অটবী সুখ পর্ব-০৪

0
597

অটবী সুখ

৪.
রাস্তার একপাশে সবুজ দূর্বাঘাসের ওপর বসে আছে অটবী আর ত্রিস্তান। পাশেই তনয়া মহানন্দে কচরমচর শব্দে চিপস খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোমল পানীয়র বোতলে চুমুক দিচ্ছে একটু একটু করে। ত্রিস্তানের দৃষ্টি বোনের পানেই স্থির। নির্মল চোখে বোনের আনন্দ দেখছে সে। তবুও চেহারার কোথাও যেন একটা চাপা অসন্তুষ্টি ভাব। কপালের মাঝখানে গুটিকয়েক সূক্ষ্ণ ভাঁজ। এর কারণ অটবী জানে। টিউশনি থেকে আজই এ মাসের বেতন পেয়েছে সে। হাতে চার হাজারের মতো আছে। ত্রিস্তানের কাছে টাকা নেই শুনে সে অনেকটা জোড় করেই তনয়া যা চায় কিনে দিয়েছে। ত্রিস্তান মানা করেছে অনেকবার। কঠোর চাহনি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে অটবীর অন্তর। অটবী তবুও শুনেনি। সেই থেকে অটবীর দিকে তাকাচ্ছে না লোকটা।
সরব, ত্রিস্তান মৃদু গলায় বললো, “তোমার টাকা আমি আজকেই দিয়ে দেবো।”

কথাটা গম্ভীর শোনালো। লোকটা কি রেগে আছে? রাগ করতেও জানে নাকি? এ সামান্য বিষয়ে রাগ করার কি আছে? সেদিন রাতে ত্রিস্তানও তো তাকে কতবড় সাহায্য করলো। এবার অটবীর পালা এসেছে। সে কেন পিছিয়ে থাকবে? সমান-সমান করার একটা ব্যাপার আছে না? মনে মনে কয়েকদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অটবী বললো, “কিভাবে দেবেন? চুরি করে?”
ত্রিস্তানের সহজ উত্তর, “হ্যাঁ।”
—“পঞ্চাশ টাকার জন্য চুরি করবেন? এমন হলে আমি কোনো চুরির টাকা নিতে পারবো না।”

এ কথার পিঠে ত্রিস্তান আর কিছু বললো না। বোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকালো আকাশের দিকে। হাতদুটো দু’দিকে ছড়িয়ে সবুজ দুর্বাঘাসগুলো মুঠোয় পুরে নিলো। হিমেল হাওয়ায় উঁড়তে রইলো তার কপালের এলোমেলো চুল। চোখদুটো শান্ত, কিন্তু আসলে বড্ড অশান্ত। অটবীর হঠাৎ মনে হলো, ত্রিস্তান নামের দুঃখটি হয়তো তার কল্পনা থেকেও দুঃখী। নয়তো একেবারেই দুঃখী না। লোকটা প্রশান্তি নিয়ে নিশ্বাস ফেললেও মনে হয়, বুকভরা পাথর নিয়ে নিশ্বাস ফেলছে। হাসলে মনে হয়, জোর করে হাসছে। নাকি সবই তার মনের ভুল? হতেও তো পারে।
অটবী আনমনেই জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নামের অর্থটা অদ্ভুত। এমন নাম জেনেশুনে আপনার মা-বাবা রেখেছে কেন?”

ত্রিস্তান অবাক হলো না। তার নামের অর্থ জানার পর এ প্রশ্নটা তাকে অনেকেই করে। সে কখনো কাউকে উত্তর দেয়নি। শুধু মুচকি হেসেছে। অটবীর বেলায় মুচকি হাসতে ইচ্ছে করলো না। চোখেরপাতা বুজে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার বাবা একজন বইপোকা মানুষ। আমার বাসায় বাবার অনেক বই আছে। সেসব বইগুলোর মাঝে ‘সোনালী দুঃখ’ নামের একটা বই বাবা খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন। বইটা তার খুব পছন্দ। সেই বইয়ের নায়ক চরিত্রটা তাকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে, বাবা আমার নাম ত্রিস্তান রেখে দিয়েছিলেন। এতে অবশ্য আমার আম্মু রাজি ছিলেন না। আম্মু আবার অনেক কুসংস্কার মানতেন। ত্রিস্তান অর্থ দুঃখ জেনে অনেকবার আমার নাম পাল্টাতে চেয়েছিলেন। এই নামের জন্য নাকি আমার জীবনে কখনো সুখ আসবে না। রাগারাগিও করেছিলেন বাবার সাথে। কিন্তু বাবা শুনেননি। পরে বাধ্য হয়ে আম্মুও মেনে নেন। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে না। আব্বু আমাকে ত্রিস্তান বলে ডাকলেও আম্মু ডাকতেন সুখ বলে। যাতে দুঃখ আমাকে ছুঁলেও সুখও যেন আমাকে ছোঁয়।”

অটবী প্রশ্ন করলো, “আপনার পুরো নাম কি?”
—“সুখনীল ত্রিস্তান।”
—“সুখনীল? আপনি কি খেয়াল করে দেখেছেন, আপনার প্রত্যেকটা নামেই ব্যথার চিহ্ন আছে? নীলকে কিন্তু সবাই বিষাদ বলে।”

ত্রিস্তান সরাসরি অটবীর দিকে তাকালো এবার। বিস্ময়ভরা চাহনি। সে সত্যিই কখনো খেয়াল করেনি। অটবী মুচকি হেসে বললো, “আকাশের দিকে এতবেশি তাকাবেন না। আমাদের মতো মানুষের জন্য আকাশ আনন্দ বয়ে আনেনা।”

তনয়ার দিকে একবার তাকালো অটবী। মেয়েটা হা করে চেয়ে আছে ওর দিকে। কি স্নিগ্ধ চোখদুটো! মুখটা কি আদুরে! অটবী একটু হাসতেই দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। ওরাই ভালো। বাস্তবতা চিনে না। নিজের জগতেই থাকে, কল্পনায় সুন্দর একটা জীবন সাজায়।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অটবী উঠে দাঁড়ালো। মুখের হাসিটা বজায় রেখে বললো, “আসছি। ভালো থাকবেন।”

অটবী চলে যেতেই ত্রিস্তান ঘাসের ওপর শুয়ে পরলো। হাসলো ক্ষীণ। হাসিটা আদৌ কিসের, বোঝা গেল না। অনুভূতিগুলো শূণ্যে ঠেলে চরম অবাধ্য হলো। অটবী মানা করা সত্ত্বেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো আকাশকে। দেখেই চললো। অটবী মেয়েটা অবুজ। আকাশ বিষাদ বলেই তো সবার পছন্দ। মেয়েটাও তো আকাশেই আশ্রয় নিয়ে আছে।

আচমকা চিপস খাওয়া বাদ দিয়ে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে আসলো তনয়া। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে চেঁচালো, “ভাইয়া? রক্ত! রক্ত!”
বলতে বলতে নাকের দিকে ইশারা করলো সে। নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে। ভীষণ বিরক্ত হলো ত্রিস্তান। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলো রক্তটুকু।

সরোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ‘অরবিন্দ অটবী’-তে এসেছে। অটবীকে ত্রিস্তানের সাথে রেখে সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে সে। বাসার পেছনে গিয়ে নলীকে ডাকতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। কলপাড়ে কাপড় ধুঁচ্ছিল। সরোজের আওয়াজ শুনে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে সরোজ আবার ফিসফিসিয়ে ডাকলো, “ওই ম্যাইয়্য! ওইদিকে না, এইদিকে। টিনের ফুটার দিকে তাকা।”

নলী সাথে সাথে বামপাশে তাকালো। টিনের বেড়ার এদিকটা অনেকটাই ছিদ্র। সরোজের ভ্রু, চোখ দেখা যাচ্ছে। নলী দ্রুত এগিয়ে এসে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো, “তুমি এখানে আসছো কেন সরোজ ভাই? চলে যাও প্লিজ। বুবু দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
সরোজ ভরসা দিয়ে বললো, “তোর বুবু এত তাড়াতাড়ি আসবে না। ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে আছে।”
—“বুবু ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে কি করে?”
—“আমার মনে হয়, ভাইয়ের সাথে তোর বুবুর কিছু চলে।”

সরোজ কথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে বললেও নলী বিশ্বাস করলো না, “ধুর! এমন কিছুই না। আমার বুবুকে আমি চিনি।”
সরোজ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—“কচু চিনো তুমি। তোমার মতো বলদ আমি আর একটাও দেখি নাই।”
—“আপনাকে দেখতে বলেছেটাকে?”
—“তুই বলেছিস। এখন এসব কথা বাদ। কাজের কথা বল। অটবী আপু কি তোকে আর মারছে?”

নলী মন খারাপ করে বললো, “উহু, মারেনি। কিন্তু রাগ করে আছে। কালকে থেকে কথা বলছে না।”
নলীর মুখ ফুলানো দেখে সরোজের ইচ্ছে করলো গালদুটো শক্ত করে টেনে দিতে। মুচকি মুচকি হেসে বললো, “ওরে আমার নীলিমা সুন্দরী রে, মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নলী কপট রাগ দেখালো, “সরোজ ভাই, আপনাকে না বলেছি আমাকে নীলিমা বলে না ডাকতে? তবুও ডাকেন কেন? আমার সুন্দর একটা নাম আছে। নলী বলে ডাকতে পারেন না?”
—“ইছ! ওইটা কোনো নাম হইলো? নলী! গরুর গোবরের মতো দূর্গন্ধযুক্ত নাম। ওইটা আবার সুন্দর!”

নলী কটমট চোখে চাইলো। ভয়াবহ কিছু মুখ থেকে বের করার আগেই শুনতে পেল, অটবী ফিরে এসেছে। সদর দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।
সরোজ বিরক্ত হয়ে বললো, “তোর বুবুই হইলো আমাদের প্রেমের ভিলেন, বুঝলি?”
—“আপনি ভিলেন। এখন যান এখান থেকে। আর শুনুন, আমি কোনো প্রেম করিনা আপনার সাথে।”

একথায় সরোজ হাসলো খুব। চলে যেতে যেতে বললো, “অস্বীকার করে লাভ নাই সখী। তোমার আমার প্রেমের খবর পুরো পাড়ায় রটিয়ে দিতে যাচ্ছি।”

লাজুকপাতার ন্যায় রাঙা হয়ে উঠলো নলী। কাপড় ধুঁতে গিয়ে মনোযোগ হারালো। এই সরোজ ভাইটাও না!

রাতে ঘুমানোর সময় পৃথা বারবার খোঁচাচ্ছিল নলীকে। নলী রেগে গিয়ে বললো, “কি সমস্যা? খোঁচাচ্ছিস কেন?”
—“তুই ভালো হবি কবে?”
—“কি আশ্চর্য! মাথা কি গেছে? কি আবলতাবল বকছিস?”
—“আজকে দুপুরে আমি তোর সব কান্ড দেখেছি। কালকে থেকে বুবু তোর সাথে কথা বলেনা, তাও কি তোর শিক্ষা হচ্ছে না? সরোজ ভাই কি বুবুর থেকেও আপন হয়ে গেছে?”

নলী সাথে সাথে পৃথার দিকে মুখ করে শুলো। চেহারা ভয়ে জর্জরিত। পৃথা কি তবে সব দেখে ফেলেছে? মিনমিনিয়ে অনুরোধ করলো, “বুবুকে বলিস না পৃথা। বুবু নয়তো আরও রেগে যাবে।”
—“সেটা তোর সরোজ ভাইয়ের সাথে কথা বলার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”
—“পৃথা, তুই কি চাচ্ছিস বুবুর সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হোক?”
—“তাহলে বল সরোজ ভাইয়ের আর সাথে কথা বলবি না।”

নলী একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা, বলবো না।”
পৃথা আশ্বস্ত হতেই নলী একটু নিশ্চিন্ত হলো। যাক! এ যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। মনে মনে বললো, “প্রেম করতে গেলে একটু আধটু মিথ্যা বলতেই হয়। আমিও নাহয় বললাম। একটু মিথ্যা বললে কিচ্ছু হবে না।”

রাত তখন সাড়ে বারোটা প্রায়। ঘরের সব কাজ শেষে অটবীর ঘুমাতে গিয়ে মনে পরলো, সে মূল গেটে তালা লাগাতে ভুলে গেছে। শোয়া থেকে উঠে টেবিল থেকে চাবি নিলো সে। ওড়না গায়ে জড়িয়ে গেট লাগাতে চলে গেল।
গেট-টা পুরোনো আমলের। অটবীর বাবা প্রায় গর্ব করে বলতেন, গেট-টা তার বাবার বাবা বানিয়েছেন। খুলতে, লাগাতে গেলেই বিশ্রী একটা আওয়াজ হয়। অটবী সাবধানে দরজা লাগালো। মৃদু শব্দটাও যেন বিরাট হয়ে গেল নিশ্চুপ পরিবেশে। প্রায় তালা লাগিয়ে ফেলেছিল, এসময় দরজার ওপাশ থেকে ভরাট গলা শোনা গেল, “অটবী?”

ত্রিস্তানের গলা না? হ্যাঁ, তারই তো! অটবী তবুও নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো, “বাহিরে কে? ত্রিস্তান?”
—“হ্যাঁ। দরজা খুলো।”
অটবী খুললো না, “কি দরকার? এভাবে বলুন।”
—“তোমার ঘরে দা-বটি আছে না? আগের মতো নিয়ে আসো। দরজা খোলার পর কিছু করলে ডাইরেক্ট গলায় চালিয়ে দিও।”

অটবী মোটেও অতটা অবিশ্বাস করে না ত্রিস্তানকে। এই সল্প পরিচয়েই যেন অনেকটা চিনে ফেলেছে।
ধীর-স্থির ভাবে দরজা খুলে অটবী তাড়া দিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি বলুন কি বলবেন। মা জেগে গেলে সমস্যা হবে।”

প্রতিবারের মতো গুছানোহীন ত্রিস্তান! কিন্তু এখন একটু বেশিই অগোছালো লাগছে তাকে। বিনাবাক্যে তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, “নাও।”
—“হু?”

ত্রিস্তানের হাতে একশ টাকার কচকচে নোট। মুঠ করে রেখেছে। অটবী দেখেই বললো, “আমি নিবো বলেছি?”
ত্রিস্তান আবারও বললো, “চুরি করিনি। নাও।”

বলতে বলতে সে নিজেই অটবীর হাত টেনে টাকাটা গুঁজে দিলো। অটবীকে চমকানোর সময়টুকুও দিলো না। অটবী দেখলো, ত্রিস্তান শুধু টাকাই দেয়নি, দুটো চকলেটও দিয়েছে। সাথে সাদা কাগজে ছোট্ট লিখা, “তুমি অনেক তিতা অটবী। তোমার উচিত বেশি বেশি মিষ্টি খাওয়া।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে