অটবী সুখ পর্ব-০৫

0
590

অটবী সুখ

৫.
দিনটা বাদল কন্যাদের দখলে ছলমল করছে। সুদূরে সূর্য রোদ্দুর ছড়ালেও আজ একটু বেশিই মলিন তা। উত্তাপ গা ছুঁচ্ছে না। বরং খোলা জানালা মাড়িয়ে দক্ষিণা হাওয়া সুরসুর করে ভেতরে ঢুকে প্রাণ-জান উজাড় করে দিচ্ছে। চোখ বুজে লম্বা তিনটে শ্বাস ফেললো অটবী। এমনটা সে প্রায়ই করে। ঘুম থেকে ওঠার পর পা দুটো আপনা আপনি চলে যায় জানালার কাছে। ভোরের দুষ্টু-মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট। ছোট্ট একটা মুহুর্ত। অথচ এই ছোট্ট মুহুর্তটাই সারাদিনের ব্যবস্তা ছাপিয়ে তার নিজের। এতে কারো ভাগ নেই। এই কয়েক সেকেন্ড অটবীর একার।
সকালটা একটু ঠান্ডা, ঠান্ডাই বলা যায়। হাত-মুখ ধুঁতে গিয়ে সেটা বেশ ভালো ভাবেই টের পেল অটবী। পানি ছুঁতেই শরীরের লোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠে। অটবী কাঁপতে কাঁপতে গামছা দিয়ে মুখ মুছলো। রান্নাঘরে এগোতেই দেখলো, রেবা বেগম আজও একা একা কাজ করছেন। এতে বড্ড রেগে গেল সে। অসহ্য বিরক্তি নিয়ে বললো, “তুমি একটা কি বলো তো মা? তোমাকে না বলেছি সকালে উঠলে আমাকে ডাকবে? ডাকোনি কেন?”

রেবা বেগম মেয়ের কথায় গ্রাহ্য করলেন না বোধহয়। তার মেয়েটা অতিরিক্ত বদমেজাজি হলেও মাকে ভীষণ ভালোবাসে। এই রাগটা তারই বহিঃপ্রকাশ। মাছে হলুদ, মরিচ, লবণ পরিমাণ মতো দিয়ে তিনি বললেন, “লালশাকগুলো বেছে দেয়, আয়।”

অটবীর বিরক্তি বাড়লো। মায়ের এমন ছন্নছাড়া কাজ তার ভালো লাগছে না। ধুপধাপ পায়ে মোড়া টেনে শাক বাছতে বসে পরলো ও। রেবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তোর বোন দু’টো কি উঠেছে? ওদেরকে উঠাবি কখন? ইস্কুল আছে না?”
—“পৃথাকে ডেকে এসেছি। উঠে যাবে একটুপর।”

কথাগুলো গম্ভীর শোনালো। মেয়েটা কি অভিমান করেছে? রেবা বেগম মিটিমিটি হাসলেন। সাবধানে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তুই নাকি নলীর সাথে কথা বলছিস না? বিচার দিলো আমাকে।”
অটবী সে কথার উত্তর দিলো না। এড়িয়ে গেল দারুণ কৌশলে, “লালশাকগুলো কিভাবে রাঁধবে? চিংড়ি মাছ দিবে সাথে?”

রেবা বেগম তড়িঘড়ি করলেন। হঠাৎ কিছু মনে পরার মতো করে বললেন,
—“ভালো কথা মনে করেছিস। আমি তোকে বলবো বলবো করে ভুলে গেছি। পাশের বাসায় চিংড়ি মাছ রেখেছিলাম। এক্ষুণি গিয়ে নিয়ে আয়। পরে আর মনে থাকবে না।”

লালশাক বাছা প্রায় শেষের দিকে। হাতদুটো ভালো করে ধুঁয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো অটবী। তাদের পাশের বাসায় ইলিয়ানা আন্টিরা থাকেন। ভদ্র মহিলা এমনিতে সবার উপকার করলেও মুখ চলে বেশি। কোথাও স্থির থাকতে পারেন না। এরওর কথা একেওকে বলে বেড়ান। অটবী যতবারই উনার বাসায় গিয়েছে, জোর করে একঘণ্টা নিজের কাছে বসিয়ে হাজারটা গীবত গেয়ে গেছেন। এটা তিনি সবার সাথেই করেন। এজন্য পৃথা আর নলী উনার কাছে আসতে অতটা পছন্দ করে না। বাধ্য হয়ে অটবীকেই আসতে হয়। তাছাড়া ইলিয়ানা নামক মহিলাটির স্বামীর বাজারে বড় মুদির দোকান আছে। পাড়ার সবার থেকে টাকা পয়সাও বেশি। তাই দাপটও বেশি।

দরজায় কড়া নাড়ানোর এক মিনিটের মাথায় দরজা খুলে দিলো এক ছেলে। ঠিক ছেলে না। যুবক। অটবী থেকে বড়ই হয়তো। হয়তো বা সমান বয়সী। দরজা খুলে অটবীর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। পরনে কালো গেঞ্জি, কালো হাফ-প্যান্ট।
অটবী ভদ্রভাবে বললো, “ইলিয়ানা আন্টি আছেন? আমি উনার কাছে এসেছি।”

সদ্য ঘুম ভাঙ্গা, খসখসে গলায় ছেলেটা উত্তর দিলো, “আম্মু নেই বাসায়। কি দরকার আমাকে বলেন।”
—“আপনাদের ফ্রিজে মাছ রেখেছিলাম আমরা। ওটা নিতে এসেছি।”

এত বড় ছেলেকে একথাটা বলতে গিয়ে একটু লজ্জাই পেল অটবী। কিন্তু ছেলেটা বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। অনতত তার মুখ তো তা-ই বলছে।
—“কিভাবে দিয়েছেন মাছ? প্যাকেটে নাকি বক্সে?”

ছেলেটার কথার ধরণে মনে হলো, সে একাজে ভীষণ পটু। যেন বহুকাল ধরে একাজই করে আসছে। কিন্তু তবুও খানিকটা অস্বস্তি হলো অটবীর। ইতস্তত কণ্ঠে বললো, “ছোট নুডুলস্-এর প্যাকেটে।”
—“আচ্ছা।”

বলে সাথে সাথে দরজা আটকে দিলো ছেলেটা। ভড়কালো অটবী। এভাবে দরজা আটকানোর মানে কি? সে কি ছেলেটা না আসা অব্দি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে? কি আশ্চর্য! ছেলেটা এমন বেয়াদব কেন?

পাশের বাসা থেকে অটবী আসতে আসতে পৃথা আর নলীও ঘুম থেকে উঠে গেছে। কালকের মতো আজও কথা বলার সুযোগ খুঁজছে নলী। অটবী পাত্তা দিচ্ছে না। এসেছে থেকে রেবা বেগমের সাথে কথা জুড়ে দিয়েছে। পাশের বাসার ছেলেটা নাকি খুব বেয়াদব। মানুষকে সম্মান করতে জানেনা। নলী অবশ্য ইলিয়ানা আন্টির ছেলেটাকে একবার দেখেছে। সরোজের সাথে প্রায়ই মাঠে ক্রিকেট খেলে। দেখতে তো ভালোই ছেলেটা।

নলী ভয়ে ভয়ে বোনের পাশে গিয়ে বসলো। মৃদু স্বরে ডাকলো, “বুবু?”
অটবী উত্তর দেয়নি। সে আবারও ডাকলো, “ও বুবু, শুনো না!”
—“কি?” কণ্ঠে অল্পসল্প ধমকের রেশ। নলী কিন্তু তবুও দমলো না। সাহস নিয়ে বললো, “আমি আর সরোজ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো না বুবু। সত্যি বলছি! তুমি প্লিজ আমার থেকে রাগ ঝেড়ে নাও না বুবু।”

রেবা বেগম একবার অটবীর দিকে আড়চোখে তাকালেন। নাহ্! মেয়ের রাগ গলছে। তিনি দেখেই বুঝতে পারছেন। অনেকটা কৈফিয়তের সুরে তিনিও তাল মেলালেন, “ক্ষমা করে দেয় অটবী। ও আর ওই ছেলের সাথে কথা বলবে না। অনেক রাগ করেছিস। এবার সব ঠিক কর। মেয়েটা তোর জন্য সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।”

অটবী এবারও তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার রাগ অনেকটাই কমে গেছে। ছোটবোন দুটোকে জন্ম থেকে আগলে রেখেছে সে। মায়ের মতো না হোক, মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না। তবে অকপটে শুধু এটুকুই বললো, “ওদেরকে দ্রুত তৈরি হতে বলো মা। স্কুলের দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

স্কুলে যাওয়ার পথে সরোজের সাথে দেখা হলো নলীর। অটবী পাশেই ছিল। সরোজ নলীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও নলী একবারের জন্যও তাকায়নি। বুবু তার অনেক কষ্টে রাগ ভুলেছে, এখন সে আর আগের মতো ছেলেমানুষী করতে পারবে না। যা করতে হবে, সব সাবধানে, লুকিয়ে।
সরোজের জন্য স্কুলে আসার আগে চিঠি লিখে এনেছিল নলী। সেটাই অটবী না দেখে মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছে। আসার আগে সরোজকে চোখের ইশারায় বুঝিয়েও এসেছে, চিঠিটা যেন সে তুলে।

অটবীদের এলাকার একদম শেষে একটা বাজার পরে। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে শুকনো বাজার সব পাওয়া যায়। কিন্তু ‘অরবিন্দ অটবী’ থেকে বাজারটা বেশ দূরে। নলীদেরকে স্কুলে দিয়ে অটবী বাজারেই গেল। বাজারটা মাছের গন্ধে ভরে গেছে। কিছু ভদ্র লোকদের দেখতে পেল, রুমাল চেপে বাজারে ঘুরঘুর করছে। আবার কেউ কেউ খুব বাজে ভাবে মুখ বিকৃত করে রেখেছে। অটবী বেশ মজাই পেল ওদের দেখে। মনে মনে ভাবলো, সেও যদি এমন আহ্লাদী বাবার সন্তান হতো, তবে কি ওদের মতোই মুখটা এমন করে রাখতো? নিজের চেহারা কল্পনা করে নিজ মনেই খিলখিল করে হেসে ফেললো অটবী। ভাগ্যিস সে আহ্লাদী বাবার মেয়ের হয়নি! তাকে ওভাবে মোটেও সুন্দর লাগতো না। ভীষণ বিশ্রী দেখাতো।

বাজার করা শেষে হুট করে বৃষ্টির আগমন ঘটে গেল। অটবী তখন বাজারের একপাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। তার কাছে ছাতা নেই। পরনে হলুদ রঙের জামা। কাপড়টা খুব পাতলা। এ জামা পরে বৃষ্টিতে ভেঁজা সম্ভব না৷ সে একমনে রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল। ফোঁটায় ফোঁটায় রাস্তায় বৃষ্টি পরার দৃশ্যটা দারুণ লাগছে তার।
সরব, ত্রিস্তান এসে পাশে দাঁড়ালো। অটবী প্রথমে খেয়াল করেনি। লোকটা কালো রঙের ছাতা মুখের কাছে ধরতেই চমকে উঠলো। ত্রিস্তান বললো, “ছাতা নিয়ে বাসায় যাও।”

কি নিঃসংকোচ আবদার! অটবী আবদারটা রাখতে পারলো না। কাঠকাঠ গলায় মানা করে দিলো, “আমি কি আপনার কাছে ছাতা চেয়েছি? আমার লাগবে না।”
—“জানি, তবুও নাও।”

অটবী মুখ তুলে সরাসরি তাকালো। লোকটার হাতে বড়সড় বাজারের ব্যাগ শোভা পাচ্ছে। কপাল, চুল, শার্ট ক্ষীণ ভেঁজা। অটবী মুখ ফিরিয়ে নিলো, “অনেক উপকার করেছেন ত্রিস্তান। কিন্তু এ উপকারটা আমার লাগবে না।”

ত্রিস্তান ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো, “তুমি অনেক বেশি কথা বলো। কান তিতা করে দিচ্ছো। তোমাকে যে চকলেট দিয়েছি, খাওনি?”
—“আপনার দেওয়া জিনিস আমি কেন খাবো?”
—“পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম অটবী! তুমি এত সহজে ফেলে দিয়েছো?”

কথা শুনে মনে হলো, ত্রিস্তান প্রচন্ড অবাক হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে মোটেও তেমনটা মনে হচ্ছে না। অটবী ক্লান্ত চোখজোড়া কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আবার খুললো। সে ফেলে দেয়নি ত্রিস্তানের চকলেটগুলো। টাকার ব্যাগে এখনো আছে। কিন্তু সেটা ত্রিস্তানকে বললো না। আবার ত্রিস্তানের সঙ্গে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না।
ত্রিস্তানের হাত থেকে ছো মেরে ছাতা নিতে নিতে অটবী বললো, “পরে ছাতাটা কিভাবে দেব আপনাকে?”
—“আমি নিজেই নিয়ে নিবো।”

অটবী আর কথা বাড়ালো না। ত্রিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনে হাঁটতে লাগলো।
কালো ছাতা হাতে চলে যাওয়া চরম অকৃতজ্ঞ মেয়েটাকে উদাসময় শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ত্রিস্তান। ভিষণ আস্তে বললো, “আকাশের মতো সুন্দর তো তুমি নও। বৃষ্টির মতো মুগ্ধময়ীও নও। অরণ্য, তবে তুমি কি?”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে