অটবী সুখ পর্ব-০৯

0
558

অটবী সুখ

৯.
কারেন্ট নেই। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঝিমঝিম করছে চারপাশ। অটবী মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবধানে বইয়ের কাছে রাখলো। ক্ষীণ হলদেটে আলোয় এখন যা একটু দেখা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর একটা নিশ্বাস ফেললো। কারেন্ট-টা আর যাওয়ার সময় পায়নি। পৃথা আর নলী এমনিতেই পড়তে চায় না। অনেক কষ্টে বকে বকে পড়তে বসিয়েছিল, ওমনি কারেন্ট ফুরুৎ!
মাথার ওপর মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। তবুও চাঁদের দ্যুতি ঠিক ধরণীতে পৌঁছাচ্ছে না। উঠোনে পাটি বিছিয়ে পৃথা আর নলী পড়ার ভান করছে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে সমানে ফুসুরফাসুর করে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। সেদিকে চেয়ে অটবী ভ্রু কুঁচকালো। এই টুনটুনির মতো মেয়েগুলো কি ভেবেছে? সে কিছু বুঝতে পারছে না ওদের চালাকি? থমথমে গলায় অটবী তৎক্ষণাৎ ধমক লাগালো, “পড়ছিস না কেন তোরা? বইয়ের দিকে তাকিয়ে যে নাটক করছিস, ভেবেছিস আমি বুঝতে পারছি না? বেতের বারি খেতে মন চাচ্ছে? দিবো একটা?”

সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো পৃথা আর নলী। পরমুহুর্তে এমন ভাবে পড়তে লাগলো, যেন এই ইহকালে পড়া ছাড়া তারা আর কিচ্ছু চিনে না। মেয়েদের এমন কান্ড দেখে হাসলেন রেবা বেগম। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললেন, “চা বোধহয় এতক্ষণে হয়ে গেছে অটবী। নিয়ে আয় তো। আমার এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
—“আনছি। তুমি ওদের দিকে খেয়াল রাখো। তোমার মেয়েগুলো এত ফাঁকিবাজ হয়েছে!”

অটবী রান্নাঘরে চলে যেতেই নলী আবারও অসমাপ্ত আলোচনাটুকু শেষ করতে উদ্যোগী হলো। রহিমের বখাটে দল অটবীদের বাসার আশেপাশেই আছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে রাখছে না কিছু। ইদানিং ইলিয়ানা আন্টির স্টাইলিশ, উচ্চ শিক্ষিত ছেলে কাদিনও ওদের সঙ্গ দিয়েছে। সারাদিন রহিমের সাথে ঘোরাফেরা করে। নলীও দেখেছে কয়েকবার। কিন্তু পৃথা বিশ্বাস করতে চাইছে না।
নিজেকে সত্য প্রমাণ করতে নলী গলার জোর বাড়িয়ে বললো, “কাদিন ভাইয়া ভালো ছেলে না, পৃথা। আমি নিজের চোখে উনাকে একটা মেয়ের সাথে চিপায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”

পৃথার মন খারাপ হলো। কিন্তু সে বুঝতে দিলো না। বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই ফিসফিসিয়ে বললো, “তুই হয়তো ভুল দেখেছিস। কাদিন ভাইয়া মোটেও এমন না। আমি উনাকে চিনি।”
নলীও ফিসফিসালো, “কি এমন চিনিস? কয়দিন কথা বলেছিস ওনার সাথে? দূর থেকে দেখেই আপন হয়ে গেল? নাকি তোর রোমিও খারাপ হতেই পারে না! তোদের চোখে তো একমাত্র সরোজ ভাই-ই খারাপ। আর সবাই তো ধোঁয়া তুলশি পাতা।”

পৃথা বই থেকে চোখ তুললো। রেবা বেগমের এদিকে খেয়াল নেই। পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে তিনি ঝিমুচ্ছেন। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে পৃথা বললো, “সাবধানে কথা বলবি নলী। কাদিন ভাইয়া আমার রোমিও হতে যাবেন কেন?”
—“রোমিও না হোক, তুই তো উনাকে পছন্দ করিস। তাছাড়া—”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ-ই থেমে গেল নলী। রহিমদের গলার আওয়াজ একদম কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। শুধু রহিম না, সরোজ, কাদিন আরও গুটিকয়েক ছেলের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট কানে আসছে। নলীর চোখ চিকচিক করে উঠলো। উত্তেজনায় পৃথার বাহু খামছে ধরে বললো, “শুনেছিস? কাদিন ভাইয়ার গলা। আমি বলেছিলাম না উনি রহিম ভাইদের সাথে চলাফেরা করে? তুই তো বিশ্বাসই করতে চাইছিলি না।”
পৃথা থমকালো। একটু না, অনেকখানি। গেটের ওপাশ থেকে কাদিনের বলা কথাগুলো সেও শুনতে পারছে। রহিম ভাই ডেকে ডেকে প্রাণ জান উজাড় করে দিচ্ছে ছেলেটা। অন্যমনস্ক পৃথা বইয়ের একটা লাইন বার বার পড়তে লাগলো। পাশ থেকে নলী অনেক কিছু বলছে। সে শুনছে না। তার ভেতরটা কেমন যেন করছে। অদ্ভুত ভাবে ঢিপঢিপ করে অস্থির করে তুলছে ওকে। আগে তো এমন কখনো হয়নি। কক্ষনো না।

_

অটবীদের রান্নাঘর থেকে সামনের রাস্তা দেখা যায়। চুলার আগুন বন্ধ করে কাপে চা ঢালতে ঢালতে অটবী জালানার বাহিরে তাকালো। ওইতো, রহিম ভাইকে দেখা যাচ্ছে। দলবল নিয়ে গেড়ে বসেছে রাস্তার দূর্বাঘাসের ওপর। কি নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। অটবীর মেজাজ খারাপ হলো। আজকাল রহিমের সাহস অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কাউকে পরোয়া করে না। কেউ শাসন করতে চাইলে উল্টো তাকে শাসিয়ে ঘর বন্ধী করে দেয়।
আচমকা টর্চ লাইটের তীক্ষ্ণ আলো মুখের ওপর পরলো তার। অটবী হকচকালো। দীর্ঘক্ষণ পর এমন তেজি আলোর সংস্পর্শে এসে চোখটা জ্বলে উঠলো যেন। অসহ্য ঠেকলো। শুনতে পেল, “কিরে, খুকি না? ওইখানে দাঁড়াই দাঁড়াই কি করো খুকি? আমাদের দেখো?”

রহিমের খসখসে কণ্ঠস্বর। অটবী তখনো তাকাতে পারছে না। লাইটের আলো চোখে সইতে আরও কয়েক সেকেন্ড লাগবে। বেয়াদপ লোকটা এখনো চোখের ওপরই লাইট ধরে আছে।
অটবী চেঁচিয়ে উঠলো, “এগুলো কি ধরণের বেয়াদবি রহিম ভাই? মুখের ওপর লাইট ধরেছেন কেন?”
রহিম খ্যাঁকখ্যাঁ করে হাসলো। যেন কোনো কৌতুক শুনেছে সে। বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে বললো, “আশেপাশে অন্ধকার খুকি। অনেকদিন তোমারে দেখিনা। তাই লাইট মাইরা দেখলাম।”

রহিমের বামপাশে সরোজ আর কাদিনকে দেখা যাচ্ছে। অটবী একটা তাচ্ছিল্য দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো ওদের। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। এত অসহায় লাগছে নিজেকে! প্রবল অসহায় দৃষ্টিটা ঘুরেফিরে ত্রিস্তানের দিকে স্থির হলো। লোকটা জলন্ত সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। সবসময়কার উদাসীন দৃষ্টি রাস্তায়। অন্যদের মতো অটবীর হেনেস্তা দেখে মজা নিচ্ছে না, হাসছে না, তাকাচ্ছে না।

ত্রিস্তান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে দিলো। অটবী খেয়াল করলো, সে এদিকেই আসছে। অটবীর কাছে। জানালার একেবারে মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করলো, “কি করছো?”

অসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠ। যেন এ প্রশ্নটা ত্রিস্তান রোজই তাকে করে। কিন্তু অটবী স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েই রইলো।
ত্রিস্তান আবার বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। উত্তর দাও।”

অটবী সময় নিলো। হাজারটা বিস্ময়ের সঙ্গে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললো, “চা… চা বানাচ্ছি।”
—“লাল চা? নাকি দুধ চা?”
—“লাল চা।”
—“একদিন তোমায় বাসায় আসবো কেমন? আমি লাল চা খাই না। আমাকে দুধচা খাওয়াবে, ঠিকাছে?”

মনে হলো, ত্রিস্তান হেসে কথাটা বলেছে। কিন্তু তার ঠোঁটে হাসি নেই। চোখদুটো স্থির, শান্ত। খুটখাট শব্দে কি যেন করছে। তার হাত নড়ছে। তবে আসলে ঠিক কি করছে, সেটা বুঝতে পারছে না অটবী।
কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, “আমি আপনাকে কেন খাওয়াবো?”
—“বিশেষ কারণ নেই।”
—“আপনি অদ্ভুত আচরণ করছেন।”
—“করছি নাকি?”

বলতে বলতে ত্রিস্তান তাকালো। অটবীর বিস্মিত মুখখানা পরখ করে আলতো হেসে বললো, “তোমাকে রাগলে অনেক সুন্দর লাগে অটবী। তাই আরেকটু রাগাচ্ছি। তুমি রাগ করো না, কেমন?”

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান। হঠাৎ-ই সশব্দে জানালা লাগিয়ে দিলো ত্রিস্তান। ‘ধাম’ করে শব্দ হলো। ভয়ংকর শব্দ! অটবীর হাত থেকে চার ছাকনি পরে গেছে। শরীর এখনো কাঁপছে। রেবা বেগম দৌড়ে আসলেন মেয়ের কাছে। উদগ্রীব হয়ে সুধালেন, “কি হয়েছে অটবী? কাঁপছিস কেন? কিসের আওয়াজ ছিল ওটা?”

অটবী জবাব দিতে পারেনি।

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। পরে ঠিক করে দিবো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে