অটবী সুখ
১০.
এলাকার বড় মাঠ-টায় বড়সড় আয়োজন করা হয়েছে। আশেপাশে এত মানুষ! এত ব্যস্ততা! অটবী শাড়ি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একেতো সে সচরাচর শাড়ি পরে না, আবার শাড়ি তেমন সামলাতেও পারে না। কেন যে মায়ের কথা শুনে শাড়ি পরতে গেল! বড্ড আফসোস হচ্ছে অটবীর। তার হাত দুটো নলী আর পৃথাকে শক্ত করে ধরে আছে। চোখ দুটো ব্যস্ত হয়ে খুঁজছে, কোনো একটা নির্জন স্থান। যেখানে একটু শান্তিতে দাঁড়ানো যাবে। কিন্তু এমন লোকসমাগমে নির্জন জায়গা পাওয়া আসলেই কঠিন। হাল ছেড়ে অটবী নলী আর পৃথার দিকে তাকালো। হতাশ সুরে বললো, “বাসায় যাবি? চল, চলে যাই।”
নলী জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। সে কিছুতেই যাবে না। তাড়াহুড়ো করে বললো, “আমরা না মাত্র আসলাম? কনেও তো আসলো না এখনো। কনে না দেখেই চলে যাবো?”
পৃথাও সহমত জানিয়ে বললো, “নলী ঠিক বলেছে বুবু। তাছাড়া আমরা অনেক কষ্ট করে সেজে এসেছি। এখনই চলে গেলে ঘণ্টাখানেক ধরে সেজে লাভ কি হলো?”
অটবীর দৃষ্টি সন্তুষ্ট নয়। তবুও সে কিছু বললো না। খুঁজে খুঁজে মানুষ তুলনামূলক কম, এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই এলাকার সুনামধন্য মুন্সি চাচার মেয়ের বিয়ে আজকে। ছোট থেকে বুড়ো সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। অটবী যদিও দাওয়াতে আসতে চায়নি কিন্তু মুন্সি চাচা বারবার অনুরোধ করছিলেন ওকে আসতে। উনার মেয়েকে দু’বছর টিউশন পড়িয়েছে বলেই হয়তো এত আহ্লাদ-আদর। অটবীর ভেতর থেকে একটা গুমরে ওঠা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। গরিব বলে পাড়ার সব মেয়েদেরকেই আঠারো পেরোনোর আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মুন্সি চাচার মেয়ের বয়সও আঠারো হয়নি। এবার নিউ টেনে উঠতো। চোখ ভরা কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটার! প্রত্যেক ক্লাসে রোল ১ হতো। প্রায়ই বলতো, অনেক বেশি বেশি পড়ে একদিন ডাক্তার হবে। অনেক টাকা কামাবে। পাশের বড়লোকি এলাকায় নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে বাবা-মার সাথে থাকবে। কই? কিচ্ছু তো হলো না।
নাহ্! সবই হলো। সবার সব ইচ্ছে পূরণ হলো। মাঝখান দিয়ে মেয়েটার আকাশচুম্বী স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।
ভাবনার অকূল পাথারেই কোত্থেকে তনয়া দৌঁড়ে এলো অটবীর কাছে। পেছনে ত্রিস্তানও আসছে। ঝটপট গলায় বললো, “ভালো আপু, ভালো আছো?”
তনয়া আজকে লাল টুকটুকে ফ্রক পরেছে। আদুরে চেহারার মেয়েটাকে সদ্য ফোটা নিষ্পাপ ফুলের মতো লাগছে। অটবী ক্ষীণ হাসলো। সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
—“ভালো নেই।”
—“কেন?”
তনয়া আড়চোখে একবার পাশে দাঁড়ানো ত্রিস্তানকে দেখে নিলো। গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলিয়ে অভিমানে টইটম্বুর হয়ে বললো, “ভাইয়া পঁচা। শুধু বকা দেয়।”
ত্রিস্তান অটবীর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো স্বভাবটা আজ একটু কম। চুল জেল দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো, শার্ট ইন করা। গাল ভর্তি দাঁড়ি গুলো একটু কম কম লাগছে না? হ্যাঁ, ঠিক। দাঁড়িও ছেটেছে বোধহয়। বেশভূষা বড় সাহেবের মতো। সচ্ছ চোখটা যেন অটবীকে অনেক কিছু বলছে। অটবী ধরতে পারেনি। সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি ওকে আবার বকেছেন?”
ত্রিস্তানের ছোট্ট উত্তর, “আগে আগে হাঁটছিল।”
—“তো কি হয়েছে? আগে আগে হাঁটা কি অপরাধ নাকি? আমার সাথে ওর যখনই দেখা হয় তখনই দেখি আপনি ওকে বকছেন! সমস্যা কি আপনার?”
কপালের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হলো। গাঢ় দৃষ্টে কয়েক পল অটবীর দিকে তাকিয়ে রইলো ত্রিস্তান। ধীর কণ্ঠে বললো, “তনয়াকে আর ভালো লাগছে না আমার। তুমি ওকে নিয়ে যাও।”
কথাটা বুঝে উঠতে পারলো না অটবী। চোখ পিটপিট করে বোকা বোকা কণ্ঠে সুধালো, “জি? কি নিবো?”
ত্রিস্তনকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না সে মজা করছে। বরং আগের মতোই নির্বিকার গলায় বললো, “তনয়াকে নিয়ে যেতে বলেছি।”
—“আশ্চর্য! আপনি কয়েকদিন ধরে এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন আমার সাথে?”
ওপাশ থেকে জবাব এলো না। অবাক অটবী হতবাক হয়ে দেখলো, ত্রিস্তান তাকে কি ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে অগ্রাহ্য করে নলী আর পৃথার সাথে কথা বলছে। পাজি দুটোও কম না। তনয়াকে নিয়ে তাদের এতক্ষণের জমানো প্রশ্ন এক এক করে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে ত্রিস্তানকে। লোকটাও জবাব দিচ্ছে। যেন অটবী নামক কেউ তাদের মাঝে কস্মিনকালেও ছিল না। কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!
–
কনে আর বরকে একসাথে বসানো হয়েছে। একদল মানুষ তাদের দেখতে ব্যস্ত থাকলেও অন্যদল খেতে ব্যস্ত। মাঠে আলাদা করে খাওয়ার জায়গা করা হয়নি। যারা চেয়ারে বসেছে তাদের সেখানেই বিরিয়ানির প্লেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আর যারা বসার জায়গা পায়নি তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে।
ত্রিস্তান কোত্থেকে যেন তিনটা চেয়ার জোগার করে নিয়ে এলো। পৃথা, নলী আর তনয়াকে সেখানে বসিয়ে বললো, “চেয়ার আর পাইনি। তুমি কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে?”
অটবী আস্তে করে বললো, “সমস্যা নেই।”
সরোজ আর কাদিন দূর থেকে ছুটে আসছে। দু’হাতে দুটো করে বিরিয়ানির প্লেট। সরোজ তাড়াহুড়ো করে এসে একটা প্লেট অটবীর দিকে এগিয়ে দিলো। মুখের সবকটি দাঁত বের করে বললো, “অটবী আপু, স্পেশাল তোমার জন্য।”
অটবী প্লেট নিতেই কাদিনের আগে আগে সরোজ আবার ছুটে গেল নলীর কাছে। প্লেট দেওয়ার বাহানায় ছুঁয়ে দিলো নলীর হাত। নলী বড় বড় চোখে তাকালো। ছেলেটা পাগল নাকি? অটবী সামনে দাঁড়িয়ে!
সরোজ নলীর ভয়ের ধার ধারলো না। ঠোঁটে লাজুক হাসি ফুঁটিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “তোরে খুব সুন্দর লাগতাছে ডার্লিং। আমার বুক তো নাচা বন্ধ করতাছে না রে!”
নলী লজ্জায় লাজুক পাতার ন্যায় মিইয়ে গেল। সরোজের পানে আর একবারও মাথা তুলে তাকালো না। তার কিশোরী মনে ঝড় বইছে। তীব্র ঝড়। ঝড়টা কি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে? মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করলো নলী। ভাবলো, প্রেম এত রঙিন কেন? এত সুন্দর কেন?
–
বিরাট গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিস্তান আর অটবী। ত্রিস্তান এক প্রকার জোড় করেই নিয়ে এসে এসেছে ওকে। অটবী টিয়াপাখির মতো একটু একটু করে খাচ্ছে। চোখ জোড়া স্থির পাজি দুটোর দিকে। পৃথাকে স্বাভাবিক লাগছে না। একটু আগের উৎফুল্লতা হারিয়ে কেমন মন মরা হয়ে আছে। অটবী খেয়াল করেছে, কাদিনকে দেখার পর থেকেই ওর এমন পরিবর্তন।
অটবী অনেক কিছু বুঝেও না বুঝার ভান ধরলো। পাশে থাকা ত্রিস্তান ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের জন্য খাবার আনেনি। আনতে যাচ্ছেও না। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আপনি খেতে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
—“পরে খাবো।”
—“আমি আপনাকে বুঝে উঠতে পারছি না।”
ত্রিস্তান কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে বললো, “আমি নিজেও আজকাল নিজেকে চিনতে পারছি না।”
—“আপনি– আমার মনে হয় আমাদের এত বেশি মেলামেশা উচিত হচ্ছে না। আপনার উচিত আমাকে এড়িয়ে চলা।”
ত্রিস্তানের ঢিমানো কণ্ঠস্বর, “চেষ্টা করছি।”
অটবী সময় নিলো। বলতে চাইলো, “চেষ্টা না, আপনার করতেই হবে।” কথাটা বলতে গিয়ে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো সে। কিন্তু বলতে পারলো না। হাতের প্লাস্টিকের প্লেট-টা শক্ত করে ধরলো। কণ্ঠ-টা অল্পসল্প কাঁপলো যেন। আঁতকে উঠলো, “আপনার নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে ত্রিস্তান!”
সাথে সাথে ত্রিস্তানও তাকালো। অটবী দিশেহারা হলো খুব। হাতের প্লেট-টা ত্রিস্তানকে দিয়ে ঝটপট সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করলো। চোখ-মুখ কুঁচকে নড়বড়ে গলায় বললো, “আপনার আসলে কি হয়েছে বলবেন প্লিজ?”
ত্রিস্তান উত্তর দিলো না। ত্যাড়া স্বভাবটা খুব দৃঢ় ভাবে ধরে রাখলো। রুমাল দিয়ে নাক মুছে রুমালটা বেশ সাচ্ছন্দ্যে প্যান্টের পকেটে পুরে গাঢ় গলায় বললো, “আমি, সুখনীল ত্রিস্তান, তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি অটবী। রুমালটা তুমি আর পাচ্ছো না।”
____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা