব সম্পত্তি নিজের নামে করে ফেলেন। এই বাড়িটা আমার নামে থাকায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তাই এই বাড়িটা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। আর আমিও তোমার ধারণাকৃত তথাকথিত বড়োলোক নই।”
অটবী থামলো না। আবারও প্রশ্ন করলো, “আপনাকে আমি কখনো এ এলাকায় দেখিনি কেন?”
“কারণ আমি শহরে বড় হয়েছি। মাঝে মাঝে এখানে আসতাম। বাসাতেই থাকতাম বেশি। আর আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি।”
কথায় কথায় কখন যে তারা ‘অরবিন্দ অটবী’-তে পৌঁছে গেছে, অটবী খেয়াল করেনি। খেয়াল হয়েছে তখন, যখন চুপি চুপি তার হাতে একটা-দুটো চকলেট গুঁজে দিলো ত্রিস্তান। সেই তখনকার চকলেট। যেটা অটবী নিতে চায়নি। ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি একবার দেওয়া জিনিস ফেরত নেইনা, অরণ্য। রাত হয়েছে, বাসায় গিয়ে চকলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পরো। তুমি এখনো তেতো রয়ে গেছো।”
–
আকাশে ঘন কালো মেঘেরা ছোটাছোটি করছে। এসময় আবহাওয়ায় একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই পুরোনো, অব্যবহৃত পুকুরটা সেটা হতে দিচ্ছে না। নাকের আশেপাশে শুধু বিশ্রী দুর্গন্ধই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুম হয়নি সরোজের। তন্দ্রার অভাবে চোখের শিরা-উপশিরা রক্তিম হয়ে আছে। চোখের পাতা ফুলে একাকার। ফর্সা ত্বক লাল টকটকে। কোনোমতে রুমাল দিয়ে নাক চেপে আছে সে।
নলী এসেই সরোজকে এভাবে দেখে চমকে উঠলো। উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “আল্লাহ্! এই কি অবস্থা আপনার? রাতে ঘুমান নাই?”
গলায় জোড় পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও লহু স্বরে সরোজ উত্তর দিলো, “না।”
–“কেন?”
এই ‘কেন’-র উত্তরে সরোজের কি বলা উচিত? কাল রাতের কথা ভাবতেও তো তার শরীর শিউরে উঠছে। রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে জঙ্গলের ভয়াবহ আঁধারের মাঝে ঠান্ডা জমজমে পুকুরের পানিতে গোসল করা কোনো চারটি খানি কথা না। তবে সেটাকে গোসল বলা চলে না। গুণেগুণে পঁচিশটা ডুব দিতে হয়েছিল তাকে। আল্লাহ মাবুদ জানে, পুকুরের ভেতর কি না কি! এমনিতে পিচ্ছিল সিঁড়ি, তারওপর পায়ের সাথে কি কি যেন বারি খাচ্ছিল বারবার। সরোজ তো ভেবেই নিয়েছিল, এটাই আর জীবনের শেষ সময়। এইতো! এখনই পানির নিচ থেকে একটা রাক্ষসী এসে ওর পা টেনে ধরবে!
অসহনীয় সেই ভয়ের কথা ভেবে সরোজের যেন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। রুমালের ওপাশে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে তাড়াহুড়ো গলায় বললো, “আজকের পর থেইকা এই পুকুরে আর দেখা করতে পারুম না। পুকুর দেখলেই আমার গা জ্বলে। শা’লার অজাতি-কুজাতি পুকুর! একটুর জন্য মাইরাই লাইতো।”
নলী কপাল কুঁচকে তাকালো। ইদানিং পৃথা বেশিই সিআইডি গিরি করছে। আঠার মতো চিপকে থাকে। অনেক কষ্টে সরোজের সাথে দেখা করতে এসেছে সে। অথচ ছেলেটা কাজের কথা না বলে সেই কখন থেকে আবলতাবল বকেই যাচ্ছে!
বিরক্ত হয়ে নলী বললো, “আমার হাতে সময় নেই। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। পৃথা থেকে নজর বাঁচিয়ে এসেছি। উলটাপালটা কথা না বলে ভালো কিছু বলুন।”
ওমনি, সরোজ তেঁতে উঠলো, “ভালো কিছু আর কি কইতাম? আমার মুখ দেখছিস? সর্দি-কাশিতে মইরা যাইতেছি। আদর-যত্ন না কইরা চেতস ক্যান?”
“আশ্চর্য! আপনি আমাকে ধমক দিচ্ছেন কেন?”
নিমিষেই সরোজ বড় বড় চোখে তাকালো। সে ধমক দিলো কখন? তড়িৎ গলায় বললো, “আমি কহন ধমক দিছি? তুই কি এহন অসুস্থ প্রেমিকের লগেও ঝগড়া করবি?”
নলী শুনলো না। ঠোঁট চেপে কাঁদো কাঁদো নয়নে তাকালো, “আপনি অন্যের রাগ আমার ওপর দেখাচ্ছেন, তাই না? ভালো! যত দেখানোর দেখান! এটাই আমাদের শেষ দেখা।”
নলী দৌঁড়ে চলে গেল। সরোজ বলতে চাইলো, “নলী, আমার কথাটা তো শোন।”
কিন্তু কথার মাঝখানেই ডাকাতের মতো ভয়াবহ বাজে হাঁচি-কাশিটা চলে এলো বাঁধা দিতে। কি বিশ্রী ব্যাপার-স্যাপার! আজকাল সর্দি-কাশিও এমন চরম মুহুর্তে এসে হাজির হয় নাকি?
–
অটবী কাদিনকে পড়াচ্ছে আজ নিয়ে পাঁচদিন। প্রচুর ফাঁকিবাজ ছেলে। একদিনও পড়া ঠিক মতো দিবে না। অংক করে রাখতে বললে কিচ্ছু করবে না। এসে থেকে ছুটি ছুটি বলে পাগল বানিয়ে ফেলবে। বয়সে ছোট হলেও কাদিন অটবী থেকে প্রায় দুই-তিন ইঞ্চি লম্বা। এত বড় একটা ছেলেকে মারতে-বকতে দ্বিধা হয় অটবীর। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। কালকে এত করে বলে গেছে, অংকগুলো করে রাখতে। অথচ কাদিন ছুঁয়েও দেখেনি। কয়টা অংক দিয়েছিল সে? ছোট ছোট মাত্র চারটা! আর কোনো পড়াও ছিল না।
অটবী বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। থমথমে গলায় বললো, “খাতা বের করো। এক্ষুণি আমার সামনে অংকগুলো করবে। দ্রুত!”
কাদিন নিজ জায়গা থেকে নড়লো না। ঠায় বসে রইলো। দায়সারা কণ্ঠে বললো, “আমি আজকে পড়বো না। ছুটি দিন।”
“কি বললে তুমি?”
“আমার ছুটি…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই স্কেলের আঘাতে কাদিনের শ্যামবর্ণ হাতের পিঠ ব্যথায় জর্জরিত করে দিলো অটবী। কাদিন তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো অটবীর দিকে। অটবীর মুখশ্রী কঠোর, রাগে লাল। টেবিল থেকে ব্যাগটা কাঁধে এঁটে চলে যেতে যেতে বললো, “তোমার আম্মুকে বলে দেবে, আমি আর তোমাকে পড়াচ্ছি না।”
ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অপমানে চৌচির হয়ে ইলিয়ানা আন্টির বাসা ত্যাগ করার পূর্বে অটবী খেয়াল করলো, ড্রইংরুমের দামি সোফার মাঝখানে অবাক হয়ে বসে আছে ত্রিস্তান। তাকে দেখছে। তার রাগান্বিত নিশ্বাসের উত্তাপ পরিমাপ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
১৭.
আষাঢ়ের ঘর বাঁধার সময় হয়েছে। পথ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল। আকাশ মেঘলা। গাছের ডালপালা, পাতা সতেজতায় মোড়ানো। এসময় কড়া একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা ধন্য! অথচ অটবীর সেই সুযোগ নেই। বিকেল চারটার মধ্যে তৈরি হয়ে ছুটতে হচ্ছে টিউশনে। হাতে ছোটখাটো ছাতা। কালো রঙের। বাহিরে বৃষ্টি তেমন না হলেও গুড়িগুড়ি ভাব। অটবীর আবার সমস্যা আছে। বৃষ্টিতে ভিঁজতে পারে না। বৃষ্টির পানি শরীরে একটু লাগতেই জ্বর-কাশি শুরু হয়ে যায়।
সাবধানে কদম ফেলে চলতে চলতে অটবী খেয়াল করলো, মোড়ের রাস্তায় ভয়ানক জটলা বেঁধে আছে। অসংখ্য মানুষ, তুমুল ঝগড়ার চিৎকার-চেঁচামেচি! একটু দূরেই ত্রিস্তান, কাদিন আর সরোজ দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, সবসময়কার মতো বাইকে রাজকীয় ভাবে বসে সিগারেটে একেকটা সুখটান দিচ্ছে। ঝগড়ার ওদিকে বিন্দু মাত্র মন নেই। ভাবখানা এমন, এসব অহেতুক জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখালেই তার মহা মূল্যবান সময় গণহারে পাচার হয়ে যাবে। দেশের অসহায় মানুষ সেই পাচার সইতে না পেরে দুর্ভিক্ষে শহিদ হবে। ত্রিস্তান তো আবার মহা দয়ালু! সে তো আর এ অন্যায়টা করতে পারে না! কিছুতেই না।
কিন্তু পাশের দুটো ছেলে আবার অন্যরকম। কাদিন আর সরোজ ভীষণ উৎসুক দৃষ্টে ঘটনাস্থলে তাকিয়ে আছে। কৌতূহলের চটে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে একেবারে। অটবী ওদেরকে কিছুক্ষণ দেখে সামনে পা বাড়ালো। কাছাকাছি আসতেই সরোজ তাড়াহুড়ো গলায় বললো, “তুমি ওই দিকে কই যাইতেছ, অটবী আপু?”
অটবী দাঁড়ালো। আস্তে করে বললো, “পড়াতে যাচ্ছি।”
“আজকে আর যাইও না। এই ঝগড়া বড় হইবো। পুরা এলাকায়ও ছইড়া যাইতে পারে। ওইযে? রাজু আছে না? ওর লগে বিরাট ঝামেলা হইছে। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার! আইজকা ঘর থেইকা বাইর না হওয়াই ভালো। তুমিও বাসায় চইলা যাও।”
অটবী এসব কখনই পাত্তা দেয় না। এবারও দিলো না। তাছাড়া ছাত্রের কালকে পরীক্ষা। আজকে না গিয়ে উপায় নেই। যেতেই হবে।
সামনে পা বাড়াতে নিলেই কাদিন এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “আরে আশ্চর্য! আপনাকে না ওখানে যেতে মানা করলো? তারপরও যাচ্ছেন কেন?”
এই কাদিন ছেলেটাকে অটবীর একদম পছন্দ না। সরোজ থেকেও চার ডবল বেয়াদব। আজ নিয়ে একমাস হচ্ছে সে কাদিনকে আর পড়ায় না। ইলিয়ানা আন্টি যদিও অনেকবার বলেছিলেন, কিন্তু সে যায়নি। তবুও দেখো! একটুও অপরাধবোধ নেই ছেলেটার মাঝে। কেমন নির্লজ্জের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অটবী তুচ্ছ শ্বাস ফেললো। একদম না শোনার ভান করে চলে গেল মোড়ের রাস্তার ওপাশে।
সরোজের চিন্তা কমলো না। অন্যমনস্ক ত্রিস্তানকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, ভাবী যে চইলা গেল? এখন যদি কোনো বিপদ হয়?”
সিগারেট-টা রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিসে ফেললো ত্রিস্তান। নির্লিপ্ত গলায় বললো, “বিপদ হলে আর কি… কালকে চকলেট নিয়ে তোর ভাবীকে হাসপাতালে সমবেদনা জানাতে চলে যাস।”
কাদিন বোকার মতো প্রশ্ন করলো, “কি চকলেট নিবো? দামি চকলেট নিতে পারবো না। এক টাকার চকলেট পাঁচটা নিলে হবে না?”
সরোজ চটলো খুব। এ নাকি ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! জেনেরাল নলেজটুকুও নেই! গোবর ভরা মাথা! ক্ষেপে গিয়ে বললো, “অ্যাঁই! তোর এখানে কি? রহিমের পিছে পিছে এ-না লেগে থাকবি! এনে কি? মধু বিলাইতেছি আমরা? যা তো এন থেইকা!”
কাদিন চোয়াল শক্ত করে তাকালো। ত্রিস্তানকে অভিযোগের সুরে বললো, “ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া। দেখো কিভাবে কথা বলছে! সবসময় এমন করে।”
—“ওই! বিচার দেস কারে? ত্রিস্তান ভাই কি তোর মা লাগে? ‘ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া!’ হুহ্! ঢং!”
কাদিন বেজার মুখে চেয়ে রইলো ত্রিস্তানের পানে। কিন্তু আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হতাশ হলো খুব। নিঃশব্দে কেটে পরলো ওখান থেকে। সরোজ সময় নিলো না। নির্জন একটু ফাঁকফোঁকর পেতেই আবারও অসমাপ্ত কথাটা শেষ করতে চাইলো, “ভাই! তোমার কিন্তু উচিত ছিল ভাবীরে আটকানো।”
—“তোদের ভাবীকে আটকিয়ে আমার কি লাভ?”
—“কারণ, ভাবী তোমার ভবিষ্যৎ বউ।”
ত্রিস্তান কিভাবে যেন হাসলো। তাচ্ছিল্য, অনীহার রেশ স্পষ্ট। ঠাট্টার সুরে বললো, “আমার বউ না, সে অন্যকারো বউ।”
“ধুর! মনে মনে প্রেম করো, অথচ মুখে শিকার করতে চাও না। এই আবার কেমন প্রেম?”
কপালে গুটিকয়েক বলিরেখা দৃশ্যমান হলো। কণ্ঠে বিস্ময়ের মিছেমিছি রেশ এঁকে ত্রিস্তান সুধালো, “এসব আজগুবি খবর কোথা থেকে শুনে এসেছিস? আমি মনে মনে প্রেম করতে যাবো কেন?”
—“অন্যখান থেইকা শুনতে হইবো ক্যান? আমার কি চোখ নাই? চোখ দিয়া দেখছি।”
ত্রিস্তান প্রথমেই উত্তর দিলো না। মিনিট খানেক নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে কিসের যেন হিসেব মেলালো। লুকোচুরি খেলতে আর ভালো লাগছে না। এই শীতল আবহাওয়াও ভ্যাপসা ঠেকছে। হাঁসফাঁস লাগছে। ভেতর থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ঠেলে আসলো। ত্রিস্তান ভীষণ ঠান্ডা গলায় বললো, “মনে মনে প্রেম, ভালোবাসার কিচ্ছু হয়নি, সরোজ। যেটা আছে, সেটাকে টাইমপাস বলতে পারিস।”
“কি কইলা?” সরোজের যেন বিশ্বাস হলো না। তার এত বছরের চতুর চোখ! ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অটবীর জন্য ত্রিস্তানের তাকানোর ধরণ তো সে কথা বলে না! একদমই না! এনিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল সরোজ। ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, জানা নেই। তাকে যে সাথে নিবে না, তা সরোজ ভালো করেই জানে। আপাতত জরুরি যেটা, সেটা হচ্ছে অটবীর নিরাপত্তা।
সরোজ একরোখা কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ বললো, “তুমি এভাবে যাইতে পারো না, ত্রিস্তান ভাই। অটবী আপুরে অনতত বাঁচাও।”
বাইকটা স্টার্ট দিয়ে সরোজের চিন্তিত মুখটা একবার দেখে নিলো ত্রিস্তান। অনেকটা অতৃপ্ত গলায় বললো, “তোর এত চিন্তা হলে তুই যা, ওকে বাঁচা। তারওপরও যদি বাঁচাতে না পারিস আমি আসবো কালকে, হাসপাতালে? তোরা কি চকলেট খাবি, আমাকে এসএমএস করে দিস।”
–
রাস্তায় বিশ্রী জ্যাম এঁটে আছে। জ্যামের ভেতর খুঁজে খুঁজেও একটা খালি রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না৷ তুমুল বর্ষণে শহরের অবস্থা জুবুথুবু। কারেন্ট আসছে-যাচ্ছে। রাত ক’টা বাজে, অটবীর জানা নেই। হাতঘড়ি পানি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। ফোনে চার্জ নেই। তবুও কয়েকবার পাওয়ার বাটন চেপে দেখলো সে। নাহ্! চালু হচ্ছে না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চারপাশটায় নজর বুলালো অটবী। সে আপাতত কোনো এক দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একঘণ্টা যাবত। ছাত্রের বাসা থেকে বেরোনোর আগে শেষ সময় দেখেছিল। দেওয়াল ঘড়িতে ন’টা বাজছিল তখন। এখন নিশ্চই আরও রাত হয়েছে? মা বোধহয় এতক্ষণে চিন্তা করে করে প্রেসার হাই করে ফেলেছেন। মায়ের কথা মাথায় আসতেই বৃষ্টিকে আর পরোয়া করতে মন চাইলো না অটবীর। অনেক হয়েছে। আর কত? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?
দৈবাৎ, বামদিক থেকে কে যেন ছুটে এলো অটবীর কাছে। লম্বা, সুঠাম ধরণের লোক। পরনের কালো শার্ট কনুই অব্দি গোটানো। হাঁটুর ওপর দু’হাত ভর দিয়ে একাধারে নিশ্বাস ফেলছে, নিচ্ছে। নিশ্বাসের আওয়াজ সুস্পষ্ট। গুটি কয়েক চুল ঢেকে রেখেছে সমস্ত কপাল।
অটবী আড়চোখে একবার তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠলো সে। বিমূঢ়তা সামলাতে না পেরে অজান্তেই বললো, “ত্রিস্তান?”
বুকের ভেতরটা বিষাদ যন্ত্রণায় নিমজ্জিত। সারা রাস্তা হন্নের মতো দৌঁড়ে আসায় শরীর ক্লান্ত, মন বেজার। বার কয়েক জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ঠিক অটবীর পাশে।
—“আপনি এখানে কি করছেন?” প্রশ্নটা অটবীর। সে করতে চায়নি। কিন্তু না করেও শান্তি পাচ্ছিল না। সে যেখানে যায় ঠিক সেখানেই লোকটা এসে হাজির হয়। প্রতিবার তো বিষয়টা কাকতালীয় হবার নয়।
ত্রিস্তান সময় নিলো না। ত্যাড়া কণ্ঠে উত্তর দিলো, “খেতে এসেছি।”
—“কি?”
—“তোমাকে। অনেকদিন মানুষ খাওয়া হয় না।”
ত্রিস্তান যতটা নির্বিকার হয়ে বললো, ততটা সহজ ভাবে নিতে পারলো না অটবী। তৎক্ষণাৎ চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনার দ্বারা কি একটুও স্বাভাবিক আচরণ হয় না?”
ত্রিস্তান নজর ফেরালো। চোখেচোখ রাখলো। হীম শীতল চাহনি। নিগূঢ় কণ্ঠ, “হয়, অটবী।”
কথাটায় কি যেন ছিল। অটবী আর একটা কথাও বলতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এক মিনিট, দুই মিনিট, এক ঘণ্টা! মিনিটের কাঁটা ঘুরে ঘণ্টায় ঠেকে গেছে। বৃষ্টি তখনো কমেনি। দোকানপাট বন্ধ করে অনেকেই এই বৃষ্টির ভেতর ভিঁজে ভিঁজে চলে গেছে। মানুষহীন, যানবাহন ছাড়া রাস্তা। বৃষ্টির তীব্র ঝরঝরে শব্দ ছাড়া কানে আর কিচ্ছু আসছে না। পা দুটো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ব্যথায় টনটন করে উঠছে। যেন বলছে, “মাফ চাই, ভাই। আর কতক্ষণ আমাকে এভাবে কষ্ট দিবি? একটু তো কোথাও গিয়ে বয়? এই অসহায়ের ওপর দয়া কর?”
নাহ্! সত্যিই আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। অটবীর শেষ ধৈর্যটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ? এ বৃষ্টি আজ আর থামবে না। থামার হলে আগেই থামতো। অটবী মনে মনে ভেবে নিলো, এই বৃষ্টির মাঝেই সে বাড়ি ফিরবে। পরে যা হওয়ার হবে। ভিঁজলে ভিঁজবে। জ্বর হলে হবে। এসব পরোয়া করার সময় তার আর নেই।
পলিথিনে মোড়ানো ছাতা বের করে অটবী যেই না এক পা বাড়াবে! ওমনি ওর হাত খপ করে ধরে ফেললো ত্রিস্তান। গাঢ় গলায় বললো, “কোথায় যাচ্ছো?”
অটবী হাতের বাঁধনের দিকে একপলক তাকালো, “বাসায় যাচ্ছি। আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো?”
—“এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আরেকটু অপেক্ষা করো। বৃষ্টি কমে যাবে।”
মিথ্যে কথা। বৃষ্টির যে তীব্রতা, তিন ঘণ্টার আগে এই বৃষ্টি কমবে কি-না সন্দেহ। শুধু শুধু আশায় বসে থাকার কোনো মানে আছে?
ত্রিস্তান থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী বললো, “কমলে কমবে। আমার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না।”
—“তাহলে বসে থাকো। ক্ষুধা লাগলে বলো, কিছু আনার ব্যবস্থা করছি৷ কিন্তু তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না।”
বলতে বলতে ত্রিস্তান আবারও অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে। চোখের দৃঢ়তা স্পষ্ট বলছে, সে কিছুতেই অটবীকে এখান থেকে যেতে দিবে না।
সহসা, অটবী তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। কণ্ঠ নমনীয় করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি চাইছেনটা কি?”
—“বেশি কিছু না। একটু সাথে থাকো।”
ত্রিস্তানের কি দৃষ্টি বদলেছে? চোখের চাহনি? কই? নাতো! সবসময়কার মতো অদৃশ্য কঠিনতাই তো দেখতে পাচ্ছে অটবী। তাহলে হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? এখনকার ত্রিস্তানকে বড্ড অপরিচির মনে হলো তার। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো, দোকানের সামনে একটা পুরাতন বেঞ্চ পরে আছে। ছোটখাটো। ভেঁজা। ভেঁজা দেখে এতক্ষণ সে সেখানে বসেনি। কিন্তু ত্রিস্তান খুব অনায়াসে সেখানে পা ছড়িয়ে বসে পরলো। অটবীকে ডাকলো, “তোমার না পা ব্যথা করছে? এটা চোখে দেখোনি? এখানে এসে বসো। আসো!”
অটবী কথা শুনলো। অবাধ্য হলো না। ত্রিস্তানের পাশে চুপটি করে বসলো। তার পা ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে। তার ২৩ বছরের জীবনে সে কখনো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেনি।
ত্রিস্তান অটবীর দিকে একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও।”
সে নিলো। মানা করলো না। ত্রিস্তান যেন অবাকই হলো। মেয়েটা জেদি স্বভাবের। সবকিছুতেই আগে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করে। আজকে হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কিভাবে? কপাল কুঁচকে একটু করে দেখে নিলো অটবীকে। আদুরে লাগছে। মাথায় ওড়না নেই। সরে গেছে। জামার একপাশ ভেঁজা৷ ঠান্ডা হয়তো একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। ঠোট আদ্র, নাক লাল টকটকে!
ত্রিস্তান আস্তে করে শুধালো, “পানি আনবো? পানি খাবে অটবী?”
—“এসময় পানি পাবেন কোথায়? দোকান তো সব বন্ধ।”
—“বৃষ্টির পানি আছে না? দু’হাত ভরে এনে দেবো। তুমি সেখান থেকে খেতে পারবে না?”
কথাটা বলে ত্রিস্তান হাসলো। নিঃশব্দ হাসি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। শীত লাগছে। ভেঁজা শরীরে থাকার কারণে কি? হয়তো! সেও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। আবার হয়তো পারেও। এইযে, এখন যেমন ঠায় বসে আছে। ভদ্র ছেলের মতো। কিন্তু আসলে সে ঠিক নেই। গায়ে উত্তাপ ওঠা জ্বর। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। অথচ পাশের মানুষটা সেটা বুঝতেই পারছে না!
ঠোঁটের প্রস্থ বাড়িয়ে ত্রিস্তান আচমকা বললো, “তুমি ভয়ানক সুন্দর, অটবী।”
অটবী যেন বুঝলো না। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “জি?”
অটবীর দিকে শাহাদাত আঙুল তাক করলো ত্রিস্তান। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে হেসেই আবার বললো, “তুমি, তুমি মেয়েটা এত সুন্দর কেন?”
বাতাসে বাতাসে ত্রিস্তানের শার্ট, প্যান্ট, চুল শুকিয়ে গেছে। চোখের সাদা অংশ ক্রমশ রক্তে ভরে যাচ্ছে। মুখ লাল। মুখাবয়ব অসন্ন কিছুর ইঙ্গিত বরাবরই দিচ্ছে। অটবী কি মনে করে ত্রিস্তানের কপালে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো ভীষণ, “আপনার শরীর তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে। এই জ্বর নিয়ে বসে আছেন কিভাবে? ত্রিস্তান?”
ত্রিস্তান চুপ। কপাল থেকে হাতটা খুব আস্তে করে নিজের কাছে নিয়ে অবাঞ্ছিত এক চুমু এঁকে দিলো। এতেও যেন মন ভরলো না। কাছে এগিয়ে অটবীর কপালেও অধর ছুঁইয়ে দিলো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। অটবী চমকালো, থমকালো। এক মুহুর্তের জন্য রাগলো খুব। ছিটকে সরে গিয়ে বললো, “সমস্যা কি আপনার? এটা কি করলেন এই মাত্র?”
ত্রিস্তান জবাব দিলো না। একটু আগের তার সেই দীর্ঘ হাসিটাও হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় কাতর দেখাচ্ছে মুখটা। অটবী দূরে সরে গেলেও সে আবারও কাছাকাছি এগোলো। সন্তপর্ণে কপাল ঠেকালো অটবীর কাঁধে। লহু স্বরে আহাজারি করলো, “তোমাকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, অটবী। তোমাকে যদি সারাজীবন কাছে রাখতে পারতাম!”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা