অটবী সুখ
১২.
একফালি রোদ্দুর চোখে এসে পরছে। সারা মাথায় টনটনে ব্যথা। চোখদুটো মেলতে গিয়ে বুঝতে পারলো, আঁখিপল্লব ভারী হয়ে আছে। সরাসরি তাকাতে পারছে না। আশপাশ ভীষণ অস্পষ্ট। নিজেকে সামলাতে ক্ষীণ সময় নিলো ত্রিস্তান। কালরাতে অনেক দেড়ি করে রুমে এসেছিল। ততক্ষণে তনয়া গভীর ঘুমে মশগুল। সরোজও বাসায় ফিরেনি। ড্রইংরুমের সোফায় এখনো হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটা অনেক সরল-সোজা। ত্রিস্তান কি করে না করে, সেসব না জেনেই তাকে সাহায্য করছে। অবশ্য, জানলে হয়তো কখনো ত্রিস্তান মুখো হতো না।
“ভাইয়া, তোমার চোখ এত লাল কেন?”
ত্রিস্তান চমকালো। থমকানো দৃষ্টে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো, তনয়া মেঝেতে বসে আছে। দুটো হাত, থুতনি রয়েসয়ে বিছানার ওপর ঠেকানো। মায়াবী একজোড়া নয়ন ড্যাবড্যাবিয়ে ওকে দেখছে। ত্রিস্তান বার কয়েক পলক ফেলে চোখের দূর্বলতা ঢাকতে চাইলো। কপাল কুঁচকে ভরাট গলায় বললো, “তুই এত সকালে আমার রুমে কি করছিস?”
“তুমি কোন দুনিয়ায় আছো? সকাল তো সেই কবেএএ শেষ! আমার ক্ষুধা লেগেছে। পেটের ইঁদুরগুলো একটু পর আমার পেট ফুঁটা করে দিবে। তুমি নাস্তা বানাবা কখন?”
ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। নগ্ন পেটানো শরীরে জড়িয়ে নিলো কালো রঙা টি-শার্ট। কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো, “তোর সরোজ ভাইয়া কোথায়? চলে গেছে?”
“নাহ্। সোফায়। ঘুমায়। অনেক্ষণ ধরে ডাকছি, উঠে না।”
“জগে পানি আছে না? ওর মুখে ঢেলে দে। উঠে যাবে।”
“সত্যি মুখে ঢালবো?” তনয়া অবুজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
মায়ের মতো দেখতে মেয়েটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা শীতলতায় মিইয়ে যায় ত্রিস্তানের। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগে সে মৃদু গলায় অনুমতির সুরে বলে, “চাইলে লাথিও মারতে পারিস।”
রান্নাঘরের অবস্থা নাজেহাল। চায়ের কৌটা উদলা হয়ে পরে আছে। চুলার ওপর এঠো কেতলি, চামচ। ঢাকনাটাতেও ময়লা লেগে আছে। ত্রিস্তান তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। নিশ্চিৎ সরোজের কাজ এটা। রাতে চা বানাতে গিয়ে এমন অবস্থা করেছে। সে এঠো জিনিসগুলো দক্ষ হাতে ধুঁয়ে নিলো। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে বেশির ভাগ সময় রান্নাঘরের দিকটা বাবা সামলাতেন। ত্রিস্তানও টুকিটাকি সাহায্য করতো। মা অসুস্থ থাকতেন সারাবছর। সে সুবাধে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থাতেই রান্নাবান্নায় ভীষণ পটু হয়ে গেছে ত্রিস্তান।
হঠাৎ! সূক্ষ্ণ একটা চিৎকার এসে বারি খেল দেওয়ালে। সরোজের চিৎকার। ত্রিস্তানের নাস্তা বানানো ততক্ষণে শেষ। কাপে চা ঢেলে আস্তে ধীরে ডাইনিংটেবিলের ওপর খাবার রাখলো সে। চেয়ার টেনে বসলো। সরোজ ভিঁজে একাকার হয়ে আছে। পরনে ভেঁজা প্যান্ট আর গায়ে পাতলা গামছা জড়িয়ে কাতর দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকেই। ত্রিস্তান তাকাতেই প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বললো, “ভাই! ও ভাই! সক্কাল সক্কাল তোমার বোন কামডা কি করছে দেখছো? ঘুমাইতে ছিলাম, মুখের উপর পানি ঢাইলা দিলো! তুমি এর একটা বিচার করো।”
ত্রিস্তান প্রথমেই কিছু বললো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অনেকদিন চুল কাটা হয়না। মাথার একগুচ্ছ চুল বারবার চোখ ঢেকে ফেলছে।
“আমি তো তনয়াকে আরও একঘণ্টা আগে পানি ঢালতে বলেছিলাম। তোর ভাগ্য ভালো, ও আরেকটু ঘুমাতে দিয়েছে তোকে।”
“ভাই! তুমি এমনটা করতে পারলা?”
“পারছি। এখন বেশি কথা না বলে খেতে আয়।” সরোজ চেহারা কুঁচকে ত্রিস্তানের মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। আবহাওয়া অতটা ঠান্ডা না। কিন্তু তবুও তার শীত শীত লাগছে। ঝটপট গরম গরম চায়ের কাপে হামলে পরতে পারলেই বাঁচে!
ত্রিস্তান সময় নিয়ে প্রশ্ন করে, “তনয়া কই? ওকে দেখছি না কেন?”
সরোজ হাভাতের মতো পরোটা দিয়ে চা খাচ্ছে। অনেকটা সেভাবেই বললো, “তোমার বোন যে বিটকেল! পানি ছুঁইড়াই দৌঁড়! বকারও সুযোগ দে নাই।”
অর্ধেক পরোটা রয়ে গেছে। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ত্রিস্তান তনয়ার জন্য দুটো পরোটা প্লেটে আলাদা করে রাখলো। থমথমে গলায় বললো, “খাওয়া শেষে চলে যাবি। আঙ্কেল ফোন করেছিল। তোর নাকি দুপুরে কোচিং আছে?”
“তোমার মনে হয় আমি কোচিং-এ যামু?”
“তুই কয়বার ম্যাট্রিক ফেল করেছিস যেন?”
সরোজ মিনমিনিয়ে বললো, “একবারই তো ফেল করছি। এমন করো ক্যান?”
“এবারও ফেল করবি। তোর কপালে লেখা আছে।”
সরোজ সে কথায় কান দিলো না। আয়েশ করে পরোটার টুকরা চায়ে ভিঁজিয়ে মুখে পুরে নিলো। সুধালো, “ভাই, তুমি রক্ত দিয়া কি করো?”
ত্রিস্তান চমকে তাকালো ঠিক কিন্তু পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। হিম শীতল গলায় বললো, “খাই।”
অথচ সত্যটা সরোজ একেবারেই বিশ্বাস করলো না, “ধুর! রক্ত আবার খাওয়া যায় নাকি? কি করো আসলে কও তো। ওই দোকানের ব্যাটাও দেখলাম তোমার কথা শুইনা কেমন ভয় পাইয়া গেল।”
দোকানি ত্রিস্তানকে দু’কারণে ভয় পায়। এক. ইভটিজিং করায় একবার রাস্তায় পিটিয়েছিল বলে। আর দ্বিতীয় কারণটা অবচেতন মনের ভয়।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বিশেষ কিছু না। এক্সপেরিমেন্ট করি।”
“কি এক্সপেরিমেন্ট?”
“আরেকটু বড় হ, তারপর বলবো।”
সরোজের আগ্রহী মন দমলো না। খেতে খেতে সে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। সে অপেক্ষা করবে। সামনে বসে থাকা ত্রিস্তান দমবন্ধ করে চেয়ে রইলো শুধু। মনে মনে হাসলো খুব। সরোজের ওপর না। নিজের ওপর। ভাবলো, বোকা মানুষগুলো তার পাল্লাতেই পরে কেন? সে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতক, খারাপ, মিথ্যুক। ভাবুক হওয়ার ভান ধরে থাকে। এসব মানুষগুলো যখন তার আসল সত্য জানবে, তখন কি করবে এরা? ত্রিস্তান চায় না ওরা কিছু জানুক। একদমই চায় না। যাদের চোখে সে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়, তাদের চোখের ঘৃণা কিভাবে সহ্য করবে? আদৌ পারবে সহ্য করতে? ত্রিস্তান জানে, সে পারবে না।
–
গুটিকয়েক চড়ুই তারে বসে আছে। বাতাসে উত্তাপ নেই। তবুও হাঁসফাঁস লাগছে। কাঁধের ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময়টা দেখে নিলো অটবী। পাঁচটা দশ বাজছে। আজকে একটা টিউশন করাতে পারেনি। ছাত্র বেড়াতে গেছে। অথচ অটবীকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধও করেনি। অতদূর হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেখে দরজায় তালা ঝুলানো।
অটবীর বুকের ভেতরটা গুমট অনুভূতিতে চুপসে আছে। ক্লান্ত শরীর ঘেমে একাকার। ওইতো, রাস্তার একপাশে ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। ভাবলেশহীন লোকটা এখনো নির্লিপ্ত। অনায়াসে হাত পা ছড়িয়ে ফুটপাতের দূর্বাঘসে শুয়ে আছে। অটবী কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলো। শক্ত হাতে কাঁধের ব্যাগ সামলে গটগট পায়ে এগলো। নিঃশব্দে বসলো ত্রিস্তানের পাশে। ত্রিস্তান ওকে দেখে হাসলো অল্প। একদম ক্ষীণ। উঠে বসতে বসতে বললো, “অভাগার দুয়ারে এসেছ যে? তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু আমার কাছে নেই।”
“আমি আপনার কাছে এসেছি, কে বললো?”
মেয়েটার চোখের তীক্ষ্ণটা সরাসরি বুকে বিঁধছে। ত্রিস্তান অকারণেই আবার হাসলো। বললো, “তাহলে আমার পাশে বসেছ কেন?”
অটবী আনমনা হলো। সুবজ ঘাসের মাঝে একদুটা হলুদ ঘাসেরা উঁকি দিচ্ছে। একটা একটা করে হলুদ ঘাসগুলো ছিঁড়ে সে মৃদু স্বরে বললো, “দেখছিলাম, এত দায়িত্বের ভারেও আপনি কেন নুইয়ে পরছেন না। হাসছেন, ঘুরছেন, ফুর্তি করছেন। হয়তো লোকদেখানো। কিন্তু তবুও… আমি কেন পারি না?”
ত্রিস্তান আজ বড্ড বেশিই হাসছে। সচরাচর তাকে হাসতে দেখা যায় না। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে সর্বদাই শীতলতা লুকোচুরি খেলে। বাদামী চোখদুটো কালো অধ্যায় যেন। অঘোষিত আইনের এলোমেলো চুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থাকা নোনতা পানিগুলো ক্লান্তির সূক্ষ্ণ প্রকাশ। ত্রিস্তান চোখেচোখ রাখলো। অন্যরকম দৃষ্টি। চঞ্চল। প্রশ্ন করলো, “শিখতে চাও?”
অটবী চোখ সরালো না। ত্রিস্তানের মতো করে জানতে চাইলো, “কি?”
“কিভাবে ভালো থাকতে হয়।”
অটবীও হাসলো এবার, “চাই।”
“কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে।”
“কি দিতে হবে?”
অটবীর চাহনি পাল্টালো। কঠোরতায় ডুবুডুবু হতেই ওর দিকে ঝুকলো ত্রিস্তান। চট করে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো পিঠে। ফিসফিসিয়ে বললো, “Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
অটবী সুখ
১৩.
“Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”
স্নিগ্ধ একটা পরশ আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ত্রিস্তানকে পুরোনো দিনের সুদর্শন, সুশৃঙ্খল ‘ডিউক’ কিংবা ‘নোবেল’ থেকে কম লাগছে না। একহাতে অটবীর হাত ধরে অন্যহাতটা পেছনের দিকে মুড়িয়ে রেখেছে সে। দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চোখ বুজে হাতের পিঠে দীর্ঘ চুমুর মুহুর্তটা বোধহয় বর্ণনা করা যাবে না। শুধু অভাব একটা রাজকীয় পোশাকের। তাহলেই হয়তো ত্রিস্তান নামক আজীবন দুঃখী ছেলেটা কোনো এক রাজ্যের সুখী রাজকুমার হয়ে যেত।
অটবী হালকা করে নিশ্বাস ফেললো। ত্রিস্তান থেকে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে শান্ত গলায় বললো, “আমার উত্তরটা আপনার জানা, ত্রিস্তান।”
“উত্তরটা কি পাল্টাবে না বলছো?”
“হ্যাঁ।”
ত্রিস্তান আবারও পা ছড়িয়ে বসলো। স্বভাবহীন হাসিটা হাসলো আরও একবার। ঠাট্টার সুরে বললো, “সমস্যা নেই, অটবী। আমি তবুও তোমার শিক্ষক হতে রাজী আছি। আমি বুকভরা আবার দয়ামায়া! সামলে রাখতে পারিনা। অকৃতজ্ঞদের সাথেও ভুলেভালে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে ফেলি।”
অটবী চোখ-মুখ কঠিন করে বললো, “দরকার নেই এমন শিক্ষকের। আমি আপনার থেকে কিচ্ছু শিখতে চাই না।”
“একটু আগেই না বললে ভালো থাকার উপায় শিখতে চাও?”
“একটু আগে চেয়েছিলাম। এখন চাই না।”
ত্রিস্তান ঘাসের ওপর শুয়ে পরেছে। শুয়ে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে একমনে দেখছে অটবীকে। রুঢ় মেয়েটা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। সামনের রাস্তায় কি যেন নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কালো লম্বা চুলে মোটা বেণুনী। গোলগাল হলদেটে চেহারায় মানিয়েছে খুব। ভীষণ সাদামাটা পোশাক। এটাকেই থ্রি-পিস বলে বোধহয়। ত্রিস্তান আকাশ পানে মুখ উচিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো। ঠোঁটের সূক্ষ্ণ হাসিটা ধরে রেখে বললো, “তোমরা কি বলো তো অটবী! আমার কাছে আসতে সময় নাও, অথচ দূরে যেতে একদম সময় নাও না।”
ত্রিস্তান জবাবের অপেক্ষা করলো। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড— এক মিনিট! অটবীর জবাব পাওয়া গেল না। মেয়েটা এত নিষ্ঠুর! অনুভব করতে পারলো, ভেতরটায় একটা বিশ্রী, তেঁতো যন্ত্রণা আন্দোলন করছে। চারিদিকের মৃদুমন্দ বাতাস, হৈ-হুল্লোড়, যানবাহনের হর্ণ— প্রত্যেকটা জিনিস এত বিষাদ ঠেকছে! শরীরের শক্তি যেন নাই হয়ে গেছে। ত্রিস্তান ঘুরেফিরে আবারও অটবীর দিকে তাকালো। দৃষ্টি আবছা, ঘোলা। ঠোঁট নাড়িয়ে হালকা কণ্ঠে পৃথিবীর সবচে’ আশ্চর্যজনক প্রশ্নটা করলো, “অটবী… মৃ’ত্যু কি খুব কষ্টের? সেখানেও কি একা থাকা লাগে?”
প্রশ্নটা বুঝতে অনেক্ষণ সময় লাগলো তার। পরক্ষণেই অর্থ উদ্ধার করতেই চট করে ফিরে তাকালো। লোকটাকে স্বাভাবিক লাগছে না। একটু আগেও ভালো ছিল। অথচ এখন ঘেমেনেয়ে একাকার! কপাল বেয়ে বেয়ে ঝরছে লবণাক্ত জলকণা। বুকের উঠানামা তীব্র। নিশ্বাসের শব্দ কান ঝাঁঝিয়ে দিচ্ছে। হতবাক অটবীর দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো। ত্রিস্তানের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় আর্তনাদ করলো, “ত্রিস্তান? এমন করছেন কেন? শুনছেন আপনি? কি হয়েছে?”
ত্রিস্তান কিছু একটা বললো। অস্পষ্ট। বোঝার জন্য তার দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকলো অটবী।
“বাম দিকে ফোন… সরোজকে কল দাও।”
সঙ্গে সঙ্গে বাম দিকে তাকালো অটবী। এক প্যাকেট সিগারেট, লাইটার, মোবাইল ফোন, ওয়ালেট! বড্ড অবহেলায় পরে আছে সেগুলো। অটবী ঝটপট মোবাইল হাতে নিলো। কোনো ধরণের লক নেই বিধায় সহজেই ডায়াল লিস্টে গিয়ে কল লাগালো সরোজকে। সরোজ আশেপাশেই আছে। এখান থেকে সাত-আট মিনিটের রাস্তা।
“কল করেছি। এক্ষুণি চলে আসবে।”
“তুমি চলে যাও অটবী।”
“জি?” চমকিত হয়ে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো সে। লোকটার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। শুধু অস্থিরতা কমে নির্জীব হয়ে গেছে। ব্যাপারটা পূর্বের থেকেও বেশি ভয়াবহ।
“আমাকে কি অমানুষ বলে মনে হয় আপনার? আপনাকে একা রেখে কেন যাবো?”
“আমি অমানুষ, অটবী।”
ত্রিস্তান অসুস্থ! ত্রিস্তান পাগল! ত্রিস্তান আবোলতাবোল বকছে! এ তিনটা বাক্য ছাড়া আর কোনো কিছু মাথায় ঢুকছে না অটবীর। সে শক্ত হয়ে বসে আছে। যাবে না এখান থেকে। কিছুতেই না। অথচ ত্রিস্তানও নাছোড়বান্দা। পাষাণের মতো এত জোড়ে ধমকে উঠল তার ওপর! অটবীর রাগ করার কথা। নিস্তেজ ত্রিস্তানকে সেখানে একা ফেলে আসার পর সারা রাস্তা সে রেগে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এটা কি ধরণের যন্ত্রণা? এত অসহ্য!
–
বাসা থেকে তুমুল ঝগড়া করে এসেছে সরোজ। আজকে কোচিংয়ে পরীক্ষা ছিল। সে যায়নি। ফলসরূপ জসিম আখতার ভীষণ রেগে ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। থাপ্পড়ও মেরেছেন বোধহয়। বাম গালটা টকটকে লাল হয়ে আছে। নলী সরোজের গোমড়া মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। বাদাম খেতে খেতে বললো, “আঙ্কেল ঠিকই করেছে। আরও মারা উচিত ছিল।”
সরোজ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “তিনটা থাপ্পড় মারছে! তোর কাছে কি কম লাগে? কই একটু আদর-টাদর করবি! আইছোস শ্বশুড়ের পিছ ধরতে!”
“বাজে কথা বলবেন নাতো। পড়ালেখা করতে হবে। ভালো চাকরি না পেলে বুবু জীবনেও আপনাকে মেনে নিবে না।”
সরোজ পাত্তা দিলো না। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে। এসব নিয়ে এখন প্যারা নিয়ে লাভ নেই। পৃথা আজকে স্কুলে আসেনি। ধরা পরার তাই ভয় নেই। নলীকে জোড় করে অনেক কষ্টে নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছে। টিফিন টাইম শেষ হতে দেড়ি নেই। এই অল্পটুকু সময়ে প্রেমালাপ না করে এসব ফালতু আলোচনার কোনো মানে হয়?
তৎক্ষণাৎ মুখে জ্বলজ্বলে হাসি ফুঁটালো সরোজ। নলীর বাহুতে আলতো গুটা মেরে বললো, “এইসব বাদ দে নীলিমা। ভালা কথা ক। কত্তদিন পর এমন সুন্দর জায়গায় প্রেম করার সুযোগ পাইছি! বড় রোমান্টিক রোমান্টিক ফিল আসতাছে রে!”
নলী কোণা চোখে তাকালো একবার। কটমট গলায় বললো, “আপনি ভালো হবেন না, তাই না? আপনার বাবা আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। মনে হয় না দুইতিন দিনে ঢুকতে দিবে। একয়দিন কোথায় থাকবেন, কি খাবেন! এসব চিন্তায় আমারই তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আপনাকে দেখুন! কোথাকার কোন নবাবজাদা! যেন পাঁচ-ছয়টা বাড়ির মালিক। একটা থেকে বের করে দিলে অন্যটায় গিয়ে উঠবে।”
সরোজ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“ঠিক বলছিস। নিজের বাড়ি না থাকলেও থাকার অভাব নাই। ত্রিস্তান ভাইয়ের বাসায় বিন্দাস থাকমু। কার বাপের কি?”
“ত্রিস্তান ভাইয়া না হাসপাতালে? এখন কেমন আছেন ভাইয়া?”
“হাসপাতালে আর থাকছে কই? জ্ঞান ফিরার পরই বাসায় যাওনের লাইগা যে কি অবস্থা করছে! তয়, করা স্বাভাবিক। তনয়া বাসায় একা না?”
“কি হইছিল ভাইয়ার?”
“জানি না। ডাক্তাররে কইতে শুনছিলাম প্রেসার লো।”
নদীর পাড়ে পা ভিঁজিয়ে বসে ছিল ওরা দুজন। নলী উঠে দাঁড়ালো। হাতের অবশিষ্ট বাদামগুলো সরোজকে দিয়ে বললো, “বাকিটা আপনি খান। আমি যাই। টিফিন টাইম শেষ হতে বেশি দেড়ি নেই।”
সরোজ মন খারাপ করলো খুব। মুখে এখনো বাদাম রয়ে গেছে। সেগুলো চিবুতে চিবুতে অসম্ভব করুণ গলায় বললো, “এখনই চইলা যাবি? প্রেম তো শুরুই করলাম না।”
নলী পেছনে ফিরে বললো, “এখন প্রেম করতে হবে না। বিয়ের পরে কইরেন।”
–
রাত ক’টা বাজে জানা নেই। হাতে খাবারের মস্ত বড় প্লেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে ত্রিস্তান। নিচ থেকে আওয়াজ আসছে। ধাপধুপ ধুপধাপ! বাতি জ্বালাতেই অন্ধকার রুমটা স্পষ্ট হয়ে এলো। রুক্ষ-সূক্ষ্ম, জীর্ণ শরীরের ব্যক্তিটি মাঝ বরাবর বসে হাত পায়ের শিকল খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো, “খাবার আনতে এত সময় লাগে? আমারে মেরে ফেলতে চাইছিস তুই? এত সহজ আমাকে মা’রা?”
ত্রিস্তান ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলো, “ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”
বলতে বলতে খাবারের প্লেট-টা সামনে রাখলো সে। প্লেটে বড় বড় দুটো মাছ ভাঁজা, ভাত, আলু তরকারি।
খাবারগুলো দেখা মাত্রই ঘৃণায় নজর সরিয়ে ফেললো ব্যক্তিটি। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “এইগুলা কি আনছিস? রক্ত কই? রক্ত খাবো।”
“রক্ত নেই।”
“রক্ত নেই মানে? তুই ইচ্ছা করে দিচ্ছিস না। আমি জানি না মনে করেছিস? খাবো না এগুলা। নিয়ে যা এখান থেকে।”
“এগুলোই খেতে হবে।” ত্রিস্তানের চোয়াল শক্ত। চোখে মুখে দারুণ কাঠিন্যতা। বোঝা গেল, আজকে সে কিছুতেই রক্ত খেতে দিবে না। মুহুর্তেই ব্যক্তিটি অধৈর্য হয়ে গেল। মেঝে থেকে খাবারের প্লেট উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ত্রিস্তানের বুকে। কিন্তু এতেও যেন তৃপ্তি মেলেনি। তেঁড়ে এসে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে লাগলো ত্রিস্তানের গাল, হাতের চামড়া। অনবরত পাগলের ন্যায় চিৎকার করতে লাগলো, “তুই ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছি। তুইও আমাকে মেরে ফেলতে চাস। আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবি না তোরা। অভিশাপ তুই! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ!”
নখের ধারালো আঁচড়ে বিষাক্ত যন্ত্রণা অনুভব করলেও মনের ব্যথা থেকে এই ক্ষত যেন খুবই নগণ্য। ত্রিস্তান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। টু শব্দটিও করলো না। নিশ্চল চোখজোড়া স্থির চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার পানে।
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা