অটবী সুখ
১১.
শান্ত মেজাজের ত্রিস্তান যে কতটা ত্যাড়া, তা এই মুহুর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে অটবী। এখনো ঠায় গাছের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। অটবী এতগুলো প্রশ্ন করলো, তারও উত্তর নেই। মুঠোয় পুরে রেখেছে রক্তে ভেঁজা রুমাল।
প্লেটের অবশিষ্ট বিরিয়ানিটুকু গলা দিয়ে আর নামতে চাইলো না অটবীর। শক্ত হাতে প্লেট-টা ধরে রাখলো। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
“কোন প্রশ্ন?” ত্রিস্তানের সঙ্গে এতদিন মেলামেশার পর অটবী একটা বিষয় খুব করে লক্ষ্য করেছে। লোকটা অনুভূতি লুকাতে ভীষণ পটু। আমরা যেমন মন খারাপ হলে মন খারাপের রেশ ধরে কথা বলি, আনন্দিত হলে উল্লাস নিয়ে কথা বলি, ত্রিস্তান তেমনটা করে না। সুখ, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা- সবেতেই তার বাচনভঙ্গি থাকে এক রকম। শান্ত, স্থবির, নিশ্চল।
“আমি তো অনেকগুলো প্রশ্ন করেছি। আপনি একটারও জবাব দেননি।”
“আবার করো। এবার জবাব দিবো।”
অটবী ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। ধীরস্থির ভাবে বললো, “আপনি এখানে শুধু শুধু কেন দাঁড়িয়ে আছেন? খেতে যাচ্ছেন না কেন? আপনি কি অসুস্থ? আর সর্বশেষ, আমার রুমাল দিয়ে আপনার কি কাজ?”
জবাবগুলো যেন আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছিল ত্রিস্তান। অটবীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই একাধারে বলে চললো, “ক্ষুধা নেই। তাই খেতে যাচ্ছিনা। কাজ নেই, তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। কাজ নেই বলেই তোমার রুমালটা কুকাজে লাগানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি। চুরি-ডাকাতিতে রিস্ক থাকলে ওন দ্যা স্পট তোমার রুমাল ফেলে আসবো। আমার বদলে তুমি জেল খাটবে। আর সর্বশেষ, আমি সুস্থ। ঠিক আছি।”
অটবীর চোখজোড়া গভীর গম্ভীর অরণ্যের মতো। টলটলে মিঠা নদীর গহীন। আর ত্রিস্তান! সে তো বাজপাখি। শিকারের আগেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টে ঝাঝরা করে ফেলে শিকারকে। অটবী সেই দৃষ্টির ধারে কাছে গেল না। কোত্থেকে যেন রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে গানের উৎস খুঁজতে লাগলো। মৃদু হেসে বললো, “আমি কিন্তু মানুষের মিথ্যে ধরতে পারি ত্রিস্তান। তাছাড়া আপনার এই মিথ্যে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
“কই? আমি তো জানি সবাই বিশ্বাস করে।”
“আমি তো করি না।”
“স্বাভাবিক। তোমার নামেই একটা রহস্য রহস্য ভাব আছে। তুমি তো রহস্য খুঁজবেই।”
অটবী না চাইতেও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো। বাজপাখির চোখে মিঠা পানির ঘোল মিশিয়ে অন্ধ করে দিলো তাকে। ভালো লাগার প্রাপ্তি অনুভব করার আগেই আবার দূরে ছিঁটকে ফেললো, “আমি আজীবন দুঃখী একটা মেয়ে, ত্রিস্তান। দুঃখ-দুঃখী মিলে সুখ হবে কি-না জানি না, কিন্তু পৃথিবী ধসে পরবে। আমি এমন রহস্য খুঁজতে চাই না। এই অরণ্য কৌতূহলী নয়, ভীষণ ভীতু।”
অদ্ভুত, ত্রিস্তান হাসছে। অটবী অবাক হলো এইভেবে, এতগুলো সাক্ষাতের পর এই প্রথম ত্রিস্তান অকৃত্রিম হাসছে। যেখানে কোনো পর্দা নেই। খোলা জানালার মতো ভেতর-বাহির দারুণ স্পষ্ট। কিন্তু এহেন কথায় হঠাৎ হাসার মানে কি? ত্রিস্তান তো এমন না। হাসিটা এত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন?
নিঃশব্দ অথচ শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া হাসিটা থামলো অল্পক্ষণ পর। অটবী খেয়াল করলো, হাতের মুঠোয় থাকা রুমালটা গায়ের সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে ত্রিস্তান। বাতাসের তালে তালে ফিসফিসিয়ে বলছে, “ভয় নেই ভীতু অরণ্য, আমি আমার নামের শেষ দুটো শব্দ তোমাকে কখনোই দিবো না।”
–
সরোজ ফাঁকফোকর খুঁজছে নলীর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। অটবী সারাক্ষণ বোনদের সামনে শক্ত দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সরোজ একটু বিরক্তই হলো। এত পাহারা দেওয়ার কি আছে? সে কি নলীকে খেয়ে ফেলবে নাকি? আশ্চর্য!
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। অটবী বোনদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। সরোজ সেদিকে চেয়ে আছে। মনটা তার একটু বেশিই খারাপ। প্রেমিকা এত সুন্দর করে সেজেগুজে আসলো, অথচ সে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারলো না। হাহ্! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরানোর পূর্বে সরোজ গুনগুনিয়ে ‘এই মেঘলা, দিনে একলা’ গানটার রফাদফা করে দিলো, “এই রোদেলা, দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন। কাছে যাবো, কবে পাবো ওগো দোকলা হওয়ার নিমন্ত্রণ।”
ত্রিস্তান যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সরোজ খেয়াল করেনি। ত্রিস্তানের ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টির সম্মুখীন হতেই ভ্যাবলা হাসলো। সিগারেট আর ধরালো না। পকেটে পুরে রাখলো। কণ্ঠে একরাশ মধু ঢেলে বললো, “একটু ক্রিয়েটিভ হওয়ার চেষ্টা করলাম ভাই। কতকাল আর এক লিরিক্স গাইতে থাকমু?”
পাশ হতে মুখভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে কাদিন বললো, “তোর এই ক্রিয়েটিভিটি হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় দেখলে তোরে জেলের ভাত খাওয়াইতো।”
“তুই আগে তোর মুখের ভাত শেষ কর ব্যাটা।” কাদিনকে সরোজ অত বেশি পছন্দ করে না। ছেলেটা কথায় কথায় দোষ ধরে। সারাদিন মুখে ইংরেজি ফুঁটিয়ে রাখবে। এমন একটা ভাব, যেন সে ছাড়া আর কেউ ইংরেজি বলতে পারে না, জানে না। কোত্থেকে যে এগুলো আসে! সরোজ একটা তাচ্ছিল্য দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো কাদিনের দিকে। প্রচন্ড অনিহা নিয়ে বললো, “রহিম ভাই তোরে ডাকে। তুই যা তো এনথেইকা।”
কাদিন বেজার মুখে চলে গেল। ত্রিস্তান তখন তনয়ার ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা খাবার টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে। সরোজ সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি বাসায় চইলা যাইবা গা ভাই?”
—“তুইও যাচ্ছিস আমার সাথে।”
বলে একটু থামলো ত্রিস্তান। অস্বাভাবিক শান্ত চোখে চেয়ে বললো, “যা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?”
প্রশ্নটা শুনে সরোজের মুখভঙ্গিও একটু পালটে গেল যেন। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “আনছি ভাই।”
“কোথায় পেলি? দাম কত নিয়েছে?”
“তোমার দেওয়া দামই নিছে। কুড়ি টাকা বাইঁচা গেছে শুধু। প্রথমে দিতে চায় নাই। লোভ দেখানোর পর রাজী হইছে। ওইযে, হাশেম আলী আছে না? ওইটার পরের দোকান।”
ত্রিস্তান চোয়াল শক্ত করে বললো, “বাকি টাকা তুই রেখে দিস। এখন বাসায় চল।”
–
জঙ্গলের ঠিক মাঝখানটায় ত্রিস্তানের বাড়ি। দীর্ঘদিন যাবত মেরামতের অভাবে খানিকটা কুড়েঘর মনে হয়। আসলে কিন্তু ছোটোখাটো রাজপ্রাসাদ। বাহিরটা যতটা ভাঙ্গাচোরা, ভেতরটা ততটাই রুচিশীল, গোছানো। একতলা বাড়ি হলেও মাটির নিচে আরেকটা গুপ্ত পথ আছে। ত্রিস্তান ছাড়া সেটা কেউ জানে না। বাবা অবশ্য জানতেন। তার ডিজাইন করা বাড়ি বলেই হয়তো। কিন্তু তিনিও এখন বেঁচে নেই।
সরোজকে তনয়ার কাছে রেখে ত্রিস্তান অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছু স্পষ্ট নয়। আঁধারে ধরে আসছে চোখদুটো। কিন্তু ত্রিস্তান স্বাভাবিক ভাবেই নিচে নামছে। অভ্যস্ত বলে কথা! এ কাজটা সে নতুন করছে না।
কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতেই বাতি জ্বালিয়ে দিলো ত্রিস্তান। মাঝারি আকারের ঘর। দেওয়ালগুলোর একেকটায় কালচে আবরণ, খামচির দাগ, রক্তের দাগ! এককোণে জোড়োসড়ো হয়ে বসে আছে একজন ব্যক্তি। গায়ে জড়ানো পরিষ্কার কাপড়। ডান পায়ে শেকল বাঁধা। কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ত্রিস্তান নিষ্প্রাণ গলায় বললো, “খাবার এনেছি।”
ব্যক্তিটি আলো জ্বালানোতে এমনিতেই রেগে ছিল। ত্রিস্তান কথা বলতেই খেঁকিয়ে উঠলো, “ওই বাজে খাবার আমি খাবো না। নিয়ে যা এখান থেকে।”
“ওসব আনিনি। তুমি যেটা পছন্দ করো, সেটাই এনেছি।”
সাথে সাথে তাকালো ব্যক্তিটি। বাদামি চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। ত্রিস্তান হাতের বাটি-টা সামনে রাখতেই ছুটে আসলো বাটি-টার কাছে। কালো দাঁতগুলো বের করে উচ্ছলতার সঙ্গে হাসলো। বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে বেশ কয়েকবার একই কথা বললো, “আমি খুশি হয়েছি।” “আমি খুশি হয়েছি।”
ত্রিস্তানের পা দুটো দুলছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আজ অনেকদিন পর প্রিয় মুখটা দেখেছে সে। আগের সেই স্নিগ্ধতা কোথাও নেই। খামছে, আঁচড়ে ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত করে ফেলেছে। ত্রিস্তান কাঁপা পায়ে দেওয়াল ঘেঁষে বসলো। ব্যক্তিটি অনেক্ষণ লোভাতুর চোখে বাটি-টির দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, “তুইও কি একটু খাবি আমার সাথে?”
“না।”
“তাইলে কি খাবি? ওইযে, সাদা সাদা লবণের মতো কি জানি খাইতিস, ওগুলো?”
“ছেড়ে দিয়েছি।”
“ওহ্!”
ত্রিস্তান চোখের পলক ফেললো না। বুকে পাথর বেঁধে ব্যক্তিটির রক্ত খাওয়ার দৃশ্য একাধারে দেখে গেল। ঠোঁটের কোণে তাজা রক্ত নিয়ে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে সে। দাঁতেও রক্ত লেগে আছে। ভয়ংকর হাসি। ভয়ংকর তৃপ্ত চোখ। ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা বুজে নিলো। দেওয়ালে ঠেকিয়ে রাখলো মাথা। একটা কাঁটাময় শুকনো ঢোক গিলতেই কে যেন কানের কাছে এসে বললো, “অপ্রিয় দুঃখ, তুই কারো প্রিয় সুখ হতে পারবি না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা