অটবী সুখ
৩.
রাস্তার মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অটবী। সিক্ত, মলিন চোখজোড়া একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছে ত্রিস্তানকে। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে যাচ্ছে ছেলেটা। বড্ড শান্ত একেকটা কদম। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। দেখে মনে হয়, ভদ্র ঘরের চাকরি করা সভ্য একটা ছেলে। যে সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলে। অথচ একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায়, সে আসলে কতটা ছন্নছাড়া, উদাসীন। যেন হাজারটা দুঃখ, কষ্ট আর চিন্তা সে একাই আগলে রেখেছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, “অরণ্য, রহস্য লুকানোর বদলে এবার একটু দুঃখ খুঁজে দেখাও তো দেখি!”
বাসায় ফিরে অটবীর আর বিশ্রাম নেওয়া হলো না। এই কাজ, সেই কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো। কিছুক্ষণ পর নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হবে। হাতে বেশি সময় নেই। আর মাত্র পনেরো মিনিট। কোনোমতে একপ্লেট ভাত খেয়েই অটবী বেরিয়ে পরলো। ভরা পেটে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সে অন্যান্য সময় যত দ্রুত হাঁটে, এখন তার অর্ধেকও হাঁটতে পারছে না।
ধীরে ধীরে, একটু একটু করে স্কুলের কাছাকাছি আসতেই বোনদের দেখতে পেল অটবী। ঝালমুড়ি দোকানের একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। নলী ঠোঁটে জ্বলজ্বলে হাসি এঁটে রাখলেও পৃথা বেজার মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ দুটো ঝালমুড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হলো সরোজ। একটা নলীকে দিতেই মেয়েটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। কিন্তু পৃথা নিতে চাইছে না। অটবী পায়ের গতি বাড়ালো। ভেতরে ভেতরে মারাত্বক দাবানলে ছটপট করে উঠলো মন। বিষিয়ে গেল। কাদের জন্য সে এতটা কষ্ট করছে? জীবনের সখ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছে? এরা তো তাকেই মান্য করে না।
চোয়াল শক্ত করে নলীর মুখোমুখি দাঁড়ালো অটবী। ভীষণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তোদের কাছে তো টাকা নেই। ঝালমুড়ি কোত্থেকে পেলি?”
সহসা চমকে উঠলো নলী। মুখের উজ্বলতা মিইয়ে গিয়ে স্পষ্ট ভয়ের ভাঁজ দেখা দিলো। আমতা আমতা করে বলতে চাইলো, “সরোজ ভাই কিনে দিছে বুবু।”
সেকেন্ডের ব্যবধান। আচমকা রুক্ষ হাতের চড় পরলো নরম গালটায়। নলী গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। অটবী যেন রণমুর্তি ধারন করেছে। ভয়ংকর রাগে শ্যামবর্ণ মুখটাও লাল দেখাচ্ছে। নলীর কান্নার আওয়াজ বাড়লো। গালের ব্যথায় না, বোনের ভয়ে।
সরোজ হাঁসফাঁস করে বললো, “নীলিমার দোষ নাই অটবী আপু। আমিই জোর করছিলাম।”
পৃথা একপাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। মনে মনে খুব চাইছিলো, নলীর এমন একটা শিক্ষা হোক। মেয়েটা বেশ বাড় বেড়েছিল। সে এতবার সাবধান করেছে, তবুও শুনেনি। আরেকটু মজা নেওয়ার জন্য নলীর কানের কাছে গিয়ে পৃথা আস্তে আস্তে বললো, “তোকে আবারও নীলিমা বলে ডাকছে সরোজা ভাই। তুই কিছু বলবিনা?”
অন্যসময় হলে নীলিমা ডাকার অপরাধে সরোজের সাথে বিশাল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো নলী। নীলিমা নামটা তার একদমই পছন্দ না। কিন্তু সরোজ তাকে এই নামেই ডাকবে! এ নিয়ে কম বাকবিতর্ক হয়নি সরোজের সাথে তার। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। সে তো কেঁদেই কূল পাচ্ছে না। ঝগড়া করার সময় কই?
সরোজ নম্র কণ্ঠে আবার বললো, “ওকে বইকো না, আপু। ওর সত্যিই দোষ নাই। আমিই জোর করে ঝালমুড়ি কিনে দিয়েছি। ও নিতে চায় নাই।”
অটবী নলীর বাহু শক্ত করে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বললো, “আমি ছোট নই সরোজ। তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়। জোর করছো কি করছো না সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। নলীর বয়স কম। সঠিক-ভুল এখনো চিনতে শিখেনি। ভালো হয়, তুমি ওর থেকে দূরে থাকলে। ওর আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি।”
“তুমি যা ভাবছো, সেসরক কিছুই না আপু।”
“তোমার থেকে আমার জানা লাগবে না সরোজ। পারলে এসব বখাটেপনা ছেড়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দাও। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার অনেক স্বপ্ন। সামান্য পিয়নের চাকরি করে পুরো পরিবার চালাচ্ছেন। তাকে আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য করতে না পারো, অনতত দশটা লোকের সামনে মাথা নিচু করতে দিও না।”
নলীকে এক প্রকার টেনে নিয়ে যেতে লাগলো অটবী। নলী কেঁদেই যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। রাস্তার পথচারীদের অনেকেই চেয়ে চেয়ে দেখছে ওদের। ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে এই ভেবে, শান্ত মেজাজের হাসিখুশি মেয়েটাকে তারা কখনো এতটা রেগে যেতে দেখেনি।
–
রেবা বেগম এখন অনেকটাই সুস্থ। সকাল থেকে খুটখাট শব্দে এটা ওটা করছেন। গোছানো জিনিসগুলোও মাঝে মাঝে গুছিয়ে রাখছেন। ঘুম ভাঙ্গার পর মাকে কাজ করতে দেখে রেগে গেল অটবী। রেবা বেগম তখন রুটি ছেঁকছিলেন। ঝটকা মেরে তার থেকে খুন্তি নিয়ে অটবী বললো, “তোমার সমস্যা কি মা? সুস্থ হয়েছ একদিনও হয়নি। তোমাকে রান্না করতে বলেছে কে?”
রেবা বেগম অল্প হাসলেন। অটবী থেকে আবারও খুন্তি নিয়ে বললেন, “এতদিন তো শুয়েই ছিলাম। আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না।— যা, হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
অটবী আর কিছু বললো না। বিরক্ত ভঙ্গিতে কলপাড়ে যেতে যেতে বললো, “কখন উঠেছো ঘুম থেকে? উঠে ডাকতে পারলে না? আর একা একা কাজ করবে না। আমাকে ডাকবে।”
“শুক্রবার দেখে আর ডাকিনি। এমনিতেই তো সকাল সকাল উঠিস।”
হাতমুখ ধুঁয়ে আসতে আসতে নলী আর পৃথাও ঘুম থেকে উঠে গেল। নলীর চোখ দুটো ফুলে একাকার। রাতে বোধহয় কেঁদেছে অনেক। অটবী দেখেও দেখলো না। চুপচাপ নাস্তা খেতে লাগলো। কালকে টিউশন দুটো করাতে পারেনি। নাস্তা খেয়েই এখন বেরিয়ে পরবে।
নলী কয়েকবার অটবীর সাথে কথা বলতে চাইলেও অটবী এড়িয়ে গেছে। সুযোগ দেয়নি। নলীকে এত সহজে ক্ষমা করে দিলে চলবে না। এখন থেকেই শাসনে রাখতে হবে। তারা নিম্নবিত্ত, এমনিতেই সুখ তাদের কাছে ধরা দেয় না। আবেগের বশে ভুল করলে হয়তো জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
–
প্রতিবার টিউশনিতে গেলে জড়তায় চুপসে থাকে অটবী। তার পরনের কোনো ভালো জামা নেই। ঘুরেফিরে এক কামিজ পরে আসে। এনিয়ে ছাত্রের মায়েদের চিন্তার শেষ নেই। অটবীকে দেখেই কেমন মুখটা কুঁচকে রাখেন। ভালো করে দুদণ্ড কথাও বলেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য না পারতে নাস্তা দেন, পানসে চা আর ঘরের সবচে’ কমদামি বিস্কুট। অটবীর মনে হয়, তারা হয়তো অটবীর জন্যই দোকান থেকে কমদামি বিস্কুটটা কিনে আনেন।
যতটা সময় সে পড়ায়, একটা অন্ধকার খাঁচায় বন্দি থাকার মতো অনুভূতি হয় তার। হাঁসফাঁস করে। বড়লোকদের সাথে এজন্যই মিশতে ভয় হয় তার। বন্ধুবান্ধবও নেই তাই। কারণ অটবী জানে, সে এই মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে চলতে পারবে না।
বাসায় আসার পথে সরোজ পিছু নিলো অটবীর। অটবী তা দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। শান্ত সুরে বললো, “কি হয়েছে সরোজ? কিছু বলবে?”
কি মিষ্টি করে বললো অটবী! যেন সরোজের প্রতি রাগ-টাগ কিচ্ছু নেই মেয়েটার। সরোজ একদফা ভড়কালো। মৃদু স্বরে বললো, “তুমি কি নলীকে বকছিলা, অটবী আপু?”
অটবী আগের মতোই বললো, “সেটা দিয়ে তুমি কি করবে?”
“ওকে প্লিজ বকিও না আপু। আমি আর ওর সাথে কথা বলবো না।”
“ভালো।” বলতে বলতে সামনে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। একটা মেয়ের হাত ধরে টানছে সে। মেয়েটা কিছুতেই যেতে চাইছে না। চিৎকার করে কাঁদছে। রাস্তায় বসে পরেছে। মেয়েটা কে হতে পারে? এভাবে টানছেই-বা কেন?
অটবীর দেখাদেখি সরোজও সেদিকে তাকালো। পরপরই মুখে একটা অকৃত্রিম আফসোস নিয়ে বললো, “আহারে! ত্রিস্তান ভাইয়ের বোনটা! কয়েকদিন আগেও কি ভালো ছিল! এখন নাকি এই মাইয়্যা পাগল। বিশ্বাসই হইতে চায় না।”
“কি বললে?” অবাক চোখে সরোজের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। খেয়াল হলো, মেয়েটাকে আসলেই দেখতে সুস্থ লাগছে না। পরনের জামা কাপড় এলোমেলো। চুলে সুন্দর করে বেণী করা থাকলেও মেয়েটা সেই বেণী টেনেটুনে একাকার করে ফেলেছে। তাকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ত্রিস্তানের। চেহারা অসহায়, ক্লান্ত।
সরোজ বললো, “ওই মেয়ে ত্রিস্তান ভাইয়ের বোন, তনয়া। কয়েক বছর আগে বিয়ে হইছিল। বিয়ের পর বাচ্চা হইতে গিয়ে একটা দূর্ঘটনায় বাচ্চা মারা গেল। মা হইতে পারবে না নাকি আর! তাই জামাই ডিভোর্স দিসে। ডিভোর্সের দিনই আবার ত্রিস্তান ভাইয়ের বাপ-মা একলগে মারা গেল। তখন থেকে তনয়া আপু এমন হইয়া গেছে।”
অটবী নিশ্চুপ হয়ে শুনছে। অনড় দৃষ্টি ত্রিস্তানের পানেই। ধৈর্যহারা ত্রিস্তান ততক্ষণে বোনকে কোলে তুলে নিয়েছে। এদিকেই আসছে। তনয়া নামের মেয়েটা এতে আরও উত্তেজিত হয়ে গেল। বড় বড় নখ দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে ত্রিস্তানের মুখ, গলা, হাত।
কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হলো ওরা দু’জন। অটবীর মন কেমন যেন করে উঠলো। ভীষণ গোপনে সুধালো, “দুঃখ, তুমি কি আমার থেকেও দুঃখী?”
জবাব পাওয়া গেল না। অটবী তবুও চেয়ে রইলো। ত্রিস্তান চোখ সরিয়ে নিলেও। আচমকা বলে বসলো, “মেয়েটা যা চাইছে ওকে দিচ্ছেন না কেন?”
ত্রিস্তান থমকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো একবার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আমার কাছে টাকা নেই।”
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা