অটবী সুখ
৮.
গাছের ছায়ার নিচে বসে থাকতে অটবীর মন্দ লাগছে না। আশেপাশে খুব কম মানুষজন। বেশির ভাগই স্টুডেন্ট। অটবীর একটু অস্বস্তি হলো। জোড়সড়ো হয়ে বসলো খানিকটা। সে বাসার জামা পরেই চলে এসেছে। ওড়নার কোণা ছেঁড়া। গম্ভীর ভাবে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। কিন্তু অটবীর অবচেতন মন বলছে, সবাই বুঝি তার ছেঁড়া ওরনা দেখে ফেলেছে? সেটা দেখেই হাসছে?
অটবী জানে এসব তার নিছক কল্পনা। তবুও অস্থিরতা কাটছে না। ত্রিস্তানের সাথে তার এখানে আসাই উচিত হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। দোকান থেকে কি কি সব কিনে এদিকেই আসছে সে। হাতে মাঝারি আকারের পলিথিনের ব্যাগ। চোখাচোখি হতেই অটবী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। এ লোকটার দিকে সে যতবারই তাকায়, চোখাচোখি হবেই!
ত্রিস্তান এসেই ধপ করে বসে পরলো অটবীর পাশে। পলিথিন থেকে পাঁচটা ডেইরি মিল্ক বের করে অটবীর কোলে ছুঁড়ে মারলো। সে জানে, অটবীকে সরাসরি চকলেটগুলো দিলে মেয়েটা নিবে না। পলিথিনের বাকি জিনিসগুলো তনয়াকে দিয়ে বললো, “সবগুলো খাবি না। এখানে দুটো, বাসায় দুটো। কালকে আবার বাকি চারটা। ঠিকাছে?”
তনয়া জোরে জোরে মাথা দুলালো। ইতিমধ্যে পলিথিন থেকে একটা চিপস্ নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে সে। বড় বড় মায়াবী চোখগুলো খাওয়ার সময়টাতেও চঞ্চলতা ছাড়ছে না। ব্যস্ত হয়ে মাঠের ছেলেপেলের ক্রিকেট খেলা দেখছে। চোখেমুখে কি ভীষণ উৎফুল্লতা!
ত্রিস্তান নজর ফেরালো। অটবীও মাঠের ছেলেগুলোকে দেখছে। একটু গম্ভীর নয়নে। কোলের চকলেটগুলো এখনো সেভাবেই পরে আছে। মেয়েটা ছুঁয়েও দেখেনি। ত্রিস্তান চোখ সরু করলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? এভাবে ভাঁজ হয়ে বসে আছো কেন?”
অটবী নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলো। কপাল কুঁচকে এমন একটা ভাব করলো, যেন সে ভীষণ বিরক্ত ত্রিস্তানের ওপর। ভীষণ মানে ভীষণ!
জবাব না পেয়ে ত্রিস্তান আবার বললো, “তোমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না অটবী। এই যে, আমার শার্টের সেলাই খুলে প্রথম দুটো বোতাম পরে গেছে। কেউ কি দেখছে? দেখছে নাতো!”
ভুল কথা। অটবী সেই প্রথম থেকে দেখছে। যদিও সে জানতো না সেলাই খুলে বোতাম পরে যাওয়ার জন্যই ত্রিস্তানের ফর্সা বুকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। সে ভেবেছিল লোকটা স্টাইল করে ইচ্ছাকৃতভাবে বোতাম খুলে রেখেছে। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অটবী বললো, “আমি ঠিক আছি। শুধু বাসায় যেতে চাইছি।”
—“আর একটু।”
একথা অটবী অনেক্ষণ ধরে শুনছে। ‘আর একটু’ ‘আর একটু’ বলে ত্রিস্তান আধঘণ্টা পার করে দিয়েছে। নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হবে কিছুক্ষণ পর। সে এতক্ষণ অবশ্যই ত্রিস্তানের সাথে বসে থাকতে পারবে না।
—“তনয়া কবে থেকে অসুস্থ?”
ত্রিস্তান তখন একমনে আকাশ দেখছিল। অটবীর প্রশ্ন শুনে দেখাটা আরেকটু গভীর করলো। ধীরস্থির কণ্ঠে বললো, “দু’বছর আগে থেকে।”
—“ওকে ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেন? নাকি দেখিয়েছেন?”
—“দেখিয়েছিলাম। ট্রিটমেন্টে অনেক টাকা লাগবে। জমাচ্ছি।”
অটবী একপলক তনয়ার দিকে তাকালো। তার প্রচন্ড মায়া হয় মেয়েটার ওপর। হয়তো খুব নরম মনের ছিল মেয়েটা। এত বড় কষ্ট সামলাতে পারেনি। অটবী আজকে দেখেছে, তনয়ার পেটের বিদঘুটে দাগটা। এখনো চোখে ভাসছে। অটবী জানে না দাগটা কিসের। হয়তো খুব খারাপ কিছু হয়েছিল তনয়ার সাথে। হয়তো কষ্টের কিছু। এজন্যই হয়তো তনয়ার স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সন্তান জন্ম দিতে না পারায়।
আচমকা ত্রিস্তানের প্রতি রাগ হলো অটবীর। রুক্ষ গলায় বললো, “চুরি করে কত টাকা জমিয়েছেন? হারাম টাকা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবেন বোনের?”
ত্রিস্তান শান্ত, স্বাভাবিক, স্থির। অসম্ভব নির্লিপ্ততা নিয়ে বললো, “আমি চুরি করি না অটবী।”
—“এখন কি মিথ্যে বলা শুরু করে দিয়েছেন?”
ত্রিস্তান আগের মতোই বললো, “নাহ্। আমি ওদেরকে কিভাবে চুরি করতে হবে সেটার প্ল্যান করে দেই। ওরা চুরি করে।”
হাহ! তাতে কি? এটাও তো হারামই! অটবী বললো, “প্রশ্নের উত্তর দিন। কত টাকা জমিয়েছেন?”
—“চুরি করে জমাইনি। আগে পার্টটাইম জব করতাম। পঞ্চাশ হাজারের মতো জমিয়েছিলাম সেখান থেকে।”
—“জব ছেড়েছেন কেন?”
—“ছাড়িনি। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।”
ত্রিস্তানের দৃষ্টি আকাশে। বড্ড উদাসীন দৃষ্টি। হতাশাপূর্ণ। মুখটা গুমরে রাখা। একটা চাকরি তার সত্যি খুব প্রয়োজন। অটবী আস্তে করে বললো, “আপনাকে বলেছিলাম আকাশের দিকে না তাকাতে।”
ত্রিস্তান আজও অবাধ্য হলো। দেখেই রইলো আকাশকে। বললো, “দেখতে ভালো লাগে।”
অটবী আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলো। এপাশ-ওপাশ চুপচাপ। মাঠের ছেলেগুলো একদফা খেলা শেষে এখন আবার খেলতে নেমেছে। হৈ-হুল্লোড় আওয়াজ কানে লাগছে। নাহ্। আর বসে থাকা যাবে না। ছোট্ট নোকিয়া মোবাইলের স্ক্রীনে চারটা বাজছে। এক্ষুণি রওনা না দিলে ছুটির আগে পৌঁছানো যাবে না। অটবী উঠে দাঁড়ালো। ত্রিস্তানকে কিছু না বললেও তনয়াকে বিদায় জানিয়ে কদম ফেললো যাওয়ার জন্য। ত্রিস্তান সেই কদমের গভীরতা মাপলো। দেখলো, তাকে অগ্রাহ্য করে কি অনায়াসে চলে যাচ্ছে মেয়েটা! অথচ ঠিকই তার দেওয়া চকলেটগুলো যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। তাহলে এই মিছে অভিনয় কেন? নাকি বুঝতে পারছে না?
চোখ বুজে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো ত্রিস্তান। ক্ষীণ সুরে আওড়ালো, “আমি তারে কই, শুনো হে মানবী, তুমি মোটেও বিশেষ নও। হে কয়, আমি জানি, আমি অন্যরকম। আমি কই, উহু। মিছে কথা। অন্যরকম হইলে আমি তোমারে বুঝি কেমন করে? হে কয়, তুমি তো আমার আপন মানুষ। তুমিই তো আমারে চিনবা। আমি হাসিয়া কই, আমি তোমার আপন মানুষ হইতে পারুম না। আপন হইতে সুখ থাকা লাগে। আমার কাছে সুখ নাই। হে কিছু কয় না। মলিন আঁখি মেলিয়া ধরে।”
_
জায়গাটা অটবীর বাড়ির পেছনে। সরোজ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক্ষণ হচ্ছে, নলী আসছে না। চিঠিতে বলেছিল, ঠিক বিকাল চারটায় এখানটায় আসবে। এসময় নাকি অটবী পৃথাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। পৃথার জ্বর এসেছে হঠাৎ। স্কুলেও যায়নি তাই। এখন সাড়ে চারটা বাজছে। মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সরোজের পা ব্যথা করছে। একটা সিগারেট শেষ করে মাত্রই আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল, নরম পায়ে নলীকে দৌড়ে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি ফেলে দিলো। নলী কাছাকাছি আসতেই দাঁত বের করে হেসে বললো, “এত দেড়ি করে আসছিস ক্যান?”
নলী রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। আসার আগে মায়ের কাছে প্রায় ধরা পরে যাচ্ছিল। এতক্ষণ বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছে, সে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে। নোট আনতে।
বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে নলী বললো, “মা আসতে দিচ্ছিল না। অনেক কষ্টে এসেছি।”
বলতে বলতে খেয়াল করলো, সরোজ বিশ্রী ভাবে হাসছে। ভ্যাবলাদের মতো। এরকম তো হাসে না! ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কি হইছে? এভাবে হাসছেন কেন?”
—“কিচ্ছু না। কসম!”
নলী নাক কুঁচকে বললো, “আপনার শরীর থেকে এরকম গন্ধ আসছে কেন? কি খেয়েছেন?”
সরোজ হাসি বাড়ালো। খাঁটি অভিনেতার মতো বললো, “মনে হয় সিগারেটের গন্ধ। আমি খাইনাই। রহিম ভাই খাইছে। আমি পাশে ছিলাম। উনার থেকে মনে হয় আমার গায়ে আসছে।”
নলী বোধহয় বিশ্বাস করলো। বললো, “ওদের সাথে মিশেন কেন? পাড়ার সবাই ওদেরকে খারাপ বলে। আপনি ওদের সাথে মিশেন দেখে আপনাকেও খারাপ ভাবে। বুবুও এজন্য আপনাকে পছন্দ করে না।”
—“তোর বুবু যে কেমনে আমারে পছন্দ করবো, সেইটা আমি ভাইবা ফেলছি। আমার মনে হয়, অটবী আপু আর ত্রিস্তান ভাইয়ের ব্যাপারটা কয়দিন পরই রমরমা হইয়া যাইবো। এটাই আমাদের সুযোগ। ত্রিস্তান ভাই আমারে চিনে। আমি কেমন সেটাও জানে। তুই মনে কর, তোর বুবু আর ত্রিস্তান ভাই এক হইলে আমি আর তুইও এক।”
শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নলীর কিশোরী মন। হাসি হাসি মুখ করে বললো, “সত্যি?”
—“হ্যাঁ।”
—“কিন্তু আপনি তো এস.এস.সি. ফেল। এবার ফেল করলে কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”
কেউ সরোজকে ফেল করার কথা বললে সরোজ ভীষণ রেগে যায়। নিজের বাবার সাথেও এজন্য কম রাগারাগি হয়নি। কিন্তু নলীর সাথে তো সে আর রাগ করতে পারবে না, তাই মন খারাপ করে তাকালো। বললো, “এবার ফেল করতাম না। একটা বন্ধু পাইছি। পরীক্ষায় ওর খাতা দেইখা কপি-পেস্ট কইরা দিমু। তাইলেই পাশ!”
নলীও মন খারাপ করলো এবার, “কপি-পেস্ট করতে হবে কেন? একটু পড়ালেখা করলেই তো হয়।”
—“আমার পড়ালেখা করতে ভাল্লাগে নারে। আমার শুধু তোরে ভাল্লাগে।”
প্রেমিকের মুখ থেকে এমন কথা শোনার পর প্রেমিকার আর কি চাই? মন খারাপ-টন খারাপ সব উধাও!
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা